মামুনুল, মৌলবাদ এবং উগ্রপন্থা দমনে সরকারের কঠোরতা বজায় থাকবে কি?

মর্তুজা হাসান সৈকতমর্তুজা হাসান সৈকত
Published : 19 April 2021, 03:02 PM
Updated : 19 April 2021, 03:02 PM

ধর্মীয় মতবাদের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা সংগঠন হেফাজতে ইসলামের উগ্রবাদী অংশের নেতা মামুনুল হককে মোহাম্মদপুরের জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া মাদ্রাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী এবং মুজিববর্ষের উদযাপনকে কলঙ্কিত করতে নাশকতা চালানোয় নেতৃত্ব দিয়ে এবং নারী কেলেংকারির ঘটনার কারণে বেশ কিছুদিন ধরেই যিনি টক অব দ্য কান্ট্রি। ইসলামের লেবাসধারী এ উগ্রপন্থী নেতা রিসোর্টে জান্নাত আরা ঝর্ণা নামের এক নারীসহ ধরা পড়ার কয়েকদিন পর জান্নাতুল ফেরদৌস লিপি নামের আরেক নারীর সাথে অভিসারের কারণেও খবরের শিরোনাম হয়েছিলেন। 

মামুনুলের নারী কেলেংকারির ঘটনা নিয়ে বেশ কিছু কলরেকর্ডও ফাঁস হয়েছে। পাশাপাশি, মামুনুলের কথিত দ্বিতীয় স্ত্রী জান্নাত আরা ঝর্ণার প্রথম পক্ষের সন্তান মায়ের ডায়েরি ফাঁস করেছে। সেখানে দেখা গেছে কাবিন দূরে থাক, হেফাজত নেতা মামুনুল ঝর্ণাকে আসলে বিয়েই করেননি। পুরো ব্যাপারটাকে একসময় এমন মনে হচ্ছিলো যে, যত ফোনালাপ আর নারী কেলেংকারির ঘটনা ফাঁস হতে থাকবে মামুনুলের কাবিনবিহীন স্ত্রীর সংখ্যা ততই বেড়ে যাবে। 

তবে একজন মামুনুল হক বিয়ে করেছেন কী করেননি, কতটি করেছেন, কিংবা রিসোর্টে কাকে নিয়ে গেছেন তা নিয়ে আমার কোনও মাথাব্যথা নেই। আমার মাথাব্যথা ছিল, স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী এবং মুজিববর্ষের উদযাপনকে কলঙ্কিত করতে দেশজুড়ে তার তাণ্ডব-ভাংচুরে নেতৃত্বে দেওয়া নিয়ে। তার অপরাধ ছিল, মুজিববর্ষে মাসিক আল কাউসার আর জামায়াতে ইসলামীর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত দুইটি লেখাকে ভিত্তি হিসেবে তুলে ধরে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যকে মূর্তি হিসেবে উপস্থাপন করে গোটা দেশকে অস্থিতিশীল করে তোলা। স্বয়ং আরবি ভাষাতে মূর্তি এবং ভাস্কর্য ব্যাপার দুটোকে আলাদা আলাদাভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে এবং আরবের দেশগুলোসহ মুসলিম বিশ্বের দেশগুলোতে প্রচুর ভাস্কর্য থাকার নিদর্শন রয়েছে। এমনকি বিভিন্ন সময়ে মামুনুল যে ভাষায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর প্রতি বিদ্বেষ ছড়িয়েছিলেন তা ছিল রীতিমত রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল। যিনি এ রাষ্ট্রটির স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন, এ দেশটিকে স্বাধীনতা দান করেছেন- মামুনুল তার ভাস্কর্য বুড়িগঙ্গায় ফেলে দেওয়ার স্পর্ধাও দেখিয়েছিলেন। এখানে উল্লেখ্য, ২০১৩ সালে ঢাকায় হেফাজতে ইসলাম শাপলা চত্বরে যে তাণ্ডব চালিয়েছিল, তারও অন্যতম হোতা ছিলেন এই মামুনুল হক। তখনও তাকে বঙ্গভবন, গণভবনে রক্তের বন্যা বইয়ে দেওয়ার হুমকি দিতে দেখা গেছে। 

হেফাজত কিংবা মামুনুল আসলে সরকারের শক্তিকে ভুল বুঝেছিল। যে কারণে তারা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও মুজিববর্ষ বানচালের পরিকল্পনা করেছিল। এমনকি এখনো তারা সরকারের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে চলছে। সরকার ঘোষণা দিয়েছে, এতিমখানা ছাড়া দেশের সব মাদ্রাসা বন্ধ থাকবে, একই সাথে পরীক্ষাও বন্ধ থাকবে। কিন্তু কে শোনে কার কথা! হেফাজত সরকারের সিদ্ধান্ত মানে না। দেশের সব মাদ্রাসায় তাদের দাওরায়ে হাদিস পরীক্ষা চলছে। ভাবখানা এমন, সরকার আমাদের ব্যাপারে নির্দেশ দেওয়ার কে? এই ধ্বজাধারীরা মানুষকে ধর্মের নামে উত্তেজিত করে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যে জ্বালাও পোড়াও করেছে, তা শুধু পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বর্বরতাকেই স্মরণ করিয়ে দেয়। তারা কোমলমতি শিশুদের রাস্তায় নামিয়েছে। অনেকে বলেন এরা ইসলামি দল। বাস্তবে এরা হচ্ছে একদল সন্ত্রাসী, যারা দিনের পর দিন শান্তির ধর্ম ইসলামকে অপমানিত করে চলছে। 

নিজেদের অরাজনৈতিক ইসলামি সংগঠন হিসেবে দাবি করলেও আহমেদ শফীর মৃত্যুর পর বাস্তবে হেফাজতে ইসলামের যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছিলো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে। শফীর সাথে সরকারের সুসম্পর্ক থাকায় যেহেতু এই অংশটি তাদের স্বার্থ হাসিল করতে পারছিলো না, তাই তাকে নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দিতে নিষ্ঠুর 'অনৈসলামিক' পন্থা বেছে নেওয়া হয়। পরিকল্পিতভাবে ঠেলে দেওয়া হয় মৃত্যুর দিকে। ইতিমধ্যে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এই হত্যাকাণ্ডের সাথে হেফাজতের বর্তমান আমির জুনাইদ বাবুনগরী, যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক ও সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক ইসলামাবাদীসহ ৪৩ জনের সম্পৃক্ততা পেয়েছে। 

সংগঠনটির সাম্প্রতিক আন্দোলনের পেছনের লোক দেখানো কারণ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফর হলেও মূল কারণটি ছিল রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হওয়া। ফলে একটি অরাজনৈতিক সংগঠন হয়েও হেফাজত রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলে তৎপর হয়ে উঠেছিল। 

সম্প্রতি 'জামায়াত-হেফাজত চক্রের বাংলাদেশ বিরোধী তৎপরতা: সরকার ও নাগরিক সমাজের করণীয়' শীর্ষক এক ওয়েবিনারে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, হেফাজতে ইসলাম ধর্মকে ব্যবহার করে জামায়াতে ইসলামের মত রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে চায়। 

অন্যদিকে, ১৬ এপ্রিল একটি ওয়েব পোর্টালের প্রকাশিত এক সংবাদে ডিএমপি গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) যুগ্ম কমিশনার মাহবুব আলম বলেন, "মামুনুল হক সুপরিকল্পিতভাবে সহিংসতায় উসকানি দিয়েছেন। মামুনুল হক দেখলেন তার কথায় তো অনেক কিছু হয়ে যাচ্ছে, অনেক সমর্থক তার, উনি যা বলছেন তারা তাই করছেন। ভাস্কর্যবিরোধী বিক্ষোভ থেকে শুরু করে মোদিবিরোধী বিক্ষোভে তিনি যা বলেছেন, তাই হয়েছে। তখন তিনি ভাবলেন জামাত-বিএনপি তার সঙ্গে আছে, তিনি তাহলে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হতে পারবেন।" 

হেফাজতের আরও গোমর ফাঁস হয় গত বছরের ১৬ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে 'প্রয়াত শাহ আহমদ শফীর জীবনকর্ম, অবদান' শীর্ষক আলোচনা ও মতবিনিময় সভায়। ওই সভায় শফি ঘনিষ্ঠ হেফাজতের সাবেক নেতারা দাবি করেন, হাটহাজারী মাদ্রাসায় হামলা, ভাংচুর করার পাশাপাশি আল্লামা শফীর প্রতি চরম বেয়াদবি করা হয়েছিল। গৃহবন্দি করে নির্যাতনের মাধ্যমে তাকে শাহাদাত বরণ করতে বাধ্য করা হয়েছে। তারা জানান, খাবার-ওষুধ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, অ্যাম্বুলেন্স বন্ধ ছিল- আর এগুলোই ছিল আহমেদ শফীর মৃত্যুর মূল কারণ। 

আহমেদ শফীর অনুসারীদের দূরে সরিয়ে রেখে হেফাজতে ইসলামের নতুন কমিটিতে আমির হিসেবে নির্বাচিত করা জুনাইদ বাবুনগরী প্রসঙ্গে তারা জানান, মতিঝিলের শাপলা চত্বরে ২০১৩ সালের ৫ মে সংঘটিত পুরো ঘটনার দায়ভার হেফাজতে ইসলামের ওই সময়ের মহাসচিব জুনাইদ বাবুনগরীর। তারা অভিযোগ করেন- তৎকালীন আমির আল্লামা শাহ আহমেদ শফীকে না জানিয়ে হেফাজতের নেতাকর্মীদের রাতভর শাপলা চত্বরে রেখে দেন বাবুনগরী। 

এ প্রসঙ্গে হেফাজতের সাবেক যুগ্ম মহাসচিব সলিমুল্লাহ বলেন, "আমি নিজে যা দেখেছি তাই বলেছি৷ তিনি কী উদ্দেশ্যে এটা করেছেন, কাদের সাথে যোগাযোগ করেছেন তা তিনিই ভালো বলতে পারবেন৷" 

তিনি আরও বলেন, "মাওলানা আহমেদ শফী ও মাওলানা কাসেমী বলেছিলেন সন্ধ্যা ৬ টার মধ্যে সমাবেশ শেষ করে যে যার মতো চলে যাবেন৷ কাসেমী এবং মুফতি ওয়াক্কাস তাকে বার বার সমাবেশ শেষ করার জন্য বলছিলেন৷ কিন্তু বাবুনগরী বিভিন্ন জায়গায় যোগাযোগ করছিলেন আর বলছিলেন এখানে অবস্থান করলে রাতে সেনাবাহিনী নামবে৷ এটা তিনি বার বার বলছিলেন৷ এরপর তিনি আহমেদ শফীকে না জানিয়ে রাতে অবস্থানের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন৷ তার কারণেই এত হতাহতের ঘটনা ঘটে৷" 

মাওলানা সলিমুল্লাহর ভাষায়, "২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতে ইসলামের অবস্থান কর্মসূচি সফল করতে নানা উৎস থেকে প্রাপ্ত অর্থের মধ্যে অন্তত এক কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছিলেন তৎকালীন মহাসচিব বাবুনগরী। তাছাড়া, অসুস্থতার কারণে চিকিৎসার কথা বলে সংগঠন থেকে নিয়েছিলেন অন্তত আরও ২০ লাখ টাকা।" 

এখানে উল্লেখ্য, শাপলা চত্বরের তাণ্ডব-ভাংচুরের পর গ্রেপ্তার হয়ে গোয়েন্দা পুলিশের কাছে বাবুনগরী স্বীকার করেছিলেন, তাদের নেতৃত্ব মূলত জামায়াতে ইসলামের হাতে ছিল।

ওইসময় মামুনুল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে না আসতে পারলেও গত বছর বাবুনগরী গ্রুপের বিদ্রোহের মুখে বিনা চিকিৎসায় আল্লামা শফীর মৃত্যুর পর পাল্টে যায় দৃশ্যপট। হেফাজতের নতুন কমিটিতে এক নম্বর যুগ্ম মহাসচিব হিসেবে নিয়ে আসা হয় বাবুনগরীর চাইতে আরও একধাপ বেশি উগ্র মামুনুল হককে। গত ডিসেম্বরে মহাসচিব মাওলানা নূর হোসেন কাসেমী মারা যাওয়ার পর কার্যত যাকে সংগঠনটির দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ধরা হয়। তিনি এবং জামায়াতঘেঁষা কয়েকজন নেতা আল্লামা শাহ আহমেদ শফীর  জানাযায় জামায়াত-শিবিরের নেতৃবৃন্দকে সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ করে দিয়ে জামায়াতের সাথে হেফাজতের সেতুবন্ধন সৃষ্টিতে ভূমিকা রেখেছিলেন। এসবের ইক্যুয়েশনে হেফাজতের নতুন কমিটিতে ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা এক তৃতীয়াংশ নেতাই আসে বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের দলগুলো থেকে। আর এ কারণেই হেফাজতের এবারের হরতালে বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের লোকজন ঢুকে হামলা ভাংচুর করে। 

উগ্রবাদী সংগঠন হেফাজতে ইসলামের জন্মই ছিল তীব্র বিদ্বেষ থেকে। ২০০৯ সালের খসড়া 'জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি'তে সম্পত্তির উত্তরাধিকারে নারী-পুরুষের সম অধিকারের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে আন্দোলনের জন্য ২০১০ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলায় অবস্থিত হাটহাজারী বড় মাদ্রাসায় সংগঠনটি প্রতিষ্ঠিত হয়। সংগঠনটি মূলত কওমি মাদ্রাসার প্রতিনিধিত্ব করে। দেওবন্দের ওলামারা ঐতিহ্যগতভাবে সরাসরি রাজনীতি থেকে দূরে থাকলেও হেফাজতের কাছে তাদের মূল পরিচয় গৌণ হয়ে রাজনৈতিক অভিলাষ বড় হয়ে পড়েছে। দেওবন্দে যারা পড়ালেখা করেন তারা ভারতে ইসলামের নামে কোনও সন্ত্রাস বা সহিংসতা সৃষ্টি না করলেও ২০১৩ সালের মে থেকে এ সংগঠনটি এতটাই উগ্র আর ধ্বংসাত্মক হয়ে উঠেছে যে এর জন্য মানুষের মুক্তচিন্তা, স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়াই কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত ২৬,  ২৭ ও ২৮ মার্চ তারা দেখিয়েছে গণতন্ত্র, স্বাধীনতা এবং স্বাভাবিক জীবনের জন্য তারা কত বড় হুমকি। 

সবশেষ কথা এটাই, সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থানের আশঙ্কা থেকে যে অস্থির পরিবেশ বিরাজ করছে তা থেকে উত্তরণে সময় এসেছে এখন গণজাগরণের। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ লালন করা সব শক্তিকে এজন্য একত্র হতে হবে। মামুনুলকে যেমন গ্রেপ্তার করা হয়েছে তেমনই বাবুনগরীসহ উগ্র হেফাজতিদের সবাইকে সুনির্দিষ্ট মামলা দায়েরের মাধ্যমে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। এরা সরকারের শক্তিকে ভুল বুঝেছিল, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে চ্যালেঞ্জ করেছিল। উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে নাশকতা চালানো, ইসলামের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করা, নারীদের অবমাননা করা, রাষ্ট্রের মূল চেতনার বিরোধিতা করাসহ ধর্মান্ধতা-উগ্রতার বিষবাষ্প সমাজদেহের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যারা ছড়িয়ে দিচ্ছে তাদের জন্য কোন সহানুভূতি থাকতে পারে না। স্বাধীনতার চেতনা সমুন্নত রাখতে হেফাজতসহ সকল মৌলবাদী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর ও নির্মোহ হওয়ার সময় এখনই।