পেট খালি থাকলে কেউ সাফল্যের বাজনা শুনবে না

বিভুরঞ্জন সরকারবিভুরঞ্জন সরকার
Published : 11 Feb 2012, 10:04 AM
Updated : 21 April 2021, 06:28 PM

মহামারী করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ তার মারণ-আক্রমণ অব্যাহত রেখেছে। প্রথম দফায় বাংলাদেশে করোনার আঘাত কিছুটা সংযত মনে হলেও দ্বিতীয় দফায় তার আচরণ একেবারেই বেপরোয়া মনে হচ্ছে। প্রতিদিন আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। বাড়ছে মৃতের সংখ্যা, সুস্থও হয়ে উঠছেন অনেকে। শুধু বাংলাদেশ নয়, আমাদের নিকট প্রতিবেশী ভারতের অবস্থাও প্রতিদিনই কারাপ হচ্ছে। 

প্রথম দফায় আমেরিকা ও ব্রাজিলে করোনার যে সংহারমূর্তি দেখা গিয়েছিল, দ্বিতীয় দফায় ভারতে সেরকম দেখা যাচ্ছে। পৃথিবী জুড়ে মানুষকে তবে এখন পেয়ে বসেছে মৃত্যুভীতি। কঠোর, শিথিলসহ নানান ধরনের লকডাউন, চালাচলে বাধার কারণে পৃথিবী অনেকটাই অবরুদ্ধ হয়ে আছে এক বছরের বেশি সময় ধরে। আবার কবে মানুষ মুক্ত জীবনের স্বাদ নিতে পারবে, কবে সবকিছু আবার স্বাভাবিক হবে, তা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না। করোনার ক্রমাগত ধরন বদল, এক দেশ থেকে আরেক দেশে তার তীব্রতার হেরফের এত অস্বাভাবিকভাবে ঘটছে যে, গবেষক-বিজ্ঞানীরাও হিমশিম খাচ্ছেন।

অবশ্য সবকিছু মিলিয়ে আশা করা হচ্ছে, ২০২২ পর্যন্তই বহাল থাকতে পারে করোনাঝড়। তারপর হয়তো আবার নতুন করে শুরু হবে সব কিছু। এরমধ্যেই করোনার টিকা বা ভ্যাকসিন আবিষ্কারে সফলতা পাওয়া গেছে। উৎপাদন ও বণ্টনে এখনও সমস্যা থাকলেও দুশ্চিন্তা কিছুটা দূর হয়েছে। করোনা নিয়ন্ত্রণে আসতে আসতে আরও কত প্রাণহানি হবে (ইতিমধ্যে সারা পৃথিবীতে প্রায় সাড়ে ত্রিশ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে), কারা থাকবেন, কারা থাকবেন না, কেমন হবে করোনা-উত্তর বিশ্বের চেহারা এসব নিয়ে জল্পনাকল্পনা চলছে, চলবে। মানুষ আরো মানবিক হবে নাকি হৃদয়হীনতা বাড়বে তা নিয়ে কৌতূহল আছে। রাষ্ট্রব্যবস্থা, সরকার পদ্ধতি, অর্থনৈতিক অবস্থা, সামাজিক সম্পর্ক সব কিছুতেই পরিবর্তনের সম্ভাবনা দেখছেন চিন্তক-গবেষকরা। পরিবর্তন ভালোর দিকে, না খারাপের দিকে সেটা এখনও অস্পষ্ট।

 কত মানুষের জীবনের বিনিময়ে আমাদের এ ধরিত্রীতে সুস্থিতি আসবে তা অজানা থাকলেও, ধরে নেওয়া যায়, সংখ্যাটা একেবারে কম হবে না। অনেক ঘরেই হয়তো নতুন করে আলো জ্বলবে, আবার অনেক ঘরে বেদনা-বিরহও স্থায়ী হবে। এমন অদৃশ্য অথচ ক্ষমতাবান মানব-শত্রু মানুষ আগে দেখেনি। শতবর্ষ পর পর প্রাণঘাতী রোগের কথা আমরা ইতিহাস থেকে জানছি। তাহলে কেন মানুষ শতবর্ষব্যাপী রোগ প্রতিরোধ বিষয়ে চিন্তা-গবেষণা করল না? গত একশ বছরে পৃথিবীতে শক্তিমত্তা দেখানোর জন্য, আধিপত্য বিস্তার ও প্রতিষ্ঠার জন্য কত আয়োজন-উদ্যোগ হয়েছে। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার উত্থান ও পতন হয়েছে, দুটো বিশ্ব যুদ্ধ হয়েছে, মারণাস্ত্র তৈরির জন্য কত সম্পদ নষ্ট করা হয়েছে। কিন্তু জীবনকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য, মানুষের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসার বিষয়টি হয়েছে চরমভাবে উপেক্ষিত। আজ তার মাসুল গুনছে উন্নত সভ্য বলে দাবিদার দেশগুলো। সভ্যতার এত বড় সংকট আগে আর কখনো দেখা যায়নি।

করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আঘাত হেনেছে আমাদের দেশেও। আমরা নিজেদের সুরক্ষার জন্য সময় পেয়েছি। তবে আমরা সময়ের সদ্ব্যবহার করতে পেরেছি, সে দাবি  জোর দিয়ে করতে পারা যাবে না। প্রথমবার যেসব অব্যবস্থা-অসঙ্গতি ছিল, দ্বিতীয় দফাতেও তার পুনরাবৃত্তি দেখা যাচ্ছে। স্বাস্থ্যখাতের দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার জন্য আমরা দূরদর্শিতার পরিচয় না দিয়ে জোড়াতালি দিয়ে চলার নীতিই অনুসরণ করেছি। স্বাস্থ্যখাতে জরুরি কেনাকাটায় সমন্বয়হনতার খবর সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। মূল্যবান স্বাস্থ্যসামগ্রী বিমানবন্দরে পড়ে ছিল মাসের পর মাস। আমাদের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা করোনার ভয়াবহতার বিষয়টি সেভাবে আঁচ করতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। তারা হয়তো ধরে নিয়েছিলেন, এ আর কী, কত বিপদ-দুর্যোগই তো আমরা মোকাবিলা করেছি। ঝড়-জলোচ্ছ্বাস আমাদের কাবু করতে পারেনি। সামান্য এক জীবাণু আমাদের বড় ক্ষতি করতে পারবে না। আমরা যুদ্ধজয়ী জাতি। তাই করোনাবিরোধী যুদ্ধে জেতাকেও আমরা সহজ মনে করেছিলাম। করোনা যে দুর্বল শত্রু নয়, এতদিনে তা সবারই বোঝা হয়েছে।

শুরুর দিকে সরকারের পক্ষ থেকে 'সব ঠিক হ্যায়' বলে স্বস্তির ঢেকুর তোলা হলেও, বাস্তবে কিছুই যে ঠিক ছিল না এখন আবার দেশে করোনা আক্রান্ত মানুষের এবং মৃতের সংখ্যা বাড়তে থাকায় টের পাওয়া যাচ্ছে। তবে আশার কথা এটাই যে,  করোনা যেমন তার দাপট দেখিয়ে চলছে, তার প্রবল তেজে ছড়িয়ে পড়ছে এক দেহ থেকে আরেক দেহে, তেমনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও অত্যন্ত সাহস নিয়ে, নির্ভয়তার সঙ্গে করোনা-প্রতিরোধ যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন। তবে এটাও স্বীকার করতে হবে যে, তিনি সঠিক সিদ্ধান্ত নিলেও তা বাস্তবায়নে ত্রুটি থাকছে। সরকারি প্রশাসন, সরকারি দল আগেও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দৌড়ে কুলাতে পারেনি, করোনাকালেও পারছে না। যদি বিদেশ প্রত্যাগতদের দেশে ছড়িয়ে পড়ার আগে কঠোরভাবে আইসোলেন, কোয়ারেন্টিনে রাখা যেত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে শিক্ষার্থীদের আনন্দ ভ্রমণের সুযোগ না দিয়ে ঘরে আটকে রাখা যেত, যদি সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে মানুষকে উৎসব ভ্রমণ থেকে বিরত রাখা যেত, যদি পোশাককর্মীদের নিয়ে অত্যন্ত দায়িত্বহীন আচরণ করা না হতো, যদি দেশের মানুষ সচেতন হতো, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলত, সাময়িক কষ্ট স্বীকার করে হলেও শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখত তাহলে আমরা করোনা মোকাবিলায় যে সফলতা পেতাম এখন তা পাচ্ছি না।

প্রধানমন্ত্রী প্রতিদিন যেসব নির্দেশনা দিয়ে থাকেন,  মাঠপর্যায়ে সব নির্দেশনা যথাযথ বাস্তবায়িত না হওয়ার অভিযোগ আছে।

প্রধানমন্ত্রীকে সহযোগিতার জন্য একটি মন্ত্রিপরিষদ আছে। কিন্তু এমন নিষ্প্রভ, উদ্যোগহীন, এমনকি যথাযথভাবে হুকুম তামিলেও অযোগ্য মন্ত্রীরা (ব্যতিক্রম হয়তো আছেন, তবে তা দৃশ্যমান নয়) বাস্তবে এখন প্রধানমন্ত্রীর ঘাড়ে বোঝা হয়ে আছেন বলেই অনেকে মনে করেন। প্রধানমন্ত্রী হয়তো কাজ করছেন তার প্রশাসনিক টিমের সহযোগিতায়। তবে আমাদের দেশের আমলাতন্ত্র মূলত জনবান্ধব নয়। যেহেতু সাধারণ মানুষের কাছে তাদের সরাসরি কোনো জবাবদিহিতা নেই, তাই সাধারণ মানুষের প্রতি তাদের সংবেদনশীলতাও কম। নিয়োগ কর্তার তুষ্টি বিধানেই তাদের সন্তুষ্টি। তাদের মধ্য সাহসের পরিবর্তে তোয়াজ করার মনোভাব থাকে। তারা সহজ কাজকেও অনেক সময় জটিল করে তোলেন। দেশে এখন সেই অবস্থা চলছে কিনা তা দেখবে কে? 

আমাদের দেশের মানুষ একটু কম ধৈর্যশীল। যাদের আছে তাদের মধ্যেই তাড়াতাড়ি পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা প্রবল। তাই কোনো ক্ষেত্রে প্রকৃত সংকট দেখা দেওয়ার আগেই চারদিকে হাহাকার শুরু হয়ে যায় । দরিদ্র, অসহায়, কর্মহীন মানুষই যে কেবল জীবনধারণের তাড়নায় অস্থির হয়ে উঠেন, তা নয়। গাড়িওয়ালা মানুষও দিন কয়েক ধৈর্য ধরতে পারেন না। চারদিকে শোনা যায় নাই নাই ধ্বনি। প্রথম দফায় সরকারের পক্ষ থেকে নানা ধরনের ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হয়েছে। হতে পারে ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কারণে বণ্টন ব্যবস্থায় কিছু সমস্যা হয়েছে। যাদের প্রকৃতই সাহায্য দরকার তাদের সঠিক তালিকাও হয়তো সঠিকভাবে হয়নি। 

কিন্তু না খেয়ে থাকার পরিস্থিতি দেশে হয়নি। সরকারি উদ্যোগের বাইরেও কিছু রাজনৈতিক-সামাজিক শক্তি, এমনকি ব্যক্তিগত উদ্যোগেও অভাবী মানুষকে সাহায্য-সহযোগিতা করা হয়েছে । আমাদের এটাও একটি সমস্যা যে, অভাবের কথা যতটা জোর দিয়ে প্রচার করা হয়,  অভাব মেটানোর বিভিন্ন উদ্যোগের খবরগুলো ততটা প্রচার পায় না। তবে এবার অবস্থা কিছুটা ভিন্ন দেখা যাচ্ছে। দিন এনে দিন খাওয়া অভাবী মানুষদের পাশে দাঁড়ানোর উদ্যোগ-আয়োজনে ঘাটতি লক্ষ করা যাচ্ছে। অথচ গত এক বছরে মানুষের অভাব-দারিদ্র্য-কর্মহীনতা সত্যি বেড়েছে। সাধারণভাবে মানুষের আয় কমেছে, ব্যয় বেড়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর দামও বাড়তির দিকেই। ফলে মানুষের মধ্যে উদ্বেগ ও হতাশা বেশি। 

মানুষকে সাহায্য-সহযোগিতা করা, দুঃসময়ে দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সাংবিধানিক দায়িত্ব সরকারের। এক্ষেত্রে সরকারের গাফিলতি, উদ্যোগহীনতা, অব্যবস্থাপনা থাকলে তার সমালোচনা হবেই। সরকারকে দোষারোপ সব দেশেই করা হয়। হয়তো আমাদের দেশে একটু বেশি হয়। এ জন্য ক্ষুব্ধ হওয়ার কিছু নেই। মানুষ সরকার এবং সরকার প্রধানের সমালোচনা করে নিজেদের মনের ক্ষোভ-হতাশা প্রকাশ করে কিছুটা মানসিক তৃপ্তি অনুভব করে। এজন্য ঢালাওভাবে মানুষের সমালোচনা করা ঠিক না। মানুষের জন্যই তো সরকার। মানুষকে আস্থায় নেওয়ার কোনো বিকল্প নেই।

দেশে সরকার কিংবা সরকার সমর্থিত গোষ্ঠীর বাইরে যারা তাদের সীমাবদ্ধ সাধ্য নিয়ে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ান, দাঁড়াতে চান, তাদের কাজের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি থাকা প্রয়োজন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেহেতু এখন জাতির অভিভাবকের ভূমিকা পালন করছেন সেহেতু তিনি যদি এসব উদ্যোগের প্রশংসা করে অন্যদের এগিয়ে আসতে বলেন তাহলে সুফল পাওয়া যেতে পারে বলে মনে হয়। যারা সরকারকে অনুদার ভাবছেন, তাদেরও মনোভাবে পরিবর্তন আসবে।

ত্রাণ বিতরণের সময় কে কোন দল করে, তা বিবেচনায় না নেওয়ার নির্দেশনা আগেরবারও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিয়েছিলেন। সেটা কতটুকু মান্য করা হয়েছে তা দেখার বিষয়। তিনি বলেছিলেন, দলমত-নির্বিশেষে মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখে তাদের তালিকা তৈরি করতে হবে। যার অবস্থা খারাপ, দুস্থ, যার ঘরে খাবার নেই, তার ঘরে খাবার পৌঁছে দিতে হবে। একই সঙ্গে ত্রাণ বিতরণে দুর্নীতি ও অনিয়ম কোনোভাবেই বরদাশত করা হবে না বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছিলেন তিনি। মানুষ এটাই চায়। যার প্রয়োজন তার হাতে ত্রাণ এবং ত্রাণ নিয়ে কোনো সামান্য দুর্নীতিও নয়। মনে রাখতে হবে অভাব মানুষকে দুর্বিনীত করে তোলে। করোনার দাপট মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসী নেতৃত্বের প্রতি মানুষের আস্থা তখনই দৃঢ় হবে যখন মানুষ দেখবে চোরেরা প্রশ্রয় পাচ্ছে না এবং মানুষ না খেয়ে থাকছে না।

সামনে ঈদ। সরকারকে এখনই পরিকল্পনা করতে হবে। মানুষকে সাহস জোগাতে হবে। কোনও মানুষ যেন ঈদের আনন্দ থেকে বঞ্চিত না থাকে। মানুষের দীর্ঘশ্বাস দূর করতে সম্ভব সব কিছুই করতে হবে সরকারকে। উন্নতি ও সমৃদ্ধির গল্প তখনই মানুষ বিশ্বাস করবে, যখন তারা দেখবে দুঃসময়ে সরকার তাদের সঙ্গে আছে। গাল ভরা বুলি নয়, মানুষ চায় দুবেলা পেট ভরে খেতে। মানুষকে খালি পেটে রেখে সাফল্যের বাদ্য বাজালে তা বেসুরোই লাগবে।