করোনাভাইরাস: অভিজ্ঞতা গেল কোথায়!

রাশিদুল রাশেদ
Published : 15 April 2021, 07:20 PM
Updated : 15 April 2021, 07:20 PM

মৃত্যুদণ্ডের রায়ের পর সক্রেটিসকে প্রিয় শিষ্য প্লেটো পরামর্শ দিয়েছিলেন, "গুরু, আপনি পলাইয়া যান! আমি সব ব্যবস্থা করে রেখেছি!" কিন্তু গুরু সক্রেটিস বলেছিলেন, "বেকুব, বিচার ভুল হইয়াছে! কিন্তু আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রাখিতে হইবে!" 

চিরকালই যেন এ আইন কানুন দিয়ে নাগরিক, দার্শনিক, অসঙ্গতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারীদেরকে কোণঠাসা করে রাখে রাষ্ট্র ও সরকার। যার পরিপ্রেক্ষিতে যুগে যুগে বা কালে কালে কথিত আর্যগণের শাসন নামক শোষণ উৎপীড়নে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠে যায়। আর এ নাভিশ্বাসের পরিধি মহামারী পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি টের পাওয়া যায়। যেটা এখন বঙ্গরাষ্ট্রের প্রেক্ষিতে নভেল করোনাভাইরাস মহামারীর দ্বিতীয় ঢেউয়ে বোঝা যাচ্ছে। রাষ্ট্রের চিকিৎসা ব্যবস্থার ফক্কা দশা নিয়ে এমনকি বাচ্চা শিশুরও এখন আর কোনও সন্দেহ নেই।

এখানে রোগী আছে কিন্তু আইসিইউ নেই, অক্সিজেন সিলিন্ডারের অভাব, চিকিৎসকের অভাব, বেডের অভাব, ওষুধের অভাব। এমনি অবস্থায় চলছে কোভিড-১৯ মহামারী দ্বিতীয় ধাপের মোকাবিলা! যা অত্যন্ত দুঃখজনক, পাশাপাশি বেদনাদায়কও বটে।

ঠিক এভাবে কোভিড-১৯ এর দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলার অপরিপক্ক পরিকল্পনা আমাদের সাধারণ নাগরিকদের ভাবিয়ে তোলে। আর এ ভাবিয়ে তোলা থেকে আমার লেখার তাগিদ অনুভব করা।

এ রাষ্ট্রে গতবছর একই সময়ে কোভিড-১৯ প্রথম আঘাত এনেছিল, যদিও তখন এ রাষ্ট্রের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের এ মহামারী সংক্রান্ত কোনও অভিজ্ঞতা ছিল না। প্রাকৃতিক কারণেই হোক আর স্বাস্থ্যসেবার বিভাগের প্রচেষ্টার প্রেক্ষিতেই হোক কোভিড-১৯ এর প্রথম ঢেউ সামলানো গিয়েছিল। কিন্তু এবার কেন যেন স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অভিজ্ঞতা থাকা স্বত্বেও আক্রান্ত মানুষের মৃত্যুহার অনেক বেশি এবং আক্রান্তের সংখ্যাও যথেষ্ট। 

আমি জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ নই। তবু আমার মনে একটি প্রশ্ন নাড়াচাড়া দিচ্ছে। পৃথিবীর সমস্ত কার্যক্রমে অভিজ্ঞতার বিশাল একটা মূল্য রয়েছে। অভিজ্ঞতাসম্পন্ন লোক কর্ম সম্পাদন করে নিখুঁতভাবে। যেটা নিশ্চিত স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য বটে। কেননা কোভিড-১৯ এর প্রথম ধাপ মোকাবিলা একটা অভিজ্ঞতা অর্জনের চেষ্টা। কিন্তু বঙ্গরাষ্ট্রের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ গতবারের অভিজ্ঞতাকে কেন কাজে লাগাতে পারলো না? 

অথবা স্বাস্থ্যসেবা খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা গতবার কোনও অভিজ্ঞতা অর্জনে সমর্থ হননি! তা নাহলে সংক্রমিত হওয়ার হার এবং মৃত্যুহার কেনই বা বেড়ে যাচ্ছে দিনকে দিন!

আবার রাষ্ট্র তার নিজস্ব ৫১ কোটি টাকা খরচ করে কোভিড-১৯ এর জন্য দুইটি স্পেশাল হাসপাতাল তৈরি করেছিল গতবছর। কিন্তু দুইদিন আগে বেসরকারি একটি টেলিভিশনে সংবাদে জানতে পারলাম ওই দুইটি হাসপাতাল নাকি উধাও হয়ে গেছে। অর্থাৎ হাসপাতাল দুইটিরই অস্তিত্ব নেই। যেটা মোটেও কাম্য নয়। কেননা হাসপাতাল দুইটি শুধু করোনা রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার জন্য নির্মিত হয়েছিল এবং করোনাভাইরাস এখনও পুরো পৃথিবীতেই চলমান।  

কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক হাসপাতাল দুইটির গায়েব হওয়ার ফলে ক্ষতির আলোচনা না করেই বরং গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে একহাত নিলেন। যেটা আমার কাছে দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় বলে মনে হয়।

অন্যদিকে কোভিড-১৯ এর দ্বিতীয় ধাপের থাবা থেকে বাঁচার জন্য সারাদেশে সরকার লকডাউন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। আমরা জানি যে, এ ধরনের কর্মসূচিতে রোগের প্রাদুর্ভাব কমবে। তবে লকডাউনে নিন্মআয়ের মানুষের অনেকটা না খেয়ে থাকার উপক্রম হয়। বিশেষ করে দিনমজুর, পরিবহন শ্রমিক, রিকশাওয়ালাসহ আরো কিছু শ্রমজীবী মানুষদের কাউকে কাউকে অনাহারেও থাকতে দেখেছি। তাদের জন্য অন্তত খাবারের ব্যবস্থা করা উচিত ছিল রাষ্ট্র ও সরকারের পক্ষ থেকে। কিন্তু রাষ্ট্র ও সরকার এ ব্যবস্থা কবে করবে? গত বছর যখন প্রথম ধাপের লকডাউন শুরু হয়েছিল তার আগেই তো এ পরিকল্পনা করা যেত! অথচ এক বছর পর দ্বিতীয় ধাপের লকডাউনের তিনদিন পার হলেও এখন পর্যন্ত কোনও পরিকল্পনার কথা শোনা গেল না।

দ্বিতীয় ধাপের লকডাউন শুরুর আগে তড়িঘড়ি করে ব্যাংক বন্ধ এবং তারপর আবার খোলার সিদ্ধান্ত, মুভমেন্ট পাস নিয়ে লেজেগোবরে অবস্থা, চিকিৎসকদেরও ভোগান্তিতে পড়া এবং আরও অনেক কিছুর সিদ্ধান্ত নিয়ে দোনোমোনো ভাব বা অস্পষ্টতা প্রমাণ করে বড় ধরনের ধাক্কা খাওয়ার পরও আমাদের স্বাস্থ্যখাতের কর্তাব্যক্তিরা দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে উদাসীনই রয়েছেন।