উন্নয়ন অগ্রযাত্রা আর সমৃদ্ধির গল্প যখন আমাদের স্বপ্নকে জাগ্রত করছে, দিন দিন নতুন আশার কথা শোনাচ্ছে তখন একই সাথে অন্ধকার ও বিপন্নতা ধেয়ে আসছে ঝড়ের মতো। ভাববেন না এগুলো কোনও বিচ্ছিন্ন বা হঠাৎ ঘটে যাওয়া ঘটনা। যদিও এগুলো এখন স্বাভাবিক বলেই মনে হয়।
মানুষ এসব শুনতে শুনতে এতবেশি ক্লান্ত ও হতাশ- যে তারা শুনতে চান না। শুনলে বা প্রতিবাদ করলেও কি কোন লাভ আছে? সবকিছু বুদবুদের মতো, উঠেই মিলিয়ে যায়। শুধু কিছু সময় এ নিয়ে সামাজিক মিডিয়া তোলপাড়। তিতিবিরক্ত মানুষের জানমালের নিরাপত্তা যেখানে ব্যাহত সেখানে চরিত্র বা শ্লীলতা নিয়ে ভাবার সময় কোথায় আসলে?
মে মাসের শেষ সপ্তাহের পত্রিকার খবরের দিকে নজর নেওয়া যাক-
লালমনিরহাট শহরে চার বছরের এক শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে এক কিশোরের (১১) বিরুদ্ধে। ধর্ষণের শিকার শিশুটি বর্তমানে লালমনিরহাট সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। ২৭ মে রাতে সদর উপজেলায় ওই ঘটনা ঘটে।
সাভারের আশুলিয়ায় মহাসড়কে চলন্ত মিনিবাসে এক নারীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় ছয়জনকে আটক করেছে পুলিশ। ভুক্তভোগীকে স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) পাঠানো হয়েছে। ২৯ মে সকালে আশুলিয়া থানার পরিদর্শক (অপারেশন) আব্দুর রশিদ বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরীতে স্বামীর সহযাগিতায় এক নববধূ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। ২৫ মে উপজেলার কেদার ইউনিয়নের সরকারটারী গ্রামে এ ঘটনা ঘটে।
নওগাঁর বদলগাছীতে ব্ল্যাকমেইল করে চাচিকে একাধিক বার ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে জয় নামের এক যুবকের বিরুদ্ধে। জয় তার স্বামীর চাচাতো ভাইয়ের ছেলে। ভুক্তভোগী ওই গৃহবধূ গত ২২ মে থানায় অভিযোগ দিলেও অভিযুক্তকে আটক করতে পারেনি পুলিশ।
এরকম অসংখ্য যৌনবিকৃতি ও ধর্ষণের খবরে সয়লাব পত্রিকা। কিছুতেই কমছে না।
এগুলো এখন এতো বেশি নৈমিত্তিক যে মানুষ আর উদ্বিগ্নও হয় না। উন্নয়ন অগ্রযাত্রার আড়ালে হররোজ ঘটে যাওয়া এসব ঘটনা কী প্রমাণ করে? আমরা সবাই জানি বাংলাদেশ এগোচ্ছে । অনেক বড় বড় ঘটনা ঘটছে, যা আমাদের জন্য আশার খবর। সবাই জানেন বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো তার রিজার্ভ ফান্ড থেকে এককালে আমাদের চাইতে অনেক এগিয়ে থাকা শ্রীলংকাকে সাহায্য করতে চলেছে। এ টাকা সরকারি ফান্ডে থাকলেও মূলত জনগণের টাকা। বিশেষত প্রবাসীদের পাঠানো কষ্টার্জিত অর্থ। প্রতিবেশীর বিপদের সময় সাহায্য করা কর্তব্য- তা নিয়ে কথা নেই। কথা আছে- টাকা ও উন্নয়ন সমাজকে কোথায় দাঁড় করাচ্ছে তা নিয়ে?
ফিরে আসি মূল কথায়। ধর্ষণ সবদেশে হয়। আগেও হতো। আমাদের দেশে ধর্ষণ বা যৌনতার অপব্যবহার নতুন কিছু না। কিন্তু এই যে মহামারী করোনাভাইরাসের সময় গণধর্ষণ ও শ্লীলতাহানির যে প্রতিযোগিতা- এর সামাজিক ব্যাখ্যা কী? সমাজ গবেষক বা সমাজবিজ্ঞানী নামে পরিচিতজনেরা কোথায়? অবশ্য যে দুএকজন-কে চিনি তাদের দিকে তাকালেই বুঝি এখন সমাজবিজ্ঞানীর কাজ হচ্ছে বাড়িতে বসে মানুষের স্তুতি উপভোগ আর মাঝে মাঝে বক্তৃতা দেওয়া। যারা লেখেন বা বলেন তাদের বিষয়ও নির্দিষ্ট- বঙ্গবন্ধু, প্রধানমন্ত্রী আর উন্নয়নের বাইরে কোনও বিষয়ে তারা আর মুখ খোলেন না। প্রশ্ন হচ্ছে ধর্ষণ ও যৌনবিকৃতিতে ক্লান্ত দেশের এ তারুণ্য বা মানুষ উন্নয়নের ঝাণ্ডা বহন করবে কিভাবে? এসব উন্নয়নের শেষটা কী দাঁড়াবে?
সমাজ এখন মারাত্মক এক ভঙ্গুর জায়গায় দাঁড়িয়ে। ডিজিটাল দুনিয়ার নামে খুলে যাওয়া জগত মানুষকে পাগল করে ফেলেছে। সন্দেহ নাই এ অন্ধকারের আগ্রাসন সব দেশে সব সমাজে তার থাবা মেলেছে। সারাদিন জোশ আর উত্তেজনায় ডুবে থাকা পাকিস্তানের মুখে ধর্ম থাকলেও তাদের মানুষজন দুনিয়ায় পর্নো দেখার বিষয়ে রেকর্ডধারী। আমরা কি খুব পিছিয়ে? যে সব ধর্মব্যবসায়ীরা সম্প্রতি মানুষকে হেদায়েত করার নামে উত্তেজনায় ডুবিয়ে রাখতেন, তাদের কথা শুনেছেন নিশ্চয়ই। তারা মানুষকে সংগীত নিকেতন, হারমোনিয়াম, তবলা ভাঙ্গার জন্য জোশ জোগালেও নিজেরা তার চেয়ে জঘন্য অপরাধ করতে কসুর করেন না। ঘটনা সত্য হলে তাদের নীলছবি দেখার কথাই মনে করিয়ে দেয় যৌনবিকৃতির অন্ধকার এখন সর্বগ্রাসী।
বয়স ভেদ না মানা যৌনবিকৃতি ও ধর্ষণ একাকার হয়ে ঢুকেছে সমাজে। ঘটনাগুলো পড়লেই বুঝবেন এ নিষিদ্ধ আকর্ষণ বয়স, সম্পর্ক কিংবা শিষ্ঠাচার কিছুই মানছে না। যে কারণে আত্মীয়তাও আছে ঘোর বিপদে। অথচ এতোটা ধর্ষণপ্রবণ সমাজ কখনো দেখিনি আমরা। চোখের লজ্জা মানবিকতাসহ মানুষের জীবন নিয়ন্ত্রণ করতো নৈতিকতা। সে নৈতিকতা আজ কোথায়? কে আজ রোল মডেল? কারা দেখাবেন পথ? যে যেখানে- সেখানেই হয় টাকা, নয় নারী, নয় জমি- নয়তো অন্যকিছু নিয়ে কেলেংকারী। এ যেন এক আলীবাবার জগত- খুলে যাওয়া দুনিয়া মানেই লুটপাট, ধর্ষণ আর অনাচার। কাজেই সাধারণ নামে পরিচিত মানুষ কেন থেমে থাকবে? আজ আর বলার দরকার পড়ে না যে তরুণ, বয়স্ক এমনকি কিশোর- কোনও প্রজন্মই এর বাইরে নেই।
সবাই যে যেভাবে পারছে উপভোগে ব্যস্ত। কত সংসারে আজ ভাঙ্গনের শব্দ, কত পরিবার বিপন্ন- সে খবর জানাও যায় না। এমন এক সমাজ- যেখানে একদিকে ধর্মের নামে নানা আচরণ আর ফতোয়া, অন্যদিকে ভেতরে ভেতরে চলছে এসব জঘন্য কর্মকাণ্ড। আজ মধ্যবিত্ত থেকে নিম্মবিত্ত সব স্তরেই চলছে অবাধ যৌনতার লীলাখেলা। তটস্থ সাধারণ মানুষ। তাদের চোখের ঘুম কেড়ে নিয়েছে এমন সব কাহিনী। সন্তানসন্ততি নিয়ে বাঁচাটাই আজ বড় চ্যালেঞ্জ। সমাজপতিরা ঘুমে। সমাজবিজ্ঞানীরা ব্যস্ত পদক পুরস্কার নিয়ে। রাজনীতি মৃত প্রায় । তাহলে উপায়?
উপায় একটাই- সমাজ ও পরিবারের অবিচ্ছেদ্য বন্ধন। ডিজিটাল দুনিয়া থেকে মুখ ফিরিয়ে ফিরতে হবে ঘরে। সময় দিতে হবে সবাইকে। বায়বীয় যোগাযোগ কমিয়ে গড়ে তুলতে হবে সরাসরি যোগাযোগ। সোজা কথায় ভালোবাসার আন্তরিকতা, পুরনো সে টান ফিরিয়ে আনতে হবে। তাহলেই আবার আমরা বুক টান করে দাঁড়াতে পারবো। তা না হলে যৌনতার কাছে পরাজিত সমাজ কি পারবে উন্নয়ন এগিয়ে নিতে? মানবসম্পদ মানে কী? ধর্ষণকামী কোন সমাজ মনোবল, নৈতিকতা আর চারিত্রিকভাবে দৃঢ় কোন জাতি হিসেবে কখনও দাঁড়াতে পারেনি, পারবে না। এর মীমাংসা না হলে আমাদের কপালে দুর্ভোগ আছে আরও। সরকার পারবে না। একমাত্র জনগণই ভরসা।
সিডনি