রিসোর্টে যাব, যাবে?

আহসান কবিরআহসান কবির
Published : 10 Feb 2012, 10:00 AM
Updated : 7 April 2021, 02:06 PM

একবার চোখ বন্ধ করে ভাবুন। বহু বছর ধরে জমে থাকা বালির কোল ভাঙছে মারমুখো ঢেউ। দূর থেকে ভেসে আসছে সমুদ্র গাঙচিলের ডাক। ইলিশের পেটির মতো চিকচিক করছে সমুদ্র জল। এসব দেখতে দেখতে উপন্যাস লিখছেন হুমায়ূন আহমেদ! যে জায়গায় বসে লিখছেন তার নাম 'সমুদ্র বিলাস'। ১৯৮৮ সালে মাত্র ১৬ হাজার টাকায় সেইন্ট মার্টিনে ২২ শতক জমি কিনে হুমায়ূন আহমেদ গড়ে তুলেছিলেন সমুদ্র বিলাস রিসোর্ট। ২০১১ সালের ১৮ ডিসেম্বর সর্বশেষ এই রিসোর্টে এসেছিলেন হুমায়ুন আহমেদ। খুব কম মানুষ পাওয়া যাবে যারা সেইন্ট মার্টিন ঘুরে এসেছেন কিন্তু সমুদ্রবিলাসে যাননি কিংবা এর সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তোলেন নি। 

কবি সাহিত্যিকদের রিসোর্টপ্রীতির হাজারো গল্প আছে। গল্প আছে রিসোর্টের নামকরণ নিয়েও। যেমন বান্দরবান জেলার এক পাহাড়ি রাজকন্যার নাম নাকি ছিল সাইরু। তার প্রেম হয়েছিল অন্য গোত্রের এক ছেলের সাথে। প্রেম কখনো গোপন থাকে না। থাকলে নাকি সেই প্রেম ম্লান হয়ে যায়। অসম প্রেমের কথা শুনে রাজকন্যা ও তার প্রেমিকের পরিবারের মুরুব্বীরা নড়েচড়ে বসলেন। প্রেমিকের গোত্রের মুরুব্বীরা তাকে নিজ গোত্রের এক মেয়ের সাথে বিয়ে পরিয়ে দিলেন। 

প্রেমিকের বিয়ের খবর শুনে রাজকন্যা সাইরু এতটাই দুঃখ পান যে একদিন নির্জন জঙ্গলের পথ ধরে একা বেরিয়ে পড়েন। এরপর আর ফিরে আসেন নি। আমাদের লোকগল্প 'বাকরখানির' মতো সাইরুর প্রেমকাহিনীকে মাথায় রেখে বান্দরবানের এক রিসোর্টের নামকরণ করা হয়েছে 'সাইরু রিসোর্ট'! 

এ রিসোর্টের পাশেই মুকুট পাহাড়ের কাছে পাশাপাশি দুটো বৃক্ষ দেখতে যান পর্যটকরা। এই বৃক্ষের ছায়ায় নাকি সাইরু ও তার প্রেমিক প্রেম করতেন। সম্ভবত হোটেল বা রিসোর্টের 'রুমপ্রেম' থেকে 'ডেটিং' (নির্দিষ্ট 'ডেট' এ রুমভর্তি প্রেম হয়তো ডেটিং। প্রেম নির্জনতা খোঁজে!) শব্দটা এসেছে। এ রিসোর্ট থেকে খুব কাছেই সাংগু নদী। প্রেম যেহেতু নদীর মতো বহমান (ঝর্ণাও নাকি প্রেমকে উসকে দেয়! বিশ্বাস করুন ইদানিং কোন এক রিসোর্টের কোন আলোচিত নারীকে এখানে ইঙ্গিত করা হচ্ছে না।) তাই যে কেউ চাইলেই নদী দেখে এসে আবারও রুমবন্দি হয়ে যেতে পারেন।

খ্যাতিমান লেখক ইমদাদুল হক মিলন 'রুমবন্দি' হয়ে কিংবা হোটেলের রুম ভাড়া করে অনেক গল্প উপন্যাস লিখেছেন একসময়। লেখালেখির ব্যস্ততা এবং পরিবেশ তৈরির কারণেই হয়তো একা একা তার রুমবন্দি হওয়া। বয়সের কারণে এখন এমন লেখালেখি হয়তো তিনি করেন না। রিসোর্টের সাথে বয়সের সম্পর্ক সম্ভবত খুব নিবিড়। ভ্রমণ, ডেটিং বা আড্ডা সবসময় নিতে পারে না 'বয়স'। তবে কবি সাহিত্যিকদের বয়সকালীন আড্ডা বা প্রেম হয়তো রিসোর্টকেন্দ্রিক নয়। এপার আর ওপার বাংলায় বিউটি বোর্ডিং আর কফি হাউজের নামটা বিখ্যাত হয়ে আছে কবি সাহিত্যিকদের জমজমাট আড্ডার কারণেই।

১৯৪৭ এর দেশভাগের পর (হৃদয় সম্ভবত দুইভাগ হয় না। দেশভাগের কারণে নাকি হয়েছিল।) পুরোনো ঢাকার 'বিউটি বোর্ডিং' হয়ে উঠেছিল কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, অভিনেতাদের প্রধান আড্ডাস্থল। আলাউদ্দীন আল আজাদ, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, শহীদ কাদরী,সৈয়দ শামসুল হক, ফয়েজ আহমেদ, সমুদ্র গুপ্ত, ফজল শাহাবুদ্দীন, সন্তোষ গুপ্ত এবং আবদুল গাফফার চৌধুরীর মতো মানুষেরা নিয়মিত যেতেন বিউটি বোর্ডিংয়ে। আড্ডা দিতে যেতেন শিল্পী নিতুন কুন্ডু, কাইয়ুম চৌধুরী, দেবদাস চক্রবর্তী, টিভি ব্যক্তিত্ব ফজলে লোহানি কিংবা সুরকার সত্য সাহা। এক সময় আসতেন অভিনেতা ভানু বন্দোপাধ্যায়ও। 

কোন আড্ডাতেই মানুষেরা চিরস্থায়ী নয়। শামসুর রাহমান এবং সৈয়দ শামসুল হকের অনেক কবিতা এবং গদ্যে বিউটি বোর্ডিং এর স্মৃতিচারণ উঠে এসেছে। এর একটা কারণ হতে পারে যে- কবি শামসুর রাহমান থাকতেন পুরোনো ঢাকার আওলাদ হোসেন লেইনে আর সৈয়দ হক থাকতেন সে সময়ে লক্ষীবাজারে। বিউটি বোর্ডিং সম্ভবত এই দুইয়ের মাঝামাঝি। স্বাধীনতার পর বিউটি বোর্ডিং এর আড্ডাটা আর জমজমাট থাকে নি, এখন স্মৃতি হয়ে আছে শুধু। বিউটি বোর্ডিং নিয়ে কোন গান সম্ভবত নেই, যেটা আছে ওপার বাংলার বিখ্যাত মানুষদের এক সময়কার তুমুল আড্ডাস্থল 'কফি হাউজ' নিয়ে। 

কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়,কবিতা সিংহ  কিংবা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়রা যেমন যেতেন কফি হাউজে, গায়ক মান্না দে, সত্যজিৎ রায় সহ আরেও অনেকে আসতেন সেখানে। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে শামসুর রাহমান,আল মাহমুদ, বেলাল চৌধুরী কিংবা আবদুল গাফফার চৌধুরী যেতেন কফিহাউজে। মান্না দে কফি হাউজকে বিখ্যাত করে গেছেন তার গান- "কফি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই…।" 

এ গানের এক অমর লাইন এমন- "সুজাতাই আজ শুধু সবচেয়ে সুখে আছে শুনেছি তো লাখপতি স্বামী তার…"। সৃষ্টিশীল মানুষের হাতে সুজাতা, লাবণ্য, মোনালিসা কিংবা বনলতা সেন যে-ই পড়ুক বেঁচে থাকবে হাজার বছর। আর একালের কোন রিসোর্টে কোন ঝর্ণাকে (জ্বর না!) তার প্রেমিক বা স্বামীর সাথে দেখা গেলেও কপালে খারাবি আছে। ধর্ম কিংবা রাষ্ট্র সেখানে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। 

কোন কোন রিসোর্ট আবার ঝাঁপিয়ে পড়ার জায়গাও অর্থাৎ রিসোর্টে দৃষ্টিনন্দন সুইমিংপুল থাকে। উত্তাল সমুদ্র কিংবা নিস্তরঙ্গ পুকুর ভেবে আপনি সেখানে ঝাঁপাঝাঁপি করতেই পারেন। ঢাকার অদূরে টঙ্গী, গাজীপুর, কালিয়াকৈর কিংবা জয়দেবপুরে আছে অগণিত রিসোর্ট। জল ও জঙ্গলের কাব্য কিংবা নক্ষত্রবাড়ি রিসোর্ট, তাজ, ত্রিধা বা ঢাকা রিসোর্ট, মেঘবাড়ি কিংবা মেঘমাটি ভিলেজ রিসোর্ট যেখানেই যান- সুইমিংপুল আছে। সেখানে যেয়ে বিপরীত ভাবনার কবিতাও লিখতে পারেন- সবটুকু জল তুলে নিলে পড়ে থাকি একলা পুকুর।

একা বা একলা হয়ে রিসোর্টে গিয়ে সম্ভবত কোন মজা নেই। নীরবতা বজায় রেখে শুধু লেখালেখি করার ইচ্ছে থাকলে সেটা অন্য কথা। পদ্মা বা যমুনা রিসোর্টে গেলে হয়তো নদী বা আশে পাশের মানুষ নিয়ে লেখার শখ জাগতে পারে। রূপকথা, রত্নদ্বীপ কিংবা মারমেইড রিসোর্টে গেলে অনুভূতি ভিন্ন হতে পারে। কক্সবাজার, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি কিংবা বান্দরবানের কোন রিসোর্টে গেলে পরিবেশগত কারণে সেখানকার অনুভূতিও আলাদা হতে বাধ্য। কক্সবাজারে গেলে মারমুখো জল হয়তো আছড়ে পরবে পা-য়, আপনি লিখে ফেলতে পারেন, 'ভালোবেসে ডেকেছিল জল! মুগ্ধতা নিয়েছিল ঘরে'…। 

বান্দরবান বা সাজেকের কোন রিসোর্টে গেলে মনে হতে পারে যে মেঘ ঘুমুচ্ছে পাহাড়ে হেলান দিয়ে। সেই মেঘ ছুঁয়ে যাচ্ছে আপনার গাল, শরীর কিংবা পা। মনে হতে পারে পাহাড়ের আঁকাবাঁকা রাস্তা থেকে একবার পড়ে গেলে কেউ আর আপনাকে খুঁজে পাবে না। পাহাড়ের চূড়ায় বসে আকাশভাঙ্গা জ্যোৎস্নার ঢলে স্নান করতে করতে আপনার মনে হতে পারে পৃথিবীর সব তারা আপনার বন্ধু। এদের সাথে আকাশে ঝুলে থাকার ইচ্ছে জাগতে পারে আপনার। মনে হতে পারে সেই গানের লাইন- পাহাড়ের কাছে এলে কেন মনে হয় একাকী দাঁড়িয়ে থাকি?…

তবে কবি সাহিত্যিকরা শুধু যে রিসোর্টে গিয়ে লেখালেখি করেন এমন উদাহরণের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে লেখার উদাহরণও আছে। আর্নেস্ট হোমিংওয়ে লিখতেন দাঁড়িয়ে। বক্তৃতার ডায়েজের মতো একটা কাঠের স্থাপনায় টাইপ রাইটার রেখে টকাস টকাস করে টাইপ করতেন আর লেখা শেষ হলে কাগজগুলো হাওয়ায় উড়িয়ে দিতেন যা আবার পড়ে থাকতো মেঝেতে। আর শুয়ে শুয়ে লিখতেন জেমস জয়েস। চোখ খারাপ ছিল বলে নীল কালিতে বড় বড় করে লিখতেন। ওয়াল্টার স্কট কবিতা লিখতেন ঘোড়ার পিঠে চড়ে। আলেকজান্ডার নভোকভ লিখতেন পার্ক করা গাড়ির ভেতরে বসে আর এদেশের জনপ্রিয়তম লেখক হুমায়ূন আহমেদ লিখতেন মেঝেতে বসে জলচৌকি কিংবা ক্যাশবাক্স টাইপ একটা টেবিলের ওপর কাগজ রেখে! অগাথা ক্রিস্টি রহস্য গল্পের কাহিনী সাজাতেন বাথটাবে শুয়ে আর ভিক্টর হুগো তার বিখ্যাত উপন্যাস হ্যাঞ্চব্যাক অব নটরডেম লিখেছিলেন ন্যাংটো হয়ে! অ্যাডগার অ্যালান পো যখন লিখতেন তখন তার পাশে থাকতো পোষা বিড়াল।

প্রেম বা বিয়ে করলে মানুষ নাকি 'পোষা' হয়ে যায়! এই পোষা হয়ে যাওয়াটা নাকি ভালোবাসার রেজিমেন্টেশন। পোষা মানুষকে নিয়েই মানুষ যেতে চায় সমুদ্রে, পাহাড়ে কিংবা নিদেনপক্ষে রিসোর্টে। প্রেম নির্জনতা চায়। নচিকেতা তার গানে বলেছিলেন- এদেশে প্রকাশ্যে ঘুষ খাওয়া অপরাধ না, প্রকাশ্যে চুমু খাওয়া অপরাধ। মানুষের জন্য ভালোবাসাটাই আসল। এদেশে প্রচুর রিসোর্ট গড়ে উঠেছে। পর্যটন শিল্প কিংবা ভ্রমণকে ভালোবেসে রিসোর্টগুলোতে বারবার যাওয়া আসা করলে এই শিল্পটা আরও ভালোমতো টিকে থাকবে। কাকে নিয়ে সেখানে যাবেন আর কাকে নিয়ে যাবেন না, কাবিন নামা সঙ্গে নেবেন কি নেবেন না সব কিছু হিসেব করলে চলবে? কবি সাহিত্যিক এবং রিসোর্ট নিয়ে লেখাটা শুরু করেছিলাম। শেষ করি তাদের দিয়েই। দয়া করে এসব গল্পের ভেতর কোন হিসেব নিকেশ খুঁজতে যাবেন না।

গল্প এক. 

মার্ক টোয়েনের ভ্রমন কাহিনী নিয়ে বহু গল্প প্রচলিত আছে। ধারণা করা হতো তিনি এক ঈশ্বর এবং এক বান্ধবীতে ( সম্পর্কের একজন থাকলে অন্য আর কেউ নয়) বিশ্বাসী। তাকে একবার জিজ্ঞাসা করা হলো- এমন একজন মহাপুরুষ দেখান যিনি বহুবিবাহের বিপক্ষে ছিলেন। মার্ক টোয়েন চট করে উত্তর দিয়েছিলেন- কেন যিশু খ্রিস্টকে চোখে পড়ে না? উনি-ই তো বলেছেন- একজন মানুষের পক্ষে দুই জন মনিবের সেবা করা সম্ভব না!

পৃথিবীর নিয়ম হচ্ছে যাকে আপনি ভালোবাসেন বা পছন্দ করেন, তার সাথে আপনার ব্যবহার যেমন হয়, যাকে অপছন্দ করেন তার সাথে ব্যবহার বা তাকে নিয়ে মন্তব্য হয় ভিন্ন। 

গল্প দুই. 

বিশ্বাস করুন আর না-ই করুন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের মধ্যে সম্পর্ক ছিল খুব ভালো। শামসুর রাহমান ও আল মাহমুদের সাথেও একদা সম্পর্ক খুব ভালো ছিল। নিচের গল্পটা যখন তাদের মধ্যে ভালো সম্পর্ক ছিল সেই সময়কার। গল্পটা কবি আবু হাসান শাহরিয়ারের এক লেখা থেকে নেওয়া-

ভারতের সাবেক বিচারপতি বিমল বসাকের কলকাতার বাসভবনে আড্ডা হচ্ছে । সেখানে উপস্থিত আছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, আল মাহমুদ, শামসুর রাহমান,তারাপদ রায়, শরৎকুমার মুখোপাধ্যায় এবং আবু হাসান শাহরিয়ার সহ আরও অনেকে। এই আড্ডার ভেতর হঠাৎ করেই আল মাহমুদ শামসুর রাহমানকে বললেন- ঘাড় নাড়াতে পারছি না।

শামসুর রাহমান: আমার কাছে এই রোগের একটা টোটকা জানা আছে। 

আল মাহমুদ: কী সেটা?

শামছুর রাহমানঃ খচ্চর দিয়ে চাটালে ঘাড়ের ব্যথার তাৎক্ষনিক উপশম পাওয়া যায়!

আল মাহমুদ খানিক ভেবে বললেন-  ফজলা ( ফজল শাহাবুদ্দীন) এখানে আসে নি। ও আসলে ওকে দিয়ে চাটানো যেত। আপনি অন্য টোটকা জানা থাকলে বলেন। 

উল্লেখ্য ফজল শাহাবুদ্দীনের সাথে শামসুর রাহমানের ভালো সম্পর্ক ছিল। শামসুর রাহমান সেটা বুঝতে পেরে তাদের সাথে আসা আল মুজাহিদীর দিকে ইঙ্গিত করে উত্তর দিলেন- কেন আপনি (আল মাহমুদ) নিজেই তো একজন খচ্চরকে সাথে করে এনেছেন। কিছুক্ষণ আগে না তাকে (আল মুজাহিদী) নীচে পাঠালেন শাহীপান কিনে আনার জন্য? 

রিসোর্টে রিসোর্টে ঘুরুন আর শাহীপান খান!