প্রাথমিক শিক্ষা, দুর্নীতি বনাম একুশ শতকের শিক্ষা-ভাবনা

ফারহানা মান্নানফারহানা মান্নান
Published : 16 May 2015, 04:27 PM
Updated : 8 Nov 2012, 05:10 PM

সাম্প্রতিক চিত্র
সরকার প্রথমবারের মত পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা নেয় ২০০৯ সালে । উক্ত সালে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী উত্তীর্ণদের মধ্যে ২ লাখ ১৭ হাজার ৩৮৮ জন শিক্ষার্থী এবারের জেএসসি পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে না। অর্থাৎ তারা এরই মধ্যে ঝরে পড়েছে। শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার কারণ হিসেবে আর্থিক অনটনসহ বিভিন্ন সামাজিক বিষয়গুলো জড়িত বলে উল্লিখিত হয়েছে।

সাম্প্রতিক কালে প্রকাশিত আরও একটি ঘটনায় জানা গেল প্রাথমিক শিক্ষা খাতে বরাদ্দ টাকা লুটপাটের কাহিনী। সারা দেশে সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকার কাজে দুর্নীতি হয়েছে বলে সন্দেহ করা হয়েছে।

উপরে উল্লিখিত ঘটনা দুটি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, জেএসসি পরীক্ষায় শিক্ষার্থীর ঝরে পড়ার পেছনে আর্থিক অনটনসহ বিভিন্ন সামাজিক বিষয়গুলোই একমাত্র কারণ হয়তো নয়। শিক্ষাখাতের উন্নয়নের জন্য বরাদ্দকৃত টাকার সদ্ব্যবহার না করার ফলে বিদ্যালয়ে আদর্শ শিক্ষণ পরিবেশ তৈরি হচ্ছে না। কাজেই নিজেদের সামাজিক দুর্গতির সঙ্গে বিদ্যালয়ের পরিবেশের দুর্গতির চিত্র সমন্বয়ের মাধ্যমে শিক্ষা অর্জনের ক্ষেত্রে তাদের একটি নেতিবাচক ধারণা তৈরি হচ্ছে। স্পষ্টভাবেই শিক্ষার্থীদের পাঠের প্রতি ক্রমশ আগ্রহ হারাবার ক্ষেত্রে এটি একটি উল্লখযোগ্য কারণ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।

শিক্ষা মানুষের জন্মগত অধিকার। বাধ্যতামূলক শিক্ষার প্রথম ধাপ হল প্রাথমিক শিক্ষা। প্রাথমিক শিক্ষার সাধারণ উল্লেখযোগ্য লক্ষ্যসমূহ হল, সাধারনের মাঝে মৌলিক সাক্ষরতা ও সংখ্যাজ্ঞান বিস্তার এবং একই সাথে বিজ্ঞান, গনিত, ভূগোল, ইতিহাস সহ অন্যান্য সামাজিক বিজ্ঞানের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন। নার্সারি শিক্ষার পরবর্তী ধাপে প্রাথমিক শিক্ষা এবং মাধ্যমিক শিক্ষার পূর্ববর্তী ধাপে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০অনুযায়ী প্রাথমিক শিক্ষার মেয়াদ ও বাস্তবায়ন সম্পর্কে বলা হয়েছে, প্রাথমিক শিক্ষার মেয়াদ পাঁচ বছর থেকে বৃদ্ধি করে আট বছর অর্থাৎ অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত সম্প্রসারণ করা হবে। সেখানে আরো বলা হয়েছে, জাতীয় জীবনে শিক্ষার গুরুত্ব বিবেচনা করে এবং জনসংখ্যাকে দক্ষ করে তুলবার কথা বিবেচনা করে ২০১১-১২ অর্থ বছর থেকে প্রাথমিক শিক্ষা ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত চালু করার জন্য অনতিবিলম্বে নিম্নলিখিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবেঃ

• প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষার নতুন শিক্ষাক্রম, পাঠ্যপুস্তক এবং শিক্ষক নির্দেশিকা প্রণয়ন করা;
• প্রাথমিক পর্যায়ের সকল শিক্ষকের জন্য শিক্ষাক্রম বিস্তারসহ শিখন-শিখানো কার্যক্রমের ওপর ফলপ্রসূ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা;
• শিক্ষা প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনার প্রয়োজনীয় পুনর্বিন্যাস করা।

জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ এ উল্লেখিত তথ্য অনুযায়ী প্রাথমিক শিক্ষার এই পুনর্বিন্যাসের জন্য প্রাথমিক পর্যায়ের সকল বিদ্যালয়ের ভৌত সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি এবং শিক্ষকের সংখ্যা বাড়ানো হবে। যথাযথ পদ্ধতি অনুসরণ করে ৮ বছরব্যাপী প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন ২০১৮-এর মধ্যে ছেলে-মেয়ে, আর্থ-সামাজিক অবস্থা এবং জাতিসত্তা নির্বিশেষে পর্যায়ক্রমে সারা দেশের সকল শিশুর জন্য নিশ্চিত করা হবে। একই সাথে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষাগ্রহণও নিশ্চিত করা হবে।

শিক্ষার এই স্তর পরবর্তী সকল স্তরের ভিত্তি সৃষ্টি করে বলে যথাযথ মানসম্পন্ন প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা অপরিহার্য। এ জাতীয় ব্যবস্থা পরিকল্পনাকল্পে প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় দেশের সব বিভাগ, জেলা, উপজেলা ও থানায় প্রয়োজনীয় শ্রেণীকক্ষ নির্মাণ, প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবন সম্প্রসারন, শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তি বিষয়ে দক্ষ করে তুলতে কম্পিউটার সরবরাহকরন, শিক্ষার্থীদের জন্য আর্সেনিক মুক্ত নলকূপ স্থাপন, টয়লেট নির্মাণ ইত্যাদি পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। প্রাথমিক শিক্ষাকে ফলপ্রসূ করবার লক্ষ্যে বিদ্যালয়ে কেবল মাত্র ভৌত সুবিধা নিশ্চিত করলেই চলবে না। একই সাথে একুশ শতকের শিক্ষণ-শিখন পদ্ধতিও অনুসরণ করতে হবে।

একুশ শতকের শিক্ষার মূল ধারনাটি বলে, "One can't believe impossible things." নতুন সহস্রাব্দের সূচনা হয়েছে প্রযুক্তির নাটকীয় বিপ্লবের মধ্য দিয়ে। আমাদের সমাজ এখন বৈচিত্র্যময় আবার বিশ্বায়িত, জটিল এবং মিডিয়া সম্পৃক্ত। Dr. Douglas Kellner-এর মতে আমাদের শিক্ষণ-শিখন পদ্ধতি বর্তমানে ওরাল থেকে প্রিন্ট সংস্কৃতিতে পৌঁছেছে। ইন্টারনেট ও কম্পিউটার প্রযুক্তির কারনে ১৯৮২ সালের পর থেকে জন্ম নেয়া ছেলেমেয়েদের তথ্যের সাথে সম্পৃক্ততা ভিন্ন মাত্রার। এ শতকে শিক্ষার্থীর মধ্যে critical thinking, problem solving, communication, collaboration, creativity এবং innovation, এইসকল পারদর্শিতামুলক criteria গঠন করতে হয়। শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে উপযুক্ত শিখন পরিবেশ গঠন করা যেতে পারে audio-visual instruction, instructional technology, communication in the classroom, verbalism and pictorialism এবং active learning এর মাধ্যমে। একুশ শতকের শ্রেণীকক্ষের সংজ্ঞার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দুইটি term হল, 'design real world challenges' এবং 'make it relevant'। অর্থাৎ শ্রেণীকক্ষে বিশালতা থাকতে হবে। শ্রেণীকক্ষ হবে আকাশের মত মুক্ত। যেখানে কেবল শিক্ষা নয় সু-শিক্ষার চর্চা হবে। কারন 'An effective learner is a lifelong learner'। একুশ শতকের স্কুলের ধরন, শিক্ষকের শিক্ষাদান পদ্ধ্যতি, শিক্ষার্থীর শিখন দক্ষতা ও ক্ষমতা ও কারিকুলাম তাই বিংশ শতাব্দীর চেয়ে ভিন্ন।

এখন প্রশ্ন হল, প্রাথমিক ক্ষেত্রে একুশ শতকের এই ধারণার প্রয়োগ কতখানি যুক্তিযুক্ত এবং প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার্থীর ঝরে পড়া রোধ করতে একুশ শতকের এই শিক্ষা ঠিক কতখানি কার্যকর বলে বিবেচিত হবে?

প্রথম প্রশ্নের সমর্থনে বলতে হয়, John Baugh ২০১০ এর ২০শে অক্টোবর গ্রেট ব্রিটেনের 'The Telegraph' নামক পত্রিকায় উল্লেখ করেছেন, "Primary schools must evolve in the 21st century"। তার প্রধানতম কয়েকটি কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেছেন,
• গত পাঁচ হাজার বছরের তুলনায় এই শতকে অনেক বেশি তথ্য নিয়ে কাজ হচ্ছে।
• প্রাথমিক পর্যায় চিন্তন দক্ষতা অনুশীলনের ক্ষেত্রে প্রাথমিক ভূমিকা রাখে।
• প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের আবিষ্কারকের ভূমিকায় অবতীর্ণকরনের ক্ষেত্রে কয়েকটি মৌলিক প্রশ্নের অনুশীলন করতে হয়, যেমন কী শিখতে হবে বা কিভাবে শিখতে হবে।
• এই স্তরে শিক্ষার্থীর শিখন, চিন্তন, যোগাযোগসহ আন্তব্যক্তিক দক্ষতা গড়ে তুলতে হয়।
দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরে বলতে হয়, একুশ শতকের শিক্ষা বর্তমানের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চিত্র আমুলে না হলেও একটা চিহ্নিত পরিবর্তন আনবে। একটা সময় উপযোগী বিদ্যালয়ের পরিবেশ নিঃসন্দেহে শিক্ষার্থীদের পঠন-পাঠন কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে আকর্ষণ তৈরি করবে। কিন্তু শিক্ষার উন্নয়নের ক্ষেত্রে একুশশতকের শিক্ষার ধারণার প্রবর্তন দুর্নীতির বিরুদ্ধাচরণ করবে এমনটি বলা যায় না। তবে সময়ের সাথে অবস্থার পরিবর্তন ঘটানো এবং একই সাথে যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ যে কোনো সিস্টেমের উন্নয়নের সূচক তেমনটি নিঃসন্দেহে দাবী করা যায়।

এখন কথা হচ্ছে একুশ শতকের শিক্ষার্থী হিসেবে গড়ে তুলতে গেলে উপরে উল্লিখিত দক্ষতা অর্জনের ক্ষেত্রে কী কী প্রধান পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে?
• প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে যুগোপযোগী কারিকুলাম প্রণয়ন করতে হবে।
• বিদ্যালয়ে ভৌত সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। তবে এ শতকের প্রকৃত শিক্ষা শ্রেণীকক্ষের চার দেয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে মৌলিক পদ্ধতি অবলম্বনের মাধ্যমে প্রকৃতির সাহচর্যে সবুজ বাস্তব পরিবেশে শিক্ষা গ্রহণের কথা বলা হয়েছে।
• শিক্ষকদের একুশ শতাব্দীর শিক্ষন-শিখন পদ্ধতি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা প্রদান করতে হবে।
• সরকার ও প্রশাসনের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে।
• প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচারণা চালাতে হবে।
• পাঠ্য-পুস্তক বোর্ডের পাঠ্যপুস্তক রচনার ক্ষেত্রে কারিকুলাম, নীতিমালা, জাতীয় দর্শন, বিভিন্ন লেখকের মতামত, সম্পাদনা ইত্যাদি বিষয়গুলোর মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করতে হবে।
• প্রাথমিক শিক্ষা খাতে বরাদ্দকৃত টাকার সঠিক প্রয়োগের ক্ষেত্রে বিভিন্ন টাস্ক ফোরসের মধ্যে স্বচ্ছতা নির্ধারণের ক্ষেত্রে সরকারকেই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।"One of the saddest lessons of history is this: If we've been bamboozled long enough, we tend to reject any evidence of the bamboozle. We're no longer interested in finding out the truth. The bamboozle has captured us. It's simply too painful to acknowledge, even to ourselves, that we've been taken. Once you give a charlatan power over you, you almost never get it back." ― Carl Sagan, The Demon-Haunted World

তাই প্রাথমিক শিক্ষাক্ষেত্রে একুশ শতকের ধারণাসমূহের এই অনুশীলন নিশ্চিতভাবেই যুক্তিযুক্ত। তবে,আমাদের মতন উন্নয়নশীল, দরিদ্র, দুর্নীতিপরায়ণ দেশে এই ধারণার প্রবর্তন প্রাথমিক শিক্ষার মান উন্নয়ন, শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে পঠন-পাঠনের ক্ষেত্রে প্রেষণা প্রদানে ঠিক কতখানি সফল হবে তা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না।

আমাদের মতন তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর জন্য ক্ষমতা নিয়ে মারামারি, প্রশাসনের সর্বস্তরে দুর্নীতি; এই কি আমাদের নিয়তি? সামাজিক সমস্যা উতরে গিয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবার ক্ষেত্রে শিক্ষাই যে অন্যতম মাধ্যম এটা কি আমরা বুঝি না? নিয়ম নীতিমালার বাহার তো আছে। কিন্তু নীতিমালার সাথে মিল রেখে কাজের অগ্রসর কতটুকু? সামান্য কিছু টাকার লোভ সামালানো দায় হলে এ জাতি শিক্ষা অর্জনের ক্ষেত্রে চলমান ব্যর্থতার এই ধারার প্রতি দায়বদ্ধ হয়ে থাকবে আজীবন। গতস্য শোচনা নাস্তি নয়, বরং অতীতকে মনে রেখে সম্মুখে এগিয়ে চলি।

ফারহানা মান্নান : লেখক এবং শিক্ষক।