মিতা হক: ‘রূপে তোমায় ভোলাব না’

আহমাদ মাযহারআহমাদ মাযহার
Published : 11 Feb 2012, 02:12 PM
Updated : 21 April 2021, 07:00 PM

১.

এ কথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না যে, রবীন্দ্রসংগীতে নিমজ্জিত সাধক মিতা হক ছিলেন আমাদের প্রজন্মের অগ্রগণ্য শিল্পী। সাধারণ সংগীত বোধসম্পন্ন মানুষের অনুভবেই ধরা পড়ে যে, তার কণ্ঠ যেমন ছিল সুরেলা তেমনি গানের ভাবকে তিনি ধারণ করতে পারতেন হৃদয় দিয়ে। রবীন্দ্রসংগীত তিনি যেমন অন্তর থেকে ভালোবাসতেন তেমনি এর জন্য যে তার গভীর দায়বোধ ছিল তা বোঝাও আয়াসসাধ্য ব্যাপার নয়! রবীন্দ্রসংগীত তার কাছে বাণিজ্যপণ্য হয়ে ওঠেনি, ছিল নিজের অনুভবের শিল্পিত প্রকাশ মাধ্যম! অন্য দিকে রবীন্দ্রসংগীতের শিল্পী হিসেবে তাঁর প্রধান পরিচয় থাকলেও পঞ্চকবির গানেও সমধিক পারঙ্গমতা ছিল!

২০২১ সালের ১১ এপ্রিল (রোববার) সকাল ৬টা ২০ মিনিটে রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি চলে গেলেন জীবনপারের সীমানা পেরিয়ে। ৫ বছর ধরে বিকল কিডনি ডায়ালাইসিস করে চলছিল জীবন যাপন। কিন্তু কদিন আগে করোনায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে যেতে হয় তাকে। দুর্ভাগ্য যে, করোনামুক্তির পর করোনা-উত্তর জটিলতা তাকে থাকতে দিল না; তারও স্থান হলো কেরানীগঞ্জের বড় মনোহারিয়ায়, বাবা-মায়ের কবরের পাশে। 

তার চলে যাওয়ার জন্য এটাই যথার্থ সময় নয়, কারণ তিনি জন্মছিলেন স্বাধীনতার মাত্রই অল্প আগে, ১৯৬২ সালের ৬ সেপ্টেম্বর! ষাট বছর বয়সও যে পূর্ণ হয়নি তার। জীবনবোধের যে পর্যায়ে পৌঁছেছিলেন সেখান থেকেই তো একজন শিল্পীর কাছ থেকে সমাজের আসল বস্তু পাওয়ার কথা। দীর্ঘ জীবনপথের দুর্গমতার অভিজ্ঞতা যে নির্দেশনা তাকে দিয়েছে তাকে উত্তরপ্রজন্মের হাতে তুলে দেওয়ার এখনই তো ছিল প্রকৃত সূচনাসময়!

মিতা হকের বাবা রেজাউল হক পেশায় ছিলেন মূলত সাংবাদিক, ব্যবসায়ও কিছুটা সাফল্য এসেছিল একসময়। কিন্তু কন্যাকে তিনি উদ্বুদ্ধ হতে দিয়েছিলেন শিল্পিত জীবনেই। তার চাচা বাংলাদেশের খ্যাতিমান সংগীতজ্ঞ, সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ওয়াহিদুল হকের সাংস্কৃতিকতাও তার মানস গঠন করেছে অনেকটা! তার কালের বিখ্যাত মানুষ দাদা মাজহারুল হকও ছিলেন সে কালের তুলনায় অগ্রসর ব্যক্তি। বৃটিশ উপনিবেশ আমলে অখণ্ড বাংলায় বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার তিনি ছিলেন নির্বাচিত সদস্য। মুসলিম পরিবারের রক্ষণশীলতা অতিক্রম করে তিনি হয়ে উঠেছিলেন সংগীতরসিক মানুষ। নিজের বাড়িতে উচ্চাঙ্গ সংগীতের আসর বসাতেন। নেতৃত্ব দানের ব্যক্তিত্ব মিতা হক হয়তো দাদার কাছ থেকে খানিকটা পেয়েছিলেন উত্তরাধিকার সূত্রেই। আমার প্রতি তার যে একটা আলাদা ভালোবাসা ছিল তার একটা কারণ হয়তো আমার নামের সঙ্গে নিজের দাদার নামের আংশিক মিল। 

২.

আশির দশকের মাঝামাঝি সময় তার গান প্রথম শুনি। খালেদ খানের সঙ্গে বিয়ের পর মাঝেমধ্যেই দেখা হতো এ দম্পতির সঙ্গে। কিন্তু ঘনিষ্ঠতা ও পারিবারিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে আরেকটু পরে, ১৯৮৯ সাল থেকে, তার একক সংগীতানুষ্ঠান আয়োজনের সূত্রে!

মিতা হকের কথা মনে এলেই মনে পড়ে শিল্প-সংস্কৃতিতৃষিত আমাদের যৌবন কালের কথা। স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে শিল্প ও জীবনরসিক চয়ন ইসলামের সঙ্গে কাটানো আমাদের তুমুল দিনগুলো। এখন রাজনীতিক হিসেবে বেশি পরিচিত হলেও আশির দশকে তিনি চেনা ছিলেন শান্তিনিকেতনে উচ্চাঙ্গ সংগীত শিখে ফিরে আসা প্রাণবন্ত একজন মানুষ হিসেবে। রবীন্দ্রসংগীত, পুরোনো দিনের বাংলা গান, কিংবা জনপ্রিয় হিন্দি গান যখন তখন গেয়ে উঠতেন। শান্তিনিকেতনের অতি রাবীন্দ্রিকতা তার ব্যক্তিত্বে তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি; অন্য দিকে সেখানে দীর্ঘকাল থাকার সুবাদে উন্নত সংগীত শুনে নিজের মধ্যে বৈচিত্র্যপূর্ণ ও পরিশীলিত রুচি তৈরি করে নিয়েছেন। সংগীতরসের আস্বাদনে তার মন উদার। আশির দশকের প্রথম দিকে কবি আসাদ চৌধুরী পরিকল্পিত ও উপস্থাপিত বাংলাদেশ টেলিভিশনের রুচিসম্মত ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান 'প্রচ্ছদ'-এ এখনকার তুলনায় অনেক ক্ষীণকায়া চয়ন ইসলাম কলকাতার মেয়ে লিলি গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে পুরোনো দিনের গান নতুন করে গেয়ে মাত করে দিয়েছিলেন। ফিলার হিসেবে এ যুগলের গাওয়া দুটি গান বিটিভিতে বহুবার প্রচারের সূত্রে পরবর্তী কালের চয়ন-লিলি দম্পতি তখন রীতিমতো বিখ্যাত। আমাদের বন্ধু শহীদ মনজুর শান্তিনিকেতনে পড়তে যাওয়া সূত্রে চয়ন ইসলামের সঙ্গে কথাসাহিত্যিক বন্ধু পারভেজ হোসেনের পরিচয়। সেই সূত্রেই শহীদ মনজু, পারভেজ হোসেন, শহিদুল আলম, আমি আর শিরীন বকুল মিলে একটা দল হয়ে উঠেছিলাম। পরে সাজ্জাদ শরিফও এ দলে যুক্ত হয়েছিল কিছুদিন। আমি যে সময়ের কথা বলছি তখন লিলি ইসলামের পরিচয়  কলকাতার মেয়ে লিলি গাঙ্গুলী হিসেবে, শান্তিনিকেতনের মনিপুরি নৃত্যগুরু জিতেন সিং-য়ের সঙ্গে ঢাকায় এসেছিলেন নৃত্য পরিবেশন করতে। পরে আরেকবার 'তাসের দেশ' নৃত্যনাট্যে অংশগ্রহণ করেছিলেন নৃত্যগুরু জিতেন সিংএর পরিচালনায়। চয়ন ইসলামের সঙ্গে সম্পর্কে জড়ালেও, তখনো তাদের বিয়ে হয়নি। আমরা তখন 'সংবর্ত' নামে একটা সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে তুলেছিলাম চয়ন ইসলামের নেতৃত্বে। সংগঠনের যাবতীয় ব্যয়ের পুরোটাই নির্বাহ হতো চয়ন ইসলামের পকেটের পয়সায়। কয়েকটি রুচিস্নিগ্ধ অনুষ্ঠান করেছিলাম আমরা। আমাদের লক্ষ্য ছিল বয়সে নবীন, স্বল্প পরিচিত, কিন্তু খুব ভালো শিল্পীদের নিয়ে অনুষ্ঠান করা। অনুষ্ঠানস্থল মূলত বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ছোট্ট ইসফেন্দিয়ার জাহেদ হাসান মিলনায়তন। কখনো সামর্থ্য হলে বড় কোনো হলে অনুষ্ঠান হবে এমন পরিকল্পনাও ছিল। আমাদের প্রথম অনুষ্ঠান ছিল সুমন চৌধুরী, খায়রুল আনাম শাকিল ও লীনা তাপসীর নজরুল সংগীত। বেশ প্রশংসিত হয়েছিল সে অনুষ্ঠান। তার পরই আমরা ভাবছিলাম কার একটা একক পরিবেশনার অনুষ্ঠান করা যায় তা নিয়ে। একদিনের আড্ডায় মিতা হকের নাম আমিই প্রস্তাব করি, চয়ন ইসলামও আগেই শুনেছেন তার গান, তিনিও জোর সমর্থন দিলেন আমার প্রস্তাবে। তখন পর্যন্ত ব্যক্তিগত পরিচয় না থাকলেও গান শোনার সূত্রে পারভেজেরও সমর্থন পাওয়া গেল। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও অগ্রজপ্রতিম আলম খোরশেদের নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের যুক্ততা সূত্রে মঞ্চ ও টিভির অভিনয়শিল্পী খালেদ খানের সঙ্গে আগেই সামান্য পরিচয় ছিল আমার। সেই সূত্রেই আমরা খালেদ খানের কাছে প্রস্তাব নিয়ে গেলাম। কারণ মিতা হকের সঙ্গে আমাদের কারো তখনো তেমন আলাপ ছিল না। খালেদ খান-মিতা হক রাজি হলেন আমাদের প্রস্তাবে।

বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের কম্পিউটারে কম্পোজ করে তৈরি করা হলো স্মরণিকার ব্রোমাইড। ৩০০ ডিপিআই লেজার প্রিন্টার থেকে অফসেট কাগজে প্রিন্ট নেয়া হয়েছিল ব্রোমাইডের। নিজেরাই কেটেকুটে আইকা দিয়ে পেস্ট করে তৈরি করেছিলাম স্মরণিকাটি। ডিজাইন ও মিতা হকের পরিচিতি আমার করা। তারপর ব্রোমাইডটির শ তিনেক কপি ফটোকপি করে নেওয়া হয়েছিল। ভাঁজ করে ও পিন লাগিয়ে নিজেরাই তৈরি করে ফেলেছিলাম সাশ্রয়ী অর্থব্যয়ের দীনহীন কিন্তু আন্তরিক স্মরণিকাটি! আমাদের আয়োজিত সেই অনুষ্ঠানই ছিল মিতা হকের প্রথম একক সংগীত পরিবেশনা। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ইসফেন্দিয়ার জাহেদ হাসান মিলনায়তন ছোট হলেও দর্শকে ভরা ছিল হল। বাইরেও ছিলেন উপচে পড়া দর্শক। সেই অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে আমাদের মধ্যে সেই যে পারিবারিক সম্পর্কের সূচনা- আমৃত্যু তা ছিল অটুট। ২০২০ সালে বাংলাদেশে গিয়ে তার সঙ্গে সময়াভাবে দেখা করতে পারিনি। সেজন্য টেলিফোনে তার কঠোর তিরস্কার শুনতে হয়েছে। আমাদের ছেলে সুদীপ্ত প্রিয়দর্শনের জন্মের সময় হাসপাতালে একেবারে প্রথম দিকে যারা দেখতে গিয়েছিলেন তাদের মধ্যে মিতা হক অন্যতম। প্রিয়-কে দেখে সেই যে ওর অভিধা দিলেন 'আলবিলাতি বাঘের নাতি' সেটা প্রিয় সম্পর্কে তার একটা স্থায়ী অভিধা হয়েই ছিল। মাঝে মাঝেই প্রিয়কে সেটা মনে করিয়ে দিতেন তিনি!

৩.

গানের স্কুলে গিয়ে গান শেখা হয়নি মিতা হকের। পরিবারেই তো ছিলেন সংগীতজ্ঞ চাচা ওয়াহিদুল হক। প্রথমে শেখা সেই চাচার কাছে। পরে দীর্ঘদিন ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খানের কাছে নিষ্ঠার সঙ্গে উচ্চাঙ্গ সংগীত শিখেছেন। ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খানের কাছে উচ্চাঙ্গ সংগীতের শিক্ষা গ্রহণের ফলে তার পক্ষে রবীন্দ্রসংগীতের ভাবের গভীরতাকে কণ্ঠে ধারণ করার জন্য যে সাংগীতিক বোধ ও সেই বোধানুকূল কলাপ্রকৌশল দরকার তা অর্জন সম্ভব হয়েছিল। অর্থাৎ একদিকে পরিবারসূত্রে সংগীতের সাংস্কৃতিকতায় তার ব্যক্তিত্বের বিকাশ অন্যদিকে উচ্চাঙ্গ সংগীতে নিবেদিত প্রকৃত সংগীতজ্ঞ একজন মানুষের কাছ থেকে পরিশীলনের শিক্ষা গ্রহণ- এই দুই ধারা তার সামগ্রিক সংগীত বোধকেই সমৃদ্ধ ও মজবুত করে তুলেছিল। ফলে তার কণ্ঠস্বরের জন্মগত সুরসামর্থ্য উপযুক্ত প্রশিক্ষণে পেয়েছিল পরিশীলিত এক রূপ; রবীন্দ্র সংগীত পরিবেশনে তার কণ্ঠব্যঞ্জনা হয়ে উঠেছিল স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্বে মণ্ডিত। উচ্চাঙ্গ সংগীতে ভালো তালিম থাকাতেই বোধ হয় তার রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশনায় কোনো ধরনের তথাকথিত 'রাবীন্দ্রিক' ভঙ্গিমা ছিল না। কারণ কোনো গুরুর কাছ থেকে তোতাপাখির মতো গান তুলে গাইতে গাইতে গায়িকা হয়ে ওঠেননি তিনি। সেজন্যেই হয়তো নজরুলের তথা পঞ্চকবির অন্যদের গান গাইতে গিয়েও ছিল না রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশনের অভ্যাসজনিত গায়নভঙ্গির বিশেষ প্রভাব। রবীন্দ্রসংগীতের শিল্পী হিসেবে পরিচিতি পাওয়ায় নজরুলের গান হয়তো জনসমক্ষে বেশি গাওয়ার সুযোগ হয়নি; অথবা এমনও হতে পারে, রবীন্দ্রসংগীতের ভাবলোকে নিমজ্জিত থাকতে থাকতে তাঁর শিল্পীসত্তা সেই ভাবেই ভাবিত থাকায় ও নিজেকে প্রকাশ করায় উদ্দীপ্ত থাকত।

বাণীর ভাব ও সুরের বোধ শিল্পীহৃদয়কে যেভাবে জাগিয়ে তোলে তার প্রকাশ ঘটাবার প্রয়াসের মধ্য দিয়ে শিল্পী হয়ে উঠেছেন তিনি। গান শেখানোর স্কুল তিনি চালাতেন বটে, বিনিময়ে অর্থও নিতেন না তা নয়, কিন্তু তার সার্বিক ব্যক্তিত্বেই গানকে ছাড়িয়ে টাকা বড় হয়ে ওঠেনি, শিল্প ছাড়িয়ে শিল্পীভাবের খ্যাতি বড় হয়ে ওঠেনি। তিনি নিজে যেমন সংগীতের মধ্য দিয়ে সত্তার সৌকুমার্যকে প্রকাশ করতে চাইতেন তেমনি উজ্জীবিত করতে চাইতেন তার শিক্ষার্থীদেরও। মিতা হক শিক্ষার্থীদের শিল্পীখ্যাতি অর্জনে লোভী করে তুলতে চাইতেন না, চাইতেন তাদের মধ্যে শিল্পার্থী হবার বাসনা জাগিয়ে তুলতে। 

৪.

এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার যে, তার পরিবারের কোন সদস্য কখনো তাকে তারকা বানানোর চেষ্টা করেননি, তারা চেষ্টা করেছেন তাকে রবীন্দ্র ভাবনার মর্মে পৌঁছে দিতে। তাদের এ শিক্ষাই মিতা হককে সমৃদ্ধ করে তুলেছিল, দেখিয়েছিল পথ। তিনি জোরের সঙ্গেই বলতেন, রবীন্দ্রসংগীতের সুরকে নিয়ে নিরীক্ষার কোন সুযোগ নেই, কারণ, তা রবীন্দ্রনাথকৃত কথা আর সুরের সমন্বিত বিন্যাস। এর কোনো একটাকে বিকৃত করলে আর যা-ই হোক তা আর রবীন্দ্রসংগীত থাকে না, হয়ে উঠবে ভিন্ন সংরূপ। সুতরাং রবীন্দ্রসংগীতের দর্শনটিকে মান্য করলে, সংগীত সহযোগ সৃষ্টিতে কিছু নিরীক্ষা চললেও তার সুর নিয়ে আর কোনো নিরীক্ষা চলে না। কারণ 'বিশেষ'টুকুতেই তার সাংগীতিকতার সংরূপতা। মিতা হক মনে করেন তার উত্তরপ্রজন্মের তরুণেরা এখনো রবীন্দ্রসংগীত শোনেন এবং ভালবাসেন, নিজেদের চিত্তকে পরিশীলিত করতে রবীন্দ্রসংগীতের কাছে বার বার তাদের ফিরে আসতেই হবে। তার নিজের সাংগঠনিকতা এই প্রত্যাশাকে এগিয়ে নেওয়ার জন্যই সবসময় সক্রিয় থেকেছে।

৫.

সেই ছোটবেলায়, ১১ বছর বয়সে, সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের শিশু প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে তিনি বার্লিনে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক শিশু উৎসবে অংশ নেন। ১৯৭৬ সাল থেকে তবলাশিল্পী ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খানের কাছে পদ্ধতিগতভাবে সংগীত শেখার সেই যে শুরু তা প্রবাহিত থেকেছে বিচিত্র ধারায়। সংগীতরসিকদের সংগঠন 'আনন্দধ্বনি'র সঙ্গে যুক্ত থেকে সংগীত সাধনায় মননশীলতার পথকে চিনে নিয়েছিলেন। একসময় ছায়ানটের রবীন্দ্রসংগীত বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব সামলাতে গিয়ে জেনেছেন সাংগঠনিকতাকে। বহু বছর ধরে 'সুরতীর্থ' নামে গানের স্কুল চালাতে গিয়ে অনুভব করেছেন ভারতবর্ষীয় গুরুশিষ্য পরম্পরাকেও। দেশব্যাপী রবীন্দ্রসংগীত ছড়িয়ে দেয়ার কার্যক্রম রবীন্দ্রসংগীত সম্মেলন পরিষদের 'সাধারণ সম্পাদক' এবং সহসভাপতি পদের গুরুদায়িত্বও সামলেছেন কিছুকাল। এর মধ্য দিয়ে তাঁর মধ্যে জেগে উঠেছিল জাতীয় ভাবের আকুতি। শিক্ষার্থীদের মধ্যে তিনি তা চেয়েছেন সংক্রমিত করতে। লক্ষ্যণীয় যে, বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের অনেক খ্যাতিমান রবীন্দ্রসংগীত শিল্পীই তার কাছ থেকে পয়েছে সেই পরম্পরার সম্পদ। 

৬.

বাংলাদেশ ও ভারতের প্রকাশনা মিলিয়ে তার গানের একক অ্যালবাম প্রায় ২৫টি।  এর মধ্যে ১৪টি ভারত থেকে ও ১১টি বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত। সংগীতে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য শিল্পকলা পদক (২০১৬) সহ বিভিন্ন সম্মাননা পেয়েছেন তিনি। বাংলাদেশ সরকার তাকে ২০২০ সালে একুশে পদক প্রদান করে।

কিন্তু তার জীবনের এইসব তথ্য কিংবা এসবের সম্পূরক তথ্যই কেবল তার শিল্পীসত্তা অনুভবের সম্পন্ন সূচক নয়! শিল্পী হিসেবে তার পরিচয়ের গভীরতা এসব কিছু অতিক্রম করেও অনেক বেশি!

৭.

এগুলো তো ছিল তার আনুষ্ঠানিক উদ্যোগ। এর বাইরেও কোনো রকম কৃতিত্ব দাবি না করে তিনি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের নন্দন চক্রের জন্য নিজে বিনা সম্মানীতে বহুবার গান গেয়ে, গান সম্পর্কে কথাবার্তা বলে, শিল্পীদের সঙ্গে যোগাযোগ ঘটিয়ে সহযোগিতা করেছেন। আমি নিজে ব্যক্তিগতভাবে সংগীতের নানা কলাপ্রকৌশলগত দিক সম্পর্কে তার কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছি। ২০১৯ সালে ধানমণ্ডির ভাড়া বাড়িতে প্রচুর সংখ্যক শিক্ষার্থী পরিবেষ্টিত তার সঙ্গে আমার শেষ দেখা। পরিবেষ্টন ভেঙে ছাত্র-ছাত্রীদের উপেক্ষা করে আমার সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ কথা বলেছিলেন তিনি!

৮. 

মিতা হক ব্যক্তিমানুষ হিসেবে ছিলেন খুব আন্তরিক। স্বামী খালেদ খানের অনেক ভাই-বোনদের সন্তানসন্ততিসহ তার বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীদের ও তাদের সন্তান-সন্ততিদেরও একটা হাট বসত যেন তাদের বাড়িতে। মিতা হকের শিল্পীসত্তার পাশাপাশি ছিল সংসারীসত্তাও। সংগীতের সাধনার জন্য কখনো কখনো নিভৃতির দরকার হয়। কিন্তু সে নিভৃতি ছাড়াই ছিল তার সাধনা। একজন সাধারণ মানুষের মতোই সংসারযাপন ছিল তার। নিজেই অনেক সময় রান্না করতেন। আমরা যারা তাদের পরিবারের বিপুল সংখ্যক বন্ধুমণ্ডলীর অংশ ছিলাম তাদের বিরাট একেকটা দলকে সব সময় তাদের বাড়িতে জমাট বেঁধে থাকতে দেখেছি। হয়তো সংসারী সত্তার একটু কমতি থাকলে সংগীত বিষয়ে তার মননশীলতার চর্চা আরও একটু বেশি হতো।

৯. 

আমি ব্যক্তিগতভাবেও মিতা হক-খালেদ খান দম্পতির কাছে কৃতজ্ঞ। ১৯৯৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আকস্মিকভাবে আমি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সঙ্গে দাপ্তরিক সম্পর্কচ্ছেদ করলে বেকার হয়ে পড়ি। সেসময় তার বাবা রেজাউল হক তরুণতর একজন ব্যবস্থাপক খুঁজছিলেন বেক্সিমকো কম্পানির আওতায় তার পরিচালনাধীন প্রেসের জন্য। মিতা হক আমার পক্ষে জোর সুপারিশ করায় বেক্সিমকোতে আমার চাকরিটা হয়েছিল। সেটা কেবল আমার গ্রাসাচ্ছাদন সংগ্রহের চাকরি ছিল না, সেটা ছিল আমার কর্পোরেট প্রাতিষ্ঠানিকতা অনুধাবনেরও মাধ্যম। মিতা হকের যে কোন সুপারিশকেই গুরুত্ব দিতেন বাবা রেজাউল হক। মিতা হকের জীবদ্দশাতেই এ লেখাটি সম্পন্ন হলে তিনি আমার কৃতজ্ঞতার কথাটি জানতে পারতেন। হায়, করোনা তাকে কেড়ে নেওয়ায় তার কাছে আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হলো না। লেখাটি পড়ে মিটিমিটি আর হাসা হলো না তার।

১০.

সংগীতে অনন্য অবদানের জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫৬তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে বাংলা একাডেমির 'রবীন্দ্র পুরস্কার', ২০১৬ সালে শিল্পকলা একাডেমির 'শিল্পকলা পদক', চ্যানেল আই 'আজীবন সম্মাননা' সহ নানা সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন তিনি। মিতা হক যে পর্যায়ের শিল্পী ছিলেন তাতে আরও অনেক পুরস্কারই তার প্রাপ্য ছিল। অকাল প্রয়াণ না ঘটলে আরো অনেক সম্মান তিনি হয়তো পেতেনও। যে সম্মাননা পেয়েছেন তা তাকে কিছুটা সামাজিক মর্যাদাও দিয়েছে, কিন্তু এসবই শিল্পী হয়ে ওঠার প্রেরণা ছিল না তার; তিনি শিল্পী হয়ে উঠতে চেয়েছিলেন রসিকহৃদয়কে সংগীতের ভালোবাসায় ভোলাতে। খ্যাতির ভূষণভারে ভরানো কিংবা পদকহারে সাজানোর অভিপ্রায় চালিকা ছিল না তার শিল্পীসত্তার; চাঁদের মতো অলখ টানেই তো রসিকমনে জোয়ারের ঢেউ ওঠে; সেই ঢেউ তোলাতেই ছিল তার প্রকৃত আনন্দ। তার সঙ্গে দীর্ঘদিনের মেলামেশায় তার সমগ্রসত্তার এই পরিচয়ই আমি পেয়েছি। যে যাত্রাকে সম্পূর্ণ করবার আগেই তাকে চলে যেতে হলো তার বেদনা যদি উত্তরপ্রজন্ম বহন করে নিয়ে চলে তাহলে 'চাঁদের মতো অলখ টানে' 'জোয়ারের ঢেউ তোলার' বাসনা তাদের মধ্যেও জেগে থাকবে; আর তাতেই হবে মিতা হকের শিল্পীসত্তার প্রকৃত চরিতার্থতা। এর জন্যে নিশ্চয়ই তার উত্তরপ্রজন্মে ও প্রজন্মান্তরে নিবেদিত প্রাণের অভাব হবে না।