‘কর্পোরেট মুড়ি-বান্ধব’ বাজেট

আহসান কবিরআহসান কবির
Published : 5 June 2021, 04:24 PM
Updated : 5 June 2021, 04:24 PM

দেবদাস হওয়াও কঠিন হবে এ বাজেটে! বেচারা এবার আগের মতো দেশি বা বিদেশি মদও খেতে পারবে না। বাজেটে সব ধরনের মদের দাম বাড়ানো হয়েছে।
-বাজেট  প্রস্তাবের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ট্রল

বাজেট প্রস্তাবের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আরও কিছু ট্রল হয়েছে। যেমন- সিগারেট খেলে হয় ক্যান্সার আর মদ খেলে হয় ড্যান্সার। বাজেটে বরাবরের মতো এবার সিগারেটের দামও বেড়েছে। ট্রল হয়েছে এমন- সিগারেটের দাম বেড়েছে এখন কী খামু? উত্তর হচ্ছে- মুড়ি খা! এবার মুড়ির দাম কমেছে। এটা জানার পর প্রশ্ন উঠেছে- শুকনো চিড়ার কী খবর? উত্তর হচ্ছে- মুড়ি চিবুতে চিবুতে গলা ধরে গেছে। তাই উত্তর জানা যায় নি।

বাজেট কিছু জিনিস প্রতিবছর আলোচনাতে নিয়ে আসে। যেমন সরকারের কাছে এটা সবসময়েই- "উন্নয়ন আর জনকল্যাণমুখী বাজেট। বাস্তব ভিত্তিক, সময় উপযোগী, ব্যবসাবান্ধব, বিনিয়োগবান্ধব এবং সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণের নিশ্চয়তা ও সংকটকালের বাস্তবধর্মী বাজেট।"

বিরোধী দলের কাছে এটা সবসময়ে- "গরীব মারার বাজেট। যারা দিন আনে দিন খায় তাদের জন্য কোন নিশ্চয়তা নেই কিন্তু যেসব ব্যবসায়ী অঢেল টাকার মালিক বাজেটে তাদের দুই হাত ভরে দেওয়া হয়েছে।"

যে পেশারই হন না কেন বাজেট নিয়ে সবাই কোন না কোন মন্তব্য করেন। ডাক্তার হোক আর ইঞ্জিনিয়ার হোক, রাজনীতিবিদ হোক আর গায়ক-গায়িকা হোক- বাজেট নিয়ে সবার কিছু না কিছু বলার থাকে। কিন্তু সম্পূরক বাজেট কী, কত টাকা সরকার ও তার মন্ত্রণালয় খরচ করতে পারবে, কতো টাকা ঋণ শোধে যাবে, কতো টাকা সুদ, কোন মন্ত্রণালয় কতো পাচ্ছে, বিদেশ নির্ভরতা কেমন, গরীব মানুষ বা কৃষক কী পাচ্ছে- সে হিসেব ঠিকমতো অনেকেই করতে পারেন না।

কিন্তু বড় বড় ব্যবসায়ীদের হিসেব ঠিকই থাকে। তারা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে লগ্নি করেন, সেখানে ১৫ শতাংশ কর বাড়লেও তাদের কিছু যায় আসে না, যদিও রাস্তায় নামতে বাধ্য হয় শিক্ষার্থীদের একটা অংশ। কর্পোরেট কর ২০২১ সালের বাজেটে কমানো হয়েছে। স্টক এক্সচেঞ্জের তালিকাভুক্ত এবং অতালিকাভুক্ত কোম্পানির করহার কমানো হয়েছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন- "এই বাজেট পুঁজিবাজার বান্ধব।" এছাড়া কমানো হয়েছে ব্যবসায়িক টার্নওভারের কর হার। যন্ত্রাংশ কিংবা কাঁচামাল আমদানির কোথাও কোথাও সুবিধা পেয়েছেন ব্যবসায়ীরা। সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে স্থানীয় শিল্পকেও। অর্থবিত্তের যারা মালিক এবং ধনাঢ্য ব্যবসায়ী এ বাজেটে তাদেরকে হাত খুলেই দেওয়া হয়েছে।

কালো টাকা সাদা করার সুযোগ গতবছরের মতো না থাকলেও কোন না কোনভাবে রয়েই গেছে। গরীবের কোন সাদাকালো রোগ নেই। বাজেট আসে, বাজেট যায়- গরীবদের তাতে কিছু যায় আসে না। তারা বুঝতেই পারে না প্রতিবছর তাদের দাম কতোখানি কমে! ২০২১ এর বাজেটে খুব সাধারণ বা গরীব মানুষদের জন্য কোন আশার বাণী নেই। নতুন করে যারা গরীব হয়েছে এবং করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতি যাদের নিঃস্ব করেছে তাদের জন্যও কোন নির্দেশনা নেই। নেই কোন নতুন বরাদ্দ বা বন্দোবস্ত। গরীবরা সবসময় নিয়তি নির্ভর, এবছরও তাই। ভাগ্যিস মুড়ির দাম কমেছে। বিখ্যাত হিন্দি ছবি 'শোলে'র ভিলেন গাব্বার সিং যেমন বলতো- 'এবার গোলি খা', তেমনি গরীবদের বলা যাবে-'যা এবার মুড়ি খা'!

২০২০ সালের বাজেটে আশা করা হয়েছিল স্বাস্থ্যখাতকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে। ২০২১ এ এসে কী দেখা গেল? গত তিনবছরে স্বাস্থ্যখাতের দুর্নীতি নিয়ে কম সমালোচনা হয় নি। এবারের প্রস্তাবিত বাজেট কী তাহলে করোনা প্রতিকারের বাজেট? অথবা এবারের প্রস্তাবিত বাজেট কী গবেষণাবান্ধব? প্রযুক্তিকে ভালোবাসার বাজেট?

লেখাটা সিরিয়াস হয়ে যাচ্ছে। আমরা বরং প্রশ্ন-উত্তর পর্ব এবং কৌতুকের দিকে যাই। বাজেট বিষয়ক কৌতুকের সমস্যা হচ্ছে সব কৌতুকই পুরোনো। প্রথমে প্রশ্ন ও উত্তর পর্ব।

প্রশ্ন: এবারের বাজেট কী শুধু পুঁজি বা মুড়ি বান্ধব ?
উত্তর: না। এবারের বাজেট 'নারীবান্ধব' বাজেট। কারণ এই বাজেটে স্যানিটারি ন্যাপকিনের ওপর ভ্যাট অব্যাহতি দেয়া হয়েছে!

প্রশ্ন: শায়েস্তা খানকে মনে পড়ে কখন?
উত্তর: বাজেট এলে এবং নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বাড়লে। বাজেটে দাম কমলেও নাকি পণ্যের দাম কমে না। শায়েস্তা খানের আমলে 'টাকায় আট মণ চাল' পাওয়া গেলেও মধ্যস্বত্ত্বভোগী বা মজুতদাররা ছিল না। থাকলে 'সিন্ডিকেট' শব্দটি তখনই প্রচলিত থাকতো!

প্রশ্ন: বাজেটে মানুষের দাম কতো কমলো?
উত্তর: গরীব মানুষদের নিয়ে কেউ গবেষণা করে না। আর বাজেট মানুষের জন্য বলা হলেও এটা কোন শ্রেণীর মানুষের জন্য সবাই তা জানে।

প্রশ্ন :ভাতের বদলে আর কী খাওয়া যেতে পারে?
উত্তর: ঝামেলা করে লাভ আছে? না খেয়ে থাকাই কী ভালো না! ২০০২-০৩ সালে কিছুদিনের জন্য পেঁয়াজ আর কাঁচা মরিচের দাম খুব বেড়ে গেলে প্রয়াত অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান বলেছিলেন- 'এসব না খেলে কী হয়?' আর যদি খেতেই হয় 'কর্পোরেট মুড়ি' খান। কারণ কর্পোরেট কর কমানো হয়েছে। রাস্তাঘাটের গরীবদের জন্য যে মুড়ি তার দাম কমবে কিনা এখনও বোঝা যাচ্ছে না।

প্রশ্ন: বাজেট আসলে কী?
উত্তর: তিন বছর আগে লিখেছিলাম। আবারও লিখলাম। বাজেট হচ্ছে বাজে 'ট'। তাই সরকারের বাজেট ঘোষণার পর মানুষ খুঁজতে থাকে ভালো 'ট'।

এবার বাজেটের নামে পুরোনো কৌতুক।

এক.

এক ছেলে প্রার্থনায় বিধাতার কাছে শুধু টাকা চায়। মাত্র প াশ হাজার টাকা। কিন্তু কেউ তাকে টাকা দেয় না। একদিন সে একটা চিঠি লিখে পোস্ট অফিসে দিয়ে আসলো। এই চিঠি গেল অর্থমন্ত্রীর হাতে। তিনি ছেলেটার জন্য পচিশ হাজার টাকা বরাদ্দ দিলেন। টাকা পেয়ে ছেলেটা বিধাতার উদ্দেশ্যে আরেকটা চিঠি লিখলো।চিঠিতে এমন আর্জি ছিল- হে বিধাতা এবার সরাসরি আমার কাছে টাকা পাঠাবেন। অর্থ মন্ত্রনালয়ের মাধ্যমে পাঠালে ওনারা ট্যাক্স কেটে রাখে!

দুই.

পাড়ার ক্লাবে স্থানীয় এক নেতা এসেছেন। তিনি বললেন- দুটো খবর আছে আপনাদের জন্য। একটা ভালো অন্যটা কঠিন। কোনটা আগে শুনবেন? সবাই ভালোটা শুনতে চাইলো। নেতা বললেন এক বছরের মধ্যে এই ক্লাব কয়েক তালা হবে। এসি, ফ্যান ও লাইট দিয়ে বেশ সুন্দর করা হবে ক্লাবটাকে। উপস্থিত সবাই এবার কঠিনটা জানতে চাইলো। নেতা বললেন- ক্লাব এর পুনর্নিমাণ, সংস্কার ও সৌন্দর্য-বর্ধনের টাকা আসলে আপনাদের পকেটেই আছে। যত তাড়াতাড়ি এটা আদায় হবে ক্লাব তত তাড়াড়াতাড়ি আধুনিক হবে।

বিশেষ দ্রষ্টব্য: স্বাধীনতা পরবর্তীকালে ১৯৭১-৭২ আর ১৯৭২-৭৩ সালের বাজেট একসাথে দিয়েছিলেন মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও স্বাধীনতার পর প্রথম অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। সেই বাজেটের আকার ছিল ৭৮৬ কোটি টাকা। ২০২১ সালে ৫০ তম বাজেট পেশ করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল। স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত তাজউদ্দীন আহমদই একমাত্র মানুষ যিনি পরিপূর্ণ রাজনীতিবিদ ছিলেন। এরপরে যারা অর্থমন্ত্রনালয়ের দায়িত্বে ছিলেন তারা অর্থনীতিবিদ, অবসরপ্রাপ্ত আমলা বা ব্যবসায়ী ছিলেন, কেউ পরিপূর্ণ রাজনীতিবিদ ছিলেন না।