ভাবনাগুলো আকাশকুসুম নয়

লাভা মাহমুদা
Published : 30 May 2021, 03:00 PM
Updated : 30 May 2021, 03:00 PM

মানব সভ্যতার বিরুদ্ধে করোনাভাইরাসের আঘাত এমন ব্যাখ্যাতীত অনিশ্চয়তার জন্ম দিয়েছে যে, মানুষ এতটা অসহায় আর কখনও বোধ করেনি। বিচ্ছিন্নতার অদ্ভুত এক গোলক ধাঁধায় দুনিয়ার মানুষ হতবিহ্বল। থমকে যাওয়া জরাগ্রস্ত জীবন, বাধ্যতামূলক সামাজিক বা শারীরিক বিচ্ছিন্নতা, অস্তিত্বের তীব্র সংকট, অনিশ্চিত জীবন যাপন, অর্থনীতির নিরঙ্কুশ ধস, একসঙ্গে এত বিপুল সংখ্যক মানুষের কাজ হারানো, মানুষে মানুষে ব্যবধান- এমন অসংখ্য বাস্তবতার জন্ম দিল, যার জন্য গত এক'শ বছরেও মানুষের কোনো প্রস্তুতি ছিল না।

গত এক বছরের বেশি সময়ে পৃথিবীর দেশগুলোর ভেতরের নড়বড়ে কঙ্কাল বেরিয়ে এসেছে। দেশে দেশে চিকিৎসা ব্যবস্থার এতটা করুণ দশা এ মহামারী না এলে জানা যেত না, ভ্যাক্সিন নিয়েও যে  রাজনীতি-কূটনীতি হতে পারে জানা যেত না, গরিব দেশ, ধনী দেশের চিকিৎসা বৈষম্যসহ আরও  অনেককিছু থেকে যেত অজানা। অথচ নিজেদের শ্রেষ্ঠ দাবি করা দেশগুলোর কী আস্ফালন! কথায় কথায় পারমাণবিক বোমার হুঙ্কার, মিসাইল, ক্ষেপণাস্ত্র, যুদ্ধংদেহী মনোভাব, আরও কত কী! 

রাজনীতিবিদেরা যতটা রাজনীতি বোঝেন, ততটা বোঝেন না মানুষ, মানুষের জীবন-যন্ত্রণা। মানবিক মূল্যবোধ তাদের কাছে সত্যিকার অর্থেই গৌণ, যদিও মানুষের জীবন মানের উন্নয়নের কথা বলেই তারা রাজনীতি করেন। আমেরিকা চীন রাশিয়ার মতো মহাশক্তিধর দেশই শুধু নয়, পৃথিবীর প্রতিটি রাষ্ট্র মানুষের জীবন নিয়ে খেলছে। হয়তোবা ধরনটা ভিন্ন। একনায়কতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র,  রাজতন্ত্র বাদ থাকুক….গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র বা মানবিক কোন তন্ত্রের নামে শোষিত-বঞ্চিত হচ্ছে না এ পৃথিবীর মানুষ?  কেউ কম, কেউ বা বেশি। এই যে রাজনীতি, এর নোংরা খেলাই পৃথিবীর আর সব নীতিকে খেয়ে ফেলেছে। 

মহামারী তো পৃথিবীর ইতিহাসেই আছে, অগুনতি মানুষও মরেছে। সে প্রচণ্ড নৈরাশ্য থেকে আবার জেগেও তো উঠেছে । কিন্তু প্রকৃতির সঙ্গে অতিমাত্রায় বাড়াবাড়িতে উদ্ভিদ ও প্রাণির কোটি কোটি প্রজাতি বিলুপ্ত হয়েছে। প্রায় ফুরিয়ে গেছে সুপেয় পানি। উষ্ণায়ন বেড়ে উত্তপ্ত হয়েছে পৃথিবী। যুদ্ধের উন্মাদনা যত বেড়েছে, মানুষ ততই বিপন্ন হয়েছে। অভিবাসন সংকট আজ ভয়াবহ। শরণার্থীর সংখ্যা বেড়েছে, দেশহীন বাস্তুচ্যুত ছিন্নমূল মানুষের সংখ্যাও আজ কোটি কোটি। 

আগেও মহামারী থেকে সেরে উঠেছিল পৃথিবী। এবারও নিশ্চয়ই তার ব্যত্যয় হবে না। ভ্যাক্সিন সবাই পাক আর না পাক, অনেক প্রাণের বিনিময়ে একদিন এ করোনাভাইরাসের তাণ্ডব থেমে যাবে। শান্ত নির্মল ধরিত্রীতে আবারো প্রাণের জোয়ার বইবে, এ কথা নিশ্চিত করেই বলা যায়। জেগে জেগে ঘুমিয়ে থাকা পৃথিবীটাকে  একটা সজোর ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে দিতে পারলো কি এ মহামারী – করোনাভাইরাস?  

মাটির পৃথিবীতে মানুষের অসহায়ত্বকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে আমরা গ্রহ নক্ষত্র খোঁজার পেছনে ব্যয় করছি বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার। মাটি, পানি, আকাশ দখলের বিরামহীন প্রতিযোগিতায় ক্লান্তি নেই। অক্সিজেন ভেন্টিলেটরের অভাবে মানুষের মৃত্যু হয় কিন্তু মঙ্গলের আকাশ লাল নাকি নীল, পানি আছে কী নেই- তা নিয়ে চলছে বিস্তর গবেষণা, ব্যয় অযুত মিলিয়ন ডলার। 

এ ধরিত্রী এতটা সহ্য করবে কেন? তাই আবারো হয়তো কোনও মহামারী বা অন্য কোনো বিপর্যয় নেমে আসবে। আবারো অনেক মানুষের মৃত্যু হবে, অনেক মানুষ কাজ হারাবে, আরও অনেক অনেক কষ্টকর দুঃসহ হৃদয় বিদারক ঘটনা ঘটবে। 

অথচ রাজনীতিবিদেরা মানবিক হলে- এই যে এখনও বেঁচে আছি যে পৃথিবীতে, তা আরও সুন্দর মনোরম এবং বাসযোগ্য হতে পারতো। খুব সহজেই তাকে বাসযোগ্য এবং সুন্দর করে গড়ে তোলা যেত। ভালোবাসা আর মমত্ববোধের এক চমৎকার আধার হতে পারতো। 

রাজনীতিবিদরা যদি সত্যিকার অর্থেই বিশ্বাস করতেন এবং বলতে শুরু করতেন আজকের দিনটি থেকে আর কোনো হানাহানি যুদ্ধ-বিগ্রহ হবে না, কাউকে নির্যাতন করবো না, জোর করে দখল করবো না, বাস্তুচ্যুত করবো না, মিসাইল ছুঁড়বো না, ধর্মীয় বা জাতিগত কোনো সহিংস আচরণ করবো না, হত্যা করবো না- তাহলে পরিবর্তন আসতে খুব বেশি সময় লাগবে না। নিশ্চিত বদলে যাবে এ চমৎকার গ্রহখানি। 

এসবই হয়তো আমার অর্থহীন ভাবনা। জানি, এমনটা কখনোই ঘটবে না। এটাই নিয়তি। এ নিয়তিকে মেনে নিয়েই একদিন চলে যেতে হবে অসীমের পানে। তবে মানুষের স্বপ্ন দেখা তো থেমে থাকে না। স্বপ্নই বাঁচিয়ে রাখে মানুষকে।  স্বপ্ন সফল করার নিরন্তর প্রচেষ্টার নামই তো জীবন। জীবন জয়ের অব্যাহত চেষ্টার নামই সভ্যতার নির্মাণযজ্ঞ।