তিস্তা চুক্তি: নতুনত্ব নয়, আশ্বাসের পুনরাবৃত্তি

এম এম খালেকুজ্জামানএম এম খালেকুজ্জামান
Published : 10 Feb 2012, 07:41 AM
Updated : 5 April 2021, 03:34 PM

উন্নয়ন ডিসকোর্সে 'সুষম উন্নয়ন' শব্দ সমষ্টি ইদানিংকালে কেবল তত্ত্বভূকদের আলোচনার বিষয় নয় বরং এর ফলিত রূপায়ন সাফল্য ব্যর্থতার নির্ণায়কের মর্যাদা পেয়েছে। সে উন্নয়ন কোনও রাষ্ট্রীয় সীমানার মধ্যে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হোক কিংবা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্কোন্নয়নের ক্ষেত্রেই হোক।

বাংলাদেশ ভারতের আবহমানের সম্পর্কেও  'সুষম উন্নয়ন' অতি আলোচিত প্রপঞ্চ। দেশ দুইটি যৌথভাবে তাদের উন্নয়ন ও বিকাশ যাত্রা জারি রাখতে চায়।

মাত্রই শেষ হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর উদযাপনে নরেন্দ্র মোদির সফর। প্রলম্বিত মহামারীর প্রেক্ষাপটে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর এ সফরের হিসাব-নিকাশ বাঞ্ছনীয়। এবারও সর্বোচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তিস্তা চুক্তির বিষয়ে জানতে চাইলে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী বরাবরের মতো আশ্বাসই কেবল দিয়েছেন। 

সফর নিয়ে ব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, নরেন্দ্র মোদীর কাছে তিস্তা নিয়ে জানতে চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। 

তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে বলেছেন, বহু বছর আগে তিস্তা চুক্তির বিষয়ে সমঝোতায় পৌঁছানো গেলেও এখনো তা বাস্তবায়িত হচ্ছে না। তিস্তার বিষয়ে বাংলাদেশের মানুষের অন্য রকম আকাঙ্ক্ষা রয়েছে। এ বিষয়ে নরেন্দ্র মোদির বিশেষ উদ্যোগ চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। 

ভারতের প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে কোনো উত্তর দেননি। নির্দিষ্ট কোনও দিনক্ষণও বলেননি যে কখন বিষয়টির সুরাহা হতে পারে। তবে ভারত চুক্তির বিষয়ে অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছে। বাংলাদেশ সেই অঙ্গীকারে আস্থা রাখতে চায়। (সূত্র: প্রথম আলো) 

বাঙালি নতুনত্ব চায় না, পুনরাবৃত্তিতে বিশ্বাসী সে জন্যই কি চুক্তির আশ্বাসের পুনরাবৃত্তি করেছে?

চলমান পশ্চিমা সভ্যতার প্রতিনিধিত্বকারী দেশগুলোর নাজুক অর্থনীতি বিবেচনায় নিয়ে এশিয়ার দিকে তাকালে একটি বিষয় পরিস্কার-আগামীর ছড়ি থাকবে যে দুইটা দেশের হাতে, তার একটি চীন এবং অপরটি আমাদের আঙিনার কাছের দেশ ভারত। আমেরিকান ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স কমিশন  ২০১৪ সালের তৈরি করা বৈশ্বিক প্রতিবেদনের ভাষ্য এমন। 

মনমোহন সিং  এর শাসনামলে নিউ ইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জে এক ভাষণে 'ফাস্ট ট্র্যাক ডেভেলপমেন্ট' কর্মসূচির কথা বলেন। যাতে উৎপাদন ও বিনিয়োগের জন্য বাঁধ নির্মাণ থেকে শুরু করে ভৌত পরিকাঠামো নির্মাণে উচ্চাভিলাসী ভিশনের কথা বলা হয়। 

উন্নতির উচ্চাভিলাস ভারত ১৯৪৭ সালে  উপমহাদেশ ভাগের পর থেকেই লালন করে আসছে। নদীতে  বাঁধ দিয়ে কিংবা জলাধার নির্মাণ করে কোথাও বিদ্যুত উৎপাদন বাড়িয়েছে বা কোথাও চাষের জমির পরিমান বাড়িয়েছে। ফলদায়ী বাঁধগুলোকে 'নতুন ভারতের মন্দির' নাম দিয়ে একে সুরক্ষিত করতে চেয়েছেন নেহেরু। এভাবেই ভারত তার প্রতিবেশী দেশ চীন, নেপাল, ভুটান ও বাংলাদেশের সাথে আন্ত:নদী বিষয়ে বহুপাক্ষিক জটিলতার জালে  জড়িয়েছে।

দিল্লীর সাউথ ব্লকের পররাষ্ট্রনীতির এক বিরাট অংশ দখল করে আছে পানিবণ্টন সংক্রান্ত কূটনীতি। ইদানিং বাংলাদেশের সাথে ভারতের তিস্তা চুক্তির প্রেক্ষাপটে নতুনভাবে আবির্ভুত হয়েছে কেন্দ্রের সাউথ ব্লকের সাথে পশ্চিমবঙ্গের মহাকরণ (পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সচিবালয়) এর প্রাদেশিক কূটনীতি। গত কয়েক বছরে পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ে তো বটেই, মন্ত্রী পর্যায়ের সফর বেশ নিয়মিত হচ্ছে।  ভারতের  বাঙালি প্রেসিডেন্ট  প্রণব মুখার্জীর সফরে সীমান্ত প্রটোকল ও তিস্তা চুক্তির প্রতিশ্রুতি  পাওয়া গিয়েছিল। ২০১৫-তে 'ল্যান্ড বর্ডার বিল' ভারতীর সংসদে পেশ ও পাশ করে বাঙালি প্রণবের আশ্বাস পূরণে সর্ব-ভারতীয় অবদান অভূতপূর্ব। যদিও তিস্তা চুক্তি এখনও অনিষ্পন্ন। তারপরও দুইদেশের সৌহার্দ্যেরে আদান-প্রদান থেমে নেই। ভারত বাংলাদেশের সম্পর্ক নিয়মিত চর্চায় পরিণত হয়েছে।

তিস্তা চুক্তির প্রতিশ্রুতি নরেন্দ্র মোদী তার সফরগুলোতে আগেও দিয়েছেন। প্রতিবার যে কোনও উচ্চ পর্যায়ের সফরের আগে এভাবে অমীমাংসিত বিষয়ের মীমাংসার আশা নিয়ে বসে থাকে বাংলাদেশ, শেষে নিরাশায় তার অবসান হয়। তিস্তা চুক্তি বাংলাদেশের জন্য যেমন জরুরি ভারত তথা পশ্চিমবঙ্গের জন্যও জরুরি। এ নদীর অববাহিকায় দুই দেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর বসবাস। তিস্তার  ওপর নির্ভরশীল  এ অঞ্চলের পরিবেশ ও প্রতিবেশ। যেহেতু তিস্তা দিয়ে সারা বছর সমান পরিমাণ পানি প্রবাহিত হয় না। বাংলাদেশকে তিস্তার হিস্যা দেওয়ার আগে সিকিমের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের আলাদা করে সমঝোতা হওয়া দরকার বলে মনে করে রাজ্য সরকার। 

রাজ্যের অভিযোগ, গঙ্গা চুক্তির সময় বিহার বা উত্তর প্রদেশের সঙ্গে এ বোঝাপড়া না হওয়ায় তারা অনেক বেশি পানি টেনে নেয়। চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশকে দিয়ে রাজ্যের জন্য আর যথেষ্ট প্রবাহ থাকে না। যে কারণে মরে যাচ্ছে হলদিয়া বন্দর। গঙ্গার ড্রেজিং বা সঙ্কোশ নদীর পানি বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে খাল কেটে গঙ্গায় এনে ফেলার যে প্রতিশ্রুতি কেন্দ্র দিয়েছিল তাও রাখা হয়নি। এ বিষয়গুলো যথাযথ বিবেচনায় নিয়ে তারপর অন্তর্বর্তী চুক্তি হবে-  এমন অবস্থা ছিল মমতা সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর। 

বাংলাদেশ ও ভারতের রাষ্ট্রীয় শীর্ষ পর্যায়ে চূড়ান্ত তৎপরতার প্রেক্ষিতে  মমতা প্রশাসন কল্যাণ রুদ্রকে নিয়ে একটি কমিটি করে দেন তিস্তা চুক্তি সম্পাদনের আগের হোমওয়ার্ক হিসেবে। কেন্দ্রীয় জল কমিশনের কাছ থেকে সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান  না পাওয়ায় রিপোর্টে তিস্তার পানি-বণ্টন নিয়ে কোনও সুনির্দিষ্ট সুপারিশই করতে পারেনি রুদ্র কমিটি।

কল্যাণ রুদ্র কমিটির অসম্পূর্ণ রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশকে কতটা জল দেওয়া যায় তা নির্ধারণ করার আগে নদীর প্রবহমানতা, তিস্তায় পানির সঠিক পরিমাণ ও এদেশের অভ্যন্তরীণ প্রয়োজনের বিষয়গুলো জানাটা অত্যন্ত জরুরি। 

কিন্তু কেন্দ্রীয় জল কমিশন থেকে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য দেওয়া হয়নি। ফলে কমিটি কোনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেনি। সুতরাং রুদ্র কমিটির চূড়ান্ত রিপোর্ট যেমন সরকারের হাতে জমা পড়েনি, তেমনই রাজ্য সরকারও বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তা চুক্তি নিয়ে কোনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেনি ।

মূলত ২০১১ সালের মনমোহন সিং এর ঢাকা সফরেই তিস্তা চুক্তির প্রবল সম্ভাবনা থাকলেও পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের বিরোধিতায় তা হয়নি। পানি সংকটে ভুগতে থাকা তিস্তাবাসীর সাথে সকল বাংলাদেশি এতে যুগপৎ হতাশ ও ব্যথিত হয়। আরও দুঃখের বিষয় প্রণব মুখার্জী তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন মমতা বন্দোপ্যাধ্যায়। মমতার দল যখন ইউপিএ সরকারের জোটে ছিল তার প্রেক্ষিতে কল্যাণ রুদ্র কমিটি করে দিয়েছিল। জোট ছাড়ার পর সে দায় আর নিতে চাচ্ছে না, যে কারণে তিস্তা চুক্তি প্রায় অনিশ্চিত। আন্তঃরাষ্ট্রিক সম্পর্কের নিয়ামক এখন প্রাদেশিক মূখ্যের ইচ্ছা ও দলীয় লাভালাভ।  

বহু স্তর বিশিষ্ট গণতন্ত্রের দেশ ভারতে আন্তঃদেশীয় চুক্তি সই করার আগে রাজ্য সরকারগুলোর মতামত যে গুরুত্বপূর্ণ সেটা আমলে না নেওয়াতেই  সমস্যা। ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে বন্ধুত্ব হলেও জাতিগত সদ্ভাব থাকলেও আন্তঃরাষ্ট্রিক সম্পর্ক কেবল এ সবের ভিত্তিতে হয় না। আন্তঃরাষ্ট্রিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে দুই রাষ্ট্রের স্বার্থই- কেন্দ্রীয় বিবেচনার বিষয়। তবে ভারত বাংলাদেশের আবহমান কালের সৌহার্দ্য এবং গত কয়েক  বছরে ভারতের নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বাংলাদেশের অবদানের কথা বিবেচনায় নিয়ে তিস্তা চুক্তিতে সম্মত হলে দুই দেশের সম্পর্কে ভারসাম্য আসবে।