মেকলে মিনিট: ঔপনিবেশিক উন্নাসিকতার পুনর্পাঠ

মিল্লাত হোসেন
Published : 14 June 2021, 05:17 PM
Updated : 14 June 2021, 05:17 PM

ইতিহাসে জুড়েও সম্ভবত এমন দ্বিতীয় নজির মিলবে না যেখানে এক ব্যক্তিই একাধারে একটা বৃহৎ জনগোষ্ঠীর প্রধান শিক্ষক, আবার প্রধান আইনপ্রণেতাও। এমন অভূতপূর্ব কৃতিত্বের অধিকারী হলেন টমাস ব্যাবিংটন ম্যাকাউলি; আমাদের কাছে মেকলে নামে বিখ্যাত বা কুখ্যাত। 

তার ১৮৩৫ সালের 'ভারতীয় শিক্ষাবিষয়ক কার্যবিবরণী' (Minutes on Education in Indian) বা 'মেকলে মিনিট' চিরতরে (?) বদলে দেয় ভারতীয়দের শিক্ষাব্যবস্থা। আর দণ্ডবিধি, ১৮৬০ (খসড়া প্রস্তুত করেন ১৮৩৭ নাগাদ) হয়ে উঠে ভারতবর্ষের প্রধান ফৌজদারি আইন। এ দুই কাজের মাধ্যমে তিনি ভারতবর্ষের হাজার বছর ধরে ক্রমে গড়ে উঠা শিক্ষাব্যবস্থা ও বিচারব্যবস্থাকে ঝেঁটিয়ে বিদেয় করেন। 

'মেকলে মিনিটে'র আলোকেই ফার্সি ও সংস্কৃত ভাষা, শিক্ষার মাধ্যম আর ফার্সি রাজভাষা ও আদালতের ভাষা হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে বাতিল হয়ে ইংরেজি হয়ে ওঠে শিক্ষার মাধ্যম ও রাষ্ট্রভাষা। এ কার্যবিবরণী পাঠ করলে একদিকে যেমন অনেক মজার মজার বিষয় পাওয়া যায়; অন্যদিকে মেলে এদেশীয়দের প্রতি ঔপনিবেশিক শক্তির অবজ্ঞা আর বর্ণবাদী মনোভাবের জ্বলজ্বলে প্রকাশ। 

আরবি, ফার্সি, সংস্কৃত ভাষাকে পত্রপাঠ নাকচ করে দেওয়া মেকলে তার মিনিট এর গোড়াতেই কী অবলীলায় বলতে পারেন-"…আমার সংস্কৃত বা আরবি কোনও ভাষারই জ্ঞান নাই।" মিনিটে আরবির উল্লেখ দেখে প্রথমে মনে হতে পারে এটা বোধ হয় ছাপার ভুল। আরেকটু এগোলে দেখা যায় যে, পুরো মিনিটে ফার্সি ভাষার কোনও উল্লেখই নেই। আগাগোড়াই তিনি আরবি বলে যান। সেই সময়ের সরকারি ভাষা ছিল ফার্সি, আর মেকলে মশাই সে ভাষার বদলে ইংরেজি চালুর ওকালতি করছেন অথচ বলার সময় বলছেন আরবি ভাষা, আর নামই নিচ্ছেন না ফার্সি ভাষার! যা বিস্ময়ের উদ্রেক ঘটার জন্য যথেষ্ট। অনেক ভাবনার পর যা বোধগম্য হয় তা হলো- আরবি বলতে মেকলে সম্ভবত ফার্সি বোঝাতে চেয়েছেন। কারণ, ফার্সিও আরবি হরফে লেখা হয়। পৃথিবীর সবচে প্রাচীন ও সমৃদ্ধ দুটি ভাষার কোনটিকেই এমনকি চিহ্নিত করতেও সমর্থ নন, এমন একজন এগুলোকে খারিজ করে দিচ্ছেন এক ঝটকায়- ঔপনিবেশিকতার উন্নাসিকতার এমন পরাকাষ্ঠা আর কোথায় পাওয়া যাবে? 

অবশ্য এরপর পরই তিনি সাফাই দিচ্ছেন, "কিন্তু, আমার পক্ষে যেটুকু করা সম্ভব ছিল, সেগুলোর মূল্য ও ওজন সম্পর্কে একটা যথাযথ মূল্যায়ন করা, সেটা ভালরকমেই করেছি। আমি আরবি ও সংস্কৃত ভাষার সবচেয়ে জনপ্রিয় বইগুলোর অনুবাদ পাঠ করেছি। ভারতবর্ষ ও ইংল্যান্ডে যাদের এসব ভাষায় সবচেয়ে ব্যুৎপত্তি হয়েছে বলে জানা যায়, তাদের সাথে বাৎচিত করেছি।" 

যে সরকারি নির্দেশনা সভার (Public Instructions Committee) কার্যক্রম থেকে এ মিনিটের উদ্ভব, মেকলের ভারতে আসার আগে তা খাড়াখাড়ি দুই ভাগ ছিল। ৫ জন সভ্য ছিলেন প্রাচ্যভাষাগুলোর পক্ষে যাদের 'প্রাচ্যপন্থি' (Orientalists) বলা হতো। বাকি ৫ জনকে বলা হতো 'ইংরেজিপন্থি' (Anglicists)| প্রাচ্যপন্থিদের মেকলে এভাবে মোকাবেলা করছেন- "প্রাচ্যপন্থিরা নিজেরাই যতটুকু মূল্য দেন সেই মাপেই আমি প্রাচ্যজ্ঞানকে গ্রহণ করতে রাজি আছি। প্রাচ্যপন্থিদের মধ্যেও আমি এমন কাউকে পাইনি যিনি এটা অস্বীকার করতে পারবেন যে- যে কোন ইয়ুরোপীয় গ্রন্থাগারের একটিমাত্র তাকে যে মানের লেখাপত্র পাওয়া যাবে, পুরো ভারতবর্ষ আর আরব মিলিয়েও তার সমান হবে না।" ফার্সি ভাষার জন্মস্থান পারস্য বা ইরানের কথা তার চিন্তার ভেতরেও আসেনি, সেটা আরো পরিষ্কারভাবেই বোঝা যায়।

ভারতলাঞ্ছনার এটাই শেষ নয়। মেকলে উবাচ "… এখন প্রশ্ন হলো আমরা কি এমন চিকিৎসাতত্ত্বকে পৃষ্ঠপোষকতা দেবো যা এমনকি ঘোড়ার নাল বানায় যে ইংরেজ, তার কাজেরও অধম? এমন জ্যোতির্বিদ্যা যা ইংরেজ বোর্ডিং স্কুলের বালিকাদেরও হাসির উদ্রেক ঘটাবে? এমনধারার ইতিহাস যাতে মেলে ৩০ ফুট লম্বা রাজা আর ৩০ হাজার বছরব্যাপী রাজত্ব করা সম্রাটের? আর এমন ভূগোল যা গুড় এবং মাখনের সমুদ্রে পরিপূর্ণ?" 

ভারত অবমাননার কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে তিনি তার চূড়ান্ত নিদানে উপনীত হচ্ছেন এভাবে- "….আমি কমিটিতে আমার বিরুদ্ধাচারী প্রাচ্যপন্থি সদস্যদের সাথে এই একটি বিষয়ে একমত যে, আমাদের সীমিত সামর্থের  মাধ্যমে আমাদের দেশীয় প্রজাদের ইংরেজিতে শিক্ষিত করে তোলা এককথায় অসম্ভব। আমরা এখন সর্বোচ্চ যেটা করতে পারি তা হলো- এমন একটা শ্রেণি গড়ে তোলা যারা আমাদের সাথে কোটি কোটি প্রজাদের দোভাষীর কাজ করতে পারবে। সেই শ্রেণিটা হবে এমন যারা রক্তেমাংসে ও গায়ের রঙে হবে ভারতীয় কিন্তু চিন্তায়, জ্ঞানে, রুচিতে আর নীতিনৈতিকতায় হবে ইংরেজ।" 

এ ধরনের উন্নাসিক ঔপনিবেশিক প্রভুর দেওয়া দৃশ্যত অবমাননাকর শিক্ষাব্যবস্থার গাঁথুনি যে ২০০ বছর পরেও আমাদের অঞ্চলে আজও অটুট, তার সাফাই কি নেহায়েত উপযোগবাদের চকোলেট কোটিং দিয়েই সারা যাবে? আত্মবিশ্লেষণের অবকাশ নেই কোন?