মহামারী চলছে, তবু নারীর প্রতি সহিংসতা কমছে না। ধর্ষণসহ নানা শারীরিক-মানসিক নির্যাতন অব্যাহত আছে। কোনও কোনও জরিপে জানা যাচ্ছে, গত এক বছরে নারীর প্রতি সহিংসতা না কমে উল্টো বেড়েছে।
২০২০ সালে 'মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন' এর এক জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ওই বছরের এপ্রিল মাসের চেয়ে মে মাসে নারী নির্যাতন ৩১ শতাংশ বেড়েছে।
এর বেশির ভাগই ছিল পারিবারিক সহিংসতা। গত বছর লকডাউনের সময় ঘরে বন্দি থাকাকালে প্রতিবন্ধী ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নারীরা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। নারী ধর্ষণের একাধিক খবরও এ সময়ে গণমাধ্যমে এসেছে।
লালসার ভয়ানক বিকৃতি দেখে অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে। একেকটা বীভৎস ঘটনা আরেকটিকে ছাপিয়ে যায়। কোনও কোনও ঘটনা জানা গেলে মানুষের মধ্যে কিছু প্রতিক্রিয়া হয়। প্রতিবাদে সভা-সমাবেশ হয়, ধর্ষকের শাস্তি দাবি করা হয়। আলোচিত দু-একটি ঘটনার হয়তো বিচার হয়, অপরাধীর শাস্তি হয়, তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভিকটিমরা ন্যায়বিচার বঞ্চিত থাকেন।
যেকোনও সামাজিক অনাচার-অনিয়মের মূল দায় বর্তায় সরকারের ওপর। সেজন্য কোনও কোনও ঘটনায় এমনকি সরকার প্রধান হিসেবে শেখ হাসিনার পদত্যাগও দাবি করা হয়। অপরাধ সংঘটিত হলে তাতে সরকার অবশ্যই দায় এড়াতে পারে না। কারণ মানুষের জীবন, সম্পদ এবং সম্ভ্রম নিরাপদ রাখা সরকারের একটি অন্যতম কর্তব্য। সে বিবেচনায় নারী নির্যাতনের ঘটনায় সরকার বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও দায়মুক্ত থাকতে পারেন না। ক্রমাগত ঘটে আসা এ কালান্তক ব্যাধির রাশ টেনে ধরতে ব্যর্থ হয়েছেন তিনি। এমনকি নিজের সংগঠনকেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি।
এ ধারণা থেকেই কোনও কোনও ঘটনার পর খুব নোংরা লেখা সম্বলিত ভুল বানানে প্লাকার্ড লিখে শেখ হাসিনার পদত্যাগ দাবি করতে দেখা যায়। বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা অসমীচীন নয়।
প্রশ্ন হলো, প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করলেই কি এ সমস্যার সমাধান হবে? যারা কথায় কথায় প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবিতে সোচ্চার, তারা আসলে ধর্ষণের মতো গুরুতর বিষয়কে পুঁজি করে ক্ষমতার রাজনীতির ঘুঁটি সাজান বলে মনে করার কারণ আছে। এটা আসলে সরকারকে চাপে ফেলে মূল ফোকাস থেকে দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে নেওয়ার অপচেষ্টা। এতে বিষয়ভিত্তিক আন্দোলনটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।ক্ষমতায় তো অনেকেই ছিল; আজ পর্যন্ত দেশে কোনো নারীবান্ধব সরকার আসেনি, নারীর অধিকারে নিরঙ্কুশ কাজ করেনি। ধর্ষণের মতো ভয়ঙ্কর মানসিক বিকৃতি নতুন করে সৃষ্টি হয়নি, আগেও ছিল। পূর্ববর্তী সরকারগুলোও প্রতিরোধে তেমন কোন ব্যবস্থা নেয়নি।
ধরেই নিলাম আজ বাদে কাল অন্য কেউ সরকারে আসবে। তাতে কি একেবারে ধর্ষণ ও নারীর প্রতি সহিংসতামুক্ত বাংলাদেশ পেয়ে যাবো আমরা? এমন ভাবনা যারা ভাবেন, তারা অলীক কল্পনায় মশগুল হয়ে আছেন বললে অত্যুক্তি হবে না।
এটা তো শুধু রাজনৈতিক সমস্যা নয়; এটা সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সংস্কৃতির সংকট। এটা নারীর প্রতি সামাজিক ও পারিবারিক দৃষ্টিভঙ্গিরও সমস্যা। এ সমস্যা একদিনে তৈরি হয়নি এবং এর দায় যেমন রাষ্ট্রের তেমনি ব্যক্তি, পরিবার, প্রতিষ্ঠান এবং সমাজেরও ।
সরকারের অনেক সিদ্ধান্ত বিশেষ করে বাঙালির শেকড় অন্বেষণের পরিবর্তে পাঠ্যক্রমে মৌলবাদভিত্তিক পরিবর্তন স্বাধীন মানস গঠনে বাধাগ্রস্ত করেছে। আবার পারিবারিক এবং সামাজিকভাবে পক্ষপাতমূলক পৃষ্ঠপোষকতার কারণে গোড়া থেকেই 'উচ্চতর' হিসেবে মানসিকভাবে ছেলেদের মধ্যে এক ধরনের ঔদ্ধত্য তৈরি হয়। ফলে জন্মের পর থেকেই নারীরা পারিবারিক ও সামাজিকভাবে নেতিবাচক আচরণের শিকার হতে থাকে।
তাছাড়া ধর্মের দার্শনিক চিন্তা-চেতনা ব্যতিরেকে শুধু দৃশ্যমান অভ্যাসগত দিকটিকে প্রাধান্য দেওয়ায় ধর্মের ভালো দিকগুলো আমাদের যাপিত জীবনে প্রভাব ফেলতে পারেনি। তাই ৯০ শতাংশ মুসলিমের দেশে মানুষ এত মিথ্যা কথা বলে, দুর্নীতি করে, ব্যভিচারে লিপ্ত হয়।
সুস্থ মনস্তাত্ত্বিক বিকাশের দিকটি প্রাধান্য না দেওয়া এবং এ জন্য প্রয়োজনীয় কাঠামো তৈরি না হওয়ার মতো কারণে আজ শুধু ধর্ষণ নয়, সমাজে বহুমাত্রিক অনাচারের সৃষ্টি হয়েছে। এ সম্মিলিত অনাচারের ছোবলে ক্ষত-বিক্ষত আমার প্রিয় মাতৃভূমি।
ব্যক্তির চেতনা বিনির্মাণে যথাযথ সুশিক্ষার মাধ্যমে নারী-পুরুষ-ধনী-দরিদ্র-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সব মানুষের প্রতি সম্মান ও মর্যাদার বিষয়টি নিশ্চিত করা গেলে মানুষের মনোজগতে প্রবলভাবে ইতিবাচক আলোড়ন তুলতে সক্ষম হবে বিশ্বাস করি।
ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করতে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব পরিহার করতে হবে সরকারকে। বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা কমিয়ে দোষীদের কঠিন এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা, সামাজিকভাবে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলা, নির্যাতিতাকে রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য মর্যাদা দেওয়ার মাধ্যমে ধর্ষণ থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যেতে পারে। রাষ্ট্র নিজ উদ্যোগে আন্তরিকতার সাথে প্রতিটি ঘটনায় এগিয়ে আসবে। সেইসাথে ধর্ষকের পরিবারকেও সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে। কারণ ছেলে সন্তানের বিকৃতির দায় পরিবারকে অবশ্যই বহন করতে হবে।
সব ঘটনার দায় যদি সরকারের ওপর বর্তায় তাহলে পরিবার একজনের দায় কেন নিতে পারবে না? কোনও ধর্ষক এবং সহযোগী যেন রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা না পেতে পারে সেদিকে যেমন সরকারের কঠোর নজরদারি থাকতে হবে, তেমনি সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় সব অপরাধ অপকর্ম সংঘটিত হয়- মানুষের এমন ধারণা দূর হওয়ার অবস্থাও তৈরি করতে হবে।
আমরা জানি, শেখ হাসিনা কঠিনে কোমলে মেশানো এক শক্তির আধার। সেটা উনি প্রমাণ করেছেন। তিনি রাজনৈতিক অঙ্গীকারে দৃঢ়, সাহসী। তিনি যা পারেন অন্য কেউ তা পারে না। তাকে দুর্বল না করে শক্তি জোগাতে হবে, সাহস জোগাতে হবে। অন্তত এ মুহূর্তে শেখ হাসিনার বিকল্প গ্রহণযোগ্য কেউ নেই।
আমি এখনো বিশ্বাস করতে চাই, শেখ হাসিনার শক্তিশালী নেতৃত্বই পারবে নারীর সপক্ষে কার্যকর ব্যবস্থা নিয়ে এ সংকট উত্তরণে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে। সবুজ শ্যামল সোনার বাংলা নারী পুরুষ নির্বিশেষে সকলের জন্য নিরাপদ আবাসভূমি হোক। অনেক ক্ষতচিহ্নের পরও আস্থা রাখতে চাই শেখ হাসিনায়।