ম্যাক্রোঁর চড় খাওয়া ও চড়ের মাহাত্ম্য!

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 10 June 2021, 02:38 PM
Updated : 10 June 2021, 02:38 PM

চড় বা থাপ্পড় মারা বলতে বোঝায় কোনো ব্যক্তিকে হাতের তালু ব্যবহার করে আঘাত করা​। চড় আমাদের সমাজে খুব চালু মাইরের একটা ধরন। রোমান্টিকতা প্রকাশে আলিঙ্গন যেমন শাসনের ক্ষেত্রে চড় তেমন ধন্বন্তরী ও অনিবার্য উপাচার। পারিবারিক পর্যায়ে এক সময় চড় ছিল খুবই প্রচলিত এবং সাধারণ আঘাত করার একটি মাধ্যম। আমরা ছোটকালে ভাত-মাছ, মুড়ি-মুড়কি যেমন খেয়েছি, তেমনি নিয়মিত চড়ও খেয়েছি। শৈশব ও কৈশোরের অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, বেশিরভাগ পরিবারে তখন বজায় ছিল 'মিলিটারি শাসন।' অভিভাবকরূপী শাসকরা তেমন কোনো নিয়ম-নীতি-সংবিধানের ধার ধারতেন না। পান থেকে চুন খসলেই চড়-থাপ্পড়। তারা সারাক্ষণ মুখিয়ে থাকতেন কোন উছিলায় কাকে একটা চড় কষিয়ে দেওয়া যায়। আমরাও ছিলাম নির্লজ্জ। প্রতিনিয়ত চড় খাওয়ার পরও কোনো শিক্ষা হতো না। যেন গালে চড় পড়ে-তেমন কাজই বেশি বেশি করতাম!

আমাদের সমাজে এক সময় জনপ্রিয় একটি কথা ছিল 'চড় মেরে দাঁত ফেলে দেব'। তখন পরিবারে বা সমাজে শাসনের সবচেয়ে কার্যকর হাতিয়ার বা অস্ত্র ছিল চড়। জীবনে পরিবারে, স্কুলে, কিংবা উচ্ছৃঙ্খল কোনো ব্যক্তির কাছে চড়-থাপ্পড় খায়নি-এমন সৌভাগ্যবান মানুষ আমাদের সমাজে খুঁজে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। ঘাড়ত্যাড়া-রাগী মানুষরা চড়কে বৈধতা দিতে নানা ফন্দি এঁটেছেন। তারা চড়কে বৈধতা দিতে 'মনের মানুষ' 'বনের মানুষ' এই রকম একটা উদ্ভট সীমারেখা টেনেছেন। তাদের ভাষ্য মতে, 'মনের মানুষ বাম গালে মারে যদি চড় ডান গাল পেতে দিও পাবে যে আদর!' কিংবা 'শাসন করা তারই সাজে সোহাগ করে যে!' তার মানে দাঁড়াচ্ছে যে চুমু খাবে, সে চড়ও মারতে পারে! এ ধরনের তত্ত্ব আরোপ করে আসলে এক শ্রেণির 'চড়বাজ' মানুষ নিজেদের অপকর্মকেই জায়েজ করার অপচেষ্টা করেছেন!

যাহোক, আমাদের সমাজ, সমাজের রীতিনীতি দ্রুত বদলে যাচ্ছে। সেই পুরনো আখও আর নেই, নেই সেই রস। সেই 'চড়ের শাসন' পরিবার থেকে, সমাজ থেকে প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে। এখন শিশুর শাস্তি বা 'করপোরাল পানিশমেন্ট' বন্ধে গোটা দুনিয়া একাট্টা। অভিভাবকরাও তাদের সন্তানদের গায়ে হাত তোলার আগে দশবার চিন্তা করেন। আর স্কুল থেকে শাস্তি তো প্রায় উঠেই গেছে। একালের মানুষেরা বউ পেটানোর ব্যাপারে সীমাহীন উদার হলেও শিশুদের পেটানোর ব্যাপারে খুবই কৃপণ!

মানুষ কেন চড় মাড়ে বা মাড়তে চায়, সেটা একটা রহস্য। তবে সাধারণভাবে কাউকে উচিত শিক্ষা দিতে, ভয় দেখাতে, অপমান বা আঘাত করতে চড় দেওয়া হয়। সমাজে বেহায়া, দুর্বিনীত, অশিষ্ট বেপরোয়া অনিষ্টকারীকে মানুষ চড় দেয় বা চড় দিতে চায়। প্রবল ক্ষোভ থেকেও মানুষ একে অপরকে চড় মাড়ে। তবে কিছু মানুষ আছে, যাদের হাত নিশপিশ করে। তারা অন্যকে আঘাত করে, চড় মেরে অপমান করে আনন্দ পান। এই জাতীয় মানুষ নিঃসন্দেহে অত্যন্ত বিপজ্জনক।

তবে চড় খেয়ে চড় হজম করার ব্যাপারে আমাদের দেশের মানুষের রয়েছে সীমাহীন দক্ষতা। চড় খাওয়ার ব্যাপারটা যেহেতু সম্মানজনক নয়, তাই সবাই এ ধরনের ঘটনা চেপে যায়। তারপরও কেউ কেউ চড় মেরে আলোচিত হন। কেউ চড় খেয়ে আলোচিত হন। একসময় ভারতের দুই মন্ত্রীকে চড় মেরে আলোড়ন তুলেছিলেন শিখ যুবক হরবিন্দর সিং। তার শখই নাকি ছিল মন্ত্রীদের চড় মারা! মাত্র পাঁচ দিনের ব্যবধানে টেলিকম-মন্ত্রী সুখরাম ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শারদ পাওয়ারকে চড় মারার পর তিনি মানবসম্পদ ও উন্নয়নমন্ত্রী কপিল সিবালকে প্রকাশ্যে চড় মারতে গিয়ে ধরা খান!

কয়েক দফা চড় খেয়েছিলেন ভারতের আলোড়ন সৃষ্টি করা নেতা আম আদমি পার্টির প্রধান অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে। এক সময় তো তিনি চড় খাওয়ার পর হতাশ হয়ে এক টুইটার বার্তায় প্রশ্ন রেখেছিলেন, 'কেন বারবার আমাকে চড় মারা হচ্ছে?'

সম্প্রতি ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ প্রকাশ্যে চড় খেয়ে আলোচিত হয়েছেন। কোনো ক্ষমতাধর দেশের প্রেসিডেন্টের এভাবে চড় খাওয়ার ঘটনা সত্যিই বিস্ময়কর। একথা ঠিক, ক্ষমতাবান অনেক ব্যক্তিকে আমরা মনে চড় মারতে চাই। কিন্তু তাই বলে বাস্তবে এর চর্চা? যেই লোকটা এই কাণ্ড ঘটিয়েছেন, তার সাহস আছে বটে!

বিবিসি জানিয়েছে, গত ৮ জুন দক্ষিণ-পূর্ব ফ্রান্সের ভ্যালেন্স শহরের কাছেই একটি রাস্তায় হাঁটছিলেন প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ। তাকে দেখার জন্য রাস্তার ধারে ব্যারিয়ারের ওপর দিকে দাঁড়িয়েছিলেন অনেকেই। হাঁটতে হাঁটতে হালকা মেজাজে দু'চারটে কথাও বলছিলেন ম্যাক্রোঁ। সেইসময় এক ব্যক্তিকে নমস্কার জানিয়ে আরও এক যুবকের দিকে করমর্দনের উদ্দেশ্যে হাত বাড়িয়ে দেন তিনি। কিন্তু সকলকে অবাক করে দিয়ে ম্যাক্রোঁর গালে সপাটে চড় বসিয়ে দেয় ওই ব্যক্তি। পাশাপাশি, 'ম্যাক্রোঁবাদ নিপাত যাক' বলেও চিৎকার করে ওঠে হামলাকারী। আকস্মিকতা কাটিয়ে মুহূর্তের মধ্যে প্রেসিডেন্টকে সরিয়ে নিয়ে যান তার নিরাপত্তারক্ষীরা। সঙ্গে সঙ্গে গ্রেপ্তার করা হয় অভিযুক্ত যুবক-সহ দু'জনকে। এই ঘটনার ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে নেটদুনিয়ায়।

এই ঘটনায় তীব্র চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে ফ্রান্সে। নিন্দায় সরব হয়েছেন শাসকদল থেকে শুরু করে বিরোধী নেতারা। হামলার ঘটনার কিছুক্ষণের মধ্যেই ফ্রান্সের জাতীয় সংসদে বিবৃতি দেন প্রধানমন্তী জিন ক্যাসটেক্স। তিনি বলেছেন, "কোনও ক্ষেত্রেই হিংসা বা হামলার ঘটনা মেনে নেওয়া যায় না।" ফরাসি প্রেসিডেন্টের সমর্থনে বক্তব্য পেশ করেছেন অতি দক্ষিণপন্থী নেতা ম্যারিন লি পেন। তার কথায়, "গণতান্ত্রিক আলোচনা অনেক সময় তিক্ত হয়ে ওঠে। তবে হামলার ঘটনা মেনে নেওয়া যায় না।"

উল্লেখ্য, করোনাভাইরাস মহামারীর দাপটে আতঙ্কিত গোটা বিশ্ব। নানা বিধিনিষেধে পালটে গিয়েছে পরিচিত জীবন। ফ্রান্সে কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে করোনাভাইরাস সংক্রমণ। খানিকটা শিথিল হয়েছে বিধিনিষেধ। এহেন পরিস্থিতিতে জনতার মনোবল বাড়াতে রাস্তায় ভ্রমণে বেরিয়েছিলেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ। সেই সময়ই তিনি অনাকাঙ্ক্ষিত এক চড় হজম করলেন!

ঘটনাটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এমনিতেই দুনিয়ার ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা নিরাপত্তার কারণে সাধারণ মানুষ থেকে দূরে থাকেন। কিছু কিছু উন্নত দেশে সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানগণ এখনও মাঝে মাঝে জনগণের সান্নিধ্যে যান। কিন্তু ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের চড় খাওয়ার ঘটনার পর মন্ত্রী-এমপি-রাষ্ট্রপতিরা জনগণের 'চড়-সীমা' র মধ্যে আর যাবেন বলে মনে হয় না।

বছর চারেক আগে চড় মেরে আলোচিত হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি একটি তুচ্ছ কারণে টাঙ্গাইল সদরের সংসদ সদস্য সানোয়ার হোসেনকে চড় ও ঘুষি মেরে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। তিনি ছানোয়ার হোসেন এমপিকে নাকি গুণে তিনটি চড় ও একটি ঘুষি মেরেছিলেন (https://www.bbc.com/bengali/news-39021938)! যদিও তিনি পরদিন বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন, 'আমি এমপি মো. সানোয়ার হোসেনকে শাসন করেছি। এটা আমাদের আওয়ামী লীগ পরিবারের বিষয়'। দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে এটা আমি করতেই পারি। সানোয়ারও 'পরিবার-কর্তা'র এই 'শাসন'কে ইতিবাচক ভাবেই নিয়েছিলেন। তিনিও বলেছিলেন, দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আমাকে একটু শাসন করতেই পারেন!

আমাদের দেশে অবশ্য ফ্রান্সের মতো ঘটনার কথা কল্পনাই করা যায় না। এখানে বরং উল্টোটাই ঘটে বেশি। এখানে ক্ষমতাবান ও ক্ষমতাসীনদের হাতে ক্ষমতাহীন বা দুর্বলরা নিয়মিত চড়-থাপ্পর খায়। এমনকি ঘুষি-লাথিও খায়। এসব নিয়ে অবশ্য আমাদের তেমন কোনো খেদ নেই। আমাদের অনুভূতি বরং ডিএল রায়ের কবিতার মর্মার্থের মতো :

আমি যদি পিঠে তোর ঐ লাথি একটা মারিই রাগে;/তোর তো আস্পর্ধা বড়, পিঠে যে তোর ব্যথা লাগে?/আমার পায়ে লাগলো সেটা কিছুই বুঝি নয়কো বেটা?/নিজের জ্বালায় নিজে মরিস, নিজের কথাই ভাবিস আগে।/লাথি যদি না খাবি ত' জন্মেছিলি কিসের জন্যে?/আমি যদি না মারি তো, মেরে সেটা যাবে অন্যে।/আমার লাথি খেয়ে কাঁদা, ন্যাকামি নয়? শুয়োর গাধা!/দেখছি যে তোর পিঠের চামড়া ভ'রে গেছে জুতোর দাগে!/আমার সেটা অনুগ্রহ যদি লাথি মেরেই থাকি;/লাথি যদি না মারতাম তো না মারতেও পারতাম না কি?/লাথি খেয়ে ওরে চাষা! বরং রে তোর উচিত হাসা,/যে তোর কথাও মাঝে মাঝে, তবু আমার মনে জাগে।/বরং উচিত আগে আমার পায়ে হাত তোর বুলিয়ে দেওয়া;/পরে ধীরে ধীরে নিজের পিঠের দাগটা মুছে নেওয়া!/পরে বলা ভক্তিভরে, 'প্রভু! অনুগ্রহ ক'রে/পৃষ্ঠে ত মেরেছো লাথি মারো দেখি পুরোভাগে?/দেখি সেটা কেমন লাগে!'