গার্ড অব অনার: নারী-পুরুষ বিভাজন কেন?

Published : 13 Feb 2012, 08:10 AM
Updated : 17 June 2021, 09:38 AM

সম্প্রতি বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মৃত্যুর পর 'গার্ড অব অনার' দেওয়ার ক্ষেত্রে নারী কর্মকর্তাদের বাদ রাখার প্রস্তাব দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিবিষয়টি নিয়ে চারিদিকে উঠেছে আলোচনা সমালোচনার ঝড়। সরকারের নীতিমালা অনুযায়ী, কোনো বীর মুক্তিযোদ্ধা মারা যাওয়ার পর তাকে রাষ্ট্রীয় সম্মান জানায় সংশ্লিষ্ট জেলা/উপজেলা প্রশাসন। জেলা প্রশাসক বা  উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে সেখানে থাকেন। কফিনে সরকারের প্রতিনিধিত্বকারী কর্মকর্তা ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। দেশের অনেক জায়গায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্বে রয়েছেন নারী কর্মকর্তারা, আর সেখানেই আপত্তি তুলেছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি।

অবিশ্বাস্য হলেই সত্যি যে, নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ যখন নিজেকে রোল মডেল হিসেবে দাবি করছে ঠিক সেই সময়ে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের 'গার্ড অব অনার' দেওয়ার ক্ষেত্রে নারী কর্মকর্তাদের বাদ রাখতে বলেছে সংসদীয় একটি কমিটিতাদের প্রস্তাবের পেছনে যুক্তিটিও বড় অদ্ভুত! নারীরা জানাজাতে থাকতে পারে না সেক্ষেত্রে তারা কিভাবে গার্ড অব অনার দেন- জাতীয় অসাড় এবং হাস্যকর আপত্তিকে মাথায় নিয়ে তারা এ প্রস্তাব দেন। অথচ এ প্রস্তাব দেওয়ার সময় সেসব মহোদয়দের মাথায় একবারের জন্য কাজ করেনি যে, জানাজা একটি ধর্মীয় বিধান এবং গার্ড অব অনার একটি রাষ্ট্রীয় বিধান। দুইটি সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। একটির বিধি-বিধানের সাথে অপরটির বিধি-বিধানের কোন সম্পর্ক নেই। অথচ আমাদের সংসদীয় কমিটির বিজ্ঞজনেরা কোন যুক্তিতে নারী কর্মকর্তাদের বিষয়ে এমন বিমাতাসুলভ প্রস্তাব দিলেন তারাই বলতে পারবেন! 

যে নারীদের প্রতি তারা  এমন বিমাতাসুলভ আচরণ করলেন, বাংলাদেশের আর্থ সামাজিক উন্নয়নে তাদের অবদান কি একেবারেই কম? অবশ্যই না। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের আমলে নারীর ক্ষমতায়নের অর্জন অনেক। নারী শিক্ষার উন্নয়ন এবং ব্যবসায়িক উদ্যোগে ভূমিকার জন্য গ্লোবাল উইমেনস লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা। এছাড়া জাতিসংঘের 'প্ল্যানেট ৫০-৫০ চ্যাম্পিয়ন' 'এজেন্ট অব চেঞ্জ' অ্যাওয়ার্ডে'ও ভূষিত হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। নারীর ক্ষমতায়নে বেশ কিছু আইন-নীতি ও বিধিমালা তৈরি করেছে সরকার। বর্তমানে বিচারপতি, সচিব, ডেপুটি গভর্নর, রাষ্ট্রদূত, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, মানবাধিকার কমিশনের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করছেন নারী। বর্তমানে প্রশাসনের উচ্চপদে অনেক নারী দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করছেন। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ ২০১৭ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সরকারি চাকরিতে মোট নারীর সংখ্যা ৩ লাখ ৬৮ হাজার ৮১৯ জন।এমনকি  মাঠ প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদ জেলা প্রশাসক (ডিসি) পদে এবং পুলিশের এসপি পদে নারীরা দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করছেন।

নারীর ক্ষমতায়নে বৈশ্বিক স্বীকৃতিও কম নয় হার্ভার্ড ও ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যৌথভাবে করা ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডাব্লিউইএফ) জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্টে রাষ্ট্রক্ষমতায় নারীর অবস্থান বিবেচনায় সবাইকে পেছনে ফেলে বিশ্বের এক নম্বরে উঠে আসে বাংলাদেশের নাম। ডাব্লিউইএফের হিসাবে নারীর সার্বিক ক্ষমতায়নে ৪৮তম অবস্থানে বাংলাদেশ। এ অবস্থানের কারণ, নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন। এ সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান পাঁচ। প্রথম চারটি দেশ হলো আইসল্যান্ড, নিকারাগুয়া, নরওয়ে ও রুয়ান্ডা।নারী উন্নয়নে সার্বিক সূচকে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলভুক্ত ২৪টি দেশের মধ্যে অস্ট্রেলিয়ার পরেই দ্বিতীয় শীর্ষ অবস্থান বাংলাদেশের। বিশ্বের ৩৬টি নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। দ্য গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট ২০১৭ অনুসারে, ১৪৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের সার্বিক অবস্থান ছিল ৪৭তম, যা দক্ষিণ এশিয়ার যেকোনও দেশের চেয়ে ভালো অবস্থান নির্দেশ করে। 

গত দুই দশকে বাংলাদেশে নারীর কর্মসংস্থান প্রায় ৩ ভাগেরও বেশি উন্নতি হয়ে ৩৮ শতাংশে পৌঁছেছে। বাংলাদেশই বিশ্বে সম্ভবত একমাত্র দেশ যেখানে সংসদ নেত্রী এবং প্রধানমন্ত্রী, জাতীয় সংসদের উপনেতা, বিরোধীদলীয় নেতা এবং জাতীয় সংসদের স্পিকার একজন নারী। ২০২০ সাল নাগাদ সব রাজনৈতিক দলের কমিটিতে ৩৩ শতাংশ নারী সদস্য রাখার বিষয়টি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। প্রতিটি উপজেলা পরিষদে ১ জন নির্বাচিত মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানের পদ সৃষ্টি করা হয়েছে এবং তৃণমূল পর্যায়ে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে ৩৩ শতাংশ আসন নারীর জন্য সংরক্ষিত রাখা হয়েছে। 

আমি বিশ্বাস করি না যে, উপরের একটি পরিসংখ্যান বা তথ্য স্থায়ী কমিটির মহোদয়দের অজানা। তারা খুব ভালো করে জানেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী কতটা নারী বান্ধব একজন মানুষ। তারপরেও তারা এই ধরনের নারীর প্রতি অবমাননাকর প্রস্তাব কোন যুক্তি তে দেন আসলেই বিষয়টি বোধগম্য নয়। 

যে স্বাধীন বাংলাদেশের সংসদে বসে তারা এই ধরনের প্রস্তাব দিলেন সেই বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পিছনেও রয়েছে নারীরদের বীরত্বের ইতিহাস।বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে যে নারীর অবদানের কথা সর্বাগ্রে আসে তিনি আর কেউ নন তিনি বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব। তিনি তার জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছেন। কখনো বঙ্গবন্ধুর পাশে থেকে, আবার যখন বঙ্গবন্ধু কারাগারে গেছেন তখন বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে দলকেও সামলেছেন শক্তভাবে। যদি আমরা মুক্তিযুদ্ধের দিকেও তাকাই তাহলেও দেখবো সেই মুক্তিযুদ্ধেও রয়েছে লাখো নারীর আত্মত্যাগের ইতিহাস। নারী বিভিন্নভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে- কখনো গেরিলা যোদ্ধা হিসেবে, কখনো শব্দ সৈনিক হিসেবে , কখনো যুদ্ধ ক্ষেত্রে চিকিৎসক কিংবা সেবিকা হিসেবে। এই যুদ্ধে অংশ নিতে গিয়ে নারীকে যেমন শহীদ হতে হয়েছে, অনেককে নির্যাতিত হতে হয়েছে , অনেককে হারাতে হয়েছে স্বামী-সন্তান, পরিবার। তাই আজকের এই স্বাধীন বাংলাদেশ পাওয়ার পেছনে নারীর অবদান কোনভাবেই পুরুষ থেকে কম নয়। নারীর সাথে যদি কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে  অস্ত্র হাতে মুক্তিযুদ্ধ করতে সমস্যা না থাকে, তাহলে নারীর কাছ থেকে 'গার্ড অব অনার'  নিতে সমস্যা কেন ? 

আজকে যে বিজ্ঞজনেরা মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে সদস্য হিসেবে আছেন এদের মধ্যে সবার মুক্তিযুদ্ধ দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। তারা দেখেছেন এই মুক্তিযুদ্ধ জয়ের পিছনে নারীর অবদান। তারা যখন স্বাধীন দেশে বসে নারী কর্মকরতাদের প্রতি এমন বিরূপ সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, তখন কি তাদের মনে পড়েনি সেসব নির্যাতিত নারীর কথা- যাদের বিনিময়ে এই দেশ পাওয়া? যে দেশ অর্জনের পেছনে রয়েছে নারীর অবদান সেই দেশে নারীরাই স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবেন না? এমন হঠকারী প্রস্তাব কিভাবে দিতে পারলেন তারা? মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম চেতনা হচ্ছে সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠা। বৈষম্যমূলক এমন সিদ্ধান্ত কি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে সাংঘর্ষিক হয়ে যাচ্ছে না ?

এবার যারা এই প্রস্তাব করলেন তাদের বিষয়ে একটু আলোকপাত করা যাক। যারা এই প্রস্তাব করলেন সেই সংসদীয় কমিটির সদস্যরা যেই সংসদে বসে আছেন সেই সংসদের স্পিকার একজন নারী। সেই সংসদের সরকারদালীয় নেতা, উপনেতা এবং বিরোধীদলীয় নেতা নারী। এমন কি বাংলাদেশে কোন সংসদ সদস্য কিংবা সাবেক সংসদ সদস্য মারা গেলে রেওয়াজ অনুযায়ী সংসদের দক্ষিণ প্লাজা-তে তাদের জানাজা অনুষ্ঠিত হয় এবং সেখানে স্পিকার এবং সংসদীয় নেতা শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন থাকেন। তাহলে বিষয়টি কী দাঁড়ালো? নারীর নেতৃত্বে সংসদে যেতে কিংবা অধিবেশন পরিচালনা করতে কিংবা সরকার পরিচালিত হতে এমনকি মৃত্যুর পর সংসদের দক্ষিণ প্লাজাতে শ্রদ্ধা নিতে সমস্যা নেই। সমস্যা শুধু  'গার্ড অব অনার' নেওয়ার ক্ষেত্রে?

কোন সভ্য সমাজে তো নারীকে ধর্মান্ধতার ঠুনকো অজুহাত দিয়ে ঘরে বন্দি করতে চায় নাধর্মের মিথ্যা অজুহাত দিতে নারীকে গৃহবন্দি করার উদাহরন তো আমরা দেখেছি তালেবানি রাষ্ট্র আফগানিস্তানে। তালেবানি রাষ্ট্রের ভূত আমাদের দেশে ভর করছে কেন? একজন নারী  একজন পুরুষের সাথে সমমানের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নিজ যোগ্যতা বলে  সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে  চাকরিতে যোগ দিচ্ছেন। সেই নারীর প্রতি অবমাননাকর কোন প্রস্তাব সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক হয়ে যাচ্ছে না?

তাই যে সব মহোদয়েরা এমন প্রস্তাব করেছেন তাদের কাছে সনির্বন্ধ অনুরোধ থাকবে ধর্মান্ধতা, গোঁড়ামি এবং কুসংস্কারকে পেছনে ফেলে যে চেতনা নিয়ে আপনারা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন সেই চেতনার বলে উজ্জীবিত হয়ে প্রস্তাবটি  পুনর্বিবেচনা করুন। দয়া করে এমন কোন প্রস্তাব দিবেন না যাতে সমাজে যে সাম্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করেছিল তাদের সেই স্বপ্ন ভূলুণ্ঠিত হয়ে যায়।