স্বাধীনতার ৫০ বছর: প্রথম সাফ স্বর্ণজয়ী মুজিবর

নাজমুল হক তপন
Published : 20 April 2021, 03:00 AM
Updated : 20 April 2021, 03:00 AM

কিংবদন্তীর সাঁতারু ইংলিশ চ্যানেল বিজয়ী ব্রজেন দাস কাঁদছেন অঝোরে। জড়িয়ে ধরে আছেন মুজিবর রহমান মল্লিককে। বাকিদের চোখ ভেজা। প্রথম সাফ স্বর্ণজয়ের একটা খণ্ড চিত্র এটি।

কাঠমান্ডু। ১৯৮৪ সালের প্রথম সাফ গেমস। সময়ের ডানায় চেপে একের পর এক দিন চলে যাচ্ছে। শেষ হচ্ছে ইভেন্টের পর ইভেন্ট। অন্য দেশগুলো সোনা জিতছে। নাগাল পাচ্ছে না কেবল বাংলাদেশ। ঘরোয়া আসরে পুলে নামলেই ৭/৮টা করে সোনা জেতেন সাঁতারু মোশাররফ হোসেন খান। মিশনে ব্যর্থ তিনিও। আত্মবিশ্বাস নেমে এসেছে তলানীতে। তবে কি প্রথম সাফ গেমসে সোনার পদক ছাড়াই ফিরতে হবে?

এ কঠিন বাস্তবতার সামনে দাঁড়িয়ে দুই শতাধিক ক্রীড়াবিদের দল বাংলাদেশ। এরকম একটা পরিস্থিতিতে হঠাৎই যেন মরুভুমিতে বৃষ্টির মত আশীর্বাদ হয়ে আবির্ভুত হলেন মুজিবর রহমান মল্লিক। প্রতিবেশী সব দেশের প্রতিযোগীদের টেক্কা দিয়ে সোনার পদক জিতলেন ট্রিপল জাম্পে। হাঁফ ছেড়ে বাঁচল বাংলাদেশ।

৩৭ বছর আগের সেই সোনা জয়ের প্রতিটি মুহূর্ত এখনও মুজিবরের স্মৃতিতে সজীব, মনে হয় যেন- এই তো কয়দিন আগের ঘটনা, "দেশের হয়ে সাফ গেমসে প্রথম স্বর্ণ জয়, কী করব কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছেন সাঁতারের টিম ম্যানেজার ব্রজেন দাস। বিজয় স্তম্ভে গেলাম, লাল–সবুজ পতাকা উড়ছে, আমার সোনার বাংলা বাজছে-সে এক অন্য জগত। কাউকে বলে বোঝাতে পারব না। সাফে প্রথম স্বর্ণ আমার, এ অর্জনের কি কোন তুলনা হয়"! আসলেই তুলনা হয় না। প্রথম-এর কোনো তুলনা নেই।

মুজিবরের সাফল্যের উচ্ছ্বাসে ভাসছে বাংলাদেশ। তখনকার ক্রীড়ামন্ত্রী শফিকুল গনি স্বপন পাঠিয়েছেন অভিনন্দন বার্তা। দেশে ফেরার পর এলাহী কাণ্ড। বিমানবন্দরে ফুলেল শুভেচ্ছা। প্রথম সাফ স্বর্ণজয়ীকে সংবর্ধনা দেওয়া হল ক্রীড়ামন্ত্রণালয় থেকে। সবচেয়ে বড় উপহারটি পেলেন নিজের এলাকা থেকে। পুরো দুই কিলোমিটার রাস্তা সাজানো হল। এলাকাবাসীরা আয়োজন করল গণসংবর্ধনার। বাংলাদেশের প্রথম সাফ হিরো ফিরে যান সেদিনের স্মৃতিতে, "গ্রামে যেতেই আমি তো ভীষণ অবাক।  দুই কিলোমিটার রাস্তায় ৪/৫টি জমকালো গেট তৈরি করা হয়েছে। স্কুল মাঠে দেওয়া গনসংবর্ধনায় হাজির হয়েছে হাজার হাজার মানুষ।" 

প্রথম সাফ গেমসে (বর্তমানে সাউথ এশিয়ান গেমস) শুধু একটি স্বর্ণ পদক নিয়েই ফিরতে হয়নি বাংলদেশকে। ৪ গুণিতক ১০০ মিটার রিলেতেও আসে সোনার হাসি। এ রিলে ইভেন্টেও অন্যতম সদস্য ছিলেন মুজিবর। ১০০ মিটার রিলেতে তার সোনা জেতার ঘটনাও আলাদাভাবে ব্যাখ্যার দাবি রাখে।

মল্লিকই বলেন, "প্রকৃত স্প্রিন্টার বলতে যা বোঝায়, আমি কিন্তু তা নই। ওই রিলে দলে ছিলেন সাইদুর রহমান ডন, শাহ আলম ও আফতাব মোল্লা। এরা সবাই দেশের সেরা স্প্রিন্টার। দেশে কোন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হলে রিলেতে আমার কোন সুযোগ ছিল না। কিন্তু বিদেশে কোন প্রতিযোগিতায় চতুর্থ স্পিন্টার হিসেবে আমাকে নেওয়া হত। যেমন ১৯৮৫ সালে ঢাকা সাফ গেমসে রিলে দলে আমি ছিলাম না। আবার ১৯৮৭ সালে কলকাতা গেমসে রিলেতে আমি ছিলাম।"

এর কারণটাও বেশ অদ্ভুত। দেশের প্রথম সাফ স্বর্ণজয়ীর কথায়, "আসলে বিদেশে খরচ কমানোর একটা বিষয় থাকেই। দেশে তো আর সেরকম ব্যাপার থাকে না। আর তাই বিদেশে শুধু রিলের জন্য আলাদা একজনকে না পাঠিয়ে আমাকে দিয়েই কাজ চালিয়ে নেওয়া হত। লং জাম্প, ট্রিপল জাম্পের জন্য আমাকে দৌড়ের অনুশীলন করতে হত। খেয়াল করবেন , বিশ্বের সেরা জাম্পাররা সবাই কিন্তু ভাল স্প্রিন্টার।"

সাফ গেমসের মত বড় আসরে অংশ নিয়েই 'ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ড' থেকে স্বর্ণ জিতবেন এমনটা ভাবার মত বাস্তবতা ছিল না বলেও জানান মল্লিক। তিনি বলেন, "ভারত, লংকান অ্যাথলিটদের পেছনে ফেলে স্বর্ণ পদক জেতার কথা আমাদের ভাবনারও বাইরে ছিল। একটা বিষয় আপনাদের মনে করিয়ে দেই- কাঠমান্ডু গেমসে অ্যাথলেটিকস ইভেন্ট অনুষ্ঠিত হয় সিন্ডার ট্র্যাকে। আর দেশে আমরা ঘাস, মাটির উপর দৌড়েছি, অংশ নিয়েছি লং জাম্প, ট্রিপল জাম্পে। বাংলাদেশে ১৯৮৫ সালে আর্মি স্টেডিয়ামে  প্রথম অ্যাথেলটিকস ট্র্যাক বসে। জাতীয়  পর্যায়ে অ্যাথলেট হিসাবে আমার ক্যারিয়ার শুরু ১৯৭৭ সালে। এর আট বছর পর অ্যাথলেটিক্স ট্র্যাক পেয়েছি। আরও আগে যদি পেতাম তাহলে আমাদের ক্যারিয়ার আরও কিছুটা সমৃদ্ধ হত, এটা বলাই যায়।"

এখন তো সুযোগ সুবিধা অনেক বেড়েছে, তারপরও অ্যাথলেটিক্সে আন্তর্জাতিক সাফল্য নাই বললেই চলে। হালে সাউথ এশিয়ান গেমসে অ্যাথলেটিক্স থেকে স্বর্ণ জয়ের কথা আমাদের অ্যাথলিটরা বোধকরি এখন স্বপ্নেও ভাবে না। সব দায় সুযোগ-সুবিধার উপর চাপানো কতটা যুক্তিযুক্ত, এ প্রসঙ্গে মল্লিক বললেন, "আসলে ইনিডিভিজুয়াল ইভেন্টে ব্যাক্তির ইচ্ছাশক্তি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একাগ্রতা, সাধনা সর্বোপরি নিজেকে তৈরি করার জন্য নিরলস শ্রম দেওয়া এগুলোর সঙ্গে সুযোগ-সুবিধা যোগ হলে সাফল্য আসবে। শুধু সুযোগ-সুবিধা বাড়ালেই ভাল অ্যাথলিট তৈরি হবে, এমনটা ভাবার কোন সুযোগ নাই।"

মল্লিকদের সময়ে সুযোগ সুবিধা কম ছিল, কোচদের আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা ছিল না, তবে আন্তরিকতা আর প্রবল ইচ্ছাশক্তি ছিল। সেই জোরেই ঘাটতি পূরণ সম্ভব হয়েছিল বলে মনে করেন এ অ্যাথলিট।

তিনি বলেন, "আমাদের সময়ে কোচদের আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা ছিল না। তারপরও আমি মনে করি এখনকার চেয়ে আমাদের সময়ের ট্রেনিংয়ের মান ভাল ছিল। ক্রীড়া ভবনের পঞ্চম তলয় নিবিড় অনুশীলন করানো হত। অরুণ কুমার চাকমা, আবদুল খালেক ইয়াহিয়া, শরিফুল ইসলামরা ছিলেন আমাদের কোচ। খুবই আন্তরিকতা নিয়ে অনুশীলন করাতেন। আমরাও অনেক পরিশ্রম করতাম। আমাদেরকে উৎসাহও দিতেন খুব। সব থেকে বড় কথা, আমরা যেন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ভাল করতে পারি, সবার ভিতরে এই প্রণোদনা তৈরি করতে সমর্থ হয়েছিলেন আমাদের কোচরা।"

সাফ গেমসের শুরুর দিকে অ্যাথলেটিক্স ছিল বাংলাদেশের প্রাণ। ভারতীয় অ্যাথলটিদের সঙ্গে সমানতালে পাল্লা দিয়েছে আমাদের অ্যাথলিটরা। ১৯৮৫ ও ১৯৮৭ পর পর দুটো সাফ গেমসে দ্রুততম মানব হওয়ার গৌরবের অধিকারী হন শাহ আলম। ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ড থেকে পদক আসত নিয়মিতই।  ঘরোয়া আসরে তীব্র প্রতিযোগিতার কারণে আন্তর্জাতিক আসরে সুফল এসেছিল বলে মনে করেন মল্লিক। বলেন, "আমার কথাই ধরেন। নজরুল ইসলাম রুমি, গিয়াসউদ্দিনের মত অ্যাথলিটদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হত। জাতীয় পর্যায়ে স্বর্ণ পদক জিততে আমাকে অনেকটা সময় অপেক্ষা করতে হয়েছে। জাতীয় পর্যায়ে প্রথম স্বর্ণ জিতি ১৯৮৩ সালে। এরপর অবশ্য ১৯৮৭ পর্যন্ত এই পাঁচ বছর লং জাম্পে আমাকে আর কেউ হারাতে পারেনি।" যোগ করেন, "এর মধ্যে ১৯৮৫ সালে ৭ দশমিক ২৮ মিটার দূরত্ব অতিক্রম করে রুমি ভাইয়ের রেকর্ড (৭ দশমিক ১৮ মিটার) ভেঙ্গে জাতীয় রেকর্ডও গড়ি। আর ট্রিপল জাম্পে স্বর্ণপদক জিতেছিলাম টানা তিন বছর (১৯৮৩ থেকে ১৯৮৫)। তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে আমরা সব সময়ই নিজেদের পারফরম্যান্সকে আরও উঁচুতে তুলতে চাইতাম।"

বর্তমান সময়ের অ্যাথলেটিক্সে সেই প্রতিযোগিতার অভাব আছে উল্লেখ করে বলেন, "এ বছর জানুয়ারি মাসে বঙ্গবন্ধু জাতীয় অ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হল। যতদূর মনে পড়ে লংজাম্পে ৭ দশমিক ০৪ মিটার লাফ দিয়েই স্বর্ণপদক জিতল। রেজা ভাইকে (অলিম্পিক এসোসিয়েশন সভাপতি শাহেদ রেজা) বললাম, এখনও ৭ মিটারে স্বর্ণপদক জেতা যায়!"

তিনি বলেন, "তিন যুগ আগে আগে লংজাম্পে আমার রেকর্ড ছিল ৭ দশমিক ২৮ মিটার। এখন তো এ রেকর্ডটি ৮ দশমিক ২৮ মিটার হওয়ার কথা। খাওয়া দাওয়া থেকে শুরু করে লজিস্টিক সুযোগ সুবিধা তো অনেক বেড়েছে, কিন্তু তার প্রতিফলন বাস্তবে দেখা যাচ্ছে না।"

গ্রামের কৃষক পরিবারের সন্তান কিভাবে অ্যাথলেটিক্সকে ধ্যান-জ্ঞান করেছিলেন, মল্লিকের এই গল্পের মধ্যেই লুকিয়ে আছে অনেক কিছু। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কৃষিকাজে সহায়তা করা, পড়াশুনা ঠিক রাখা এরপর বাকি সময়টুকু মন-প্রাণ ঢেলে খেলাধুলায় দেওয়া। প্রথম সাফ স্বর্ণজয়ীর  কথায়, "ছোট বেলা থেকেই আমি কখনোই সময় নষ্ট করিনি। পরিবারের সবার সঙ্গে মাঠের কাজে সাহায্য করেছি। স্কুলেও ছিলাম নিয়মিত। লেখাপড়ায় ফাঁকি দিইনি। স্কুলের রেজাল্টও বেশ ভাল থাকত। তাই আমার খেলাধুলা নিয়ে বাড়ি থেকে আপত্তি ওঠেনি। বরং উল্টো সমর্থন পেয়েছি। এলাকায় আমি কোন প্রতিযোগিতায় অংশ নিলে আব্বাকে (শাহাদাত হোসেন মল্লিক) অনেকবারই মাঠে উপস্থিত থাকতে দেখেছি। আসলে একজন অ্যাথলিট হতে চাইলে সবদিক ঠিক রাখতে হয়।"

ফুটবলের রমরমা সময়ে অ্যাথলেটিকসে নিজেকে আত্মনিবেদন প্রসঙ্গে মুজিবর রহমানের ভাষ্য, "আমাদের সময়ে ফুটবল ছিল সবচেয়ে জনপ্রিয়। টাকা-পয়সা, গ্ল্যামার বেশি ছিল ফুটবলেই। তবে অ্যাথলেটিক্সেও জনপ্রিয়তা কিন্তু খারাপ ছিল না। ১৯৭৬ সালে রাজশাহীতে প্রথমবার জাতীয় স্কুল প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলাম। এই প্রতিযোগিতাকে ঘিরে দর্শকদের সে-কি উৎসাহ ! সব জায়গাতেই অ্যাথলেটিক্স মানেই দর্শকের ঢল।"

তাদের সময়ে ভাল অ্যাথলিটদের সামাজিক মর্যাদা, নাম-ডাক, প্রভাব-প্রতিপত্তি যথেষ্টই ছিল বলে জানান মল্লিক। স্কুলে পড়াকালীন অ্যাথলেটিক্সের পাশাপাশি ফুটবলার হিসেবেও যথেষ্টই সুখ্যাতি ছিল তার। ফুটবলকে বিদায় দিয়ে শুধু অ্যাথলেটিক্সকে বেছে নেওয়ার কারণ হিসেবে বলেন, "এলাকায় ফুটবলে আমার বেশ নাম যশ ছিল। খেলতাম স্ট্রাইকার পজিশনে। ততদিনে অ্যাথলেটিক্সে বেশ নাম করেছি। বড় ভাইরা বলল, ফুটবল খেললে ইনজুরিতে পড়ে যেত পারো বরং অ্যাথলেটিক্সে মন দাও। কথাটা আমার যুক্তিযুক্ত মনে হল। মন-প্রাণ সঁপে দিলাম অ্যাথলেটিক্সে।"

১৯৭৬ সালে রাজশাহীতে অনুষ্ঠিত জাতীয় ¯কুল অ্যাথলেটিক্সে প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে মল্লিক লং জাম্পে জেতেন স্বর্ণপদক। অংশ নেন যশোর জেলার অভয়নগরের ডিআইএনজিএস উন্নয়ন স্কুলের হয়ে। এ স্কুলটি পাঁচটি গ্রামের আদ্যাক্ষর নিয়ে। এই পাঁচ গ্রাম হল- ধুলগ্রাম, ইছামতি, নাওলি, গোপীনাথপুর ও সিদ্দিপাশা। নাওলি গ্রামেই মল্লিকের জন্ম ও বেড়ে ওঠা। 

শাহাদাত হোসেন ও রাবেয়া খাতুন দম্পতির সাত ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে মুজিবর পাঁচ নম্বর। স্কুল প্রতিযোগিতারপরের বছরই অংশ নেন জাতীয় প্রতিযোগিতায়। ১৯৭৭ সালে যশোরে অনুষ্ঠিত জাতীয় প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার সময় সবে দিয়েছেন এসএসসি পরীক্ষা। ওই আসরে অংশ নেয় সেনাবাহিনী, বাংলদেশ রাইফেলস (বতর্মানে বিজিবি), বিটিএমসি ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সব বাঘা বাঘা অ্যাথলিট। যশোর জেলার হয়ে ওই আসরে প্রিয় ইভেন্ট লংজাম্পে মল্লিক জেতেন ব্রোঞ্জ পদক। তখন তিনি ১৬ বছরের কিশোর। এরপর আর পিছনে তাকাতে হয়নি তাকে। প্রথমে বিটিএমসি ও পরে বিজেএমসির হয়ে পেতে থাকেন নিয়মিত সাফল্য। 

আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় আলো ছড়ান ১৯৮০ সালের ইসলামিক গেমসে। তুরস্কে অনুষ্ঠিত ওই আসরে জেতেন ব্রোঞ্জ পদক। পদক জেতা নিয়ে বলেন, "যতদুর মনে পড়ে, বাংলাদেশের হয়ে একমাত্র পদকটি আমিই জিতেছিলাম।" ১৯৮৩ সালে কুয়েতে গুডউইল গেমসে লং জাম্প ও ট্রিপল জাম্পে পান রৌপ্য পদক। ১৯৮৫ সালে ঢাকা সাফ গেমসে লং জাম্পেও জেতেন রৌপ্য। ১৯৮৭ সালে কলকাতা সাফ গেমসে ৪ গুনিতক ১০০ মিটার রিলেতে জেতেন রুপা। সব মিলিয়ে দুটি স্বর্ণসহ মল্লিকের আন্তর্জাতিক পদক সংখ্যা ৭। নিজের অর্জন নিযে সন্তুষ্টি প্রকাশ করে বলেন, "অ্যাথলেটিক্সে শাহ আলম ছাড়া বাংলাদেশের কেউ আমার চেয়ে বেশি আন্তর্জাতিক পদক জেতেনি।"

সাফল্য দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও এশিয়ান গেমসসহ অনেক বড় বড় আসরেই অংশ নিয়েছেন প্রথম সাফ জয়ী এই অ্যাথলিট। ১৯৮৬ সালে মস্কোর গুডউইল গেমসে অংশ নেওয়ার সময় ঘটে এক মজার ঘটনা। ওই আসরে অন্যতম প্রতিযোগী ছিলেন কিংবদন্তীর অ্যাথলিট কার্ল লুইস। দুজনেই ছিলেন একই হোটেলে। অ্যাথলেটিক্সে ইতিহাসের অন্যতম সেরা এ অ্যাথলিটের সঙ্গে অন্তরঙ্গতা হয়েছিল মুজিবরের। লুইসের সঙ্গে ছবিও তোলেন। সাড়ে তিন দশক আগের সেই ঘটনা নিয়ে বলেন, "মস্কোয় আমরা একই হোটেলে ছিলাম। সম্ভবত হোটেলটির নাম গ্রোসিয়া। ওই আসরে কোন পদক পাইনি। তবে লুইসের সঙ্গে ছবি তুলেছিলাম। অনুশীলনে আমাকে পিঠ চাপড়ে দিয়েছিলেন। লুইসের সঙ্গে তোলা ছবিটি আমি বাঁধিয়ে রেখেছি। ছবিটি গ্রামের বাড়িতে আছে।"

এ লেখাটার জন্য বেশ কয়েক দফায় কথা বলতে হয়েছে বাংলাদেশের প্রথম সাফ স্বর্ণজয়ীর সঙ্গে। প্রতিবারই একটি কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন, "আমার গ্রামের নাম নাওলি। এটা কিন্তু লিখতে ভুলবেন না।" ১৯৮১ সালে বিজেএমসিতে অ্যাসিসটেন্ট ম্যানেজার হিসেবে চাকরি শুরু করেন।  সংস্থাটির মহাব্যবস্থাপক হিসাবে অবসর নিয়েছেন এ বছর জানুয়ারি মাসে। অবসরের পর এখন তার ভাবনা জুড়ে গ্রাম, আর শৈশবের ডিআইএনজিএস উন্নয়ন স্কুল। দু মাস হলো দায়িত্ব নিয়েছেন এ স্কুল কমিটির সভাপতি হিসেবে।

মল্লিক বিয়েও করেছেন নিজের এলাকায়। পাশের গ্রামের তাসলিমা নাসরিন তার চার দশকের জীবনসঙ্গী। তার স্ত্রীও একজন নামী অ্যাথলিট। তার মতই বিটিএমসি ও বিজেএমসির হয়ে খেলতেন। এই দম্পতির দু'ছেলেই পড়াশুনায় ভাল। বড় ছেলে শাহরিযার রহমান মল্লিক এমবিএ শেষে প্রতিষ্ঠিত ব্যাংকার। ছোট ছেলে শাহনেওয়াজ রহমান মল্লিক এমবিএ করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। 

নিষ্ঠা ও নিয়মানুবর্তিতার সুফল পেয়েছেন জীবন ভর। অবসর জীবনে নতুন একটা চ্যালেঞ্জ নিচ্ছেন। বললেন, "অ্যাথলেটিক্সের সুদিন ফিরিয়ে আনতে হলে নজর দিতে হবে গ্রামগুলোতে। প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে তুলে  আনতে হবে প্রতিভা। আর পরিচর্যার মধ্য দিয়ে প্রতিভাগুলোকে বিকশিত করতে হবে।  আমার গ্রামের স্কুল কমিটিতে দায়িত্ব নেওয়ার অন্যতম কারণও এটি। একটা সময় খেলাধুলার প্রাণকেন্দ্র ছিল আমাদের অঞ্চল। সেই দিনগুলো ফিরিয়ে আনা যাবে কি-না সেটা জানি না, তবে আমার দিক থেকে চেষ্টার কোন ত্রুটি অন্তত হবে না।"