‘লকডাউন’ এর ফলাফল বুমেরাং হবে না তো?

শরীফা উম্মে শিরিন
Published : 20 April 2021, 10:30 PM
Updated : 20 April 2021, 10:30 PM

দ্রুত রূপ বদলাতে সক্ষম কোভিড-১৯ সারা পৃথিবীর ভিত নাড়িয়ে দিয়েছে। অনুন্নত, উন্নয়নশীল, উন্নত এমনকি মহাপরাক্রমশালী দেশগুলোর কোনওটাই বিপর্যস্ত এবং নাস্তানাবুদ হতে বাকি নেই । 

২০২১ সালের জানুয়ারি শেষ থেকে গোটা ফেব্রুয়ারি মাস বাংলাদেশে সংক্রমণের হার অনেক কম (২৫০ থেকে ৪০০ জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ) ছিল। মার্চের শেষ থেকে বাংলাদেশে সংক্রমণ ব্যাপকহারে বাড়ছে। একে বাংলাদেশে কোভিড-১৯ সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ বলা হচ্ছে। 

এপ্রিলের শুরু থেকে সংক্রমণের সংখ্যা সাত হাজারের উপরে থাকছে। তবে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ মোকাবেলায় গত একবছরে বিভিন্ন সময়ে গৃহীত সরকারি সিদ্ধান্তের (কিছুটা অপরিকল্পিত) ফলে নিম্নবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের ভোগান্তির শেষ নেই। 

গত ১৪ থেকে ২১ এপ্রিল পর্যন্ত সরকার 'সর্বাত্মক লকডাউন' এর সিদ্ধান্ত নেয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে এদেশের লকডাউন মডেল অন্যান্য দেশের মতো নয়। ঢিলেঢালাভাবে ছুটির আমেজ নিয়ে চলে। 

ফলে লকডাউনের যে উদ্দেশ্য- জনগণকে ঘরের মধ্যে রাখা, গণজমায়েত থেকে বিরত রাখা, এটা আর হাসিল হচ্ছে না। 

'লকডাউন' এ অকার্যকর ফলাফল হবে সেটা মোটামুটি সবার জানাই ছিল। শুধু জানা ছিল না নীতি-নির্ধারকদের। কারণ, সকল কল-কারখানা খোলা রেখে যোগাযোগ বন্ধ করে লকডাউন ঘোষণা করলে কী আর এর চেয়ে ভিন্ন কিছু আশা করা যায়! 

এ অপরিকল্পিত নামসর্বস্ব 'লকডাউন' বুমেরাং হয়ে বিক্ষোভের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে, যাতে করোনাভাইরাস সংক্রমণ আরও বাড়তে পারে।  

সংক্রমণের রাশ টেনে ধরতে সরকার আবারও দ্বিতীয় ধাপে ২২ থেকে ২৮ এপ্রিল 'সর্বাত্মক লকডাউন' ঘোষণা করেছে। এ 'লকডাউন'-ও কাজ করবে বলে মনে হয় না। দেড় বছরে নেওয়া কোনও পদক্ষেপই সঠিকভাবে কার্যকর হয়নি। কারণ গোঁড়ায় গলদ ছিল। নানাবিধ ত্রুটি-বিচ্যুতি সম্বলিত প্রাইভেট কারবান্ধব বিলাসী কিন্তু অপরিকল্পিত হাফ-লকডাউন, ফুল লকডাউনে- দেশের খেটে খাওয়া ও স্বল্প আয়ের মানুষের নাভিশ্বাস তুলে ছেড়েছে। অর্থনীতি মানে কেবল জিডিপি-তে প্রবৃদ্ধি নয়!  

গতবছরের মত এ বছরও লকডাউনে ঢাকা শহর ত্যাগের চিত্র আমরা সবাই দেখেছি। এমনকি সর্বাত্মক লকডাউন কার্যকর হওয়ার আগ মুহূর্ত (১৩ এপ্রিল) পর্যন্ত ব্যক্তিগত গাড়ি, পিকআপ ভ্যান, ট্রাক ও ট্রাকের ড্রামে করে শহরত্যাগী ঘরমুখী মানুষের ভিড়ে রাজধানীর রাস্তায় ব্যাপক যানজটের সৃষ্টি হয়। সর্বাত্মক লকডাউনের আগের দিন মুভমেন্ট পাসের জন্য প্রথম ঘণ্টায় ১ লাখ ২৫ হাজার মানুষ আবেদন করেছেন। প্রতি মিনিটে ১৫ হাজার আবেদন জমা পড়েছে। পুলিশ প্রায় সাড়ে তিন লাখ মুভমেন্ট পাস ইস্যু করেছে। তাছাড়া মুভমেন্ট পাস ছাড়া লকডাউন দেখতে আসা, নববর্ষের দাওয়াতে যাওয়া, কিংবা শিং মাছ কিনতে যাওয়া মানুষের সংখ্যাটাও কম নয়। বেকায়দায় পড়েছেন রিকশাচালক, ভ্যানচালক, বিক্রয়কর্মীরা! তারা বের হলেই জীবিকা অর্জনের একমাত্র অবলম্বন রিকশা-ভ্যান উল্টিয়ে ও টায়ারের হাওয়া ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে সিটি কর্পোরেশনের গ্যারেজে রিকশা আটক রাখা হচ্ছে। সেটি কবে ফেরত পাবেন, কি আদৌ পাবেন না, বা তার জন্য কত টাকা ব্যয় করতে হবে সেটার নিশ্চয়তা নেই! এসব ত্রুটি-বিচ্যুতির দিকে খেয়াল না করেই আবারও দ্বিতীয় মেয়াদে 'লকডাউন' গড়ানোর ঘোষণা দেশের বাস্তবতায় কতটা কার্যকর- সেটি সন্দেহের অবকাশ তো রাখেই। 

সাধারণ ছুটি, লকডাউন বা সর্বাত্মক লকডাউন কোনটাই কেন কার্যকর হচ্ছে না সেটা নিয়ে ভাবা দরকার। দেশের অর্থনীতি টিকিয়ে রাখার জন্য 'সীমিত পরিসর' বলতে যে টার্ম ব্যবহার করা হয় সেটাও করোনাভাইরাস মোকাবেলার জন্য কতটা উপযুক্ত তা পর্যালোচনা করা হয় না। দেশের মানুষ ও অর্থনীতির জন্য কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া যুক্তিসঙ্গত ও বাস্তবসম্মত সেসব বিষয়ে তেমন ফলপ্রসূ আলোচনার উদ্যোগ দেখা যায় না। সারা পৃথিবী লকডাউনের সুফল পেলেও বাংলাদেশের সুফল না পাওয়ার বাস্তবসম্মত কারণগুলো আমরা জানি। 

মার্চের শেষ সপ্তাহেও যখন করোনাভাইরাসের সংক্রমণ হু হু করে বাড়তে শুরু করলো তখনই সরকার থেকে ১৪ এপ্রিল সর্বাত্মক লকডাউনের ঘোষণা আসতে পারতো। পাল্টা তখন সরকারপক্ষের কেউ কেউ বলেছেন, 'লকডাউন এর চিন্তা করছে না'! তখন ঘোষণা আসলে মানুষের একটা দীর্ঘমেয়াদী প্রস্তুতি থাকতো। উৎপাদন চালু রাখার জন্য শিফটভিত্তিক কাজ চালুর পরিকল্পনা করা যেত। 

আবার ছুটি শুরু হওয়ার আগে কর্মঘণ্টা বাড়িয়ে কোনও কোনও সেক্টরে মাসিক কাজের টার্গেট অর্জন করাও সম্ভব ছিল। রাতে বা দিনে পালা করে সেক্টর ভিত্তিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান খোলা রাখা যেত। 

১২ এপ্রিল ৩৪ হাজার ৯৬৮ জনের নমুনা পরীক্ষায় ৭ হাজার ২০১ জন (শনাক্তের হার ২০.৫৯) নতুন রোগী শনাক্ত হয়। কিন্তু এ লকডাউনে নমুনা পরীক্ষা অনেক কমে গেছে। ১৫-১৯ এপ্রিল পর্যন্ত যথাক্রমে ১৯,৯৫৯, ১৮৯০৬, ১৬১৮৫, ১৯৪০৪, ২৪১৫২ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এ কয়দিনে নতুন রোগীর সংখ্যা তিন থেকে সাড়ে তিন হাজারের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। অথচ দুইদিন আগে (১৩ এপ্রিল) নতুন রোগীর সংখ্যা ছিল ৬ হাজার ২৮ জন, নমুনা পরীক্ষা হয়েছে ৩২ হাজার ৯৫৫ জনের। তার মানে লকডাউনে একদিনের ব্যবধানে  সংখ্যা কমে গেল? মাত্র চব্বিশ ঘণ্টায় সুফল পেতে শুরু করেছি আমরা? মোটেও তা নয়। 

বরং লকডাউনে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকার কারণে নানান প্রটোকল ডিঙিয়ে উপসর্গ বহন করা ব্যক্তিরা নমুনা পরীক্ষা করা থেকে বিরত থেকেছেন। এভাবে রোগীরা নমুনা পরীক্ষাকরণে অনাগ্রহী হওয়াটা ভয়াবহ। এতে সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যাবে না। এসময়ে রাস্তায় ঘটে যাওয়া নানা অপ্রীতিকর ঘটনা, মুভমেন্ট পাস নেওয়ার প্রক্রিয়াটি বড় অংশের মানুষের অবগত না থাকা বা প্রযুক্তি জড়তা থাকাটাও সম্ভাব্য করোনাভাইরাসে সংক্রমিত রোগীদের অনাগ্রহের মূল কারণ হতে পারে। 

কার্যকর হয় না জেনেও গত দেড় বছর পরে বিকল্প চিন্তা না করে কেন লকডাউনের মতো পদক্ষেপ নিতে হলো সেটাও বোধগম্য নয়। বারবার একই অফলপ্রসূ পদক্ষেপ নেওয়া আমাদের চিন্তার অসারতাকে প্রমাণ করে। 

আমাদের বুঝতে হবে এদেশের মানুষ ইউরোপ-আমেরিকার মতো শিক্ষিত, সচেতন বা বিত্তশালী নয়। এদেরকে কাজ করে খেতে হয়, কাজের জন্য বাইরে যেতে হয়। আর সরকার নামমাত্র যে ত্রাণের ব্যবস্থা করে সেটা নানা ঘাট পার হয়ে নিম্নবিত্তের হাতে যখন পৌঁছায় তাতে তাদের তিনবেলা চলে না। 

সবচেয়ে দু:খজনক হলো গত এক বছরে দেশের পরিবহন, স্বাস্থ্যখাত ও অন্যান্য কোনো কিছুতেই পরিবর্তন হলো না। অথচ সবকিছু ঢেলে সাজানোর সুযোগ করে দিয়েছিল এ করোনাভাইরাস সংক্রমণ। 

'নতুন হাসপাতাল নিবিড় সেবা দিচ্ছে'- এমন খবরের বদলে বরং দুইটি হঠাৎ গজিয়ে ওঠা করোনা হাসপাতাল গায়েবের তথ্য পেলাম আমরা। বাসে ৬০ শতাংশ ভাড়া বাড়িয়ে স্বামী-স্ত্রীকেও অতিরিক্ত ভাড়া গুণে আলাদা সিটে যেতে বাধ্য করা হয়েছে।

কোটিকোটি টাকা অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয় না করে করোনাভাইরাসের স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় এমন অত্যাধুনিক এক হাজার বাসও তো সারাদেশে নামানো যেত! পাশাপাশি সাথে পরিবহন সংশ্লিষ্ট সকলকে সবসময়ের জন্য স্বাস্থ্যবিধি ও পরিচ্ছন্নতার নির্দেশ মানতে বাধ্য করা যেত। 

সারা বিশ্ব যখন লকডাউনের বিকল্প চিন্তা করেছে তখন বাংলাদেশ নতুন করে লকডাউনের সিদ্ধান্তু নিচ্ছে। তার মানে বিশ্ব থেকে আমরা কতটা পিছিয়ে আছি!

প্রথম প্রজন্মের ভ্যাক্সিনের নানা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকতে পারে। বৈশ্বিক গণমাধ্যমে খবর আসছে, করোনাভাইরাসের যে বিভিন্ন স্ট্রেইন বা ধরন রয়েছে তার কোনও কোনওটায় কোনও কোনও ভ্যাকসিন খুব কম সক্রিয়।   

ঘরে বদ্ধ হয়ে বাংলাদেশের মতো একটি দেশের মানুষের পক্ষে সাত দিন থাকাও খুব কঠিন। জীবিকার তাগিদেই জীবনকে তারা উপেক্ষা করবে- সেটাই স্বাভাবিক। আর তাছাড়া করোনাকাল শেষ হওয়ার সহসাই কোনও নিশ্চয়তা তো নেই! 

অর্থাৎ দেশের অর্থনীতি একবারেই ভেঙ্গে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এমন চলতে থাকলে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ না খেয়ে মরবে, যোগাযোগ বন্ধ থাকলে অন্যরোগের চিকিৎসার অভাবেও মানুষ মারা যাবে। 

বরং সবকিছু লকডাউনের বিকল্প পদ্ধতি খোঁজা জরুরী হয়ে পড়েছে। বরং কর্মঘণ্টা বাড়িয়ে শিফটভিত্তিক কাজ, খাত অনুযায়ী কাজের সময়ের শিডিউল, স্বাস্থ্যবিধি মানতে পর্যাপ্ত নজরদারির ব্যবস্থা করে সবাইকে সচেতন করেই করোনাভাইরাসের মোকাবেলা করতে হবে। 

আর এটা শুধু সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয়, প্রত্যেক নাগরিকের যার যার জায়গা থেকে সচেতন হয়ে বিশ্বব্যাপী এ মহামারী মোকাবেলায় সরকারকে সহযোগিতা করতে হবে। 

পরিস্থিতি যে আরও খারাপ হবে না সেটি কে বলতে পারে? সংক্রমণ যে আরও বাড়বে না- তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। বিশ্বের দেশে দেশে আমরা লকডাউনের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষদের বিক্ষোভ দেখেছি। খোদ আমেরিকাতেই বিক্ষোভ হয়েছে। এখনই বিকল্প চিন্তা না করে কেবল 'লকডাউন' দিতে থাকলে ফলাফল বুমেরাংই হবে- এটা বুঝতে জ্যোতিষ শাস্ত্র পড়া লাগে না।