‘একুশে উনিশে রফিক কমলা জ্বলে রাজপথে ময়দানে’

সঙ্গীতা ইমামসঙ্গীতা ইমাম
Published : 18 May 2021, 06:50 PM
Updated : 18 May 2021, 06:50 PM

উনিশে মে বাঙালির আত্ম-পরিচয়ের আরেক সংগ্রামী ইতিহাস রচনার দিন। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি যেমন বর্তমান বাংলাদেশ অঞ্চলের জনগোষ্ঠী মাতৃভাষার অধিকার রক্ষায় জীবন দিয়েছিলেন, তেমনি ১৯৬১ সালের উনিশে মে বরাক উপত্যকায় মাতৃভাষার জন্য জীবন দিয়েছিলেন সংগ্রামী জনতা। শাসকগোষ্ঠী ভাষার ঔপনিবেশিকতা চাপিয়ে দেবার যে ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের নীল-নকশা করেছিল ১৯৫২ সালে, তারই ধারাবাহিকতা আমরা দেখতে পাই ইতিহাসের আরেক অধ্যায়ে, ১৯৬১ সালে বরাক উপত্যকায়। কিন্তু ভাষার জন্য জীবন দিয়ে মানুষ এ ষড়যন্ত্র প্রতিহত করেছিল। তাই বায়ান্নের মতোই একষট্টিও মাতৃভাষা সংগ্রামের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল অধ্যায়।

আসামে ক্ষমতাসীন কংগ্রেস দল বিধানসভার ১৯৬০ সালের শরৎকালীন অধিবেশনে সংখ্যাগরিষ্ঠতার বলে অসমিয়াকে রাজ্যের একমাত্র সরকারি ভাষারূপে প্রবর্তনের চেষ্টা চালায়। ১০ অক্টোবর এ অধিবেশনে সরকারিভাবে উপস্থাপিত হয় 'আসাম রাজ্যভাষা বিল'। যদিও কংগ্রেস দলীয় বিধানমণ্ডলীর সভায় কাছাড় থেকে নির্বাচিত বিধায়কগণ অসমিয়ার সঙ্গে বাংলাকে দ্বিতীয় রাজ্যভাষা রূপে স্বীকৃতিদানের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠতার বলে সে প্রস্তাব নাকচ হয়ে গিয়েছিল। আব্দুল মাতলিব মজুমদার ব্যতীত কাছাড় থেকে নির্বাচিত সকল বিধায়কই প্রস্তাবিত ভাষা বিলের উপর বিধানসভার বিতর্কে অংশ নেন ও ভোটদানের অনুমতি দাবি করে দলীয় নেতৃত্বের কাছে লিখিত আবেদন করেছিলেন। কিন্তু তৎকালীন দলনেতা বিমলা প্রসাদ চালিহা তাঁদের আবেদন শুধু অগ্রাহ্যই করেননি, দলীয় শৃংখলা মেনে বিলটি সমর্থন করতে তারা যে বাধ্য, সে কথাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন। কাছাড় ও আসামের পার্বত্য অঞ্চল থেকে নির্বাচিত বিধায়কদের আপত্তি, এমনকি নিখিল ভারতের কংগ্রেস কমিটির উপদেশ উপেক্ষা করে ১৯৬০ সালের ২৪ অক্টোবর বিলটি চূড়ান্তভাবে গ্রহণের জন্য বিধানসভায় আনা হয়। রণেদ্রমোহন দাস ও তজমুল আলী বড়লস্করের নেতৃত্বে কাছাড়ের কংগ্রেসী বিধায়কগণ, পার্বত্য অঞ্চলের অধিকাংশ বিধায়ক এবং কাছাড়ের অকংগ্রেসী বিধায়ক বিশ্বনাথ উপাধ্যায় (প্রজা সোসিয়েলিস্ট পার্টি) ও গোপেশ নমঃশূদ্রও প্রতিবাদে বিধানসভা ত্যাগ করেন। বিলটি নিয়ে আলোচনার সময় প্রতিবাদে সভাকক্ষ ত্যাগ করেন কাছাড় থেকে নির্বাচিত বিধায়ক আসামের কৃষিমন্ত্রী মঈনুল হক চৌধুরী।

অবশেষে রাত বারোটায় কাছাড় থেকে নির্বাচিত সদস্যদের মধ্যে কেবল বিমলা প্রসাদ চালিহা ও আব্দুল মাতলিব মজুমদারের উপস্থিতিতে ৫৬-০ ভোটে বিলটি গৃহীত হয়, যেখানে ঘোষণা দেয়া হয়, অসমিয়া ভাষাই হবে আসামের প্রাদেশিক ভাষা। অসমিয়া ভাষাতেই চলবে সরকারি দপ্তর এবং শিক্ষা ব্যবস্থা। এ ঘোষণার প্রতিবাদে বর্তমান বরাক উপত্যকার বাংলা ভাষাভাষীসহ অন্যান্য সকল ভাষিক জনগোষ্ঠীর মানুষ প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠেন। প্রথম প্রতিবাদটি ছিল হাফলঙের ডিমাসা, মিকিরসহ আরো অনেক পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর। আসামের খাসি জয়ন্তিয়া, মিকির দিমাসাসহ প্রত্যেক ভাষাগোষ্ঠীর মানুষ সরকারের এ ভেদনীতির ভাষা অধ্যাদেশকে প্রত্যাখ্যান করে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছিলেন।

কাছাড় গণসংগ্রাম পরিষদের এক সভায় ১৩৬৮ বঙ্গাব্দের পহেলা বৈশাখ অর্থাৎ নববর্ষের দিবসকে (১৫ এপ্রিল ১৯৬১) 'সংকল্প দিবস' হিসেবে উদযাপনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ১৯ এপ্রিল থেকে শুরু হয় করিমগঞ্জের পদযাত্রীদের গ্রাম পরিক্রমা। করিমগঞ্জ, পাথারকান্দি, রাতাবাড়ি ও বদরপুর থানার বিভিন্ন অঞ্চল পরিক্রমা করে ২ মে করিমগঞ্জে ফিরে আসেন সংগ্রামী জনতা। ২১ এপ্রিল শিলচর মহকুমা সংগ্রাম পরিষদের আহবানে শহরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ধর্মঘট পালন করা হয়। ২ মে করিমগঞ্জে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় সংগ্রাম পরিষদের কর্মসূচি ঘোষণা করেন রথীন্দ্রনাথ সেন। এ কর্মসূচী ছিল ১৯ মে সর্বাত্মক ধর্মঘট ও পূর্ণ হরতাল

উনিশে মে-র পূর্বরাত থেকেই সংগ্রাম পরিষদ নেতাদের গ্রেপ্তার শুরু করে প্রশাসন। গ্রেপ্তারের সংবাদ পেয়ে সংগ্রামী জনতা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েন ভোরের সূর্য ওঠার আগেই। করিমগঞ্জ ও শিলচর রেলস্টেশনে সত্যাগ্রহীরা ট্রেন চলাচল বন্ধ করে দিলেন। ঘড়িতে তখন বেলা আড়াইটা। আসামবাহিনীর বন্দুক গর্জে ওঠে। পুলিশের গুলিতে শহীদ হন কমলা ভট্টাচার্য, শচীন্দ্র মোহন পাল, কানাইলাল নিয়োগী, সুনীল সরকার, সুকোমল পুরকায়স্থ, কুমুদ দাস, চণ্ডীচরণ সূত্রধর, তরণী দেবনাথ, হীতেশ বিশ্বাস, বীরেন্দ্র সূত্রধর এবং সত্যেন্দ্র দেব। ভাষার জন্য প্রাণ দেন এগারজন ভাষারক্ষার সত্যাগ্রহী। এদের মধ্যে ছিলেন কিশোরী কমলা ভট্টাচার্য প্রথম নারী ভাষা শহীদ। যাঁর আত্মদান নারী হিসেবে আমাদের গর্বিত করে।

এরপরও বরাক উপত্যকায় ১৯৭২ সালে ভাষার দাবিতে করিমগঞ্জে বাচ্চু চক্রবর্তী শহীদ হন। ১৯৮৬ সালে জগন ও যিশু নামে দুজন শহিদ হন ভাষার দাবিতে বিক্ষোভ কর্মসূচিতে। ১৯৯৬ সালে বরাক উপত্যকার পাথারকান্দি নামে ছোট্ট এক শহরে পথ অবরোধে পুলিশ গুলি চালিয়ে হত্যা করে ষোল বছরের কিশোরী সুদেষ্ণা সিনহাকে। তিনি বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী গোষ্ঠীর মাতৃভাষার দাবিতে আত্মদান করেন। মাতৃভাষা রক্ষার এ আন্দোলন আজও বহমান।

দুই

২০১৫ সালে আমার পরিচয় হয় এ শিলচরের গর্বিত সন্তান শিল্পী-সংগ্রামী শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদারের সঙ্গে। তার বাড়ি আসাম শুনে প্রথমে আমি খুব অবাক হয়েছিলাম। আসামে বাঙালিরাও আছেন! তখন তার কাছেই আমি দেশভাগ এবং বরাক উপত্যকার বাঙালিদের সম্পর্কে বিস্তারিত জানি। দেশভাগে এ অঞ্চলের কষ্টগুলোকে অনুভব করতে শিখি। তারই সূত্র ধরে পরিচয় হয় আসামের ভাষা শহীদ আন্দোলনের রাজীব করের সঙ্গে। রাজীব কর আমাকে ২০১৬ সালের উনিশে মে-র আয়োজনে আমন্ত্রণ জানান। শিলচরে সেই আমার প্রথম যাওয়া। শুভদার সঙ্গে শিলচর গিয়ে তারই দিদি তারা নন্দী মজুমদারের বাড়িতে থেকে আদরে আতিথেয়তায় বাড়ির মানুষদেরই একজন হয়ে উঠি। 

২০১৬ সালের উনিশ মে ভোর বেলায় ফুল হাতে গান্ধীবাগে যাই। সেখানে গিয়ে দেখি এ যেন একুশের প্রভাতফেরি। শত শত মানুষ ফুল হাতে মৌন মিছিলে চলেছেন। গান্ধীবাগের বহু আগে থেকে রাস্তা বন্ধ করে চলছে মিছিল। গান্ধীবাগের বিশাল চত্বরে ঢুকে দেখি নানা সাংস্কৃতিক সংগঠনের ছোটো ছোটো দল- কেউ গাইছেন, কেউ আবৃত্তি করছেন, কোথাও ছবি আঁকা হচ্ছে, কোথাওবা বড়ো ক্যানভাস আর কলম রাখা আছে, যে যার মনের অনুভূতি জানাচ্ছেন, শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন। ঠিক একুশের মত শোক ও বিজয়ের মিশ্র অনুভূতি। আরো এগিয়ে পৌঁছে গেলাম সেই জায়গায় যেখানে শ্রদ্ধায় রাখা আছে একাদশ শহিদের চিতাভস্ম। সে স্থাপনায় ঢোকার আগে আছে একাদশ শহীদের নাম। ভেতরে গিয়ে শোকের স্তব্ধতায় সকলে শ্রদ্ধাভরে পুষ্পার্ঘ্য নিবেদন করছেন। দাঁড়িয়ে দু মিনিট নিরবতা পালন করে সুশৃংখলভাবে বেরিয়ে আসছেন। গান্ধীবাগের সুন্দর প্রাঙ্গণটি ঘুরে দেখে গান কবিতা শুনে বেরিয়ে গেলাম শ্মশানঘাটে। এখানে বিশাল এক বটবৃক্ষের ছায়ায় একাদশ শহিদের স্মৃতি বাঁধানো রয়েছে। আলাদা আলাদা স্তম্ভে নাম-পরিচয় লেখা আছে শহীদদের। এখানেও মানুষের ঢল। বিভিন্ন ভাষাগোষ্ঠীর মানুষের সমাগম ও শ্রদ্ধা নিবেদন। সত্যিকার অর্থে একুশে ফেব্রুয়ারি আর উনিশে মে শুধু বাংলা ভাষার নয়, বরং সকল ভাষাভাষী মানুষের মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার আন্দোলন।

সেখান থেকে গেলাম সেই রেলস্টেশনে যেখানে পুলিশের গুলিতে একাদশ শহীদের আত্মদান। এ স্টেশনটির নাম ভাষা শহীদ স্টেশন করার দাবিতে আন্দোলন করছেন শিলচরের মানুষ। তাদেরই তিনদিনব্যাপী আয়োজনে একুশের বার্তা নিয়ে উনিশকে শ্রদ্ধা জানাই। ওখানে শিশু থেকে বৃদ্ধ সকলের স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি আমাকে একুশের ঢাকায় শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদনের অনুভব দেয়। সকল বয়সীর গান-নাচ-আবৃত্তি-অভিনয়ে অভিভূত হই। সন্ধ্যায় আয়োজকরা উধারবন্দ বলে আরেকটি জায়গায় ভাষা দিবসের আয়োজনে নিয়ে যান। সেখানেও সকলের প্রাণের স্পর্শে উনিশে মে উৎসবমুখর। উধারবন্দেও একটি বিশাল ভাষা শহীদ স্মারক স্তম্ভ দেখে ফিরে এলাম। রাত তখন এগারোটা, স্টেশনে তখনো বিশাল জনস্রোতের উপস্থিতিতে চলছে গান। অনুষ্ঠান চলল রাত সাড়ে বারোটা পর্যন্ত। তবুও যেন মানুষ বাড়ি যেতে চাইছেন না। 

পরের বছর রাজীব কর আমাকে অনুরোধ করেন উদীচীর পরিবেশনা নিয়ে উনিশে মে-র আয়োজনে অংশ নিতে। আমরা ২০১৭ সালের ১৮ মে ১০ জনের একটি দল নিয়ে সিলেটের সুতারকান্দি সীমান্ত দিয়ে ঢুকেই শিলচরের বন্ধুদের উষ্ণ অভ্যর্থনা পাই। বাসে করে শিলচর যাবার পথে করিমগঞ্জে জলখাবার খেয়ে শিলচরে পৌঁছাই। বিকেলে পরিবেশনা থাকায় বিশ্রাম নিয়ে স্টেশনে যাই। সন্ধ্যায় নিজেদের পরিবেশনা শেষে উনিশের স্মারক গ্রহণ করি। পরদিন সকালে সহযোদ্ধা বন্ধুদের নিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন যাই গান্ধীবাগ ও শ্মশানঘাটে। সন্ধ্যায় যাই উধারবন্দে অনুষ্ঠানে নিজেদের পরিবেশনা নিয়ে। 

এভাবেই একুশ আর উনিশের বন্ধনে ভাষা শহিদদের উত্তরাধিকার হিসেবে আমরা গর্বিত। কিন্তু এ গৌরবের দায়িত্বও আমাদের বহন করতে হবে। প্রতিটি জাতিগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠায়, তাদের ভাষার সৌকর্য রক্ষায় আমাদেরও সচেষ্ট হতে হবে। এই দায়িত্বই আমাদের হাতে তুলে দিয়ে গেছেন একুশ আর উনিশের ভাষা সংগ্রামীগণ।

জয় হোক একুশের। জয় হোক উনিশের। জয় হোক প্রতিটি জাতিগোষ্ঠীর নিজস্ব মাতৃভাষা আন্দোলনের।