হামাসের ‘রকেট’

আহসান কবিরআহসান কবির
Published : 12 Feb 2012, 06:28 PM
Updated : 27 May 2021, 11:29 AM

একটা পাখির বাসা আছে।
একটা ঘোড়ার আস্তাবল আছে।
একটা খরগোশের গর্ত আছে।
আমরা ফিলিস্তিনি। আমাদের কোন আবাসভূমি নেই।

ফিলিস্তিনের নির্বাসিত কবি মাহমুদ দারবিশের জনপ্রিয়তম কবিতার কয়েকটা লাইন ছিল এমন, যদিও ফিলিস্তিনিরা সে বাস্তবতা থেকে সরে এসেছে, সামান্য হলেও তাদের এক চিলতে ভূমি আছে। এ ভূমি নিয়েই ফিলিস্তিনিদের প্রধান দুই সংগঠন পিএলও এবং হামাসের মধ্যকার 'রাজনৈতিক ও কথিত নৈতিক' দ্বন্দ্ব। এ প্রসঙ্গে পরে আসা যাবে। তবে এই সামান্য ভূমিটুকু যেমনভাবেই থাক,আগের মতোই ফিলিস্তিনিরা দোজখে আছে, নিয়মিত বিরতিতে তাদের ওপর 'দোজখ'ই নেমে আসে। ১৯৪৭ সালের পর থেকে তাদের সাথে 'বাস্তবিক'ভাবে কেউ নেই, তাদের জন্য স্বান্তনার সুর অবশ্য তোলে তাদের মতোই দুর্বল কেউ!

দুর্বল 'সৎ' ছেলে মেয়েদের পাশে কেউ থাকে না। ফিলিস্তিনিরাও তাই। তারা এখনও প্রকৃতির 'সৎ সন্তান'। পৃথিবীর কোন গার্জিয়ান তাদের যেন ভালোবাসে না! ধরুন একজন ইসরায়েলি একটি কুকুরের লেজ বাঁকা করার চেষ্টা করছে। লোকজন এসে হাজির হলে হয়তো সেই ইসরায়েলি নাগরিক বলবেন- আমি আসলে কুকুরের লেজ কেন সোজা হয় না সেই ব্যাপার নিয়ে গবেষণা করছিলাম! লোকজন সেটা বিশ্বাস করবে, মিডিয়া তেমনই লিখবে। আর একজন ফিলিস্তিনি একই কাজ করলে মিডিয়া লিখবে- একটা কুকুরও রক্ষা পাচ্ছে না অসভ্য ফিলিস্তিনিদের হাত থেকে!

'সৎ ফিলিস্তিনিদের' আরেক প্রতিশব্দ দুর্বল বা পরাজিত থাকা। পরাজিতরা জন্মে শুধু বারবার মরার জন্য! ফিলিস্তিনিরাও তাই। তারা পরাজিত হয়েও মরে, বুলেট খেয়েও মরে! মরা ছাড়া তাদের আর কোন পথ খোলা নেই। এমন কী তারাও সম্মিলিতভাবে তাদের পক্ষে নেই, তারা বিভাজিত। ইসরায়েলিদের বড় শক্তি ফিলিস্তিনিদের এই বিভাজন। যদিও শোষিত বা ফিলিস্তিনিদের পক্ষে থাকাই নিরপেক্ষতা, যে কোন বিচারে 'মানব ধর্ম'। পৃথিবীতে সব ধর্ম চলমান এবং শক্তিশালী আছে, শুধু মানবধর্মটা প্রয়োজনের সময় ফিলিস্তিনের পক্ষে কখনো নেমে আসে না।

ইসরায়েলিদের আক্রমণে কার্যত বন্দি, নিঃস্ব, বেশিরভাগ আক্রমনে আহত ফিলিস্তিনিদের মৃত্যু সম্ভবত মানুষের গা সওয়া হয়ে গেছে। সারা পৃথিবীতে অনেক মৃত্যু মানুষকে বেদনাহত করে, ফিলিস্তিনিদের মৃত্যু- আমেরিকা, রাশিয়া, জার্মানি, ইংল্যান্ড কিংবা ইউরোপের জন্য বেদনার সুর হয়তো বয়ে আনে না মূলত প্রভাবশালী মিডিয়ার কল্যাণে। হোক সেটা বিবিসি, সিএনএন, ফক্স নিউজ কিংবা অন্য কিছু।

২০২১ সালের মে মাসে (সাতাশে রমজানের পবিত্র প্রার্থনার রাতে) ইসরায়েলের হামলাটা হয়ে যায় ফিলিস্তিনিদের জন্য 'রামাদান ভায়োলেন্স'! পাশ্চাত্য মিডিয়ার কাছে ফিলিস্তিন এমনই। আগে ইয়াসির আরাফাতের সংগঠন পিএলও (প্যালেস্টাইনিয়ান লিবারেশন অর্গানাইজেশন) ছিল পশ্চিমা মিডিয়ার চোখে সন্ত্রাসী সংগঠন আর এখন হামাস হচ্ছে তাই। রাজা যায় রাজা আসে, ফিলিস্তিনিদের তাতে কিছু যায় আসে না। তারা আগে যেমন সাবরা বা সাতিলার মতো আশ্রয়কেন্দ্র নামের নরকে থাকতো , এখনও তারা ফিলিস্তিন নামের নরকে থাকতে বাধ্য হয়। ইসরায়েলি হামলায় ২০১৮ সালে ২৫৯ জন, ২০১৯ এ ৩৫২ আর ২০২১ এর মে মাসের হামলায় প্রায় ২৩০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হন। এ ২৩০ জনের মৃত্যু কোন ব্যাপার না, ফিলিস্তিনিদের রকেট হামলাই সন্ত্রাস! আল আকসা মসজিদে প্রার্থনারত অবস্থায় ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলিদের হামলা কোনও ব্যাপার না, বার জন ইজরায়েলির মৃত্যুই হলো সকল শোকের কেন্দ্রবিন্দু! হামাসের রকেট হামলা হচ্ছে আনবিক বোমার চেয়েও ভয়ংকর! ইরাকে যেমন পারমানবিক বোমা বা অন্য কিছু পাওয়া না গেলেও যুক্তরাষ্ট্রের ইরাক লণ্ডভণ্ড করাটা মানবতার উজ্জ্বল নিদর্শন!

রোজার মাসে যে ২৩০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হলেন তাদের জন্য আমাদের দূরগত শোক কতোটা সহমর্মিতার সে প্রশ্ন না তুলেই বলা যায় ফিলিস্তিনিরা আবারো এমন হত্যাকাণ্ডের শিকার হবেন। এ নিয়তি কতদিন তাদের বয়ে বেড়াতে হবে কেউ জানে না। ছোট ছোট ফিলিস্তিনি শিশুরাও জানে নির্বিচার বোমা হামলা হবে কিংবা চলবে গুলি। পুড়ে যাওয়া কিংবা ধ্বংস হয়ে যাওয়া বাড়ির দেয়াল ভেঙ্গে বের হতে হবে যদি তারা বেঁচে থাকে। হাসপাতালে চিকিৎসা নেই পর্যাপ্ত, রক্ত নেই, চিকিৎসা সরঞ্জাম নেই তবু কোন রকম ডেটল বা স্যাভলন দিয়ে ব্যান্ডেজ করা গেলেই বেঁচে থাকার যুদ্ধ চলবে। বাসায় একবেলা খাওয়া নেই। যারা ফিলিস্তিনে থাকতে বাধ্য হয়, তাদের তেমন কর্মসংস্থানও নেই। তাদের একমাত্র কাজ যেন ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সার্বক্ষণিক শত্রুতা কিংবা তাদের হামলা প্রতিহত করা! রাতটা তাদের কাছে আনন্দের। পৃথিবীর যে কোন দেশের চেয়ে ফিলিস্তিনিদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বেশি কিনা এ নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। যেকোনও ফিলিস্তিনির কাছে জানতে চাইলে সবাই প্রায় একই উত্তর দেবে। যারা নিত্য অভাব অনটন নিয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়াচ্ছে কিংবা ইসরায়েলিদের বিরুদ্ধে পাথর ছুঁড়ে মারছে তাদের কয়জন শেষমেষ বেঁচে থাকে সেটাই দেখার ব্যাপার। শত্রুর বুলেট বা বোমায় মরে যাবার জন্য হয়তো তাদের আরও বেশি জনসংখ্যা দরকার। বুলেট বোমায় নিশ্চিহ্ন করতে না পারাটাও হয়তো একরকম সফলতা।

দুর্বলের সান্ত্বনা মতো আরও একটা সফলতা জুটেছে হামাসের থলেতে। সেটা 'রকেট' সফলতা। বলা হচ্ছে, হামাস ফিলিস্তিনিদের 'পাথর যুগ' থেকে 'রকেট যুগে' নিয়ে এসেছে। হামাসের উত্থান আর সারা পৃথিবীর কাছে ফিলিস্তিনিদের ন্যায্য সংগ্রামকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া ইয়াসির আরাফাতের সংগঠন পিএলওর ক্রমশ ব্যাকফুটে চলে যাওয়াটাও লক্ষণীয়। এ দুই সংগঠনের সাথে আছে বিশ্ব রাজনীতি, মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটা মাথা মোটা দেশ আর অগ্রসরমান চিন্তার 'ইরান'।

ইরানের প্রসঙ্গ আসার আগে মধ্যপ্রাচ্যের কথা বলে নেওয়া ভালো। সিরিয়া ছাড়া ইরানের কোন বন্ধু ছিল না মধ্যপ্রাচ্যে। হামাস ইরানের 'নতুন শিকার'। সৌদি আরব সহ অন্য রাষ্ট্রগুলো বিবৃতি, প্রতিবাদ আর নিন্দাজ্ঞাপনের জন্য ফিলিস্তিনিদের সাথে আছে, কখনোসখনো সাহায্যও দেয়। আবার ইসরায়েলের সাথেও সম্পর্ক রাখে। হামাসের প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ খোদ ইসরায়েলের সাথেই সম্পর্ক রেখে চলে হামাস। অসলো (নরওয়ের রাজধানীতে এ চুক্তি হয়েছিল) চুক্তির মাধ্যমে সেই কবে ইয়াসির আরাফাত ফিলিস্তিনিদের জন্য একখণ্ড ভূমি পেয়েছিলেন, কিন্তু চুক্তির পরে তার নাম বা সংগঠনের সাথে যেন আপস' শব্দটা মিশে গেল। আর ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক রেখে জন্ম নেওয়া দল হামাস হয়ে গেল বিপ্লবী! হামাস এখনও ইসরায়েলিদের হটিয়ে সেখানে ইসলামী রিপাবলিক অব ফিলিস্তিন বানাতে চায়।

একদা বিমান ছিনতাই করে লায়লা খালেদ হতেন 'বিপ্লবী'দের কাছে হিরো। ইয়াসির আরাফাতের অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম ছিল সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে আলোচনার বিষয়বস্তু। এখন তাদের সংগঠন হয়ে পড়েছে তুলনামূলক অজনপ্রিয়। পিএলও এখনও একভূমি বা একদেশে 'দুইজাতি বা ধর্মে'র সহাবস্থান মেনে নিয়ে কথা বলে। সেই তুলনায় হামাসের কথাবার্তা যুদ্ধংদেহী। তারা ইসরায়েলকে নিশ্চিহ্ন করতে চায়।

কমবয়সী ছেলেমেয়েরা হামাসের উম্মাদনায় একধরনের বিপ্লবী উম্মাদনা খুঁজে পায়। ইরানের মাধ্যমে সিরিয়া বা গোলান মালভূমি হয়ে তারা রকেটের 'মাল মশলা' পায়। কেউ কেউ বলে মিশরের সামরিক শাসকদের কেউ কেউ হামাস-কে সাহায্য করে। হামাস হয়তো এসব মালমসলা ফিলিস্তিনের 'লেদ মেশিন ফ্যাক্টরি'তে ঢেলে রকেট বানায়। পাথরের পরিবর্তে এই কুটির শিল্প নামের রকেট তাদের আরও জনপ্রিয় করেছে, সাত দশক ধরে শোষিত ও নিষ্পেষিত হওয়া ফিলিস্তিনিরা হয়তো এ রকেট দিয়েই ইসরায়েলকে নিশ্চিহ্ন করার স্বপ্ন দেখে। আর ইরানের লাভ এই যে তারা মধ্যপ্রাচ্যে সিরিয়ার বাইরে লেবাননের মতো আরেকটি 'সাময়িক' মিত্র পেল।

যে স্বপ্ন বাস্তবে নামে না, সে স্বপ্ন আসলে মানুষকে একদিন ক্লান্ত করে। খুব বেশি জীবন বিমুখ করে। ফিলিস্তিনিদের 'হামাস' ভালোবাসার পরিণতি হয়তো তাই। প্রযুক্তি এবং উন্নত দেশগুলোর সবধরনের সহযোগিতা নির্ভর দেশ ইসরায়েল। প্রযুক্তি, অস্ত্র এবং বিশ্বরাজনীতিতে অপাঙক্তেয় হয়ে পড়ার ভয়ে অনেকেই ইসরায়েলকে ঘাঁটাতে সাহস করে না। ইসরায়েল চাইলেই ১৬টা এফ-১৬ বিমান দিয়ে ইরাকের "ওসিরাক' পারমানবিক চুল্লি ধ্বংস করে দিতে পারে। কিচ্ছু যায় আসে না। চাইলেই তারা হামাস ও পিএলওর মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধিয়ে দিতে পারে। বিভাজনটা বৃদ্ধি করে রাখার পরেও কোন সুবিধা না পেলে তারা ফিলিস্তিনে হামলা চালাতে পারে। ফিলিস্তিনকে যত বেশি ধ্বংসস্তুপে পরিণত করা যায়,যারা ইসরায়েলের ক্ষমতায় থাকে,তাদের জনপ্রিয়তা তত বাড়ে কিংবা তারা আরও কিছুদিন টিকে থাকার ফুসরৎ পায়! এক পা এগুলে ফিলিস্তিন, তাদের তিন পা পেছনে ফেলে দেয়া হয়। তাই জনসংখ্যাবৃদ্ধি ছাড়া ফিলিস্তিনিদের আর কোন বিনোদন নেই। কোনদিন প্রযুক্তি ও অস্ত্র নির্ভর হয়ে অথবা কূটনৈতিক কোন বিজয়ের পর ফিলিস্তিনিরা তাদের স্বপ্ন পূরণ করতে পারবে এমন আশা বুদ্ধিমানরা তাই করে না। ইসরায়েলিরা নিশ্চিহ্ন হবে হামাসের এই ধারণা আর তাদের কুটির শিল্পের তৈরি রকেট কতোদিন তাদের সমর্থন জোগাবে তা সময়ই বলে দেবে।

ফিলিস্তিনের ব্যাপারে কেউ কেউ হয়তো নিয়তি নির্ভর কিংবা প্রার্থনামুখী হয়ে থাকেন। ইসরায়েল নামের একচোখা দজ্জালকে ঘায়েল করতে কোন একদিন আকাশ থেকে নেমে আসবেন কোন ঐশী মানব- এই স্বপ্নও দেখেন কেউ কেউ!

অলীক কল্পনা হোক আর অসম্ভব স্বপ্নবিলাস হোক অসহায় কিংবা শোষিত মানুষের এরচেয়ে বড় কোন 'রকেট' নেই!