চঞ্চল চৌধুরীর ফেইসবুক পোস্ট, ধর্মীয় ভেদবুদ্ধি ও বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 17 May 2021, 09:41 PM
Updated : 17 May 2021, 09:41 PM

বাংলাদেশের মানুষের মনোজগৎটা অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। মানুষের ঔদার্য, ধর্মীয় সম্প্রীতি বা ধর্মনিরপেক্ষ আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি ছাপিয়ে একমাত্র বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে তার ধর্মপরিচয়ের চর্চা। এ ধর্মপরিচয় তুলে ধরতে গিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে নিজ ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব। ভিন্ন ধর্মের অনুসারী হলে তাকে নিয়ে চলছে ঠাট্টা-মশকরা, ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ। মানুষের মনে জাগিয়ে তোলা হয়েছে এক অসহিষ্ণু শ্রেষ্ঠত্বের ধর্মীয় অনুভূতি। এখন ধর্ম নিয়ে একাডেমিক আলোচনাও করা যায় না। গত কয়েক বছরে ধর্মীয় অনুভূতির নাম দিয়ে গণপিটুনি থেকে আরম্ভ করে মানুষ খুন সবকিছুই হয়েছে। অর্থাৎ ধর্মপরিচয় ও ধর্মীয় অনুভূতির নামে একটা জঙ্গি সংস্কৃতি বিকশিত হয়েছে। যে সংস্কৃতিতে সহনশীলতা, ভিন্ন ধর্ম ও পরমতের প্রতি শ্রদ্ধা নেই। আছে কেবল উন্মত্ততা, অমানবিক জিঘাংসা আর নিজ ধর্মের প্রতি আরোপিত শ্রেষ্ঠত্বের বাহাদুরি। কয়েকটা ঘটনা উল্লেখ করা যাক।

এ বছরের ৯ মে মা দিবসে নিজের ফেইসবুক প্রোফাইলে মায়ের সঙ্গে তোলা একটি ছবি প্রকাশ করে জনপ্রিয় অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী লেখেন- 'মা'।

শেয়ার করা ছবিটিতে চঞ্চল চৌধুরীর মায়ের কপালে সিঁদুর দেখে কমেন্টসে বিরূপ মন্তব্য করেন অনেকে। চঞ্চল চৌধুরী সনাতন ধর্মের অনুসারী এ কথা জানতেন না বলে উল্লেখ করে তার ধর্ম বিশ্বাস নিয়েও তোলা হয় নানা প্রশ্ন। এসব মন্তব্যের জবাবে চঞ্চল চৌধুরী লেখেন, "ভ্রাতা ও ভগ্নিগণ, আমি হিন্দু নাকি মুসলিম, তাতে আপনাদের লাভ বা ক্ষতি কি? সকলেরই সবচেয়ে বড় পরিচয় 'মানুষ'। ধর্ম নিয়ে এসকল রুচিহীন প্রশ্ন ও বিব্রতকর আলোচনা সকল ক্ষেত্রে বন্ধ হোক। আসুন, সবাই মানুষ হই।"

এর আগে ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে শারদীয় দুর্গোৎসব উদযাপন সংক্রান্ত একটি ছবি পোস্ট করে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন দুই বাংলার জনপ্রিয় অভিনেত্রী জয়া আহসান। দুর্গাপূজায় নবমীর দিন জয়া ও তার মা রেহানা মাসউদ তাদের ইস্কাটনের বাড়ির পূজা মণ্ডপে যান। সেখানে পূজা উদযাপনের ছবি শেয়ার করে সকলকে নবমীর শুভেচ্ছা জানিয়ে ক্যাপশনে লিখেছিলেন, "আমাদের বাড়ির দুগ্গা পুজোতে আমি আর মা .."। ছবি ও ক্যাপশন আপলোডের পর অনেকেই ফেইসবুকে তার সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠেন। কেউ লেখেন, "আজ নিশ্চিত হলাম জয়া হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করেছেন।" কেউ লেখেন, "জয়া তোমাকে তো মুসলমান হিসেবে জানতাম।"

এসব সমালোচনার জবাবে জয়া আহসান ব্যাখ্যা দিয়ে লেখেন, বাড়ির পূজা মানে তিনি যেই বাসায় বা ফ্ল্যাটে থাকেন সেই বাসায় কিছু হিন্দু ধর্মাবলম্বীও থাকে সেখানকার আশে পাশে কিছু হিন্দু মিলে পূজাটা করছে। যেখানে ভিন্নধর্মীদেরও সহযোগিতা রয়েছে। পূজা মণ্ডপটা জয়া আহসানের বাসার নিচে হয়েছে তাই তিনি আমাদের বাড়ির পূজা লিখেছেন। এতে এতো ঘাবড়ানোর কিছু নাই। তিনি ধর্মান্তরিত হননি। পূজা মণ্ডপে উৎসব উপভোগ করতে গেছেন মাত্র।

এর আগে সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের 'রাজকাহিনী'- সিনেমায় অভিনয়ের জন্যও নানা কটূ সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছিলেন এই অভিনেত্রী। সেই ছবিতে যৌনকর্মীর চরিত্রে জয়া আহসান অভিনীত একটি দৃশ্য নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠেছিল। কট্টরপন্থি এবং মৌলবাদীরা গর্জে উঠেছিলেন সোশ্যাল মিডিয়ায়।

২০১৮ সালের মার্চ মাসের ঘটনা। জনপ্রিয় অভিনেতা মোশাররফ করিম বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের সচেতনামূলক একটি অনুষ্ঠানে 'পর্দা ও ধর্ষণ' প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছিলেন, "মেয়েদের যৌন হেনস্তের জন্য পোশাক দায়ী নয়। তাই যদি হবে তবে ৭ বছরের মেয়েশিশু কেন ধর্ষণের শিকার হয়? মেয়েদের পোশাক নয়, পুরুষের ভেতরে লুকিয়ে থাকা নোংরা ধর্ষণ ইচ্ছেই দায়ী ধর্ষণের জন্য।"

কিন্তু এ মন্তব্যের কারণে দেশজুড়ে প্রবলভাবে সমালোচিত হন তিনি। মোশাররফ করিমের এ বক্তব্য 'ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হেনেছে' বলে অভিযোগ করেন অনেকে। এর পর ধর্মবাদী পুরুষরা একাট্টা হয়ে তার বিরুদ্ধে নামে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সয়লাব হয়ে যায় মোশাররফ করিমের বিরুদ্ধে মত-মন্তব্যে ।

মোশাররফ করিম প্রথমে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। বলেছিলেন, যে কথাগুলো তিনি বলেছেন 'তা আগুনের মতো সত্য'। কিন্তু ব্যাপক সমালোচনা ও ক্ষোভের মুখে তিনি নতি স্বীকার করেন। এক পর্যায়ে মোশাররফ করিম বলেন, "আমি অত্যন্ত দুঃখিত। আমি যা বলতে চেয়েছি, তা হয়তো পরিষ্কার হয়নি। আমি পোশাকের শালীনতায় বিশ্বাসী এবং তার প্রয়োজন আছে। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা আমার অভিপ্রায় না। এ ভুল অনিচ্ছাকৃত। আমি দুঃখিত। দয়া করে সবাই ক্ষমা করবেন।"

সেদিন মোশাররফ করিমের পক্ষে খুব বেশি মানুষকে কথা বলতে শুনিনি।

এরপর ২০২০ সালের জুলাইয়ে ব্যাপক ক্ষোভের মুখে পড়েন টেন মিনিটস স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা আয়মান সাদিক। সমকামিতা ও ঋতুস্রাব এবং শারীরিক সম্পর্কে সম্মতির বিষয়ে করা দুটি ভিডিও নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়। টেন মিনিটস স্কুলের দুই ইন্সট্রাক্টরের বিরুদ্ধে সমকামিতা সমর্থন, ইসলাম বিদ্বেষের অভিযোগ আনা হয়। আর এ জন্য আয়মানকে দায়ী করা হয়। এমন দাবিও করা হয়, যেহেতু তার প্রতিষ্ঠানের দুইজন শিক্ষক সমকামিতাকে সমর্থন করেছে, তাই টেন মিনিটস স্কুল বন্ধ করে দেওয়া হোক। আয়মান সাদিককে মুরতাদ হিসেবে ঘোষণা করে হত্যা করা হোক।

ব্যাপক সমালোচনার মুখে আয়মান সাদিক ব্যক্তিগত ক্ষমা চেয়ে ওই কন্টেন্ট সরিয়ে ফেলেন। ঘোষণা করেন, "টেন মিনিট স্কুল ধর্মীয় কোন প্রতিষ্ঠান না, তার কোন ধর্ম নেই। আমার ধর্ম আছে আমি মুসলিম। আল্লাহর যে বিধিবিধান আছে যতটুকু সম্ভব সেগুলো মেনে চলতে আমি চেষ্টা করি। সবকিছু পারিনা, তবে চেষ্টা করছি।" তিনি ক্ষমা চেয়ে সবার কাছে হাত জোড় করে আকুতি জানান, "দয়া করে আমাকে বাঁচতে দিন!"  

২০২০ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশের জনপ্রিয় ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানও সোশ্যাল মিডিয়ায় ক্ষোভের শিকার হন। সাকিব কলকাতায় একটি কালী পূজার  উদ্বোধন করেছেন- এমন একটি খবর প্রকাশিত হলে বাংলাদেশে ধর্মীয় চেতনা লালনকারী মানুষের মনে ক্ষোভের আগুন জ্বলে ওঠে। একজন সেলিব্রেটি ক্রিকেটার কালী পূজার অনুষ্ঠানে গেলে কিংবা 'উদ্বোধন' করলে কী ক্ষতি হয়- তা নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। অবশ্য তেমন আলোচনার সুযোগ এদেশে কোনওকালেই ছিল না। যাহোক, এ ঘটনার পর রাতারাতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গরম হয়ে যায়। এক যুবক ভিডিও বার্তায় সাকিবকে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। হাজার হাজার মানুষ সেই যুবককে সমর্থনও করে। সেদিনও সাকিবের পক্ষে জোরালো কোনো সমর্থন দেখা যায়নি।

সমালোচনার মুখে সাকিব ঘোষণা দেন, "আমি নিজেকে একজন গর্বিত মুসলমান মনে করি। আমি সেটাই চেষ্টা করি পালন করার। ভুলত্রুটি হবেই, ভুলত্রুটি নিয়েই আমরা জীবনে চলাচল করি। আমার কোনো ভুল হয়ে থাকলে অবশ্যই আমি আপনাদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।" একইসঙ্গে সাকিব প্রতিশ্রুতি দেন তিনি আর কখনো এমন কাজ করবেন না।

উল্লিখিত ঘটনাগুলো দেখিয়ে দেয় আমাদের দেশের মানুষের মন-মানসিকতা কোথায় স্থির হয়ে রয়েছে। 'লাল সালু' উপন্যাসে মজিদের জন্মস্থানের বর্ণনা দিতে গিয়ে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ আজ থেকে ৭৩ বছর আগে বলেছিলেন,  "সত্যি শস্য নেই। যা আছে তা যৎসামান্য। শস্যের চেয়ে টুপি বেশি, ধর্মের আগাছা বেশি।" আজকের বাংলাদেশের দিকে তাকালেও একই চিত্র চোখে পড়ে। এখানকার মানুষের অন্তকরণ জুড়ে কেবল ধর্মীয় সংকীর্ণতা, বিভেদ, নিজ ধর্মকে বড় করে দেখা, অন্য ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ । এদেশে আধুনিক শিক্ষার চেয়ে ধর্ম-শিক্ষা পৃষ্ঠপোষকতা পায় বেশি। যুক্তি-বুদ্ধি বিজ্ঞানের চর্চার চেয়ে ধর্মবিশ্বাস আর পরকাল মানুষের কাছে অনেক বেশি চর্চার বিষয়।

ধর্মবিশ্বাস যে খারাপ, তা বলছি না। কিন্তু এ 'বিশ্বাসী'-দের অনেকেই ঘুষ-দুর্নীতি-লাম্পট্য সব কিছুতে ষোলো আনায় মশগুল থেকে কেবল বুলি হিসেবে ধর্ম আর ধর্মবিশ্বাসকে লালন করেন। আর তাদের প্রভাবে আমাদের মন, মনন জুড়ে মৌলবাদী আদর্শ বিকশিত হচ্ছে। শিক্ষিতরা প্রভাবিত করছেন নিরক্ষরদের। আমরা গুটিকয় মৌলবাদী যুদ্ধাপরাধীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছি, কিন্তু সেই রাজাকারি আদর্শের ধারক-বাহকরা ক্রমেই ফুলে-ফেঁপে উঠছেন। শাসকদলের মধ্যেও এই আদর্শের অনুসারীদের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে।

দেশে নাকি মোট জাতীয় আয়, প্রবৃদ্ধি ইত্যাদি বাড়ছে। কিন্তু মন-মানসিকতায় আমরা দিন দিন পিছিয়ে পড়ছি। অনেকে মাদ্রাসা শিক্ষার দোষ দেন। কিন্তু বুয়েট, মেডিকেল, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা, সচিবালয়ের কর্মকর্তারা যখন মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মনমানসিকতা লালন করেন, তখন আমরা দোষ দেব কাকে? এ ধারা চলতে থাকলে আওয়ামী লীগ-বিএনপি নয়, বামপন্থিরা তো নয়ই, আগামী দিনের বাংলাদেশ হবে মৌলবাদীদের বাংলাদেশ।