সাকিব বনাম সাকিব

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 14 June 2021, 04:04 PM
Updated : 14 June 2021, 04:04 PM

একের পর এক সমালোচনার জন্ম দেওয়া সাকিব আল হাসানই আমাদের সেরা ক্রিকেটার। ব্যক্তিগতভাবে তার খেলা আমার পছন্দের। বিশ্ব ক্রিকেটের মোড়লদের অন্যতম ভারত। তাদের অনেক ক্রিকেট তারকা এবং সাধারণ মানের খেলোয়াড়ও বাংলাদেশকে 'দুধভাত' হিসেবে নিজেদের আচার-আচরণ এবং মন্তব্য প্রকাশ করেন। মাঝে মাঝে তাদের সেরা ক্রিকেটারদের মন্তব্য আমাদের বিস্মিত করে, হতাশ করে। কিন্তু তাদের নেতিবাচক মনোভাবের ভেতরেই স্থায়ী আসন পোক্ত করেছেন সাকিব আল হাসান। আমাদের সিডনি শহরসহ অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট দুনিয়ায় বাংলাদেশের পরিচয় সূত্র সাকিব। 

আমার প্রিয় শ্যালক দেবাশীষ ক্রিকেট বোর্ডের চিকিৎসক হওয়ার সুবাদে দেশের ক্রিকেটারদের অনেক খবর পাই। যখন ঢাকায় ওর বাসায় ছিলাম সকাল-বিকাল ক্রিকেটারদের ফোন অভিযোগ সমস্যা বা আলোচনা শুনেছি। কয়েকবার বিভিন্ন ক্রিকেটারদের শারীরিক সমস্যা ও চিকিৎসার জন্য এদেশেও এসেছে ও। ক্রিকেটারদের সকলেই তাকে 'প্রিয় স্যার' বিবেচনা করেন। সে সুবাদে অনেক বছর আগে একবার সাকিব আল হাসানের সাথে কথা হয়েছিল আমার। সিডনি বইমেলার মাঠে তাকে ঘিরে অল্পকিছু যুবকের জটলা ছিল। সেখানেই কথা বলছিলেন তিনি সবার সাথে। আমি সেখানে পরিচয়সূত্রে কথা বলছিলাম। একবারের জন্যও বিনয়ের অভাব আছে এমন কিংবা উদ্ধত বলে মনে হয়নি। অথচ এ বিনয়ী ছেলেটিই হঠাৎ গত কয়েকবছর ধরে এমন সব আচরণ করছেন কিংবা এমন সব কাণ্ডে জড়াচ্ছেন যা রীতিমত উদ্বেগের; এখন তা আতঙ্কে পরিণত হতে চলেছে।

আমরা আমাদের সেরা ক্রিকেটারকে দেখেছি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিষিদ্ধ হতে, তাও জুয়াড়ির সাথে যোগাযোগের মতো অপরাধে। যে ক্রিকেটার দেশের হয়ে আন্তর্জাতিক পত্রিকা বা ম্যাগাজিনে কাভার স্টোরি হন, অভূতপূর্ব ঘটনার জন্ম দিয়ে দেশ ও সমাজকে গর্বিত করেন- তিনি কেন এমন মেজাজ হারাবেন? আমাদের আর কোনও ক্রিকেটার নেই যে বা যিনি বিশ্বসেরা হতে পেরেছেন কিংবা অদূর ভবিষ্যতে পারবেন। সাকিব তা করে দেখিয়েছেন। এ করাটা তার প্রতিভাজাত। সাকিব এমন এক খেলোয়াড় যাকে আমরা এখন অনায়াসে 'ফিনিক্স' পাখির সাথে তুলনা করতে পারি।  'ফিনিক্স' যেমন ছাই থেকেও উঠে দাঁড়াতে জানে, সাকিবও ফিরে আসতে পারেন ভগ্নস্তুপ থেকে। সে প্রমাণ মিলেছে বারবার।

সাকিব আল হাসান তবে এমন কেন করেন? এটা কি তার মনোরোগ? না ঔদ্ধত্য? না সময়ের সাথে চলতে না পারার প্রমাণ? 

শুরুটা ২০১৪ সালে। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সিরিজে ড্রেসিং রুমে বসে থেকে টিভি ক্যামেরায় বাজে অঙ্গভঙ্গি করেন সাকিব। ফলাফল- ক্ষুব্ধ বোর্ড তিন ম্যাচের জন্য নিষিদ্ধ করে তাকে; সঙ্গে জরিমানা করা হয় তিন লাখ টাকা। ভাবা হয়েছিল, এ শাস্তি হয়তো বদলে দেবে সাকিবকে।

কিন্তু আদতে দেখা গেল, যে তিমিরে তিনি ছিলেন, রয়ে যান সেখানেই। অভিযোগ ওঠে সিপিএলে নাকি খেলতে গিয়েছিলেন এনওসি না নিয়ে। পরে আবার এ বিষয় নিয়ে কোচ হাথুরুর সঙ্গেও বিবাদে জড়ান সাকিব। ফলাফল, এবার শৃঙ্খলাভঙ্গের দায়ে ৬ মাসের নিষেধাজ্ঞা দেয় ক্রিকেট বোর্ড। পাশাপাশি দেড় বছরের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয় তার ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্ট খেলা। যদিও সাকিবের আবেদনের প্রেক্ষিতে পরে সে শাস্তি কমেছিল ৩ মাস।

ক্যারিয়ারের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনার নেতৃত্ব দেন সাকিব। বোর্ডের বিপক্ষে শুরু হয় ক্রিকেটারদের আন্দোলন। অধিকার আদায়ের সংগ্রামে ঢাল হয়ে দাঁড়ান সতীর্থদের পাশে। তবে, বাংলাদেশের ক্রিকেটে সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা আশে এরপরই। আইসিসির নিষেধাজ্ঞায় পড়েন সাকিব। অভিযোগ, বাজিকরদের সঙ্গে যোগাযোগের তথ্য জানাননি আকসুকে। ফলাফল, এক বছরের নির্বাসন ক্রিকেট থেকে।

এগুলো বড় ঘটনা। ছোট ছোট আরও ঘটনা আছে এর ফাঁকে। বুঝতে অসুবিধা হবার কথা না, বারবারই বিপাকে পড়ছেন সাকিব। এবারের ঘটনা আরো এক নতুন অধ্যায়। ঘরোয়া ক্রিকেটের সাধারণ খেলায় দলের অধিনায়ক হয়ে এমন উগ্র আচরণ কি তাকে মানায়? তর্কের খাতিরে আমরা যদি ধরে নেই সাকিব আসলে সঠিক ছিলেন, তারপরও এটা মানা যায় না। আম্পায়ারকে ধন্যবাদ জানাবো। উত্তেজনার পারদেও তিনি মাথা ঠিক রাখতে পেরেছিলেন। তার মনে হয় জানা ছিল, কিছু উল্টাপাল্টা বললে তিনিই হবেন টার্গেট। খালেদ মাহমুদ সুজন আমাদের দেশের পুরনো একজন ক্রিকেটার। এতো অভিজ্ঞতার পরও তিনি মাথা ঠিক রাখতে পারেননি। তেড়ে গিয়েছিলেন তিনিও। এটাও কিন্তু ভালো কিছু না। 

সব মিলিয়ে এখন আমাদের ভাবতে হবে এমন আচরণ আর কতকাল সহ্য করতে হবে? একজন বড় মানের খেলোয়াড় দেশ ও জাতির পরিচয় স্মারক সাকিব। তাকে দেখে রাখা তার জন্য কিছু করা জাতির কর্তব্য। তাকে যেমন বাদ দেওয়া অসম্ভব, তেমনি তার এ জাতীয় আচরণও সহ্য করা যায় না। 

সাকিব আল হাসানের মঙ্গল কামনা করার পাশাপাশি জাতি ও দেশের কল্যাণে এমন অসহনশীল আচরণ নিরসন এখন সময়ের চাহিদা। আর যেন মুখে কালিমা লিপ্ত করার ঝামেলায় না পড়ে দেশের ক্রিকেট। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ইতোমধ্যে এ ঘটনার নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখছি। এবার থামাতেই হবে। শান্তি ফিরিয়ে আনতে হবে সবার স্বার্থে।

সিডনি