হারানো মানুষের সন্ধানে

কুলদা রায়
Published : 5 Nov 2012, 04:40 PM
Updated : 5 Nov 2012, 04:40 PM

১. যে গল্প তোমার আমার
সাত চল্লিশে আমার ঠাকুরদা দেশ ত্যাগ করেননি। তারা তিন ভাই। বড় জন বিরাজ মোহন রায়—কৃষক। মেজ ভাই সতীশ রায় ওভারশীয়র হিসেবে কাজ করে একদিন কন্টাক্টরী করতেন বৃটিশ আমলে। ইটের ভাটাও দিয়েছিলেন। নমশুদ্রদের মধ্যে তিনি সেকালে কিছু পয়সা কড়ি করেছিলেন। আমাদের খাটরা গ্রামে প্রথম নমশুদ্র হিসেবে দোতলা বিল্ডিং দিয়েছিলেন। সেটা ছিল চুন সুরকির লাল দালান।

আমার ঠাকুরদা ছোটভাই হিসেবে একটু আদুরে বলেই পালা গানের দল করেছিলেন। করেছিলেন যাত্রা দল। নাম রায় কম্পানি। পরে আমার বাবার জন্ম হলে দলটি নাম হয়েছিল শংকর অপেরা। সেখানে ম্যালকম সাহেব অভিনয় করতেন। শোনা যায় একবার অভিমন্যু বধ পালায় কৃষ্ণ সাজতেন যে অভিনেতাটি, তিনি পালার সময়ে অসুস্ত হয়ে পড়লে স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এসে তার চরিত্রটি করে গিয়েছিলেন। এটা আমাদের এলাকায় লোকশ্রুতি ছিল। কিন্তু আমার ঠাকুরদা কখনও সেটা নিজ মুখে স্বীকার করেননি। বলতেন—কৃষ্ণ আসবে কই থেইকা? সেতো বানানো গল্প। কৃষ্ণ নামে আমাগো এক প্রম্পটার ছিল। সেই বদলি হিসেবে অভিনয় করেছিল। তবে এলাকার লোকে দাদুর কথাকে আমল দিত না। বলত, বিদুবাবু মদ টদ খায়। কখন কী বলে ঠিক নাই। তাদের কাছে ভগবান শ্রীকৃষ্ণই ছিল সত্যি। কিন্তু সত্যি হল আমার দাদার পরে আমার জন্মের পরে দাদু আর মদ ছুঁয়ে দেখেন নি। তার মদ কেনার সঙ্গতিই ছিল না। তিনি তখন কপর্দক শূন্য। ভেড়ার হাট থেকে এক মন চাল কিনে রাস্তার পাশে ছালা পেতে বিক্রি করতেন। আর আমার বাবা লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে প্রেসের মেশিনম্যানের কাজে যোগ দিয়েছিলেন। পরে দোকানের কর্মচারী। ঠাকুমা ছিলেন পাগল। আমার কিশোরী মা হাড়িকুড়ি ধুয়ে মুছে চুলার পাশে অপেক্ষা করত। দাদু আর বাবা বাজার করে ফিরলে তবে রান্না চড়াত।

এই দাদু, তার বড় দুই ভাই—কেউই দেশ ত্যাগ করে ভারতে যাননি। এর মধ্যে দেশে দাঙ্গা হয়েছে। তাড়গাঁর দাঙ্গায় হিন্দু-মুসলমান নিহত হয়েছে। গ্রামকে গ্রাম হিন্দুরা দেশ ত্যাগ করেছে। গ্রামের অবস্থাপন্ন হিন্দুরা শহরে এসে আস্তানা করেছে। পয়ষট্টির যুদ্ধের পরে আরেক দফা চলে গেছে। তারপর একাত্তরে যখন পাকবাহিনী পরিকল্পিতভাবে শুরু করেছিল হিন্দু নিধন, নারী ধর্ষণ, লুঠপাট তখন মরতে মরতে অনেকে দেশ ছেড়ে চলে গেলেন। তাদেরকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করেছিল পাকবাহিনী। শরণার্থী হয়ে যাওয়ার পথে, পশ্চিম বঙ্গের বিভিন্ন ক্যাম্পে মানবেতর জীবন যাপন করে ক্ষুধা-তৃষ্ণায়, রোগে-শোকে। রোদ-বৃষ্টিতে পুড়ে-ভিজে অনেকেই মারা গেছে। তাদের সংখ্যা ছিল লাখ লাখ। আমার বড় ঠাকুরদা আর মেজ ঠাকুরদা দুজনেই পাকিস্তান আমলে মরে গিয়েছেন। আমার ঠাকুরদা একাত্তরে আমাদের সবাইকে নিয়ে গুলির মুখে বেঁচেছিলেন। শরণার্থী জীবন ছেড়ে বাহাত্তরে দেশে ফিরে এলে তিনি প্রতিবেশী নূরুল হক বিএ দাদাজানকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন—ভাইজান, এই দ্যাশ ছাড়া বাঁচনের ইচ্ছা জাগে না। পঁচাত্তরে তিনি মারা গিয়েছেন। তার দুই দাদার সঙ্গে আছেন বাংলাদেশের মাটিতে ঘুমিয়ে । তাঁরা কখনোই দেশ ত্যাগ করতে চান নি।

২. যে গল্প আমার শহরের –আমার গ্রামের
আমাদের চারটি বাড়ির পরেই ইরানী ফুফুদের বাড়ি। তার বোনের নাম তুর্কী। তাদের বাড়ির দরজায় একটি নাম ফলকে লেখা ছিল—বর্ধমান হাউস। ইরানী ফুফুদের দাড়ি বর্ধমান। ইরানী ফুফুর বাবা শামসুল হক বর্ধমানের কোনো এক কলেজের শিক্ষক ছিলেন। তিনি বর্ধ্মান ছেড়ে পূর্ব বঙ্গে আসতে চাননি। তিনি এসে খুব বিপদে পড়ে গিয়েছিলেন। সারাক্ষণ তার মন পড়ে থাকত বর্ধমানে। এভাবে তিনি বিষাদ রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। মারা যাওয়ার সময় তিনি বারবার একটি কাটালীচাঁপা ফুল গাছের কথা বলতেন। গাছটি ছিল বর্ধমানে—তাদের বাড়িতে।

কাঠালীচাঁপা গাছটি লাগিয়েছিলেন তাঁর আম্মাজান। সেই গাছটিতে তিনি প্রতি ভোরে পানি দিতেন। মাকড়সার জাল পড়লে ছাড়িয়ে দিতেন। গোড়ার মাটি খুঁড়ে দিতেন। এই গাছটির কথা মনে করে তিনি বহুদূর থেকে কাঁদতেন। তার জন্য একটি কাটালীচাঁপার গাছ লাগানো হয়েছিল। সে গাছে ফুল ধরার আগেই তিনি মারা গেলেন। তার বিধবা স্ত্রী সেই গাছটির কাছে এসে ভোরের বেলায় দাঁড়াতেন। সন্ধ্যায় বিষণ্ন হয়ে পড়তেন। কাঠালীচাঁপার ঘ্রাণ পেলে তিনি কান্না করতেন। বলতেন, সুযোগ থাকলে তারা বর্ধমানে ফিরে যেতেন। কিন্তু সুযোগটি তাদের ছিল না। জিন্না সাহেব আর নেহেরু সাহেব তাদের বাধ্য করেছে বর্ধমান ছেড়ে যেতে। এদের কারণেই তারা সেই কাঠালীচাঁপাকে ছেড়ে এসেছেন।

আমাদের ছোট শহরের লালু আর সালুদের বাড়ি ছিল বিহারে। তাদের ভাষা ছিল উর্দু। বাংলাভাষাটাও বলত বিহারী ঢঙ্গে। তারা পেশায় ছিল তুলো-ধোনকার। কারো সঙ্গেই তাদের খারাপ সম্পর্ক ছিল না। সব সময়েই তাদের একটা ভয় তাড়া করে বেড়াত। তারা বিহারে থাকতে পারেননি। প্রাণভয়ে পূর্ব পাকিস্তানে এসেছে। এখানে বাঙ্গালীরা তাদের মন থেকে মেনে নেয়নি। তারাও বাঙ্গালীদের সঙ্গে মিশতে পারেনি। একাত্তরে পাকবাহিনী তাদের রাজাকার হিসেবে ব্যবহার করেছে। পাকিস্তানীদের পক্ষে লড়াই করার মাধ্যমে বিহারীরা সত্যিকারের মত মাথাগোঁজার ঠাঁই পাবে— এই চিন্তা থেকেই তারা রাজাকার হয়েছে। পরাজিত পাকবাহিনী চলে যাওয়ার সময় তাদের বিপদে ফেলে রেখে গিয়েছিল। আমরা দেখতাম তারা সবসময় মাথা নিচু করে চলেছে। তারা বিহারে থাকতে পারেনি। বাংলাদেশেও তাদের গ্রহণযোগ্যতা নেই। পাকিস্তান তাদেরকে ব্যবহার করে মাত্র। পাকিস্তানী হিসেবে স্বীকার করে না। প্রকৃত অর্থে এরা এই পৃথিবীতে শেকড়হীন। কোন পাপে তারা জন্ম থেকেই শেকড়হীন হয়ে গেলো?

অথবা আমাদের সেই জ্ঞানা জেঠিমা, একাত্তরে শরণার্থী হয়ে যখন পশ্চিম বঙ্গে গিয়েছিলাম, তখন জ্ঞানা জেঠীমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল বনগাঁয়ে। তিনি তখন বেশ বয়েসী হয়ে পড়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, তারা যখন ভোর রাতে দেশ ছেড়ে আসেন তখন তাদের ধলি গাইটাও জানে না। প্রতিদিনের মত ভোর হলে গাইটা অপেক্ষা করেছে জেঠীমা তার জন্য জাবনা নিয়ে আসবে। বালতি ভরে জল নিয়ে আসবে। গলার কাছে আদর করে দেবে। দেরী হলে হাম্বা কবে ডাকবে। জেঠীমা বলেছিলেন চব্বিশ বছর আগে দেশ ছেড়ে এসেছি। কিন্তু সব সময় ধলী গাইটা কানের ভেতরে হাম্বা করে ডাকছে। জ্ঞানা জেঠী বলেছিলেন, এটা শুনলে নিজেকে অপরাধী মনে করেন। গাইটা না খেয়ে আছে। কে তাকে খেতে দেবে? এই গাইটার জন্য তার পাপ জমছে। সেই পাপে তাঁর মন পোড়ে।

অথবা সাতক্ষীরার ধুলীহর গ্রাম থেকে সাতচল্লিশে নাট্যকার অভিনেতা মনোজ মিত্রের ঠাকুরমা দেশ ত্যাগ করবেন না করবেন না বলেও শেষ পর্যন্ত দেশ ত্যাগ করে চলে গেলেন, তখন তিনি ক্ষোভে-দুঃখে তাঁর জীবিতকালে আর কখনো দুর্গা মুর্তি দেখেননি। যে দুর্গা তাঁর দেশকে রক্ষা করতে পারেনি—তাকে দেখে লাভ কী?

সাত চল্লিশে যারা এই দেশ ত্যাগ করেছিলেন তাদের সিংহভাগ কিন্তু জানতোই না—দেশটি ভাগ হওয়ার পথে আছে। কিছু রাজনীতিক সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন তারা হিন্দুদের জন্য হিন্দুস্থান, মুসলমানদের জন্য পাকিস্তান চাইছেন। এই চাওয়াটা কিন্তু সাধারণ মানুষেরর চাওয়া ছিল না। রাজনীতি মানুষ বুঝতই না। মনে করত ওটা কলকাতার বাবু আর খান সাহেবদের কাজ কাম। ১৪ আগষ্টে যখন দেশ ভাগ হয়ে যাচ্ছে তখন বিষাদ বৃক্ষ উপন্যাসের লেখক বরিশালের কীর্তিপাশার সমীর সেনগুপ্তর অসহায় বাবা অবাক হয়ে দেখতে পাচ্ছেন—রাতারাতি মানুষ ভাগ হয়ে যাচ্ছে। তার অবস্থাপন্ন দাদা ওই পারে চলে যাচ্ছেন। কিন্তু তিনি কী খাবেন পরদিন এই চিন্তা করতে দিশা পাচ্ছেন না। আর আমার ঠাকুরদা পালা গান শেষ করে এসে দেখতে পাচ্ছেন—পরদিন ভোরে এই শহরের অর্ধেক হিন্দু সব ফেলে রেখে চলে গেছে। বাকীরা যাবো যাবো করচ্ছেন।

কোটালীপাড়ার কবিরাজ বাবু শিল্পী যোগেন চৌধুরীর খুড়তুতু ভাই কোনোদিন তার নিজের গ্রাম ছেড়ে কোথাও যান নি। এখন কোন বিদেশ বিঁভূইয়ে যাবেন? যাওয়ার সাহস কিংবা সামর্থ্য তার নাই। তিনি শেষ পর্যন্ত কোটালীপাড়া ছেড়ে মহাকুমা শহরের একটি ভাড়া বাড়িতে আশ্রয় নিলেন। ছেলেপিলে নিয়ে কোনো মতে দিন গুজরান করলেন। শেষে অন্ধ হয়ে গেলেন। বিছানায় শুয়ে শুয়ে কোটালীপাড়ার কথা বলতে বলতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন। আমাদের এই কবিরাজ মশাইয়ের কি দেশপ্রেমের কোনো ঘাটতি ছিল কোনোকালে? তিনি কেনো নিজ দেশে পরবাসী হবেন?

এই বর্ধমানের শামসুল হক, বিহারী লালু-সালু, মনোজ মিত্রের ঠাকুরমা আমাদের গাই হারানো জ্ঞানা জেঠীমা দেশ ত্যাগ করেছেন সেই সাত চল্লিশে। তাদের এই দেশত্যাগ তাদেরকে চির বিষাদে নিঃশেষ করে দিয়েছে। তারা আর জীবনে দাঁড়াতে পারেনি। তাদের প্রাণটাই মরে গিয়েছিল। এই মৃত্যুর সঙ্গে তুলনীয় আর কোনো মৃত্যু হতে পারে না। তারা নাগরিকের চেয়ে পরিণত হয়েছে সংখ্যালঘুতে।
এ গল্পের শুরু আছে– শেষ নেই।

৩. কিছু তথ্য নিয়ে তত্ত্বকথা
এই সংখ্যালঘু ধারণাটি এসেছে সংখ্যাগুরু শব্দ প্রচলনের বিপরীতে। গণতান্ত্রিক দেশে সরকার নির্বাচনের সময়ে সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘু বলে সাময়িকভাবে একটি প্রপঞ্চের সৃষ্টি হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে নির্বাচিত সরকার ক্ষমতাগ্রহণ করার পরে সকলের সরকার হয়ে যায়। সরকারের কাছে সংখ্যাগুরু- সংখ্যালঘু বলে কোনো প্রপঞ্চ থাকে না। রাষ্ট্র-পরিচালক হিসেবে সরকার সমদর্শনের নীতি অনুসরণ করবেন—এটাই রীতি। এটাই সভ্যতা। সেভাবেই বাংলাদেশের সংবিধান অনুসারে সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। এবং বলা হয়েছে—কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষ ভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবে না। অর্থাৎ রাষ্ট্রের কাছে মুসলমান-হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীস্টানের বদলে সকলের পরিচয় নাগরিক। তাহলে ধর্মগতভাবে 'মুসলমান-হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান' নাগরিকের ধর্মীয় পরিচয়। রাষ্ট্রে যে কোনো নাগরিকের যে কোনো ধর্ম-গ্রহণ এবং পালন করার সমান অধিকার রয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান-সংখ্যালঘিষ্ঠ হিন্দু আসলে পরিসংখ্যানগত একটা পরিস্থিতি মাত্র। এর বেশি কিছু হওয়ার কথা নয়।

এই রকমই পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় পূর্ববঙ্গে জনসংখ্যার হিসেবে বহুকাল থেকেই মুসলমানরা সংখ্যাগুরু এবং হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীস্টান জনগোষ্ঠী হল সংখ্যালঘু। সংখ্যালঘুদের মধ্যে আবার সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুরা। বৌদ্ধ এবং খ্রীস্টান জনসংখ্যা স্থির হয়ে আছে শতকরা ১ ভাগে।

১৮৯১ সালে এই পুর্ব ভুখণ্ডে হিন্দুদের সংখ্যা ছিল শতকরা ৪২ ভাগ। বাকী ৫৮ ভাগ ছিল মুসলমান।
হিন্দুদের সংখ্যার অনুপাতটি ছিল নিম্নরূপ—
কামার- ৮%, সদগোপ—৮%, কৈবর্ত—৬%, চামার—২.৭%, গোয়ালা—৫%, বাগদী—২%, তেলি—১.৫%, মালো—২.৩%, কুমোর—১%।. মোট—৩৫.৫০%
ব্রাহ্মণ—৩%, কায়স্থ—২%। .মোট—৫%।

এই শতকরা ৪২ জন হিন্দুর মধ্যে মাত্র ৫ জন ছিলেন ব্রাহ্মণ ও কায়স্থ। ওরা ছিলেন তথাকথিত ভদ্রলোক। এরাই ছিলেন জমিদার, তালুকদার, আমলা, ব্যবসা-বাণিজ্যের অধিকর্তা। এদের মধ্যে কায়স্থ শ্রেণীরাই ছিলেন ব্যবসায়ী। মহাজন-সুদের কারবারী শোষক শ্রেণী ছিল এই কায়স্থ বা সাহা শ্রেণীর অন্তর্গত। হিন্দুদের মধ্যে ৭.৬% ছিল শিক্ষিত। এই শিক্ষিত হিন্দুদের সিংহভাগই উচ্চবর্ণের। ব্রাহ্মণ—২৭.৫ জন। কায়স্থ—১৬.৪ জন এবং বৈদ্য ৩২ জন।
মুসলমানদের সিংহভাগই ছিল দরিদ্র। শিক্ষার হারও ছিল মাত্র ১.৬ জন।

তাহলে দেখা যাচ্ছে ৯০ শতাংশেরও বেশি অধিবাসী ছিল দরিদ্র, অশিক্ষিত—নিম্নবর্ণজ, বৃত্তির দিক থেকেও নিম্নশ্রেণীর ও নিম্নবিত্তের। এরাই মুসলমান ও নিম্নবর্গের হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন। এই উচ্চবর্ণের হিন্দু জমিদার , মহাজন, ব্যাবসায়ী ও শিক্ষিত মধ্যবিত্ত অংশটি সাতচল্লিশে দেশত্যাগ করেছিলেন। তারা মনে করেছিলেন—পাকিস্তানের চেয়ে ভারত তাদের জন্য নিরাপদ হবে। কিন্তু পাকিস্তান অংশে সে সময়ে যে ৩০ ভাগ হিন্দু ছিল তাদের অধিকাংশই ছিল নিম্ন বর্ণের হিন্দু। ছিল নিম্নবিত্ত ব্রাহ্মণ-কায়স্ত-সাহা গোষ্ঠীর লোকজন। তাদের কাছে যে কোনোভাবেই হোক না কেনো স্বদেশটাই প্রধান।

এই স্বদেশের নাম হয়েছে পাকিস্তান। তাতে কিছু তাদের কিছু যায় আসে না। তারা তাদের পিতৃ-পুরুষের জন্মভিটাতেই থাকতে চায়। পরিচিত মানুষদের সঙ্গেই থাকতে চায়। তারা জানে—ধর্মের চেয়ে দেশ বড়—দেশের চেয়ে মানুষ অনেক বড়। মানুষ দেশকে বানায়। মানুষ ধর্মকে বানায়। ধর্ম মানুষকে বানায় না। এ কারণেই পৃথিবীতে নানা দেশ—নানা ধর্ম। বহুর মধ্যে ঐক্য থাকে। ঐক্যের মধ্যেই প্রাণের মিলন। এই মিলিত প্রাণেই মহাপ্রাণের সৃষ্টি।

ধর্মের নিজের কোনো হাত-পা নেই। ধর্ম নিজে কাউকে গ্রহণ বা বর্জন করতে পারে না। ধর্ম কিছু-বিধি-বিধানের সমষ্টি মাত্র। কেউ যে কোনো ধর্ম গ্রহণ বা বর্জন করতে পারে—এই বিধি-বিধান মেনে মানসিক শান্তি পেতে পারে। এই শান্তি থেকে ঐ ধর্মের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে পারে। ঐ বিশ্বাস একান্তই তার নিজের বিশ্বাস। এই বিশ্বাস অন্যের কাছে অবিশ্বাস হয়ে উঠতে পারে। তাতে কিছু যায় আসে না। নিজের মতকে অন্যের ঘাড়ে জোর করে চাপাতে গেলে অনেকের যায় আসে। মহা ঝামেলা তৈরি হয়ে যায়। রক্তারক্তি কাণ্ড ঘটে। অথচ ধর্ম বলে—আমার ধর্ম আমার কাছে-তোমার ধর্ম তোমার কাছে। যত মত—তত পথ। সব পথই শান্তির মোহনায় পৌঁছায়। শান্তিই আসল।

কিন্তু পাকিস্তান রাষ্ট্রটি এই ধারণার বিপরীতে চলেছে। মানুষে মানুষের সম্প্রীতির জায়গাটিতেই আঘাত করতে চেয়েছে। তারা মানুষের দেশের বদলে ধর্মের দেশ বানাতে চেয়েছে। এই ধর্মের রাষ্ট্র করার জন্য তারা একটা মানব গোষ্ঠীকে কলেপড়া ইঁদুরের মত ব্যবহার করতে চেয়েছে। এই ধর্ম যত না প্রকৃত ধর্ম—তার চেয়ে অনেক বেশী তাদের শোষণের ধর্ম। ফলে তারা যে ধর্মের নামে দেশটি চালাতে চেয়েছিল তারা পূর্ব ভূখণ্ডের সেই ধর্মের অনুসারীদের প্রকৃত ধার্মিক হিসেবেই মনে করেনি। তারা বলেছে—এই পূর্ব ভূখণ্ডের মুসলমানেরা হিন্দুদের সঙ্গে থেকে হিন্দুয়ানী শিখেছে। তাদেরকে মেরে ধরে এই হিন্দুত্ব থেকে মুক্ত করতে হবে। এই রাষ্ট্র যখন মুসলমানদের জন্যও জল্লাদসম—সেখানে অন্য ধর্মের লোকদের অবস্থা কী হতে পারে?

ফলে পাকিস্তান রাষ্ট্রটির জন্মের পর থেকেই পাকিস্তান ভূখণ্ড থেকে অন্য ধর্মের মানুষদের মাইনাস করতে চেয়েছে। এই মাইনাস করার ধরনগুলি নিম্নরূপ–

এক. হিন্দুদের পাকিস্তানের শত্রু হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

দুই. হিন্দুদের নাগরিক অধিকার রাষ্ট্রে অকেজো করা হয়।

তিন. হিন্দুদের সম্পত্তিকে শত্রু সম্পত্তি হিসেবে পরিগণিত হয়।

(লক্ষ্য করুণ, সাত চল্লিশের আগে পর্যন্ত পূর্ব বঙ্গ এবং পশ্চিম বঙ্গ অখণ্ডই ছিল। দীর্ঘদিন কোলকাতা অখণ্ড বঙ্গের প্রশাসনিক প্রধান নগর হওয়ায় সেখানে সকলের অবাধ যাতায়াত ছিল। এই অখণ্ডত্বের কারণে পশ্চিম ভূখণ্ডে আত্মীয়-স্বজন থাকাটাই স্বাভাবিক। রাজনৈতিক কারণে দেশভাগ হওয়ার ফলে আত্মীয়-স্বজন ভাগ হয়ে যাবে—এটা অস্বাভাবিক। এই আত্মীয়তাকে রাষ্ট্র শত্রু হিসেবে বিবেচনা করছে– এটা একটা উন্মাদ চিন্তা। এবং সেই শত্রুত্ব যদি কেবলমাত্র একটি দেশের জন্যই বলবৎ করা হয়—সেটা চূড়ান্ত উন্মাদনা। হিন্দুরা ভারতে গেলে তারা শত্রু, আর মুসলমানরা পাকিস্তানে গেলে মিত্র, খ্রীস্টানরা আমেরিকা গেলে অসুবিধা নাই, বৌদ্ধরা কোথাও যায় না বলে কোনো ভাবনা নাই—এই অসুস্থ ভাবনা নিয়েই পাকিস্তান রাষ্ট্র চলেছে।)

চার. বাংলা ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতিকে ঘৃণিত হিন্দুদের ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি হিসেবে অভিহিত করে তাকে পালটে দেয়ার পরিকল্পনা করা হয়। বাংলার বদলে উর্দুকে রাষ্ট্র-ভাষা করার চেষ্টা করা হয়। রবীন্দ্রনাথকে হিন্দু ঘোষণা করে বাতিল করা হয়।

পাঁচ. মুসলমান কবি সাহিত্যিকদের রচনা থেকে হিন্দু পুরান সম্পর্কীয় শব্দাবলী মুছে দেওয়া হয়। কীর্ত্তন, শ্যামা সঙ্গীত, পদাবলী, বাউল গানকে কালো তালিকাভূক্ত করা হয়। লালন শাহ নিজে জাতের বিরুদ্ধে অবস্থান করলেও রাষ্ট্র থেকে তার একটি সাম্প্রদায়িক পরিচয় খাড়া করা হয়।

ছয়. এক তরফাভাবে ধারাবাহিক সাম্প্রদায়িক হামলা চালানো হয় নীরিহ হিন্দুদের উপর।

সাত.
হিন্দুদের জমি সম্পত্তি দখল করতে নাগরিকদের মধ্যে দুর্বত্ত-লোভী মানসিকতা সৃষ্টির কৌশল বলবৎ করে রাষ্ট্র।

আট. পুলিশী মামলায়-হামলায় জড়িয়ে হয়রানী করার ব্যবস্থা রাখা হয় হিন্দুদের জন্য। তাদেরকে বিনা বিচারে দিনের পর দিন জেলে পঁচিয়ে রাখার মাধ্যমে আতংকগ্রস্থ করা হয়।

নয়. হিন্দু মানেই হল ভারতের দালাল বা এজেন্ট। দেশের প্রতি তারা অবিশ্বস্ত। বিশ্বাসঘাতক। সন্দেহভাজন। কাফের। এ ধরনের ধারাবাহিক প্রচার চালানো হয়। যারা হিন্দুদের রক্ষা করতে এগিয়ে আসে, সম্প্রীতির পক্ষে কাজ করে, ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য লড়াই করে, সাম্প্রদায়িকতাকে হটিয়ে দিতে জান পরান দেয়—তাদেরকেও ভারতের দালাল—হিন্দুদের এজেন্ট বলে প্রচার দেওয়া হয়।

ভারত একটি দেশ। পাকিস্তান আরেকটি দেশ। হিন্দু একটি ধর্ম। ইসলাম আরেকটি ধর্ম। সুতরাং ভারত দেশটির সমস্যার দায় হিন্দুদের উপর আসবে কেনো? আবার পাকিস্তান আর ইসলাম সমার্থক হবে কেনো? ভারত যদি উপনিবেশবাদী হয়ে থাকে—পাকিস্তানও তাই। উপনিবেশবাদ তো সাম্রাজ্যবাদেরই একটি প্রক্রিয়া। সেটা রাষ্ট্র মোকাবেলা করবে। রাষ্ট্রকেই তার নাগরিক বলবে তুমি এই উপনিবেশবাদকে সমর্থন করো না। কিন্তু এই উপনিবেশবাদের ভুতটাকে নাগরিকের মাথার মধ্যে নিজেদের জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভূক্ত আরেক ধর্মগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে হিংসা আর সংঘাতের উন্মাদনা উস্কে দেওয়ার অর্থ কী? আমি ভালো—তার মানে তুমি অবশ্যই মন্দ। এই ভাবনাটাই মন্দ। হিংসাত্মক। আমি ভালো—তুমিও ভালো হতে পার। তোমাকে জোর করে মন্দ ধরে নেওয়ার মধ্যে কোনো সততা–সভ্যতা নেই।

দশ.
হিন্দুরা চিরকাল মুসলমানদের শোষণ করেছে। ঘৃণা করেছে। নির্যাতন করেছে। শিক্ষা-দীক্ষা-কর্মের অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। সুতরাং এই হিন্দুদের উপর এখন প্রতিশোধ নেওয়া ফরজ। এ ধরনের হিংসামূলক চিন্তা-চেতনার সম্প্রসারণে রাষ্ট্রীয়ভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করা হয়েছে এক সময়।

(অথচ আমরা দেখেছি, হিন্দু জমিদারদের মত মুসলমান জমিদারও ছিল। এই হিন্দু-মুসলমান জমিদারদের পারস্পরিক সম্পর্ক ভালোই ছিল। প্রজাশোষণের বেলায় হিন্দু-মুসলমান উভয় ধর্মের জমিদাররা কাউকে ছাড় দেয়নি। হিন্দু-মুসলমান প্রজা মুসলমান জমিদার কর্তৃক শোষিত হয়েছে। হিন্দু-মুসলমান প্রজা হিন্দু জমিদার কর্তৃক শোষিত হয়েছে। হিন্দু জমিদারের বাড়ির সামনে দিয়ে মুসলমান প্রজা যেমন জুতা পায়ে দিয়ে হাঁটতে পারেনি—হিন্দু প্রজারাও জুতা পায়ে দিতে হাঁটতে পারেনি। জমিদার তো জমিদার– তার কোনো হিন্দু-মুসলমানত্ব হয় না। প্রজারও হিন্দু-মুসলমানত্ব হয় না। একজন শোষক—আরেকজন শোষিত। এটাই মূল পরিচয়। )

এগার. পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে, লুটপাট করে, ধর্ষণ করে, গণহত্যা করে, দেশত্যাগে হিন্দুদের বাধ্য করা হয়েছে।

বার. ধর্মনিরপেক্ষতাকে চ্যালেঞ্জ করা হয়। অন্য ধর্মের বিরুদ্ধে ঘৃণা সৃষ্টির সংস্কৃতিকে উৎসাহিত করা হয়।

তের. গূরত্বপূর্ণ কর্মে হিন্দুদের নিয়োগ বন্ধ রাখা হয়।

চৌদ্দ. বাক স্বাধীনতাকে করা হয় সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্ম সম্প্রদায়ের একমাত্র অধিকার।

পনের. প্রণোদিত করা হয় এই বলে যে, পরমত সহিষ্ণুতা একটা অগ্রহণযোগ্য ধারণা। দমন-পীড়ন-নির্যাতন-খুন-জখমের মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠের শ্রেষ্ঠত্বকে প্রতিষ্ঠা করতে সংখ্যালঘুকে মাইনাস করে দাও।

ফলে নানাভাবে সংখ্যালঘুদের দেশত্যাগের ঘটনাটি একটি পরিকল্পিত রাষ্ট্রীয় নীতিতে পরিণত হয়। এই ভাবে দেখা যায় এই ভূখণ্ডের উত্তরাধিকারী হয়েও বিশাল একটি জনগোষ্ঠী হারানো মানুষের পরিসংখ্যানে পরিণত হয়েছে।

৪. যা হারিয়ে যায়
এই দেশ-ত্যাগ ঘটনাটি চলছে কখনো সরবে। কখনো নীরবে। ১৮৯১ সালে এই পূর্ব ভূখণ্ডে মুসলমান ও হিন্দুদের সংখ্যা ছিল শতকরা হিসেবে যথাক্রমে ৪৮ ভাগ ও ৪২ ভাগ। সাত চল্লিশে এসে হিন্দুদের সংখ্যা এসে দাড়াল ৩১ ভাগে। এই ছাপান্ন বছরে মোট জনসংখ্যার ১১ ভাগ হিন্দু চলে গেছে পশ্চিম ভূখণ্ডে।

সাত চল্লিশ থেকে মাত্র চার বছরে মোট হিন্দুর তিন ভাগের এক ভাগ দেশ ছেড়ে চলে গেছে। ১৯৬১ সালে জরীপে হিন্দুদের সংখ্যা পাওয়া যায় ১৮.৫ ভাগে। এর মধ্যে চৌষট্টীর দাঙ্গা (হামলা), পঁয়ষট্টীর ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধের ফলে শত্রু সম্পত্তি আইন প্রবর্তন, একাত্তরের পাক বাহিনীর গণহত্যা ও হিন্দুদের দেশত্যাগে বাধ্য করার কারণে সে সংখ্যা আরো কমে যায়। সংখ্যা দাঁড়ায় ১৪ ভাগে। একাত্তরের গণ হত্যা, নারী নির্যাতন, সম্পত্তি লুটপাট, জমি সম্পদ দখল, বাড়িঘরে অগ্নি-সংযোগের প্রধান টার্গেটই ছিল সংখ্যালঘু হিন্দুরা। এক কোটি সংখ্যা লঘু দেশত্যাগ করেছিল। ৩০ লক্ষ শহীদ বাঙ্গালী্দের মধ্যে হিন্দুদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য। তার পরেও একাত্তরের পরে ক্ষতিগ্রস্থ হিন্দুদের অধিকাংশই ফিরে এসেছিল।

এই ফিরে আসার মানুষজনের মধ্যে আমার পরিবার। আমার ঠাকুরদারা দেশ ত্যাগ করেনি। তাদের নেতা যোগেন মণ্ডল জিন্না সাহেবের সঙ্গেই থেকে গিয়েছিলেন। সোজা সাপ্টা বলে দিয়েছিলেন—আমরা, নমশুদ্ররা, ব্রাহ্মণদের চেয়ে মুসলমানদের আপন মনে করি। তারাও নিপীড়িত। আমরাও নিপীড়িত। সুতরাং তারা আমাদের বেদনাটা বুঝবে। তারা বুঝেছে। কিন্তু রাষ্ট্র বোঝেনি। বোঝার প্রয়োজন বোধ করেনি।

১৯৪৭ সালে নমশুদ্রদের নেতা যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল পাকিস্তান সরকারের মন্ত্রিসভায় আইন ও শ্রমমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। তিনিই প্রথম শাসনতান্ত্রিক সভার সভাপতিত্ব করেন। ১৯৫০ সাল পর্যন্ত তিনি পাকিস্তান সরকারের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এবং দক্ষিণাঞ্চলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় পাকিস্তান সরকার কোনো প্রতিকারের ব্যবস্থা না নেওয়ায় তিনি হতাশ হন। তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র হলে তিনি দেশত্যাগ করেন। তার এই হত্যার ষড়যন্ত্রটি শুধু ব্যক্তি যোগেন মণ্ডলের বিরুদ্ধে ছিল না। ছিল তার সম্প্রদায়ের সব মানুষদের বিরুদ্ধে।

একজন মানুষ যখন নেতা হন তখন তিনি আর ব্যক্তি মানুষ থাকেন না। তিনি সমষ্টির নেতা হয়ে ওঠেন। তার দায় যেমন তার নিজের উপর—তার চেয়েও বড় দায় তার কেন্দ্রীভূত সমষ্টি মানুষদের উপর। এটা বুঝতে যোগেন মণ্ডল ব্যর্থ হয়েছিলেন। তিনি যখন সমষ্টির চেয়ে নিজেকে বড় মনে করলেন, তাদেরকে নিঃস্ব করে চলে গেলেন, নিজে বাঁচলেন, সমষ্টিকে নিঃস্বকরণ স্রোতধারায় ফেলে গেলেন, তখন সারা জীবনের বর্ণবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে তার অবদানে নিবেদন ছিল না, ছিল না প্রাণের অংশগ্রহণ। ছিল এক ধরণের জীঘাংসা। জিঘাংসার গাছে সুফল ফলে না। কুফল ধরে। ফলে সমষ্টিকে তার ক্ষমতা অর্জনের উপায় হিসেবে ব্যবহার করেছেন। তিনি নিজের প্রাণ বাঁচিয়েছেন তার নমশুদ্র স্বজাতিকে ফেলে রেখে। বুক বেঁধে রুখে দাঁড়ানোর মত মহৎ নেতৃত্ব তার মধ্যে ছিল না। তিনি পরাজিত হয়ে নিজের নমশুদ্র সম্প্রদায়কে মানসিক দাসত্ব উপহার দিয়ে যান।

এই নিম্ন বর্গের হিন্দুদেরকে শাসক-মুসলমানগণ মানুষ বলে গণ্য করেনি। বর্ণহিন্দুরাও তাদের ঘৃণা করেছে—আর নিজেরাও নিজেদের বোঝার চেষ্টা করেনি। তারা প্রতারিত হয়েছে নিজের গোষ্ঠীর মেরুদণ্ডহীন নেতৃত্ব কর্তৃক। ফলে তারা নিজেদের সংগঠিত করার ভাবনাই আনতে পারেনি বুদ্ধিবৃত্তিক দিক থেকে। আর এদের মধ্যে যারা নানা সংগ্রাম করে–কপালের ফেরে কেউ কেউ শিক্ষা-দীক্ষা-বিত্তে উপরে উঠতে পারছে– তারা হচ্ছে দলছুট। নিজেদের ব্রাহ্মণভুক্ত ভাবতে ভালোবাসে।

আর এই নমশুদ্রদের বাইরে যে সব ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ্য-কায়স্থ-বৈদ্য গোত্রভুক্ত হিন্দু সাতচল্লিশের পরে দেশ ত্যাগ করেনি—তারা এই দেশটিতে ছিল দেশপ্রেমের কারণেই। তাদের অর্থের জোর ছিল না। কিন্তু দেশের প্রতি মমত্ব ছিল অতুলনীয়। এদের কারো পক্ষেই দাঙ্গা-হাঙ্গামা, সন্ত্রাস, অন্তর্ঘাত, ষঢ়যন্ত্র, ঘৃণা করার শক্তি-সামর্থ-সাহস কোনোকালেই ছিল না। ফলে ১৯৪৭ সালের পরে এদেশে মুসলমান-হিন্দুদের দাঙ্গা হয়নি। এক তরফাভাবে হিন্দুরা চিরকাল মার খেয়েছে। মার দেয়নি। দিতে তারা অক্ষম। যে কারণে প্রতিবেশী দেশে মুসলমানরা নির্যাতনের শিকার হলে এদেশে হিন্দুরা মুখ বুজে সহিংসার শিকার হয়েছে। অযোদ্ধার বাবরী মসজিদ ভারতের উগ্র হিন্দুদের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ হলে রাষ্ট্রের মদতে এদেশে হাজার হাজার মন্দির গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। দশ বছরের শিশু কন্যা থেকে শুরু করে সত্তর বছরের বৃদ্ধাও ধর্ষিত হয়েছে। জমি-জিরেত কেড়ে নেওয়া হয়েছে। নির্বাচনে হারজিত হলে তার দায়ে আক্রান্ত হয়েছে হিন্দুরা। এই আক্রমণকারীদের সংখ্যা কিন্তু বেশী নয়। কিন্তু এদের হাতে আছে অর্থ-অস্ত্র-বেসাত-রাজনীতি-প্রশাসন-ক্ষমতা-সরকার-রাষ্ট্র ব্যবস্থা।

হিন্দুরা আক্রান্ত হলে বুদ্ধিবৃত্তিক লোকজন চিরকালই রাষ্ট্রের উপর ভরসা করতে চায়নি—রাষ্ট্রের বদলে নাগরিকের শুভশক্তির দিকেই চেয়ে থেকেছে। অশুভের বিরুদ্ধে নাগরিককে সংগঠিত হওয়ার কথা বলেছে। নাগরিককেই এই সাম্প্রদায়িক শক্তিকে রুখে দাড়ানোর দাবী তুলেছে। ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠ অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল মুসলমান রুখে দাঁড়িয়ে নিজেদের প্রাণের বিনিময়ে হলেও সংখ্যালঘু হিন্দুদের প্রাণ দিয়ে বাঁচানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু যেখানে রাষ্ট্রের মধ্যেই এই সাম্প্রদায়িকতার বীজটি লুকিয়ে আছে, রাষ্ট্র নিজেই প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে এই সাম্প্রদায়িকতাকে পৃষ্ঠপোষকতা করছে—সেখানে নাগরিকের সংগঠিত প্রয়াস সাময়িক নিদান ছাড়া আর কিছুই করতে পারেনি।

ফলে নানা সময়ে রাষ্ট্রের মদতে সাম্প্রদায়িক হামলা থামেনি। এই দেশের মাটিতে শেকড় গাঁড়া হিন্দুরা হামলাকালে প্রতিবেশী মুসলমানদের উপর ভরসা করে থেকেছে। তারা জানে তারা তাদের রক্ষা করবে। রাষ্ট্রের কারণে যদি তারা রক্ষা করতে পারেনি– তখন তারা হিন্দুদের নিরবে দেশত্যাগে সহযোগিতা করেছে।

এভাবেই পাকিস্তানের ২৪ বছর হিন্দুরা রাষ্ট্রিয় শত্রু ও দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে দুঃসহ জীবন যাপন করেছে। মানসিক উদ্বাস্তু হয়ে কোনোমতে দিন গুজরান করেছে। পাকিস্তানী শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে বাঙালী মুসলমানেরা জেগে উঠলে, আন্দোলন-সংগ্রাম নির্মাণ করলেও এই হিন্দুরা থেকেছেন দূরে। দূরে থেকে এক ধরণের সম্ভ্রম নিয়ে সেই সংগ্রামকে নিরব সমর্থন করেছেন। তারা ভেবেছেন বাঙালী মুসলমানের মত সমভাবে নেমে পড়লে তাদের বিপদ বাড়বে। বিপদ তো তাদের মাথায় সর্বক্ষণ কৃপাণ হয়ে খাড়া রয়েছে। কারণ পাকিস্তানী শাষক শ্রেণী এই বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী আন্দোলন-সংগ্রামকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিন্দুদের চক্রান্ত হিসেবে চিহ্নিত করেছে। তারা এই হিন্দু নির্মূলে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে। কিন্তু যাদেরকে নির্মূলের চেষ্টা করা হয়েছে– তাদের মূল তো এই পূর্ব ভূখণ্ডেই প্রোথিত। মার খেয়ে—মারা গিয়ে, সর্বস্ব হারিয়েও তারা ফিরে আসার চেষ্টা করেছে শেকড়ের কাছে।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেই আবার তারা ফিরে এসেছে। পোড়া বাড়িঘরে মাথা গুজেছে। চুয়াত্তরে এই সর্বস্ব হারানো মানুষগুলোই দুর্ভিক্ষের শিকার হয়েছে সবচেয়ে বেশী। তবু তারা বাংলাদেশেই থেকেছে। থাকতে চেয়েছে শেষ পর্যন্ত। তার বাপ-ঠাকুরদারা যে মাটিতে শুয়ে আছে—সেই মাটিতেই তার ছেলেপুলেকে রেখে নিজের শেষ শোয়াটি করতে চেয়েছে। এর চেয়ে আর কিছু চাওয়া তাদের নেই।

৫. না ফেরার দেশে –যে গল্পের শেষ নেই
যারা সাতচল্লিশে দেশ ত্যাগ করেননি দেশত্যাগ করার সুযোগ থাকা সত্বেও—এই পুর্ব বঙ্গে, সেই সাতচল্লিশে, জিন্না সাহেবের মুসলমানদের পাকিস্তানে সেই হিন্দুরা, আবার নেহেরু সাহেবের হিন্দুস্তানে সেই মুসলমানেরা– থেকে গিয়েছিলেন মাটি কামড়ে, দেশের প্রতি তাদের ভালোবাসা ছিল দেশের নদী-নালা-গাছ-পালা-আলো-বাতাসের মতই অকৃত্রিম। তারা ধর্মকে থোড়াই কেয়ার করেছিলেন। তারা মনে করেছিলেন সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই। ধর্ম কখনো মনুষ্যত্বের বিরোধী হতে পারে না। যে ধর্ম মানুষকে ভাগ করে—মনুষ্যত্ব বিপন্ন করে তার নাম ধর্ম হলেও তা মূলত অধর্ম। তাকে মান্য করার কোনো মানে হয় না।

মানুষের জন্যই ধর্ম। ধর্মের জন্য মানুষ নয়। এইটাই সভ্যতা। এটাই আধুনিকতা। ধর্ম যার যার—রাষ্ট্র সবার। রাষ্ট্র ধর্মের জন্য নয়—রাষ্ট্র মানুষের জন্য। ধর্ম ব্যক্তি মানুষকে রক্ষা করে ধর্মের গণ্ডীর মধ্যে। আর রাষ্ট্র রক্ষা করে সমষ্টি মানুষকে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায়ের গণ্ডীর উর্দ্ধে উঠে। এই কারণেই রাষ্ট্র স্বাধীনতার ধারণা ছাড়া হতে পারে না। আর ধর্মের সঙ্গে স্বাধীনতার কোনো সম্পর্কই নেই। স্বাধীনতা এলে রাষ্ট্র সকল নাগরিকের দায় গ্রহণ করে।

এ কারণে একাত্তরে সব হারিয়েও স্বাধীনতা অর্জিত হলে রিক্ত-নিঃস্ব হিন্দুরা ফিরে এসেছে স্বদেশে। নতুন করে হারিয়ে যাওয়ার আতংক তাদের কাটতে শুরু করেছিল। কিন্তু স্বাধীনতার ৪২ বছর পরে দেখা গেল আবার অনেক মানুষ হারিয়ে গেছে। ১৮৯১ সালে যাদের সংখ্যা ছিল শতকরা ৪২ ভাগ—এখন এই ২০১২ সালে এসে, এই একশ' একুশ বছরে তাদের সংখ্যা কমতে কমতে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৯ ভাগে। ভোলাতে এই মানুষ হা্রিয়ে যাচ্ছে। দিনাজপুরে হারাচ্ছে। ফরিদপুরে-বরিশালে হারিয়ে যাচ্ছে, হারিয়ে যাচ্ছে সিরাজগঞ্জে-সাতক্ষীরায়। এখন শুধু হিন্দু হারাচ্ছে না। রামুতে-পটিয়াতে-উখিয়াতে বৌদ্ধরাও হারিয়ে যাচ্ছে। বানিয়ারচরে খ্রীস্টানরাও হারানো মানুষের মিছিলে শামিল হয়ে পড়েছে। কোনো না ভাবে সাত চল্লিশ থেকে একাত্তর পর্যন্ত পেলে পুষে রাখা সাম্প্রদায়িকতার বিষ-বৃক্ষটি এখন বেশ শক্তভাবে ডাল-পালা মেলেছে। শেকড় অনেক গভীরে ঢুকে পড়েছে। এই গাছে এখন ফলছে বিশ-ফল।
হারানো মানুষেরা কেউ ফিরছে না। কেউ ফেরাচ্ছে না।

৬. সেই অভেদ পাখির ডাকচিহ্ন
ঠিক এইখানে এসেই আমার চাচাজান নাইবউদিন আহমদের কথা মনে পড়ছে। আমাকে খুঁজতে আমার বাবা এসেছেন সেই ফরিদপুর থেকে ময়মনসিংহে চাচার বাসায়। ভোরবেলা নাইব চাচা উঠেছেন। আবার বাবাও উঠেছেন। দুজনে ব্রহ্মপুত্রের পাড় দিয়ে হাঁটছেন পাশপাশি। সূর্য জাগছে। নাইবচাচা পড়ছেন পবিত্র কোরানের কোনো আয়াত। আর আমার বাবা গুনগুন করে গাইছেন রামপ্রসাদের শ্যামা সঙ্গীত। এর মধ্যে একটি কাঠগোলাপ গাছের উপর একটি টুনি পাখি টুনটুন করে ডাকছে। শুনে দুজনেই দাঁড়িয়ে গেছেন। চুপ করে ডাকটিকে শোনার চেষ্টা করছেন। পাখিটিকে দেখতে পেয়েছেন। বাবা দেখাচ্ছেন নাইব চাচাকে। নাইব চাচা দেখাচ্ছেন বাবাকে। দুজনে দেখছেন একই পাখি। কোনো ভেদ নেই। এই অভেদ দর্শনে দুজনের চোখে-মুখেই আনন্দ। পাশে ছলছল করে ব্রহ্মপুত্র বয়ে যাচ্ছে। দূরে ট্রেনের শব্দ।
এভাবে মানুষ বাঁচে। এভাবে রাষ্ট্র বাঁচে। মানুষ হারিয়ে গেলে রাষ্ট্র বাঁচে না।

কুলদা রায়:লেখক ও গবেষক।