হিসাবের গরুকে বাঘে খায় না!

শিশির ভট্টাচার্য্যশিশির ভট্টাচার্য্য
Published : 22 April 2021, 02:20 PM
Updated : 22 April 2021, 02:20 PM

"আপনারা সরকারি কর্মচারীগোতো মাস গেলেই বেতন। একদিন রিক্সা না চালাইলে আমাগো প্যাডে ভাত নাই। আমাগো দুঃখ আফনেরা ক্যামনে বুঝবেন? এইসব লকডাউন গরীবের পেটে লাথি দেওনের ধান্ধা।" এক সপ্তাহ লকডাউনের ঘোষণা শুনে বলছিল ঢাকার এক রিকশাওয়ালা। 

প্রথম করোনাবর্ষে সাধারণ ছুটির সময় গরীবদের ত্রাণ দেওয়া হয়েছিল, সরকারী ও বেসরকারী উদ্যোগে। মাস্ক পরা ও মাস্কখোলা দানবীরদের সেলফিতে ভরে গিয়েছিল মুখপুস্তিকা। দ্বিতীয় করোনাবর্ষে অতি আতঙ্কে কিংবা লকডাউনের আগে নিজের বাড়িতে খাদ্য মজুতের তাড়াহুড়োয় আমরা সবাই ভুলে বসেছি যে গরীবেরও পেট আছে এবং তাদের এখনও ক্ষুধা লাগে। 

"তুমি যারে নিচে ফেলো, সে তোমারে বাঁধিবে যে নিচে। পশ্চাতে ফেলিছ যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে।" বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। গরীবের সুরক্ষার উপর ধনীর সুরক্ষা নির্ভরশীল- সমাজ এ সত্য যত তাড়াতাড়ি হৃদয়ঙ্গম করবে ততই মঙ্গল। যতই মরুক, গরীবের সংখ্যা এত বেশি যে, মৃত্যু তাদের কাবু করতে পারবে না, অন্ততপক্ষে সমষ্ঠিগত ভাবে তো নয়ই। পক্ষান্তরে মহামারীতে একটি দেশের ধনী ও মধ্যবিত্ত সমাজ কিন্তু কমবেশি উজার হয়ে যেতে পারে। 

এর প্রমাণ আছে মধ্যযুগের দ্বিতীয় পর্বের (১০০০-১৫০০) ইংল্যান্ডে। সংখ্যালঘু ইংরেজ ভদ্রলোকেরা তখন সাধারণত ফরাসি বলতো আর সংখ্যাগুরু ছোটলোকেরা বলতো ইংরেজি। প্লেগে সদলবলে মরে-হেজে গিয়ে ভদ্রলোকদের সংখ্যা হ্রাস পেয়েছিল এবং সমাজের উচ্চতর স্তরে তথাকথিত 'ছোটলোকের বাচ্চা'দের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছিল। এর ফলে (যদিও এটাই একমাত্র কারণ নয়!) বড়লোকের ভাষা ফরাসি অপেক্ষাকৃত গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছিল এবং অবশেষে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল আপামর ইংরেজ ছোটলোকের মাতৃভাষা ইংরেজি, পাঁচ শতাব্দী পর যে ভাষা ভুলভাল 'লিখে-কয়ে' (হায় মাইকেল!) বাঙালিরা 'বড়লোক' হবার 'মধ্যগ্রীস্মরাত্রীকালীন মধুস্বপনে' মগ্ন। 

'গরীবের করোনা হয় না'- এ দাবি হয়তো সত্য নয়। কিন্তু গরীব যে করোনার বাহক হতে পারে- এ দাবি সর্বৈব মিথ্যা নাও হতে পারে। গরীবকে গৃহবন্দী করে করোনা-সংক্রমণ সীমিত রাখা যদি সরকারের উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, তবে অন্ততপক্ষে গরীবের পেটের ভাতের নিশ্চয়তাটুকু সরকারকে দিতে হবে। 

কীভাবে এটা করা যায়? কীভাবে সরকার জানবে, কার আর্থিক প্রয়োজন কেমন? 

হিসাবের গরুকে বাঘে খায় না। এ প্রবাদ থেকে বোঝা যায়, বাংলাদেশে এককালে প্রচুর চারণভূমি ছিল এবং বাঘেরও উপদ্রব ছিল। এখনও গরু প্রচুর আছে, বাঘ তেমন নেই, চারণভূমি নেই বললেই চলে। কিন্তু  দুর্নীতি নামক হিংস্র বাঘ আছে এবং বেহিসাবের কারণে সে বাঘ বাংলাদেশের উন্নয়নের বেশ কিছু গরু খেয়ে নিচ্ছে। এর ফলে ধনী অধিকতর সম্পদশালী হচ্ছে এবং গরীবের দারিদ্র্য দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে।

কীভাবে সব গরুকে হিসাবের মধ্যে এনে বাঘের থাবা থেকে তাদের বাঁচানো যায়? 

আমার প্রস্তাব হচ্ছে, বাংলাদেশের ভোটাধিকারপ্রাপ্ত নাগরিক মাত্রেরই একটি ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নম্বর বা টিন থাকবে। বাংলায় একে 'কর নির্ণায়ক সংখ্যা' বা 'কনিস' বলা যেতে পারে। 'মূসক' যদি গ্রহণযোগ্য শব্দ হয়, 'কনিস' হবে না কেন? 

করবৎসর শুরু হবে প্রতি পহেলা বৈশাখ। এটা চালু করতে পারলে বাংলা সন নিছক একটি উৎসব হয়ে থাকবে না, জনজীবনের অংশ হয়ে উঠবে। কোনো সংস্কৃতি ভালো হলেই যে মানুষ গ্রহণ করবে, এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। গ্রহণের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে হয়, অনেক ক্ষেত্রে বাধ্যও করতে হয়। 

প্রতি করবৎসর সমাপ্ত হলে বৈশাখ মাসে প্রত্যেক নাগরিক বাধ্যতামূলকভাবে জানাবে, তার বার্ষিক আয় ও ব্যয় কত ছিল। প্রত্যেকের আর্থিক সামর্থ্য এভাবে সরকারের জানা হয়ে যাবে। 

প্রত্যেক নাগরিকের একটি নগদ অ্যাকাউন্ট থাকবে। সময় ও সুযোগমতো বিস্তারিত ও বিজ্ঞানসম্মত একটি আদমশুমারী করা প্রয়োজন। এ আদমশুমারীতে অন্যান্য অপরিহার্য তথ্যের মধ্যে 'কনিস' ও নগদ নম্বরও উল্লেখিত থাকবে। 

ধনী-নির্ধন নির্বিশেষে সকল নাগরিককে একটা সমন্বিত অর্থ ও কর ব্যবস্থার আওতায় নিয়ে আসা সময়ের দাবি। 'হিসাবের গরুকে বাঘে খায় না!' আমার প্রস্তাব অভাবনীয় কিছু নয়। পৃথিবীর সভ্য দেশগুলোতে এ ব্যবস্থা বহু আগে থেকেই আছে। শুনেছি, বাংলাদেশ নাকি উন্নয়নশীল থেকে উন্নত দেশে পরিণত হচ্ছে। পদ্মা সেতু কিংবা মেট্রোই উন্নয়নের একমাত্র নিয়ামক হতে পারে না। উন্নয়নের প্রথম এবং প্রধান সোপান হওয়া উচিত একটি আধুনিক অর্থ ও করব্যবস্থা । 

আর্থিক সামর্থ্য যার কম, লকডাউনকালীন সে আবেদন করবে আর্থিক সাহায্য চেয়ে। মোবাইলে নগদ অ্যাকাউন্টে একটা ক্লিক করে নিজেই সে আবেদন করতে পারে, কিংবা নিকটস্থ পোস্ট অফিসে গিয়ে কোনো কর্মচারীর সাহায্যও নিতে পারে। নগদ যেহেতু ডাক বিভাগের প্রকল্প, সেহেতু ডাকঘরের কথাটা মাথায় আসলো। ডাকবিভাগ বহু আগে থেকেই আর্থিক লেনদেন করে আসছে। যুগের পরিবর্তনে চিঠিপত্র লেনদেন যেহেতু কমে গেছে, শতাব্দীপ্রাচীন ডাকঘরগুলো নতুন ভূমিকায় অবর্তীর্ণ হওয়া প্রয়োজন।

তথ্য যাচাইয়ের পর আবেদনকারীর প্রয়োজন এবং সরকারের সামর্থ্য অনুযায়ী নগদ অ্যাকাউন্টে প্রতিদিন বা প্রতি সপ্তাহে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ জমা হয়ে যাবে। এ টাকা অনুদান বা ঋণ হিসেবে দেওয়া যেতে পারে। ঋণ যদি হয়, তবে সে ঋণ অবশ্যই হবে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সুদমুক্ত। আগেকার দিনে রাজা-জমিদারেরা দুর্ভিক্ষ বা আকালের দিনে প্রজাদেরকে অর্থ বা শস্যঋণ দিতেন বলে অর্থশাস্ত্রে চাণক্য লিখেছেন। 

এ অর্থ কোনও মতেই অপচয় হবে না। দান কিংবা ঋণ হিসেবে প্রদত্ত অর্থ বাজারচক্রে ঢুকে দশ হাত বদল হয়ে যুগপৎ অর্থনীতির চাকা সচল রাখবে এবং কার্যকর ও অনলস মূলধন সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখবে। 

কাজীর সব গরু নিশ্চয়ই গোয়ালে থাকবে না, কিছু গরু শুধু কাগজেই থাকবে। অন্য সব কাজের মতো এই কাজেও দুর্নীতি অবশ্যই কিছু না কিছু হবে, উধোদের বেশ কিছু পিণ্ডি বুধোদের ঘাড়ে দিয়ে পড়বেই পড়বে। দুটি কারণে আমি এই বিশেষ ক্ষেত্রে দুর্নীতি নিয়ে শংকিত নই। প্রথমত, কিছু টাকা নয়-ছয় হলেও টাকাটা বাজারচক্রে ঢুকছে এবং এতেও অর্থনীতির লাভ। দ্বিতীয়ত, দুর্নীতির ভয়ে, সমাজের স্বার্থে দুস্থ মানুষকে অপরিহার্য সাহায্য না দেওয়া কোনো কাজের কথা হতে পারে না। চোরের ভয়ে কি আমরা থালা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে মেঝেতে ভাত মেখে খাবো? 

কনিস বা টিন এর আরও অনেক সুবিধা আছে। বাংলাদেশে সরকারি স্কুল-কলেজ-পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নামমাত্র মূল্যে উচ্চশিক্ষা দেওয়া হয়। 'ফ্যালো কড়ি, মাখো তেল!' তেলের প্রয়োজন সকলেরই আছে, কিন্তু কড়িতো সবার নেই। কড়ি যার দেদার আছে, তাকে না দিয়ে, যার নেই, তাকে দেওয়াটাই যুক্তিসঙ্গত। টিন বা কনিস থেকে জানা যাবে, কোন নাগরিকের আর্থিক সঙ্গতি কেমন এবং সেই অনুসারে সন্তানের শিক্ষাগ্রহণের মূল্য তাকে পরিশোধ করতে হবে। কোন শিক্ষার্থী উপবৃত্তি পাবে বা না পাবে, তাও নির্ধারিত হবে কনিস অনুসারে। 

রাস্তাঘাটে, জীবনের সর্বক্ষেত্রে যাবতীয় আইন-অমান্যের জন্য (ধরা যাক মাস্ক না পড়া কিংবা গাড়ি ভুল জায়গায় পার্ক করা) জরিমানার তথ্য অপরাধীর 'কনিস' বা 'টিন' এ লিপিবদ্ধ হবে এবং জরিমানার অর্থ নগদ অ্যাকাউন্টে সরকারের খাতে ডেবিট হয়ে যাবে। অপরাধী নিজের নগদ অ্যাকাউন্টে সে টাকা জমা করে জরিমানা দিতে পারবে। জরিমানার অর্থ বিলম্ব হলে তার জন্যও জরিমানার ব্যবস্থা থাকতে পারে। 

কনিস বা টিন এ ক্লিক করে জানা যাবে ব্যক্তির কর-চরিত্র। যারা আয় অনুসারে নিয়মিত কর দেন, আয়-ব্যয়ের হিসাব নিয়মমিত সরকারে দাখিল করেন, ত্রাণ তহবিলে দান করেন, জনসেবায় অংশ নেন, কোনো অন্যায়-দুর্নীতি করেন না, সেই সব 'টিনটিন' বা 'কনিস্ক' নাগরিককে সুনাগরিকের সনদ দেওয়া যেতে পারে। সুনাগরিককে চিকিৎসা, শিক্ষা, ভ্রমণসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার কথা ভাবা যেতে পারে।

যে কোনও সরকারী সুবিধা পাবার জন্যেই টিন বা কনিস থাকা বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত। জাতীয় পরিচয়পত্রেই কনিসসংক্রান্ত তথ্য লিপিবদ্ধ থাকতে পারে। প্রত্যেকের কনিস এবং নগদ একাউন্ট থাকা বাধ্যতামূলক করা গেলে, বর্তমান সরকারের ডিজিটাল সোনার (শোনার নয়!) বাংলার ঘোষণা অনেকটাই বাস্তবায়িত হয়ে যাবে।