স্বাধীনতার ৫০ বছর: স্বপ্নের অভিষেকে আমিনুল রূপকথা

নাজমুল হক তপন
Published : 15 June 2021, 03:00 AM
Updated : 15 June 2021, 03:00 AM

"অভিষেক টেস্টের আগে বেশ একটা লম্বা সময় ছিলাম লন্ডনে। অভিষেক টেস্টে খেলতে হতে পারে, এ ভাবনা থেকেই প্রস্তুতি নিতে থাকি। কিভাবে লম্বা ইনিংস খেলা যায়, সেই প্রস্তুতি। এর জন্য কঠোর পরিশ্রম করেছি। মনে রাখতে হবে, তখনও আমাদের ঘরোয়া পর্যায়ে লংগার ভার্সন ক্রিকেট সেভাবে শুরুই হয়নি।" কথাগুলো বাংলাদেশের অভিষেক টেস্টে ক্রিকেট দুনিয়াকে তাক লাগিয়ে দেওয়া আমিনুল ইসলাম বুলবুলের।

২০০০ সালের ১০ নভেম্বর। বাংলাদেশ ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে বড় দিন। দশম টেস্ট খেলিয়ে দেশ হিসেবে মাঠে নামে টাইগাররা। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে ভারতের বিপক্ষে টস জয় দিয়ে শুরু হয় 'টেস্ট বেবি' বাংলাদেশের অভিযাত্রা। ব্যাট করতে নেমে প্রথম ইনিংসে ৪০০ রানের সৌধ গড়ে স্বাগতিকরা। ইনিংসটির ব্যাপ্তি ছিল ১৫৩.৩ ওভার আর সময়ের হিসেবে প্রায় ১১ ঘণ্টা (৬৪৬ মিনিট)।

প্রথম দুইদিনেই গোটা ক্রিকেট দুনিয়ার সবটুকু আলো নিজের দিকে টেনে নেন আমিনুল। ব্যাট করলেন প্রায় ৯ ঘণ্টা (৫৩৫ মিনিট)। ৩৮০ বলে গড়া ১৪৫ রানের ইনিংসটি সাজালেন ১৭ বাউন্ডারির সমাহারে। এ ইনিংস উপহার দেওয়ার পথে ফিরিয়ে আনলেন প্রায় সোয়া শ বছর আগের ক্রিকেট ইতিহাসের প্রথম টেস্টের স্মৃতি। ১৮৭৬-৭৭ মৌসুমে অভিষেক টেস্টে সেঞ্চুরিয়ান চার্লস ব্যানারম্যানের উচ্চতায় পৌঁছালেন আমিনুল।

দেশের হয়ে অভিষেকে সেঞ্চুরির কীর্তিটা কতটা গৌরবমাখা এটা বুঝতে বেশিদূর যাওয়ার প্রয়োজন নেই। আমিনুলকে নিয়ে সংখ্যাটা মোটে চার। সর্বশেষ এ কৃতিত্ব দেখিয়েছেন আয়ারল্যান্ডের কেভিন ও ব্রায়েন (১১৮)। আমিনুলের ১৭ বছর পর এ স্বপ্নের ক্লাবে জায়গা করে নিয়েছেন আইরিশ ব্রায়ান। অস্ট্রেলিয়ান কিংবদন্তী ব্যানারম্যানের ১১৫ বছর পর দেশের অভিষেকে সেঞ্চুরির গৌরবের অধিকারী হন জিম্বাবুয়ে অধিনায়ক ডেভিড হটন (১২১)। এর আট বছর পর ছোট্ট এই তালিকাকে সমৃদ্ধ করেন আমিনুল। গত তিন দশকে যে তিনজন এ কীর্তির ভাগিদার হয়েছেন এদের মধ্যে ব্যানারম্যানের (১৬৫) কাছাকাছি কেবল আমিনুল। ২০ রানের জন্য নাগাল পাননি ব্যানারম্যানের। আরও সহজ করে বললে টেস্ট ইতিহাসে দেশের অভিষেকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রানের ইনিংসটির মালিকানা আমিনুলের।

অভিষেকে ক্রিকেট দুনিয়াকে প্রবলভাবে ঝাঁকি দেওয়া প্রসঙ্গে আামিনুল বলেন, "সবসময়ই বলি, অভিষেক টেস্টটি সিগনেচার অব মাই লাইফ। তবে কাজটা মোটেও সহজ ছিল না। ঘরোয়া ক্রিকেটে লম্বা দৈর্ঘের ক্রিকেট খেলার সুযোগ ছিল না। আর প্রতিপক্ষ ভারত ছিল খুবই শক্তিশালী দল। তবে একটা ভাল কিছু করে দেখানোর তাগিদ ছিল ভেতরে। আমি এটাকে নিজের জন্য নিয়েছিলাম চ্যালেঞ্জ হিসেবে। ১৯৯৯ এর বিশ্বকাপে আমি ছিলাম অধিনায়ক। প্রথমবারের মত বিশ্বকাপে অংশ নিয়েই আমরা দুটো ম্যাচ জিতি। স্কটল্যান্ডের পর হারাতে সমর্থ হই পাকিস্তানকে। কিন্তু আমাকে নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। যদিও লন্ডনে টেস্টের জন্য নিজেকে তৈরি করছিলাম, তারপরও দেশের অভিষেকে সুযোগ পাব কি-না এনিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যেও ছিলাম।"

সঙ্গে সঙ্গেই প্রশ্ন করলাম এটা কিভাবে সম্ভব? উত্তরে আমিনুল বললেন, "আমাদের দেশের দল নির্বাচনে অনেক কিছুই সম্ভব। নির্বাচক প্যানেলের একজন আমাকে দলে রাখার বিরোধিতা করেছিলেন। আর তাই সুযোগ পেলে কাজে লাগাতে হবে, এর বাইরে কিছু করারও ছিল না।" নিজের ইনিংস নিয়ে বলেন, "সেই অর্থে লংগার ভার্সনের অভিজ্ঞতা ছিল না। তবে আত্মবিশ্বাসের কোন কমতি ছিল না। দুদিন মিলিয়ে ৯ ঘণ্টার মত ব্যাট করেছি। এর জন্য প্রচণ্ড স্ট্যামিনা ও মনোযোগের প্রয়োজন। আমি একটা কৌশল নিয়েছিলাম। দ্রুত সিঙ্গেল নিয়ে প্রান্ত বদল করছিলাম। এতে করে এনার্জি ধরে রাখতে পারছিলাম। আর তখন বয়সও ছিল ৩০/৩২ বছর। ওই বয়সটাতে শারীরিক সামর্থ্য ভাল থাকে।"

প্রথম টেস্ট খেলার আনন্দ-শিহরণ এর পাশাপাশি ক্রিকেটারদের জন্য দুর্ভাবনা হয়ে দাঁড়িয়েছিল দলে জায়গা পাওয়া নিয়ে। নির্বাচকদের অতি ক্যারিশম্যাটিক (!) সিদ্ধান্ত ক্রিকেটারদের টেনশন কতটা বাড়িয়ে দেয়, তারই দৃষ্টান্ত যেন বাংলাদেশের অভিষেক টেস্ট। ওই সময়ে ইনফর্ম হাবিবুল বাশার সুমনকে বাইরে রেখে দল ঘোষণা করলেন নির্বাচকরা। এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে কার্যত যুদ্ধ ঘোষণা করল মিডিয়া। শেষপর্যন্ত বাধ্য হয়ে নতি শিকার করল নির্বাচক তথা বিসিবি। দলে নেওয়া হল হাবিবুলকে। এরপর যা ঘটল সেটাকে কী বলা যায় ? আমাদের নির্বাচকদের জন্য শিক্ষা! যদিও সেই শিক্ষা শেষ হয়নি আজও!

অভিষেক টেস্টে সফরকারী ভারতের আগ্রাসনের সামনে প্রথম প্রতিরোধ গড়েন হাবিবুল। স্কোরবোর্ডে ৪৪/২। সাজঘরে দুই ওপেনার মেহরাব হোসেন অপি (৪) ও শাহরিয়ার হোসেন বিদ্যুত (১২)। লজ্জায় ডোবার শঙ্কা ততক্ষণে রীতিমতো রূপ নিয়েছে আতঙ্কে। হাবিবুলের সঙ্গে যোগ দিলেন আমিনুল। প্রান্ত ধরে রাখলেন আমিনুল। আর পাল্টা আঘাতে ভারতীয় বোলারদের উল্টো পরীক্ষা নেওয়া শুরু করলেন হাবিবুল। জুটিতে যোগ হল ৬৬ রান। ৭৯ বলে হাফসেঞ্চুরি পূর্ণ করা হাবিবুল যখন আউট হলেন, তখন তার নামের পাশে জ্বলজ্বল করছে ৭১ রান। মনোহরী ইনিংসটিতে বলকে সীমানা ছাড়া করেন দশ দশবার। হাবিবুল সাজঘরমুখো হওয়ার পর দলকে কক্ষপথে রাখার গুরুভার নিজের কাধেঁ তুলে নেন আমিনুল। চতুর্থ উইকেট জুটিতে তাকে সুযোগ্য সঙ্গ দেন আকরাম খান (৩৯)। জুটিতে আসে ৬৫ রান। এরপর আল শহারিয়ার রোকন (১২) ও অধিনায়ক নাইমুর রহমান দুর্জয় (১৫) ফিরে গেলেও হিমাদ্রির দৃঢ়তা নিয়ে উইকেট আগলে রাখেন আমিনুল। দিনের শেষে বাংলাদেশের স্কোরবোর্ডে ২৩৯/৬। আমিনুল অপরাজিত ৭৬ রানে।

 প্রথম দিন যেখানে শেষ করেছিলেন, দ্বিতীয় দিন সেখান থেকেই শুরু করলেন আমিনুল। সঙ্গী হিসাবে পেলেন আগের দিন ৩ রানে অপরাজিত থাকা খালেদ মাসুদ পাইলটকে। ভারতীয় বোলারদের জীবনীশক্তি শুষে নিয়ে সপ্তম উইকেট জুটিতে ৯৩ রান তুলে নিলেন দুজনে। পাইলট বিদায় নেয়ার পর টেল এন্ডারদের নিয়ে লড়াই চালিয়ে গেলেন আমিনুল। মোহাম্মদ রফিক (২২) ও হাসিবুল হোসেন শান্ত (২৮*) খেললেন দারুণ কার্যকরী ইনিংস। একটা পর্যায়ে মনে হচ্ছিল ব্যানারম্যানের রেকর্ডটি হয়ত নিজের করে নিতে পারবেন আমিনুল। শেষ পর্যন্ত অক্ষতই থাকল ব্যানারম্যানের রেকর্ড। নবম ব্যাটসম্যান হিসাবে আউট হলেন আমিনুল। স্কোরবোর্ডে ৩৮৫/৯। শেষ উইকেট জুটিতে ১৫ রান সংগ্রহ করে দলের রানকে চারশ-তে পৌঁছে দিলেন হাসিবুল ও বিকাশ রঞ্জন দাস।

৪০০ রানের জবাবে নাইমুরের ঘূর্ণির সামনে যথেষ্টই ঘাম ঝরাতে হয় ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের। সুবিধা করতে পারেননি ব্যাটিংয়ের দুই প্রধানতম স্তম্ভ রাহুল দ্রাবিড় (২৮) ও শচীন টেন্ডুলকার (১৮)। অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলীর সৌরভ ছড়ানো ৮৪ রানের ইনিংস আর সুনীল যোশির ৮২ রানের ‍দৃঢ়তাপূর্ণ ব্যাটিংয়ে ভর করে ৪২৯ রান সংগ্রহ করে ভারত। অভিষেকে ৬ উইকেট নিয়ে রেকর্ড গড়েন নাইমুর।

প্রথম তিনদিন ভারতের সঙ্গে সমানতালে পাল্লা দিয়ে লড়াই করল বাংলাদেশ। তবে চতুর্থ দিনে এসে ভেঙ্গে যায় প্রতিরোধ। দ্বিতীয় ইনিংসে হুড়মুড়িয়ে ভেঙ্গে পড়ে নাইমুর বাহিনী। বড় দৈর্ঘ্যের ক্রিকেটে অভ্যস্ত হয়ে ওঠার যে কোন শর্টকাট পথ নাই, সুস্পষ্ট হয়ে গেল সেটাও। স্বাগতিকদের দ্বিতীয় ইনিংস শেষ হল মাত্র ৯১ রানে। ভারত জিতল ৯ উইকেটের ব্যবধানে। একটা বিষয় লক্ষ্য করার মত। অভিষেক টেস্ট স্কোয়াডে শুরুতে হাবিবুলকে দলেই রাখা হয়নি। বাদ পড়ার আশঙ্কায় ছিলেন আমিনুলও। অথচ অভিষেক টেস্টে বাংলাদেশ যে সম্ভাবনার ঝলক দেখিয়েছিল, তা এ দুজনের ব্যাটে ভর দিয়েই!

টেস্ট ক্রিকেটে শুরুর যে সংকট, দু দশক পেরিয়ে যাওয়ার পরও একই জায়গায় দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ। দল নির্বাচন নিয়ে নির্বাচকদের খেয়ালিপনা, লংগার ভারসন ক্রিকেট উপযোগী করে ঘরোয়া কাঠামো প্রস্তুত করা, এসব জায়গাগুলো নিয়ে সেভাবে কাজ করা হয়নি বলে মনে করেন আমিনুল। তিনি বলেন, "দল নির্বাচন বলতে শুধু জাতীয় দলের প্লেয়ার্স নির্বাচন করাকেই বুঝায় না। সিলেকশন একটা প্রক্রিয়া। শুধু জাতীয় দলই নয়, ঘরোয়া ক্রিকেটে প্লেয়ার্স ও কোচ নির্বাচন বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেশে জাতীয় দলের কোচ নির্বাচন করেই দায়িত্ব শেষ করা হয়।" আরও যোগ করলেন, "খেয়াল করবেন, আমাদের দেশে ক্রিকেট ম্যানেজম্যান্টে যারা আছেন, তাদের প্রায় কারোরই নির্দিষ্টভাবে কোন ভূমিকা নাই। একই ব্যক্তি হয়ত একই সঙ্গে একাধিক দায়িত্ব পালন করছেন। আবার অনেকেরই নিজের কাজ সম্পর্কে ধারণা নাই।"

বর্তমানে আইসিসি ডেভেলপমেন্ট ম্যানেজার হিসেবে কাজ করছেন আমিনুল। কাজের অংশ হিসাবে আছেন দুবাইয়ে। আর এ বড় দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অন্য দেশের সঙ্গে দেশের ক্রিকেট কাঠামোর পার্থক্য বড্ড বেশি চোখে পড়ে বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরিয়ানের, "আমাদের দেশে কি হয় দেখেন, একজন উঠতি ক্রিকেটার প্রতিভার সাক্ষর রাখল। ওই ছেলেটি পরিপক্ক হয়ে ওঠার আগে তাকে তিন ফরম্যাটেই জাতীয় দলে সুযোগ দেওয়া হল। এবার তাকান ভারতের দিকে। সেখানে অনুর্ধ্ব-১৯ পর্যায়ে কোন ক্রিকেটারের টি২০ খেলার সুযোগ নাই। অথচ টি২০ ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় জায়গা ভারত।"

ক্রিকেটের মান বাড়াতে হলে দেশীয় কোচ তৈরির কোন বিকল্প দেখেন না আমিনুল। বলেন, "আমাদের সব উৎসাহ জাতীয় দলের জন্য বিদেশি কোচ আনা। দু দশকের বেশি সময় টেস্ট খেলছি, অথচ দেশীয় দু/তিন জন মানসম্মত কোচের নাম বলতে পারবেন না। পাশাপাশি দেখেন, ঘরোয়া ক্রিকেটে ভারতীয় কোচরা কিভাবে অবদান রাখছে।" যোগ করেন, "বৈশ্বিক রেসে টিকে থাকতে হলে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। ঘরোয়া ক্রিকেটে কোচ, প্লেয়ার্স তো বটেই, আম্পায়ার্স এমনকি ক্রিকেট ধারাভাষ্যেও উন্নতি দরকার।"

সর্বোপরি ক্রিকেটের প্রতি আস্থা ফিরিয়ে আনা উপর জোর দিচ্ছেন আমিনুল। বলেন, "ঘরোয়া ক্রিকেটে যা ঘটছে, তার উপর আস্থা রাখাটা ক্রিকেটপ্রেমীদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ছে। ম্যাচ ফিক্সিংয়ের সংবাদ নিয়মিতই প্রকাশিত হচ্ছে। এ অবস্থায় মাঠের খেলাটা ঠিকমত হচ্ছে, এই বিশ্বাসটা ফিরিয়ে আনতে হবে যেকোনও মূল্যে।"

অনেকটা আকস্মিকভাবেই ক্রিকেটের সর্বোচ্চ অর্জন টেস্ট মর্যাদায় আসীন হয়েছিল বাংলাদেশ। ক্রিকেট বিশ্বায়নের শ্লোগানকে সাংগঠনিকভাবে কাজে লাগিয়ে উঠে আসে অভিজাতদের কাতারে-শুনতে হয়েছে এমন অপবাদও। তবে অভিষেক টেস্টে সেই অপবাদ অনেকটায় ঘোচাতে সমর্থ হয় বাংলাদেশ। অভিষেক টেস্টের পারফরম্যান্সকে একটা ধারবাহিকতার ফসল হিসেবেই দেখেন বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরিয়ান, "আমাদের সময়টাতে একটা গ্রুপ অব প্লেয়ার্স একসঙ্গে খেলছিলাম। আমাদের মধ্যে গ্যাপ ছিল না। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আমরা খেলতে খেলতেই শিখছিলাম। এগুচ্ছিলাম ধাপে ধাপে। আমরা এসিসিতে চ্যাম্পিয়ন হলাম। এরপর আইসিসি চ্যাম্পিয়ন। প্রথমবারের মত বিশ্বকাপে খেললাম। বিশ্বকাপে আমাদের পারফরম্যান্সও ছিল সন্তোষজনক। এরপর অভিষেক টেস্টের চ্যালেঞ্জ।"

ফুটবলের রমরমা সময়ে ক্রিকেটে আসেন আমিনুল। ওই সময়টাতে বাংলাদেশে ক্রিকেটকে পেশা হিসেবে নেওয়ার কোন বাস্তবতাই ছিল না। খেলাধুলায় ক্যারিয়ার মানেই ফুটবল। আমিনুল শুরুটা করেছিলেন পেশাদার ফুটবলার হিসেবেই। খেলেছেন ঘরোয়া ফুটবলের সর্বোচ্চ আসর প্রিমিয়ার লিগ। ১৯৮৫ থেকে ১৯৮৭ পর্যন্ত খেলেন ইস্ট অ্যান্ড ক্লাবে। পরের বছর (১৯৮৭) যোগ দেন প্রতিষ্ঠিত ক্লাব ভিক্টোরিয়াতে। খেলতেন অ্যাটাকিং মিডফিল্ডে ও ফরোয়ার্ডে। প্রিমিয়ার লিগে গোলও করেছেন বেশ কয়েকটি। দুই মৌসুমে গোল করেছেন তিনটি করে আর একবার করেছেন পাঁচটি।

ফুটবলের যশ-খ্যাতি-অর্থের মোহ পেছনে ফেলে ক্রিকেটকে বেছে নেওয়ার কারণ হিসেবে বললেন, "১৯৮৮ সালে ঢাকার ফুটবলে প্রিমিয়ার লিগ হয়নি। এদিকে জুনিয়র ওযার্ল্ড কাপ ক্রিকেটে অংশ নিতে অস্ট্রেলিয়া গিয়েছিলাম। ওই বছরই উইলস এশিয়া কাপ ক্রিকেটে জাতীয় দলের হয়ে খেলার সুযোগ পাই।" প্রশ্ন করলাম যদি ১৯৮৮ সালে প্রিমিয়ার ফুটবল লিগ অনুষ্ঠিত হত, তাহলে কী আমরা ক্রিকেটার আমিনুলকে পেতাম ? জবাব দিলেন, "সরাসরি এর উত্তর দেওয়াটা কঠিন। ফুটবল ছিল পেশা। আর ক্রিকেট ছিল আমার ভালবাসা। আমি সবসময়ই ভালবাসার টানকেই সবকিছুর উপর স্থান দিই।"

মাঠের যে টান সেটা সন্তানদের মধ্যেও ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন আমিনুল। তার বড় ছেলে নাবিল ইসলাম ভারোত্তোলনে সুনাম কুড়িয়েছেন যথেষ্টই। ১০০ কেজি ক্যাটাগরিতে নাবিলের পারফরম্যান্সের গ্রাফটা উপরের দিকেই। ছোট ছেলে মাহদি ইসলাম অস্ট্রেলিয়ান বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে বেশ পরিচিত নাম। এরই মধ্যে অস্ট্রেলিয়া অনূর্ধ্ব-১৫ দলের হয়ে জিতেছেন ওয়ার্ল্ড সিরিজ শিরোপা। পুত্রের মধ্যে নিজের খেলার প্রতিচ্ছবি দেখতে পান আমিনুল, "আমার খেলার ধরনের সঙ্গে মাহদির খেলার সাদৃশ্য আছে, এমনটা অনেকেই বলেন। আমার স্ত্রীও তাই বলে। তবে আমি যখন খেলতাম, তখন আমার খেলার চেয়ে আমার বেটার হাফ এখন ছেলের খেলার প্রতি বেশি মনযোগী।"

 নাবিল ও মাহদি দুজনই পড়াশোনায় ভাল। মেডিকেলে ভর্তির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে বড় ছেলে। ছোট ছেলের সামনে হায়ার সেকেন্ডারি (এ লেভেলস)। সন্তানরা খেলাধুলায় ক্যারিয়ার করবে কি-না এটা তাদের উপরই ছেড়ে দিয়েছেন আমিনুল। তবে আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে ছেলেরা বাংলাদেশের জার্সি পরে খেলবে, জানালেন এমন ইচ্ছার কথা, "দেশের জন্যই ছেলেদের তৈরি করছি। সব ধরনের খেলাধুলার জন্যই অস্ট্রেলিয়াতে সুযোগ সুবিধা অনেক ভাল। তবে আমি চাই আমার ছেলেরা খেলবে আমার দেশের হয়ে। মাহদি যেন অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের হয়ে খেলতে পারে সেই প্রক্রিয়াতে যাওয়ার কথা ভাবছি। এর জন্য মাহদি দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলবে। একইভাবে বড় ছেলে নাবিলকেও বাংলাদেশে পাঠানোর পরিকল্পনা আছে। এরপর নিজেদের সামর্থের প্রমাণ দিতে হবে তাদের।"

দুবাই থেকে বাংলাদেশ সময় ভোর ছয়টার সময় দুই দফা মিলিয়ে ঘণ্টা দেড়েকের মত সময় কথা বললেন আমিনুল। এসময় বেশ কয়েকবরাই বলেছেন, "আমাদের সময়ে আমরা গ্রুপ প্লেয়ার্স একসঙ্গে এগুচ্ছিলাম। আমাদের মধ্যে গ্যাপ ছিল না। হালের বাংলাদেশে ক্রিকেটের অবস্থা সবারই জানা। ড্রেসিংরুম অশান্ত। ম্যানেজম্যান্ট-প্লেয়ার্স অন্তর্দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য। যে কোন ইস্যুতে ম্যানেজমেন্টের অযাচিত হস্তক্ষেপ নিয়মিত ঘটনা। অনেকক্ষেত্রেই প্লেয়ারদের কমিটমেন্টও প্রশ্নবিদ্ধ। এ অবস্থায় অস্ট্রেলিয়ার মত চমৎকার কাঠামোর মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠা নাবিল-মাহদিদের জন্য বাংলাদেশে মানিয়ে নেওয়ার চ্যালেঞ্জটা নিশ্চয়ই সহজ নয়।"

বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরিয়ানকে আর খোঁচাখুচি করিনি। ভালবাসার টানে যে মানুষটি রমরমা সময়ের ফুটবল ছেড়ে বেছে নিয়েছিলেন ক্রিকেটকে, যে মানুষটি মাটির প্রতি ভালবাসার টানে দেশে পাঠাতে চান সন্তানদের, স্বপ্ন দেখেন লাল-সবুজের জার্সিতে তার সন্তানরা গৌরব বয়ে আনবে দেশের জন্য, এমন স্বপ্ন দেখা মানুষটিকে নতুন করে বাস্তবতার কাটাঁছেড়ার মধ্যে ফেলতে চাইনি।