অরক্ষিত বাঁধ, পানি উন্নয়ন বোর্ডের অনিয়ম ও আমাদের ভবিষ্যত

কামরুল হাসান বাদলকামরুল হাসান বাদল
Published : 14 June 2021, 05:37 PM
Updated : 14 June 2021, 05:37 PM

অতি সাম্প্রতিক ঘূর্ণিঝড় 'ইয়াস'-এর সময় ফেইসবুকে কিছু ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে শতশত মানুষ সত্যি সত্যি বুকপিঠ দিয়ে জলোচ্ছ্বাসের দুরন্ত ঢেউকে থামিয়ে ভেঙে পড়া বেড়িবাঁধ রক্ষা করার চেষ্টা করছে। এমন দৃশ্য অনেকের কাছে নতুন হলেও পরিস্থিতিটা নতুন নয়। বছরে কয়েকবার উপকূলীয় নদীভাঙন এলাকার মানুষদের এই পরিস্থিতিতে পড়তে হয় এবং প্রতিবারই তাদেরকে এমন করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করতে হয়।

বছরের যেকোনও সময় ঘূর্ণিঝড় হোক প্রথম যে খবরটি আমরা পাই তাহলো জোয়ার বা জলোচ্ছ্বাসে বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে। মনে হতে পারে ভেঙে যাওয়ার জন্যই বুঝি বেড়িবাঁধ নির্মাণ মেরামত করা হয়।

কেন অবস্থা? জানা যায় বাংলাদেশের বেড়িবাঁধগুলোর বেশিরভাগই ষাটসত্তরের দশকে নির্মিত। সেসময়ে বড় দুইটি ঘূর্ণিঝড়ের পর জনজীবনের নিরাপত্তা কৃষি সুরক্ষার জন্য উপকূলীয় অঞ্চলে নির্মিত হয়েছিল এসব বেড়িবাঁধ। বাংলাদেশে প্রায় ১৯ হাজার কিলোমিটার বেড়িবাঁধ আছে। বলা হয়, দেশের উপকূলীয় এলাকারহাজার কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। ২০০৭ সালে ঘূর্ণিঝড় সিডর ২০০৯ সালে আইলার পর উপকূল এলাকার এসব বাঁধের অনেক জায়গা ভেঙে গিয়েছিল, অনেক জায়গা বানের তোড়ে ভেসে গিয়েছিল; কিন্তু তার বড় অংশ এখনো যথাযথভাবে মেরামত হয়নি। তার মানে গোটা উপকূলীয় এলাকা এখন অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। এর মধ্যে উপকূলীয় অঞ্চলের সাড়ে পাঁচ হাজার কিলোমিটার বেড়িবাঁধের অবস্থা অত্যন্ত ভঙ্গুর, নাজুক। বেড়িবাঁধের অবস্থার কারণ অনুসন্ধান করে জানা গেল, কার্যত দীর্ঘসময়ে ওইসব বেড়িবাঁধের কোনো উন্নয়ন হয়নি, তবে কখনো কখনো মেরামতের নামে প্রচুর অর্থ নয়ছয় হয়েছে। অন্যদিকে নদীতে জমেছে প্রচুর পলি। বাঁধ ক্ষয়ে গেছে, সমুদ্রে বেড়েছে পানির উচ্চতাও। এর মধ্যে আগের তুলনায় অল্প সময়ের ব্যবধানে আঘাত হানছে একের পর এক ঘূর্ণিঝড়। ফলে ওই পুরোনো বাঁধ দিয়ে এখন অতিরিক্ত ঘূর্ণিঝড় জলোচ্ছ্বাস আটকানো অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছে। বিগত ত্রিশ বছরে বাংলাদেশে ২৩৪টি ছোটবড় বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ আঘাত হেনেছে। এতে কয়েকলাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। সরকারের ত্রাণ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, ২০১৭ সালের মে মাসে ঘূর্ণিঝড় মোরায় প্রায় ২২ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর বাইরে ঘূর্ণিঝড় সিডর, আইলা, কোমেনের আঘাতে ১৯ হাজার কিলোমিটার বেড়িবাঁধের বড় অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেগুলো মেরামত এখনো শেষ হয়নি। বাঁধের সামান্য অংশ ভাঙা আর পুরোটা ভাঙার মধ্যে তফাৎ খুব কম কারণ ওই সামান্য অংশটি শেষ পর্যন্ত সামান্য থাকে না এবং ওই সামান্য অংশ দিয়ে যে লবণাক্ত পানি প্রবেশ করে তা স্থানীয়দের জন্য দীর্ঘকালীন দুর্গতি তৈরি করে।

সময়ে পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ২৬ শতাংশ। অন্যদিকে উপকূলীয় অঞ্চলে প্রতি বছর পাঁচ শতাংশ লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে। যা ক্রমাগত দেশের মধ্যাঞ্চলের দিকে প্রবেশ করছে। ইতিমধ্যে দেশের প্রায় ২৪০ কিলোমিটার অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছে লবণাক্ততা। অন্যদিকে প্রত্যক্ষ হিসেবেও প্রাকৃতিক দুর্যোগে অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ বর্ণনাতীত। ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের কারণে দেশের অনেক স্থানে লবণাক্ত পানি প্রবেশ করেছে। বলা হচ্ছে, দেশের অপার প্রাকৃতিক সম্পদ সুন্দরবনের জলাশয়গুলো লবণাক্ত পানিতে সয়লাব হয়ে যাওয়ায় বন্যপ্রাণীদের পানীয় জলের তীব্র সংকট সৃষ্টি হয়েছে। নিরুপায় প্রাণিকূল তৃষ্ণা নিবারণের জন্য সে লবণাক্ত পানিই পান করতে বাধ্য হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, লবণাক্ত পানি পান করার কারণে বিরূপ পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যে।

দেশে কার্পজাতীয় মাছের প্রাকৃতিক প্রজননক্ষেত্র হালদায় মা মাছ আশানুরূপ ডিম না ছাড়ার অন্যতম কারণ হিসেবে বলা হয়েছে হালদার পানিতে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়া। এটি ঘটেছে ঘূর্ণিঝড়ের কারণে নয়, দীর্ঘদিন বৃষ্টি না হওয়ার কারণে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সবসময় পরিবেশবান্ধব এবং টেকসই উন্নয়নের কথা বলেন। তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে তার দৃঢ় অবস্থানের কথা বলেন। কিন্তু সবক্ষেত্রে তার কথার প্রতিফলন হচ্ছে না। উপকূলবাসীসহ ভুক্তভোগী জনগণের কাছে পানি উন্নয়ন বোর্ড রীতিমতো একটি 'ভিলেনে'র নাম। উপকূলবাসীদের মধ্যে অনেকে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে 'ঘুষ উন্নয়ন বোর্ড' নামে অভিহিত করে থাকে। তারা তাদের দুর্গতির জন্য মন্ত্রণালয়ের লোক তাদের ঠিকাদারদের দায়ী করে থাকেন। প্রতিবছর বর্ষা এলে নদীভাঙন শুরু হয়। পানি উন্নয়ন বোর্ড বা সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত লোকজন আসেন পরিস্থিতি অবলোকন করেন, কিছু কিছু বালির বস্তা বা কংক্রিটের পাথর দিয়ে বাঁধ বাঁচানোর চেষ্টা করেন। তারপর তারা চলে যেতেই পানির তোড়ে সব ভেসে যায়, মানুষ জনবসতি রয়ে যায় অরক্ষিত।

এরা বৈশাখ মাসে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানায়, 'বাঁধ নির্মাণ বা মেরামত হইয়াছে, সরেজমিনে দেখিয়া যাইবার অনুরোধ রহিল' ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ভিজিট করার প্রস্তুতি নিতে নিতে আষাঢ় চলে আসে। এসে দেখেন কিছু নেই। তখন আবার লেখা হয়, 'বন্যায় বাঁধ ভাসিয়া গিয়াছে।' প্রতিবারই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বাঁধ নির্মাণ বা মেরামত হয় নাই তাহা প্রমাণ করিতে ব্যর্থ হন।

কিন্তু এভাবে তো চলে না, চলবে না। কারণ সামনে ভয়াবহ ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে সবচেয়ে হুমকির মুখে থাকা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কী? একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০৭০ সাল নাগাদ বাংলাদেশে গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাবে . ডিগ্রি সেলসিয়াস। অন্য আরেকটি গবেষণা বলছে, ২০৫০ সালের মধ্যে আমাদের ১৭ শতাংশ ভূমি হারিয়ে যাবে এবং এই সময়ে আমরা ৩০ শতাংশ খাদ্য উৎপাদন সক্ষমতা হারাব। ২০৫০ সালের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাবে এবং শুধু এই একটি কারণে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বাড়বে প্রায় আড়াই কোটি।

১৯৯১ সালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় জলোচ্ছ্বাসে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল বাংলাদেশের। সে অভিজ্ঞতার পর যত দিন গেছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় বাংলাদেশের সক্ষমতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। সেটি সুখের বিষয় ধরে নিয়ে বসে থাকলে হবে না। প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধেই এখন বেশি নজর দিতে হবে। নইলে টেকসই উন্নয়নের যাত্রাপথ বিঘ্নিত হবে, লক্ষ্যচ্যুত হবে। তার জন্য প্রয়োজন নদীশাসন বা খনন। তার পাশাপাশি ভাঙনরোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ। উপকূলীয় বেড়িবাঁধ নির্মাণ মেরামত।

সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ায় উপকূলীয় বেড়িবাঁধগুলোকে ১৫২০ ফুট উঁচু করা প্রয়োজন। প্রকৃত হিসাবটি জানি না তবে কারো কারো মতে, দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের বাঁধ নির্মাণের জন্য ৫০ থেকে ৭০ হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন হতে পারে তারা বলেন, অর্থ যদি আগামী পাঁচ বছর একটি প্রকল্পের আওতায় ব্যয় করা হয় তাহলে হয়তো ১০ থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকা বার্ষিক বরাদ্দ দিয়ে সেটা করা সম্ভব হবে।

দেশ তো কেনা যাবে না, আমদানি করে দেশের আয়তনও বাড়ানো যাবে না। বেশি জনসংখ্যার ছোট্ট এই দেশকে রক্ষা করার যত কৌশল আছে তার সবই গ্রহণ করতে হবে। দেশের প্রতিইঞ্চি জায়গা রক্ষার আপ্রাণ চেষ্টা করতে হবে।

গতবছর ঘূর্ণিঝড় আম্পানে ক্ষতিগ্রস্ত সাতক্ষীরার মানুষরা সাংবাদিকদের দেখে বারবার বলছিলেনআমরা ত্রাণ চাই না, আমরা একটা নিরাপদ আর শক্ত বেড়িবাঁধ চাই। যাতে মানুষকে বারবার দুর্ভোগ পোহাতে না হয়। আইলায় একবার (গ্রামগুলো) ডুবে গ্যাসে, সিডরে ডুবে গ্যাসে, আম্পানে আবার ডুবে গেল, এজন্য মানুষ চায় শক্ত একটা বেড়িবাঁধ।