হাসিনাকে রোহিঙ্গা নিয়ে জ্ঞান দেওয়ার অপচেষ্টায় কিছু মানবাধিকার সংস্থা

সুখরঞ্জন দাশগুপ্তসুখরঞ্জন দাশগুপ্ত
Published : 9 June 2021, 02:37 PM
Updated : 9 June 2021, 02:37 PM

লাখের বেশি রোহিঙ্গা ২০১৯ সালের ২৫ অগাস্ট তীব্র বৃষ্টিতে ভেজার পর কড়া রোদের মাঝে দাঁড়িয়েছিল কক্সবাজারের কুতুপালং আশ্রয় কেন্দ্রে। মিয়ানমার সেনা বাহিনীয় 'জাতিগত নিধন' থেকে বাঁচতে প্রায় দুই বছর আগে আশ্রয় নেয় তারা। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা 'হিউম্যান রাইটস ওয়াচ' (এইচআরডাব্লিউ) রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ভাসানচরে স্থানান্তরকে কেন্দ্র করে মায়া কান্না জুড়ে দিয়েছে। ইয়াস এর প্রভাবে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থান ক্ষতিগ্রস্ত হলেও ভাসানচরের কোন ক্ষয়-ক্ষতি হয়নি। কিন্তু তারপরও চলছে তাদের এ মায়াকান্না।

এইচআরডাব্লিউ ৬ জানুয়ারি ৫৮ পৃষ্ঠার এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যার নাম 'সমুদ্রের মাঝে জেলখানার দ্বীপ: বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের ভাসানচর স্থানান্তর'। প্রতিবেদনটি নিয়ে অগ্রিম কথা বলার জন্য দুঃখিত। কিন্তু এর পরিসমাপ্তিতে বলা হয়েছে, 'বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ অনেক রোহিঙ্গা শরণার্থীকে ভাসানচরে স্থানান্তর করেছে যাদের সেখানের অবস্থা সম্পর্কে কোন ধারণাই ছিল না। এ চর থেকে কাউকে মূল ভূখণ্ডেও আসতে দেওয়া হচ্ছে না। সরকার বলছে কক্সবাজার রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ওপর থেকে চাপ কমাতে কমপক্ষে ১ লাখ রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেখানে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস মোকাবিলার জন্য কোনও উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরা। সেখানে থাকা শরণার্থীরা চিকিৎসা ও শিক্ষার জন্য অপর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা, অবাধ চলাচলে বিধি নিষেধ, খাদ্য সংকট, কর্মসংস্থানের অভাব এবং নিরাপত্তা কর্মীদের হয়রানির বিষয়ে অভিযোগ করেছে।'

আশ্রয়ন-৩ নামে ভাসানচরের এ আবাসন প্রকল্প আকাশ থেকে বেশ স্পষ্ট চোখে পড়ে। এখানে 'ক্লাস্টার ভিলেজ' পদ্ধতিতে আবাসন এবং আশ্রয়কেন্দ্রগুলো নির্মাণ করা হয়েছে, যা কংক্রিট ব্লক দিয়ে তৈরি এবং ভূমি থেকে চারফুট উচ্চতায় নির্মিত।

দীর্ঘ সময় ধরে বাংলাদেশ বিষয়ে কাজ করার সুবাদে আমি বিশ্বের সকলকে একটি বিষয় স্পষ্ট করতে পারি যে, বিগত ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে বাংলাদেশের বেশ কিছু অঞ্চল জলোচ্ছ্বাসে বাঁধ ভেঙ্গে প্লাবিত হয়েছে। কিন্তু ভাসানচরে তার তেমন কোন প্রভাব ছিল না। এই তুলনা করা হচ্ছে সেই সকল মায়াকান্না জুড়ে দেওয়া মানবাধিকার সংস্থা ও বাংলাদেশের সুশীল সমাজের জন্য যারা বলছেন 'রোহিঙ্গারা কঠিন বিপদের মধ্যে রয়েছে'। এ পর্যালোচনা নিয়ে আমি তিনটি বিষয় উপস্থাপন করতে পারি।

১. যদি আমার বাসায় বিনা দাওয়াতে বিপদে পরে কেউ আশ্রয় নেয়, যেভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রায় ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছেন। তাহলে তারা কোথায় থাকবে এ বিষয়ে অতিথিদের মত গ্রহণের সুযোগ কতটুকু থাকে? আমরা কী এমন অতিথিকে তাদের ইচ্ছা মত সব কিছু করতে দিতাম? তারা আমার বেডরুমে ঘুমবে না অতিথি রুমে এ বিষয়ে কী তারা সিদ্ধান্ত নেবে? অবশ্যই না। বাংলাদেশের মত দরিদ্র এক দেশের পক্ষে রোহিঙ্গাদের মত বড় পরিসরের শরণার্থীদের খুব স্বল্প সময়ের জন্য দেখাশোনার সামর্থ্য আছে। অন্যথায় তার নিজ দেশের নাগরিকরা বঞ্চিত হবে।

কিন্তু এখন হাসিনা সরকার এমন এক অবস্থার মধ্যে পড়েছে যাকে বাংলায় বলে 'বসতে দিলে শুইতে চায়'। এক্ষেত্রে অবশ্য একটি বিষয় স্পষ্ট করা দরকার। আর তা হলো, এই আন্দোলন ও চাওয়াগুলো রোহিঙ্গাদের থেকে আসছে না, বরং আসছে বিভিন্ন পশ্চিমা সংস্থা এবং নিজেদের মানবতার ধারক-বাহক ভাবা কিছু ব্যক্তিবর্গের কাছ থেকে। তারা বলতে চাইছে, ভাসানচর মিয়ানমার থেকে আসা শরণার্থী রোহিঙ্গাদের জন্য উপযুক্ত স্থান নয়। এ স্বঘোষিত মানবতার ধারক ও বাহকদের এবং পশ্চিমা মানবাধিকার সংস্থাগুলোকে উদ্দেশ্য করে আমি একটি কথাই বলতে চাই। আর তা হলো, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর অত্যাচারের প্রতিবাদ করে যদি তারা রোহিঙ্গাদের কোনভাবেই তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে না পারে এবং বাংলাদেশ বাধ্য হয় তাদের নিজ দেশে আশ্রয় দিতে, তাহলে এই দেশের সরকার তাদের যেখানে খুশি রাখতে পারে এবং যেমন খুশি তেমনভাবেই রাখতে পারে। ওয়াশিংটন বা নিউ ইয়র্ক, লন্ডন বা ব্রাসেলস, ইস্তাম্বুল বা রিয়াদ যেখান থেকেই এ বিষয়ে বাড়াবাড়ি করা হবে বা চাপ প্রয়োগ করা হবে, তাদের বুঝতে হবে অনেক ত্যাগের বিনিময়ে এ দেশটি তাদের সার্বভৌমত্ব লাভ করেছে।

২. বিশ্বের বড় ও মাঝারি সকল শক্তি মিয়ানমারের ওপর বল প্রয়োগ করে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে ব্যর্থ হয়েছে। উল্টো দেশটি বর্তমানে সেই নৃশংস সামরিক বাহিনীর দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। নিজেদের নাগরিক রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার বিষয়ে চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেছে মিয়ানমার। কিন্তু তারপর শুধু টালবাহানা করে যাচ্ছে বিষয়টি নিয়ে। আর চলতি বছর পয়লা ফেব্রুয়ারি দেশটির রাজনৈতিক সরকারকে উৎখাত করে সামরিক সরকার ক্ষমতা দখলের পর রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়া তো অনেক পরের বিষয়, উল্টো নিজ দেশের সাধারণ মানুষের ওপর নির্বিচারে বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে এ সামরিকজান্তারা। আর এই বিষয়েও কোন ভূমিকা রাখতে পারছে না জাতিসংঘ ও তার অঙ্গ সংস্থাগুলো। যদি বার্মার এই সৈন্যরা নিজেদের লোকদের মাছির মত হত্যা করতে পারে, তাহলে তারা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে সুবিচার করবে এর নিশ্চয়তাও কী কেউ দিতে পারবে? এমনকি জাতিসংঘের সরাসরি হস্তক্ষেপেও কী রোহিঙ্গারা সেখানে নিরাপদে থাকবে? মায়াকান্না বাদ দিয়ে জাতিসংঘ ও তার অঙ্গ সংস্থাগুলো, এইচআরডাব্লিউ-এর মত সকল মানবাধিকার সংস্থা এবং বিশ্বের এ শক্তিশালীদের নিয়ে একত্রে কাজ করে মিয়ানমারের সামরিকজান্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। যেন তারা জাতিসংঘের সরাসরি তত্ত্বাবধায়নে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে।

৩. আর যদি জাতিসংঘ, বড় বড় কথা বলা এ মানবাধিকার সংস্থা ও দেশগুলো (চীন বলেছিল রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে তারা কার্যকর ভূমিকা রাখবে, যে ভূমিকায় এখন পর্যন্ত তাদের দেখা যায়নি) রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার বিষয়ে কোন ভূমিকা রাখতে না পারে, তাহলে দীর্ঘমেয়াদে শরণার্থী আশ্রয় প্রকল্পের অংশ হিসেবে এ রোহিঙ্গাদের বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে দিয়ে বাংলাদেশের বোঝা হালকা করার ব্যবস্থা করতে হবে। এ বিষয়ে পরিকল্পনা করতে হবে। আমি কি অসম্ভব কিছু বলছি? না, এটি অসম্ভব নয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ১ লাখ লৌতসম্পাসকে আশ্রয় দিয়েছে (১৯৯০ সালে বুদ্ধিস্ট ভুটান থেকে ১ লাখ হিন্দুকে বিতাড়িত করা হয় যা নেপালে আশ্রয় নেয়) যখন স্পষ্ট হয়ে যায় যে ভুটান আর তাদের আশ্রয় দেবে না। যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় পাওয়া এমন এক পরিবারের কথা প্রকাশ করে নিউ ইয়র্ক টাইমস যা আমার হৃদয় ছুঁয়ে যায়। 

আমার প্রশ্ন হলো যুক্তরাষ্ট্র লৌতসম্পাসদের যদি শরণার্থী হিসেবে গ্রহণ করতে পারে, তাহলে রোহিঙ্গাদের নিতে সমস্যা কোথায়? তারা ইসলামিক স্টেট বা মুসলিম জঙ্গি সংগঠনগুলোতে যোগ দিতে পারে, এ ভয় পাচ্ছে সবাই? যদি তাই হয়, নিজ নিজ দেশের গোয়েন্দা সংস্থার ওপর ভিত্তি করে নিজ দেশের নিরাপত্তার স্বার্থে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে চাচ্ছে না কেউ। তাহলে বাংলাদেশের ওপর কেন রোহিঙ্গা ইস্যুতে বারবার চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে? শুধু মুসলিম অধ্যুষিত দেশ বলে! পশ্চিমাদের এ দ্বিমুখী নীতির যেমন কোন শেষ নেই, তেমনি এইচআরডাব্লিউ-এর মত মানবাধিকার সংগঠনগুলোরও মায়াকান্নার শেষ হবে না। তবে এইচআরডাব্লিউ-এর প্রতিবেদনের সবচাইতে ভালো দিক হলো, সেখানে লেখা রয়েছে, 'রোহিঙ্গাদের এই অবস্থার জন্য মিয়ানমার দায়ী'।