ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলের হামলা কি ‘গণহত্যা’?

জি এম আরিফুজ্জামান
Published : 20 May 2021, 04:09 PM
Updated : 20 May 2021, 04:09 PM

বর্তমান সময়ে সারা বিশ্ব ফিলিস্তিনের জনগণের উপর ইসরায়েলের বর্বরোচিত আক্রমণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠছে। এটা মানবতার চরম লঙ্ঘন। অনেক বিশেষজ্ঞরা এটাকে যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ, এমনকি দুইটি রাষ্ট্রের বিবাদমান বিষয় হিসেবে অবহিত করেছেন। 

সার্বিক পরিস্থিতি এবং ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ থেকে বলা যায়, এটা স্পষ্টত 'জেনোসাইড' বা 'গণহত্যা'। কোনও একটি ঘটনাকে 'গণহত্যা' হিসেবে চিহ্নিত করতে গেলে তার নির্ধারক রয়েছে আন্তর্জাতিক আইনে।  

চল্লিশের দশকে সারা ইউরোপব্যাপী চলমান সহিংসতা, বিশেষ করে জার্মানির একনায়ক হিটলারের ইহুদি নিধনের মত চরম অন্যায় কাজ বিশ্ব বিবেককে নাড়া দিয়েছিল। তবে, গণহত্যার  বিষয়ে কোন আইন না থাকা , এমনকি গণহত্যার সমার্থক 'জেনোসাইড' শব্দটিকে আইনের রূপ দান না করায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে সংগঠিত অনেক জেনোসাইডের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে বিচারের আওতায় আনা সম্ভব হইনি। ১৯৪৪ সালে রাফায়েল লেমকিন নামে একজন পোলিশ আইনজ্ঞ তার 'এক্সিস রুল ইন ওকুপায়েড ইউরোপ' বইয়ের মাধ্যমে প্রথম জেনোসাইড শব্দটির ব্যবহার করেন। 

১৯৪৪ সালের আগে 'হত্যা, নৃশংসতা ও বর্বরতাকে প্রকাশের জন্য Massacre, Extermination; Crimes against Humanity- শব্দগুলো ব্যবহারের রীতি প্রচলিত ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যে বা যারা যুদ্ধের সময় মানুষ হত্যা, নারী নির্যাতন, অন্যায়ভাবে  ভূখণ্ড দখলের মত অন্যায়ের কাজের সাথে জড়িত ছিল, তাদেরকে বিচারের আওতায় আনার জন্য গঠিত হয় 'নুরেমবার্গ ট্রায়ালস' এবং 'টোকিও ট্রাইব্যুনাল'। 

১৯৪৬ সালের ৯ ডিসেম্বর  থেকে মোট ১৩টি সামরিক ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে 'নুরেমবার্গ ট্রায়ালস' এর  বিচারিক কার্যক্রম পরিচালিত হয়। ১৯৪৬ সালের ২৯ এপ্রিল 'টোকিও  ট্রাইব্যুনাল' কার্যক্রম শুরু হয়। এ আদালতগুলোর মাধ্যমে বিভিন্ন সামরিক ও রাজনৈতিক নেতার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধী, বেসামরিক অন্তর্নিহিত এবং অধিকৃত অঞ্চলগুলির বাসিন্দাদের বিরুদ্ধে আক্রমনাত্মক যুদ্ধ, হত্যা ও প্রচলিত যুদ্ধাপরাধ পরিচালনাসহ বিভিন্ন অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। এ '  ট্রাইব্যুনালের  বিচারগুলি একটি স্থায়ী আন্তর্জাতিক আদালত প্রতিষ্ঠার দিকে একটি মাইলফলক হিসাবে গণ্য করা হয়।

এরই প্রেক্ষিতে, জাতিসংঘের সাধারণ সভার অধিবেশনে ১৯৪৬ সালের ১১ ডিসেম্বর  ' জেনোসাইড শব্দটি আন্তর্জাতিক আইনে অন্তর্ভুক্তকরনের ব্যাপারে করণীয় বিষয়ক একটা রেজুলেশন  [resolution 96 (I)] গৃহীত হয় ।  ১৯৪৮ সালের ০৯ ডিসেম্বর  জাতিসংঘের সাধারণ সভায় Convention on the Prevention and Punishment of the Crime of Genocide (CPPCG) [resolution 260 A (III)] গৃহীত হয় এবং আইনগতভাবে প্রথমবারের মত 'জেনোসাইড' শব্দটিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।  ১৯৫১ সালে ১২ জানুয়ারি থেকে CPPCG  কার্যকরণ শুরু হয়। CPPCG এর ০২ নং অনুচ্ছেদ অনুসারে, 

In the present Convention, genocide means any of the following acts committed with intent to destroy, in whole or in part, a national, ethnical, racial or religious group, as such:(a) Killing members of the group;(b) Causing serious bodily or mental harm to members of the group;(c) Deliberately inflicting on the group conditions of life calculated to bring about its physical destruction in whole or in part;(d) Imposing measures intended to prevent births within the group;(e) Forcibly transferring children of the group to another group. 

এবং ০৩ নং অনুচ্ছেদে যে অপরাধ গুলো আন্তর্জাতিক আইনে বিচারের আওতায় আনা যাবে, সেগুলো হল- 

The following acts shall be punishable: (a) Genocide; (b) Conspiracy to commit genocide; (c) Direct and public  incitement to commit genocide;(d) Attempt to commit genocide; (e) Complicity in genocide.  

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরের সময়ে বিভিন্ন জেনোসাইডের বিচারে যেমন- যুগোস্লাভিয়া ট্রায়াল, রুয়ান্ডা ট্রাইব্যুনালসহ 'জেনোসাইড' অভিযোগে বিচারিক আদালতে CPPCG বিষয়কে বিবেচনা করা হয়েছে। সম্প্রতি ২০১৯ সালে আন্তর্জাতিক আদালতে গাম্বিয়ার আনীত মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উপর চালিত 'জেনোসাইড' অভিযোগের বিষয়ে  CPPCG এর ধারাগুলোকে  আমলে নেওয়া হচ্ছে। 

এখন আসা যাক, ফিলিস্তিনি জনগণের উপর ইসরায়েলের বর্বরোচিত নির্যাতন এবং আক্রমণ  কেন 'জেনোসাইড' বা 'গণহত্যা' সে প্রসঙ্গে। 

১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র ফিলিস্তিনের একটি অংশের অবৈধভাবে দখল করে নিজেদেরকে একটি  গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে প্রকাশ করে। এ দখলের জন্য ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী হাজার হাজার ফিলিস্তিনি জনগণকে তাদের নিজ বাসভূমি থেকে বিতাড়িত করে।

১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্রের গোড়াপত্তনকে ফিলিস্তিনিরা তাদের জন্য একটি 'বিপর্যয়' মনে করে। যে জায়গাটিতে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেখান থেকে প্রায় সাড়ে সাত লাখ ফিলিস্তিনি পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে ( বিবিসি বাংলা, ৬ জুন ২০১৭)। 

১৯৪৮ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের ফলে (যুদ্ধের স্থায়িত্ব ছিল মাত্র ছয়দিন) অনেক ফিলিস্তিনি জনগণ হত্যার এবং বাস্তচ্যুতির শিকার হয়। ১৯৬৭ সালের পুনরায় ইসরায়েল অন্যায়ভাবে যুদ্ধে জড়িয়ে পশ্চিম তীর, গাজা উপত্যকা, মিসরের সিনাই, সিরিয়ার গোলানভূমি ও জর্ডানের ভূমিসহ অনেক এলাকা দখল করে নেয়। ফিলিস্তিনি জনগণ হত্যা, বর্বরোচিত নির্যাতন, নারী ও শিশু হত্যা, জোরপূর্বক ভূমি দখলের মত নিষ্ঠুর এবং বর্বরোচিত ঘটনার  শিকার হয়। গত চার দশক ধরে ইসরায়েলি বাহিনী ফিলিস্তিনি জনগণের উপর নিষ্ঠুর আক্রমণ চালাচ্ছে। অবাক করা বিষয়, ফিলিস্তিনের মানচিত্র থেকে ক্রমান্বয়ে ফিলিস্তিনের অস্তিত্ব হারিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েলের অবৈধ দখলদারিত্বের কারণে।  

অবৈধ  দখলদারিত্বের এবং নিষ্ঠুর কর্মকাণ্ডের  বিরুদ্ধে যখনই হামাস এবং ফিলিস্তিনি জনগণ সোচ্চার হয়েছে তখনই ফিলিস্তিনের উপর নেমে এসেছে ইসরায়েলের নিষ্ঠুরতা। সর্বশেষ, ২০২১ সালের ১৭ মে থেকে চলমান আক্রমণে আনুমানিক ২১৯ ফিলিস্তিনি নাগরিক হত্যার শিকার হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে ৬৩ জনই শিশু। ক্রমাগত গোলা বর্ষণ, আকশপথে রকেট নিক্ষেপের ফলে বর্তমানে ফিলিস্তিন হয়ে উঠেছে মৃত্যুপুরী। অনেক বসতবাড়ি ও ধর্মীয় স্থাপনা ধ্বংস হয়েছে, অনেক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্থাপনা হামলার শিকার হয়েছে, প্রায় ৫০ হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। অনেক মানুষ প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রসমুহে আশ্রয়ের চেষ্টা চালাচ্ছে। এভাবে চললে ফিলিস্তিনের জনগণ সম্পূর্ণ বাস্তুচ্যুত হয়ে যাবে। ফিলিস্তিন ভূখণ্ড হারিয়ে যাবে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে। 

CPPCG এর ২ নং অনুচ্ছেদের প্রত্যেকটি বিষয়কে ফিলিস্তিনের প্রেক্ষাপটে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, ফিলিস্তিনি জনগণের উপর ইসরাইলের বর্বরোচিত নির্যাতন এবং আক্রমণ স্পষ্টত   'জেনোসাইড'। গত চার দশক ধরে ইসরায়েলি বাহিনী অনেক ফিলিস্তিনিকে নির্বিচারে হত্যা করেছে। যারা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন, তাদের অবস্থা এতটাই শোচনীয় যে, তাদের পক্ষে বেঁচে থাকাটাই কঠিন। ফিলিস্তিনের নারী ও শিশুদেরকে লক্ষ্যবস্তু করে হত্যার কারণ, পরবর্তীতে যেন ফিলিস্তিনের জনগণের সংখ্যা বাড়তে না পারে। ক্রমাগত নির্যাতনের ফলে জনগণ বাধ্য হচ্ছে প্রাণের তাগিদে ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যেতে। ইসরায়েলের বাহিনী ফিলিস্তিনি জাতিসত্ত্বাকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রে মত্ত।  এই বর্বরোচিত নির্যাতন এবং আক্রমণের শেষ কোথায় সেটা বলা মুশকিল।  

ফিলিস্তিনি জনগণকে ইসরায়েলের বর্বরোচিত 'গণহত্যা' থেকে রক্ষার জন্য  আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরী। অবিলম্বে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি প্রদান এবং নেতানিয়াহু সরকারের এই ধরনের অমানবিক এবং নিষ্ঠুর কর্মকাণ্ডের জন্য আন্তর্জাতিক আইনে বিচারের সম্মুখীন করাই পারে ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতি  চলমান জেনোসাইডকে বন্ধ করতে। পাশাপাশি, বিশ্বমানবতা প্রতিষ্ঠার জন্য  বিশ্বের সকল রাষ্ট্র ও জনগণকে ইসরাইলের বর্বরোচিত নির্যাতন এবং জেনোসাইড বন্ধের প্রতিবাদে ঐক্যবদ্ধ হয়ে মোকাবেলা করা সময়ের দাবী।