মাস্ক নিয়ে লুকোচুরি ও করোনাভাইরাসের হাসি

জি এম আরিফুজ্জামান
Published : 11 Feb 2012, 09:11 AM
Updated : 21 April 2021, 05:29 AM

করোনাভাইরাসের সাথে মাস্কের সম্পর্ক সাপে-নেউলের সম্পর্কের মত। একজন যদি হানা দেয়, আর একজন প্রতিরোধ করতে চায়। সাপে-নেউলের সম্পর্কটা দৃশ্যমান ,তবে মাস্কের সাথে করোনাভাইরাসের বিপরীত সম্পর্ক দৃশ্যমান না হলেও বৈজ্ঞানিকভাবে মোটামুটি প্রমাণিত। করোনাভাইরাস প্রতিরোধের পুরোপুরি কার্যকরী টিকা নিয়ে এখন পর্যন্ত স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরাই নিশ্চিত হতে পারেননি। 

বিশ্বের তিনটি টিকা তৈরিতে এগিয়ে থাকা বড় প্রতিষ্ঠান হচ্ছে ফাইজার-বায়োএনটেক, মডার্না ও অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা। ১৮ নভেম্বর ২০২০ তারিখের নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে, ফাইজারের তৈরি করোনাভাইরাসের (কোভিড ১৯) টিকা ৯৫ শতাংশ পর্যন্ত কার্যকর বলে দাবি করা হয়েছে। তবে, শর্ত হল, সেই টিকা মাইনাস ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় পরিবহন ও সংরক্ষণ করতে হবে। এক্ষেত্রে, এক দেশ থেকে বা এক অঞ্চল থেকে অন্য দেশ বা  অঞ্চলে পরিবহন করাটা একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ। ১৮ নভেম্বর ২০২০ তারিখে বার্তা সংস্থা রয়টার্সের খবর অনুযায়ী , যুক্তরাষ্ট্রের আরেক বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানি মডার্না ইনকর্পোরেশন তাদের তৈরি টিকা করোনা ঠেকাতে ৯৪ দশমিক ৫ শতাংশ কার্যকর বলে দাবি করে। এ টিকা রেফ্রিজারেটরে ২ থেকে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ৩০ দিন পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়। আর মাইনাস ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এটি সংরক্ষণ করা যায় ৬ মাস। এক্ষেত্রে, সংরক্ষণ ও পরিবহনের বিষয়টিও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকাটির একটি ডোজ ৬৪ শতাংশ কার্যকার বলেও ট্রায়ালে দেখা গেছে। এছাড়াও,  ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, করোনাভাইরাস প্রতিরোধে রাশিয়ার তৈরি টিকা স্পুৎনিক-ভি ৯১ দশমিক ৬ শতাংশ কার্যকর বলে দাবি করা হয়েছে।  ইউরোপীয় দেশ ও যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও বিভিন্ন দেশেও উল্লেখ করার মতো টিকা তৈরি হয়েছে। চীনা গবেষকেরা তৈরি করেছেন সিনোভ্যাক, ক্যানসিনো ও সিনোফার্ম নামের টিকা। সারা বিশ্বের বিভিন্ন বহুজাতিক ও ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সবচেয়ে কার্যকরী টিকা আবিষ্কারের চেষ্টা করে চলেছে। এ টিকাগুলো শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে বৃদ্ধি করে করোনাভাইরাসকে প্রতিরোধ করবে বলে আশা করা হচ্ছে, তবে পুরোপুরি নির্মূলের বিষয়টি এখনও অস্পষ্ট। 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনা ভাইরাসকে সারা বিশ্বব্যাপী মহামারী হিসেবে ঘোষণা করেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণা অনুযায়ী, এ ভাইরাসের মোকাবেলার জন্য পাবলিক প্লেসে মাস্ক ব্যবহার করা, নিয়মিত ২০ সেকেন্ড ধরে হাত ধোওয়া, কমপক্ষে ৩ ফুট সামাজিক বা শারীরিক দূরত্ব মেনে চলার বিষয়টিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এগুলোর মধ্যে মাস্কের ব্যবহারকে অনিবার্য করা হয়েছে। সঠিক ও কার্যকরীভাবে মাস্ক ব্যবহার এ ভাইরাসকে অনেকটা নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম।  

মাস্কের ব্যবহার যত কম থাকবে, সংক্রমণের হার তত বাড়তে থাকবে। বাংলাদেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে বাংলাদেশের অনেক মানুষের মধ্যে মাস্ক ব্যবহারের অনীহার বিষয়টি স্পষ্ট। মাস্ক ব্যাবহার নিশ্চিত করতে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হচ্ছে, জরিমানা করা হচ্ছে ,বিভিন্ন ধরনের জন সচেতনতামূলক কর্মসূচি পরিচালিত হচ্ছে। এর পরেও মাস্ক ব্যবহারের ক্ষেত্রে চিত্র হতাশাজনক। সঠিক ভাবে মাস্ক ব্যবহারের পরিবর্তে কেউ থুতনিতে ঝুলিয়ে রাখছে, কেউ বা ব্যাগ বা পকেটে রেখে দিচ্ছে। মাস্ক একদম না থাকলে সাময়িক সময়ের জন্য অপরের এক টুকরো কাপড় বা বিশেষ ভঙ্গিমায় হাত দিয়ে মুখ ঢেকে রাখার চেষ্ঠা করে যাচ্ছে। বিভিন্ন উন্মুক্ত জায়গায়, বাজারে, মার্কেটে , পিকনিক ও পর্যটন স্পটে মাস্ক ছাড়া অনেক মানুষ অহরহ ঘুরে বেড়াচ্ছে। করোনাভাইরাসে আদলের মুখোশ ব্যবহার করে তুচ্ছ তাচ্ছিল্যভাবে বিভিন্ন মাঠে ময়দানে খেলা দেখাচ্ছে কেউ কেউ । অনেক মানুষের মধ্যে করোনাভাইরাসের অস্তিত্বের বিষয় নিয়ে রয়েছে কাল্পনিক প্রশ্ন। আবার, এক শ্রেণির মানুষ সব জায়গায় মাস্ক ব্যবহার না করলেও যেখানে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতি চোখে পড়ছে, সেখানেই মাস্ক ব্যবহার করছেন। মনে হয়, তারা  ভাইরাস সংক্রমণের ভয়ে নন বরং জরিমানা বা শাস্তির ভয়ে মাস্ক ব্যবহার করছেন। মাস্ক নিয়ে এ লুকোচুরি বাড়াচ্ছে করোনার হাসি। ফলে,  সংক্রমণ বেড়েই চলেছে , মৃত্যুহার বেড়ে চলেছে।  

২০২০ সালের ৮ মার্চ  বাংলাদেশ সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের থেকে বাংলাদেশে তিনজন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে প্রথমবারের মত জানানো হয়। সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয় মার্চ মাসের ১৭ তারিখে।  বাংলাদেশ সরকার প্রথম দিকে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে। ২২ মার্চ, থেকে ৩০ মে পর্যন্ত সাধারণ ছুটি কার্যকরী ছিল। কার্যকরী লকডাউন এবং মানুষের মাস্ক ব্যবহার ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কারণে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ২০২০ সালের জুলাই মাসের পর থেকে কমে এলেও, পুনরায় ২০২১ সালের মার্চ মাস থেকে আবার বাড়তে শুরু করে। বাংলাদেশে বিশ্বের বিভিন্ন ধরনের করোনাভাইরাসের স্ট্রেইন পাওয়া গিয়েছে। যুক্তরাজ্যে পাওয়া করোনাভাইরাসের নতুন স্ট্রেইন 'এন৫০১ওয়াই' জানুয়ারি ২০২১ সালে বাংলাদেশেও পাওয়া গিয়েছে। ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে জানানো হয়,  ব্রিটিশ সরকারের বিজ্ঞানীরা যুক্তরাজ্যের নতুন স্ট্রেইনটিকে অন্য সব স্ট্রেইনের তুলনায় উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করছেন এবং এটি আর বেশি সংক্রামক। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে পাওয়া  দক্ষিণ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট সবচেয়ে শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। এ বছরের ৭ এপ্রিল বিবিসি বাংলার একটি প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, বাংলাদেশে আক্রান্তের ৮১ শতাংশই দক্ষিণ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্টর সংক্রমণ বহন করছেন।  বাংলাদেশের একটি বিরাট অংশ টিকার আওতায় এলেও মাস্ক ব্যবহারের অনীহা, সামাজিক দূরত্ব বজায় না রাখা এবং স্বাস্থ্য বিধি যথাযথভাবে পালন না করার কারণে দিনের পর দিন সংক্রমণ ও মৃত্যু হার বেড়েই চলেছে। সবশেষ, ২০২১ সালের ১৮ এপ্রিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, করোনাভাইরাসের কারণে  আগের ২৪ ঘণ্টায় দেশে ১১২ জনের মৃত্যু হয়েছে,  যা বাংলাদেশে একদিনে সর্বোচ্চ সংখ্যক মৃত্যুর রেকর্ড।

ইতিমধ্যে বাংলাদেশ সরকার কার্যকরী লকডাউনের ঘোষণা দিয়েছে। তবুও , থেমে নেই মানুষের ঘরের বাইরে আসা। প্রয়োজনে ঘরের বাইরে এলেও মাস্ক ব্যাবহারের রয়েছে চরম অনীহা।  জনস্বাস্থ্য বিজ্ঞানীরা মাস্ক ব্যাবহারকে করোনাভাইরাস প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকরী পন্থা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। টিকা নিলেও জোরালোভাবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশমতো স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে । মাস্কের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা না গেলে এবং জনগণ যদি মাস্ক ব্যবহার নিয়ে লুকোচুরি খেলে ,তবে করোনাভাইরাসের মুখের হাসি বাংলাদেশের জন্য হয়ে উঠবে আরও  বেশি ভয়ঙ্কর।