পেটের জ্বালা বড় জ্বালা

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 27 April 2021, 08:52 PM
Updated : 27 April 2021, 08:52 PM

ভূগোল ক্লাসে শিক্ষক বলছে, বলো দেখি সুমন, পৃথিবী কেন ঘোরে?

সুমন চট করে উত্তর দেয়, পেটের জ্বালায় স্যার! 

শিক্ষক অবাক হয়ে সুমনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, মানে?

সুমন ব্যাখ্যা দেয়, স্যার, আমার বাবা পেটের জ্বালায় দিনরাত ঘুরে বেড়ায়। পৃথিবীও নিশ্চয়ই আমার বাবার মতো পেটের জ্বালায় দিনরাত ঘোরে।

উল্লিখিত কৌতুকটির মধ্যে একটি অন্তর্নিহিত তাৎপর্য রয়েছে। আসলে ক্ষুধার্ত মানুষের কাছে ছুটে বেড়ানোর অর্থই হচ্ছে, পেটের জ্বালা বা খিদে নিবারণের চেষ্টা। পেটের খিদে নিয়ম, আইন, বিবেক, বিচার কোনো কিছুই মানে না। তাইতো প্রবাদ সৃষ্টি হয়েছে, খিদের জ্বালা বড় জ্বালা। এর থেকে বোধহয় আর কোনো অসহায়তা নেই।

করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ শুরুর পর প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে অন্যান্য মন্ত্রী, এমপি, পুলিশ, ডাক্তার, টকশোজীবী প্রত্যেকেই উপদেশ দিয়ে চলেছেন লকডাউন মানতে হবে, ঘরে থাকতে হবে। কিন্তু পেটের জ্বালা বড় জ্বালা, কোনো আইন নিয়ম, নিষেধ মানে না। তাই রাজধানীর গরিব ও মধ্যবিত্ত মানুষ সব রকম নিষেধাজ্ঞা ও নিয়মকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে নেমে পড়েছে রাস্তায়। তাদের একটাই কথা, ঘরে বসে থাকলে আমাদের পেট ভরবে? আমার খাবার আসবে কোথা থেকে? উপার্জনের উপায় কী? যাদের পেট ভরা আছে, তারা ঘরে বসে লকডাউন মানুক। গরিবের করোনা হয় না। 

'ঘরে থাকা'র দিনগুলোতে আসলে বেশিরভাগ মানুষই ঘরে নেই। অনেকের অবশ্য ঘরে থাকার উপায়ও নেই। কারখানাশ্রমিক, সবজিওয়ালা, তরকারিওয়ালা, মুদি দোকানদার, রিকশাওয়ালা, চিকিৎসাকর্মী, অনলাইন প্রতিষ্ঠানের কর্মী, ব্যাংকার, আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিবর্গ, সিকিউরিটি গার্ড, বাড়ির কাজের লোক, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, অতিদরিদ্র ভিক্ষুক, দিন মজুর, হকার, সংবাদকর্মী তাদের বাইরে যেতেই হচ্ছে। কেউ যাচ্ছে পেশাগত কারণে, কেউ বা সাহায্য-সহযোগিতা পাবার আশায়। হ্যাঁ কিছু লোক শখের বশেও যাচ্ছে, সেটা খুব বড় অংশ নয়। 

যে কোনও সামাজিক নীতির পেছনে ন্যায়ের একটা লক্ষ্য থাকে। করোনার প্রেক্ষিতে জনস্বাস্থ্যের ন্যায়ের মুল লক্ষ্য হল সংক্রমণ কমানো, প্রাণ বাঁচানো। সেই যুক্তিতে ঘরবন্দি ভালো উপায় ঠিকই, কিন্তু ঘরবন্দি হয়ে থাকতে তারাই পারে, যাদের স্থির রোজগার আছে, সঞ্চয় আছে, ঘরে যথেষ্ট খাবার আছে। আমাদের দেশে প্রায় ৩-৪ কোটি মানুষের তা নেই। ঘরবন্দির তিনটে কুফল আছে— এক, দেশের উৎপাদন কমে যাওয়া, সাধারণ মানুষের আয় ও চাকরির ক্ষতি। দুই, গরিবের অনাহার ও অর্থকষ্ট। গরিবের বড় অংশ দিন আনে দিন খায়, ঘরে বন্দি হলে তাদের খাবার জুটবে না। তিন, আমাদের দেশে গরিবের সংখ্যা এখনও বড্ড বেশি, বিশ্বব্যাংকের হিসেবে প্রায় ৫২ দশমিক শতাংশ। অপুষ্টির ফলে তাদের শরীরে প্রতিরোধ-ক্ষমতা কম। রোজগার না থাকলে অপুষ্টি বাড়বে। সেটা জনস্বাস্থ্যের ন্যায়কেও আঘাত করবে। জনস্বাস্থ্যের ন্যায়ের সঙ্গে অর্থনীতির ও জীবিকার ন্যায়ের সংঘাত এখানেই। এই সংঘাত অবশ্যম্ভাবী এবং পৃথিবীর সব দেশেই তা ঘটছে। বাংলাদেশে অপুষ্টি বিপুল, তাই সংকট এখানে তীব্র। 

করোনার সংক্রমণ প্রতিরোধে আমাদের দেশসহ বিশ্বব্যাপী লকডাউনের ফলে চাহিদা ও জোগান দুদিক থেকেই অর্থব্যবস্থায় সংকট এসেছে। ছোট ছোট উদ্যোক্তরা অনেকে পথে বসে গেছে। পরিবহনশ্রমিক থেকে শুরু করে যারা অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করেন, তাদের উপার্জন বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তারা ক্রয়ক্ষমতা হারিয়েছেন। ফলে ঘনীভূত হয়েছে চাহিদার সংকট। 

নতুন করে সংক্রমণ ও মৃত্যু বেড়ে যাওয়ার পর সরকার দেশব্যাপী দু সপ্তাহ 'লকডাউন' দিলেও তা যথাযথভাবে কার্যকর হয়নি। আমাদের মতো অধিক দরিদ্র মানুষের দেশে পুরোমাত্রায় লকডাউন কার্যকর করা সত্যিই কঠিন। কারণ অন্য সব যুক্তিকে অগ্রাহ্য করা যায়, কিন্তু পেটের খিদের যুক্তিকে অস্বীকার করা যাবে কীভাবে? আর যারা বাইরে বের হয়েছেন, তাদের অধিকাংশই রুটি-রুজির দোহাই দিয়েই বাইরে বের হয়েছেন। 

সরকার অবশ্য গরিব মানুষের জন্য কিছু সহায়তা দিয়েছে। কিন্তু সব গরিব মানুষ সেই সুবিধা পায়নি। গত এক বছর ধরে চেষ্টা করেও সরকার প্রকৃত গরিবদের তালিকা প্রণয়ন ও বিতরণ প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করতে পারেনি। আর যেখানে ত্রাণ দেওয়া হয়েছে, সেখানে চুরি-চামারিও থামানো যায়নি। আমাদের দেশে পরিপূর্ণ লকডাউনে না যাবার সবচেয়ে বড় যুক্তি হচ্ছে গরিব ও পিছিয়ে পড়া মানুষের কাছে খাবার পৌঁছে দেয়ার সমস্যা। দেশে এমন কোনো ম্যাকানিজম নেই, যা দিয়ে প্রতিটি গরিব মানুষকে খাবার পৌঁছে দেয়া যায়। যেহেতু এখানে গরিব পিছিয়ে পড়া মানুষদের কাছে খাবার পৌঁছে দেয়া যাচ্ছে না, তাই পরিপূর্ণ বন্ধ বা লকডাউন 'মিশন'নও বড় বেশি সফল হচ্ছে না। 

যতটুকু যা লকডাউন হয়েছে, তাতেই নানা শ্রেণিপেশার মানুষের কষ্টের বিভিন্ন চিত্র উঠে আসছে সংবাদ মাধ্যমে। কোথাও কাজ-হারানো মানুষ একইসঙ্গে লড়ছেন মহামারী ও অনাহারের সঙ্গে। অনেকেই একটু ত্রাণ বা সাহায্যের আশায় পথ চেয়ে আছেন। অনেকে ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান খুলে দিতে মরিয়া হয়ে আছেন। কেউ কেউ সকল ঝুঁকি উপেক্ষা করে উদ্দেশ্যহীনভাবে পথে হাঁটছেন কেবল পেটের জ্বালায়!

আগামী দিনে মহামারী আরও প্রবল হয়ে উঠলে বা দীর্ঘায়িত হলে কী হবে তা অজানা। তবে এখনও পর্যন্ত আমরা সাধারণ কর্মজীবী মধ্যবিত্ত খুব বেশি দৈহিক যাতনা ভোগ করিনি। বরং রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলা যায়, 'দেশের দারুণ দুর্যোগের দিনে আমাদের মধ্যে যাহাদের সুখের সম্বল আছে, তাহারা সুখেই আছি। যাহাদের অবকাশ আছে, তাহাদের আরামের লেশমাত্র ব্যাঘাত হয় নাই, ত্যাগ যেটুকু করিয়াছি, তাহা উল্লেখযোগ্য নয়, কষ্ট যেটুক সহিয়াছি আর্তনাদ তাহা অপেক্ষা অনেক বেশিমাত্রায় করা হইয়াছে' ('দেশনায়ক')।

তা হলে কী করণীয়? গোটা দেশ এক সঙ্গে বন্ধ করে দেওয়ার ন্যায্যতা নিয়েই প্রথমত প্রশ্ন রয়েছে। কাজেই লকডাউন করে মানুষকে ঘরে আটকে রাখা যাবে বলে মনে হয় না। আবার সব কিছু আগের মতো খুলে দেওয়ায়ও হবে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। ব্যাপক হারে সংক্রমিত হয়ে হাসপাতালগুলোতে যেন রোগীরা ভিড় না বাড়ায়, সে ব্যাপারে সরকারকে সজাগ থাকতে হবে। পাশাপাশি আয়-উপার্জনহীন গরিব মানুষের হাতে নগদ টাকা সরবরাহের আওতা বাড়ানোর দাবিও এখন জোরালো হচ্ছে। 

এদিকে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা আমাদের দেশে উদ্বেগজনক পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। গত দশ দিনে এক হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আগামী দিনগুলোতে এই হার যদি না কমে, তাহলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। 

ব্যাপক মাত্রায় টিকাকরণের উদ্যোগও আপাতত সফল হচ্ছে না। চুক্তি এবং অগ্রিম টাকা পরিশোধের পরও ভারত থেকে আপাতত টিকা পাওয়া যাচ্ছে না। চীন-রাশিয়া থেকে টিকা আনার যে উদ্যোগ চলছে, সেটা বাস্তবায়ন করাটাও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এদিকে প্রতিবেশী দেশ ভারতে যে ধরনের ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে, সেটা অত্যন্ত ভীতিকর। রূপান্তরিত এ ভাইরাসে আক্রান্ত হলে হাতে আর বেশি সময় থাকছে না। যদিও উভয় দেশের সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, তারপরও আশঙ্কামুক্ত হওয়া যাচ্ছে না। গত রোববার পর্যন্ত উভয় দেশের সীমান্ত সীমিত আকারে হলেও খোলাই ছিল। 

এখন আমাদের ব্যাপক সংক্রমণ থেকে রেহাই পাবার একমাত্র পথ হচ্ছে, ব্যক্তিগত সচেতনতা। গণপরিবহন, দোকানপাট, অফিস, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলছে খুলুক, কিন্তু আমরা যেন সবখানে অকারণে ভিড় না বাড়াই। যতদূর সম্ভব স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, মাস্ক ব্যবহার করা, ন্যূনতম লক্ষণ দেখা দিলে করোনা পরীক্ষা করা এবং বিচ্ছিন্ন থাকার নিয়মগুলো পালন করি। 

করোনাভাইরাস নিয়ে কোনো কিছুই আগেভাগে বলা যাচ্ছে না। এই দ্বিতীয় ঢেউ কতদিন পর্যন্ত চলবে- তা যেমন কেউ বলতে পারছে না, আবার তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম ঢেউ যে আসবে না, সেটাও কেউ হলপ করে বলতে পারছে না। এ অবস্থায় আমাদের স্বাস্থ্যখাতে উন্নতির জন্য ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। জেলায় জেলায় আইসিইউ-সমৃদ্ধ হাসপাতালের উদ্যোগ গ্রহণ, অক্সিজেনের ব্যবস্থা, ডাক্তার, নার্স, টেকনিশিয়ানের সংখ্যা বাড়ানো ও তাদের দক্ষ করে গড়ে তোলা, তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা, হাসপাতালগুলোতে সেবার মান বাড়ানো, চিকিৎসা ক্ষেত্রে গবেষণায় অধিক বিনিয়োগ, সব ধরনের দুর্নীতি থেকে এ খাতকে মুক্ত রাখা-এমন অসংখ্য প্রয়োজনীয় কাজ অত্যন্ত জরুরি ভিত্তিতে শুরু করা দরকার। স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়ন ও দক্ষতা বৃদ্ধি হতে হবে সরকারের এক নম্বর অগ্রাধিকার। তবে এ মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি দরকার টিকার ব্যবস্থা করা। 

আমরা কিন্তু করোনাভাইরাসের প্রথম ঢেউ থেকে তেমন কিছুই শিক্ষালাভ করিনি। তাই দ্বিতীয় ঢেউয়ে মৃত্যুর সংখ্যা এত বেড়ে গেছে। দ্বিতীয় ঢেউ থেকেও যদি যদি কিছু না শিখি, করণীয়গুলো নিয়ে উদাসীনতা দেখাই, তাহলে ভবিষ্যতে আরও আরও অনেক বেশি স্বজনের লাশ গোণা আর আহাজারি করা ছাড়া কিছুই করার থাকবে না।