স্বাধীনতার ৫০ বছর: আকরাম খান ও আইসিসি জয়

নাজমুল হক তপন
Published : 31 March 2021, 02:56 AM
Updated : 31 March 2021, 02:56 AM

সেদিন আকরাম খানের ব্যাট যদি কথা না বলত? টুং-টাং শব্দে রানের দ্যোতনা না ছড়াতো? তবে বাংলাদেশ ক্রিকেটের ভবিষ্যত কিভাবে লেখা হত কিংবা কোথায় গিয়ে দাঁড়াতো?

এই ছোট্ট প্রশ্নটা বোধকরি এখন অপ্রয়োজনীয়। তবে বাংলাদেশ ক্রিকেট ইতিহাসের সব থেকে প্রয়োজনীয় ইনিংসটি যে সেদিন আকরাম খান খেলেছিলেন, এ নিয়ে হয়ত কেউই দ্বিমত করবেন না। 

দুই যুগ পেছনে যাওয়া যাক। ১৯৯৭ সালের ৪ এপ্রিল। মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালা লামপুর থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে সুগোই বুলোর রাবার রিসার্চ ইনস্টিটিউট মাঠে নেদারল্যান্ডসের মুখোমুখি বাংলাদেশ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জহুরুল হক হলের নিচে ভেতরের দিকে চায়ের দোকানে অনেকের সঙ্গে ম্যাচের ধারা বিবরণী শুনছি রেডিওতে। পরপর বেশ কয়েকটি চায়ের দোকান। দোকানিরা তো বটেই, শিক্ষার্থীদের অনেকের হাতেই ছোট ছোট এক ব্যান্ডের রেডিও। 

টস জিতে প্রতিপক্ষকে ব্যাটিংয়ে পাঠালেন অধিনায়ক আকরাম। শান্ত, রফিকদের আটঁসাঁট বোলিংয়ে ১৭১ রানে অলআউট ডাচরা। যথেষ্টই ভাল সুযোগ। জিতলেই সেমি-ফাইনাল। এরপর এক ম্যাচ জিতলেই প্রথমবারের মত বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্নপূরণ। কিন্তু হারলে? যেহেতু তখন পর্যন্ত ওই আসরে একটা ম্যাচেও হারেনি বাংলাদেশ। ব্যাটিং লাইনআপ যথেষ্ট লম্বা। টার্গেটও ধরাছোঁয়ার মধ্যে। তাই হারের শঙ্কা মাথায় আসেনি। কিন্তু ব্যাটিং শুরু হতে না হতেই কেটে গেল স্বপ্নের ঘোর। বালির বাঁধের মত ধসে পড়ল টপ অর্ডার। ১৫ রান তুলতেই ৪ উইকেট নাই। একে একে বিদায় নিলেন নাইমুর রহমান দুর্জয় (০), আতহার আলী খান (৪) , সানোয়ার হোসেন (০) ও আমিনুল ইসলাম বুলবুল (৪)।

রেডিও-তে কান পেতে থাকা অনেকেরই উচ্ছ্বাস রূপ নিয়েছে ক্ষোভে। রেডিও ছুঁড়ে ফেলতে দেখলাম কাউকে কাউকে। আগের মতই বাংলাদেশ বিশ্বকাপে খেলতে পারবে না, মোটামুটি এই অনুসিদ্ধান্ত টেনে ফেলেছে অনেকে। আমিও সেই দলে। ম্যাচের ধারা বিবরণী শোনা অনর্থক বিবেচনা করে বেরিয়ে এলাম হল থেকে। সঙ্গী আমিনুল ইসলাম সজল (ওই সময় একটি দৈনিকের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক)। রাস্তায় নেমে ইতস্তত হাঁটাহাটিঁ করছি। রেডিও ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে অসহায় উদভ্রান্তের মত তাকিয়ে আছে-দেখলাম এমন অনেককেই। আমরা দুজনও চুপচাপ।

বেশ কিছুক্ষণ পর নীরবতা ভাঙল সজল, "বাংলাদেশের জন্য কোন কিছু করতে চাইলে নিজেকেই করতে হবে। কারো ওপর নির্ভর করা চলবে না। দেশকে বিশ্বকাপে দেখতে চাইলে নিজেদেরই ক্রিকেট খেলতে হবে।" আবারও দুইজনের কথা বন্ধ। কিছুক্ষণ পর নিজেকে আবিস্কার করলাম টিএসসিতে। পরিচিতদের নাগাল এড়িয়ে, টিএসসি এলাকা পেরিয়ে রাস্তার এক পাশটাতে দাঁড়ালাম। বেশ ধীরে হলেও ধারাভাষ্য শুনতে পাচ্ছি। আশা-শঙ্কা ‍দুটোই সঙ্গী করে কান খাড়া করে শুনছি। 

উইকেটে আকরাম খানের সঙ্গী মিনহাজুল আবেদীন নান্নু। ধারাভাষ্যকার বলে চলেছেন, আকাশে মেঘ জমেছে। ২০ ওভার ব্যাটিং হয়ে গেলে চরম বিপদ। সেমি-ফাইনালের আগেই বিদায়। অজানা আশঙ্কায় বুকটা ধুকপুক করতে থাকে। এক চিলতে আশাটুকু দুলতে থাকা আশা-নিরাশার দোলাচলে। সেই পুরনো দুঃস্বপ্নগুলোই ভেসে উঠেছে বারবার। এক বুক আশা নিয়ে আইসিসিতে অংশ নেওয়া, অতঃপর হতাশার চোরাবালিতে ডুবে যাওয়া। এমনি করে আর কতবার? এবারও কী? এমন কত প্রশ্নের আকিঁবুকি!

১৯৯৪ এর আইসিসি ট্রফিতে এই নেদারল্যান্ডসের কাছেই হারের মাশুল গুণতে হয়েছে। স্বপ্নযাত্রার সমাধি হয় কেনিয়ার বিপক্ষে হারের মধ্য দিয়ে। 

১৯৯৭ আইসিসির ট্রফিতে ভালভাবেই শুরু করল আকরাম বাহিনী। পাঁচ ম্যাচের সবচগুলেতেই জিতে গ্রুপ সেরার মুকুট পরে দ্বিতীয় রাউন্ডে পৌঁছুল বাংলাদেশ। শুরু হলো সেমি-ফাইনালে ওঠার যুদ্ধ। বিশ্বকাপের চৌকাঠে পা রাখতে হলে সেরা তিনের মধ্যে থাকতে হবে, এই বাস্তবতার সামনে হংকংকে ৭ উইকেটে হারিয়ে যেন এক লাফে প্রথম বাধাঁ পেরুল দল।

কিন্তু দ্বিতীয় ম্যাচেই ভাগ্যাকাশে জমল কালো মেঘ। আয়ারল্যান্ডকে মাত্র ১২৯ রানে বেঁধে ফেলল আকরাম বাহিনী। জবাবে ব্যাট করতে নেমে ৭.৪ ওভারে ২৪ রান জমা পড়ল স্কোরবোর্ডে। এরপরই হানা দিল বৃষ্টি। ম্যাচ পরিত্যাক্ত হওয়াতে দু'দলই পেল এক পয়েন্ট করে। এই ম্যাচ জিতলে সেমি-ফাইনাল নিশ্চিত হয়ে যেত। কিন্ত আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে পয়েন্ট ভাগাভাগি হওয়াতেই বাঁধলো বিপত্তি।

নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে জিততেই হবে-বাস্তবতার মুখে পড়ল বাংলাদেশ। সেমির রেসে থাকতে দুদলের জন্যই একই সমীকরণ। মানে জয়ই একমাত্র বিকল্প। তবে বৃষ্টিতে ম্যাচ পরিত্যক্ত হলে ডাচদের পিছনে ফেলে সেমির ছাড়পত্র পাবে বাংলাদেশ। আকাশেও জমে ছিল মেঘ। কিন্তু বৃষ্টি নামার আগে বাংলাদেশ ২০ ওভার ব্যাট করলে সর্বনাশ! ২০ ওভার ব্যাটিং হওয়া মানে ম্যাচ পরিত্যক্ত হওয়ার কোন সুযোগই নাই। 

একদিকে ডাচরা দ্রুত ওভার শেষ করতে চাইছে, অন্যদিকে আকরাম আর নান্নু নানা ছুঁতোয় করছেন সময়ক্ষেপণ। বারবার পানি খেতে চাওয়া, সাইটস্ক্রিন ঠিক করার কথা বলা, উইকেট থেকে ময়লা পরিষ্কার করা, গ্লাভস বদলানো এসব চলতে লাগল। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হল। কিন্তু জোরে বৃষ্টি যে আসছে না! খেলা চলছে। টেনশন বাড়ছে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। অবশেষে এলো কাঙিক্ষত সেই বৃষ্টি। ম্যাচ বন্ধ করতে বাধ্য হলেন আম্পায়ার। খেলা হল ১৮.৩ ওভার। ওই সময় বাংলাদেশের স্কোরবোর্ডে ছিল ৫৬/৪। ম্যাচ জয়ের জন্য ২০ ওভারে দরকার ছিল ৭৭ রান। বৃষ্টিতে খেলা বন্ধ হওয়াতে ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল। 

কিন্তু এই সুখস্মৃতিও মিলিয়ে গেল দ্রুতই। আকরাম খান টানা বলতে থাকেন, "বৃষ্টি চলাকালীনই খবর পেলাম সেমি-ফাইনালে যেতে হলে ম্যাচে জিততে হবে। ভীষণ মন খারাপ হল। নতুন করে চাপে পড়ে গেলাম। বৃষ্টি থামল। খেলা শুরু হবে। কিন্তু মাঠে তো পানি জমে গেছে। মাঠকে খেলার উপযোগী করে তুলতে ঝাঁপিয়ে পড়লাম আমরা সবাই। প্লেয়ার, স্টাফ, সাংবাদিক সবাই নেমে পড়লাম মাঠ পরিচর্যায়। যোগ দিলেন কোচ গর্ডন গ্রিনিজও। আমাদের গায়ে জড়ানো ছিল তোয়ালে। এই তোয়ালে দিয়ে মাঠ শুকানোর চেষ্টা করে যাচ্ছি।"

বৃষ্টির পর আবার ম্যাচ শুরু হল। ডাকওয়ার্থ-লুইস পদ্ধতিতে পরিবর্তিত টার্গেট দাঁড়াল ৩৩ ওভারে ১৪১ রান। অর্থাৎ, ম্যাচ জিততে ৮৫ বলে প্রয়োজন ৮৫ রানের। ওই সময় ওয়ানডে ক্রিকেটে বলে বলে রান তোলাটা সেভাবে রপ্ত হয়নি। এদিকে বৃষ্টি ভেজা ভারী মাঠে বাউন্ডারি মারাটাও বেশ কঠিন। কিন্তু কঠিনেরে ভালোবাসলেন আকরাম-নান্নুরা। ওই ম্যাচ নিয়ে আকরাম খান জানান, "বুঝতে পারলাম বাউন্ডারি মারাটা ভীষণ কঠিন। এদিকে বলে বলে রান করতে হবে। উইকেটের অন্যপ্রান্ত থেকে নান্নু ভাই সাহস দিচ্ছেন। তুই উইকেটে থাক। আমি সাপোর্ট দেব। সিঙ্গেলস-ডাবলস নিয়ে আমরা এগিয়ে যাব।" 

কিন্তু ভরসা জুগিয়ে যাওয়া নান্নুও নিলেন বিদায়। বাংলাদেশ তখন মাঝপথেও পৌঁছায়নি। ঢাকায় বসে কুয়ালা লামপুরের সেই উইকেটে ফিরে যান আকরাম, যেখানে ২৪ বছর আগে চোয়ালবদ্ধ প্রত্যয় নিয়ে পিচ কামড়ে পড়ে ছিলেন, "নান্নু ভাই আউট হওয়ার পর উইকেটে এলেন মনি (এনামুল হক মনি) ভাই । রানিং বিটুইন উইকেটে মনি ভাই খুবই ভাল। তিনি আমাকে ঠাণ্ডা মাথায় একপ্রান্ত ধরে রাখতে বললেন।"

নান্নু (২২) আউট হওয়ার সময় স্কোরবোর্ডে ৭৭/৫। জয় থেকে ৬৪ রানের দুরত্ব। এর সঙ্গে ৯ রান যোগ হতেই ফিরলেন মনি। হারের শঙ্কা ক্রমেই গ্রাস করছে। একদিকে উইকেট পড়ছে, অন্যদিকে বাড়ছে বল আর রানের ব্যবধান। কিন্তু সপ্তম উইকেট জুটিতে সাইফুলকে নিয়ে সব সমীকরণ মিলিয়ে ফেললেন আকরাম। সাইফুল (২০ বলে ১৮) যতক্ষণে বিদায় নিলেন, ততক্ষণে জয় প্রায় মুঠোবন্দি। সেমির নাগাল পেতে প্রয়োজন মাত্র ৩ রান। নতুন সঙ্গী খালেদ মাসুদ পাইলটকে ব্যাট করার সুযোগ না দিয়েই জয় নিশ্চিত করে মাঠ ছাড়লেন আকরাম।

৮ বল হাতে রেখে ৩ উইকেটের জয় নিয়ে সেমি-ফাইনালের মঞ্চে উঠল বাংলাদেশ। ইউনিভার্সিটিতে তখন আনন্দের বন্যা। মিছিলের পর মিছিল। মিশে গেলাম জনতার স্রোতে; আনন্দরাত উদযাপনে। এই ইনিংস সম্পর্কে আকরাম খান বলেন, "বারবার মনে হচ্ছিল দেশের কথা। দেশের মানুষের কথা। আমার ইনিংসটা যে দেশের কাজে লেগেছে এটাই সবচেয়ে বড় ব্যাপার।" 

ম্যাচটা কোন টুর্নামেন্টের ফাইনাল নয়। এমনকি সেমি-ফাইনালও নয়। ক্রিকেটের সর্বোচ্চ যে আন্তর্জাতিক রেকর্ড বই, সেখানেও ম্যাচটির কোন জায়গা নাই। তারপরও বাংলাদেশ ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় সুখস্বপ্ন কিংবা তারচেয়েও বেশি কিছু ম্যাচটি। এই ম্যাচ থেকেই ক্রিকেটের দেশ হয়ে ওঠার স্বপ্নের সিঁড়ির সন্ধান পায় বাংলাদেশ। আর এটা সম্ভব হয়েছিল ওই ইনিংসের বদৌলতে। দুই যুগ আগে ওই ম্যাচে ১২ কোটি মানুষের সবটুকু আবেগ- স্বপ্নের সঙ্গে একাত্ম হয়ে ওঠার থ্রিলার লেখেন আকরাম খান। বাংলাদেশ ক্রিকেট পেয়ে যায় স্বপ্নের ভিত।

৯২ বলে অপরাজিত ৬৮। স্ট্রাইক রেট ৭৫ এর নিচে। ছক্কা নাই। চারের মার মোটে তিনটি। এ সময়ের ওয়ানডে ক্রিকেটে ভুরিভুরি ডবল সেঞ্চুরির যুগে এই ইনিংসটাকে কি বলা যায় মাঝারি মানের, গড়পড়তা? ক্রিকেটের সংখ্যা যে সেরা গল্পগুলোর প্রকৃত ছবি প্রায়শই তুলে ধরতে পারে না, তারই এক দৃষ্টান্ত আকরামের সেই ইনিংসটি। সাধে কি আর স্কোরবোর্ডকে বলা হয় 'গাধা'! এখানে বলা রাখা দরকার, ওই ম্যাচে ২টি উইকেটও পেয়েছিলেন আকরাম। একটি ছিল ডাচ ইনিংসের সর্বোচ্চ রান করা রবার্ট ফন ওস্টেরোমের উইকেট। হয়েছিলেন ম্যাচ সেরা।

এরপর বাংলাদেশকে যেন আটকানোর সাধ্য ছিল না কারোরই। সেমি-ফাইনালে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে জয় এলো ৭২ রানের বিশাল ব্যবধানে। প্রথমবারের মত বিশ্বকাপের মূলমঞ্চে জায়গা করে নিল বাংলাদেশ। রং খেলার উৎসবে মেতে উঠল পুরো দেশ। যে যাকে পাচ্ছে, রং লাগিয়ে দিচ্ছে। সে এক অপূর্ব দৃশ্য।

এলো ফাইনাল। প্রতিপক্ষ কেনিয়া। আগের আসরে এই কেনিয়ার কাছে হেরেই জলাঞ্জলি দিতে হয়েছিল বিশ্বকাপ স্বপ্ন। ফাইনালের আগে দুদলই অপরাজিত। ম্যাচটি শিরোপার লড়াইয়ের সঙ্গে হয়ে উঠল একটা মনস্তাত্বিক লড়াইও। স্নায়ুক্ষয়ী ওই ফাইনালে আগে ব্যাট করতে নেমে ৭ উইকেট হারিয়ে ২৪১ রান সংগ্রহ করল কেনিয়া। বৃষ্টির কারণ ম্যাচ গড়াল দ্বিতীয় দিনে। বাংলাদেশের সামনে পরিবর্তিত টার্গেট দাঁড়াল ২৫ ওভারে ১৬৬ রান। পেন্ডুলামের মত দুলতে থাকা ম্যাচটির নিষ্পত্তি হল শেষ ওভারের শেষ বলের নাটকীয়তায়।

স্ট্রাইকে হাসিবুল হোসেন শান্ত। বোলার অভিজ্ঞ মার্টিন সুজি। নিজেদের মধ্যে শলা-পরামর্শ করে নিলেন খালেদ মাসুদ পাইলট ও শান্ত। বাউন্ডারি না মেরে, বল যেখানেই থাক দৌড়ে সিঙ্গেল নিতে হবে-এই নিদ্ধান্ত নিলেন দুজনে। সারাদেশের মনোযোগ যথারীতি রেডিওতে। বল ব্যাটে করতে পারলেন না শান্ত। প্যাডে লেগে চলে গেল শর্ট ফাইন লেগ অঞ্চলে। কেনিয়া উইকেটরক্ষক কেনেডি ওটিয়ানো বল ধরার আগেই এক ছুটে প্রান্ত বদল করে নিলেন শান্ত ও পাইলট। রুদ্ধশ্বাস ফাইনালে বাংলাদেশ জিতল ২ উইকেটের ব্যবধানে। পুরো দেশ আবারও মাতোয়ারা হয়ে উঠল উৎসব-আনন্দে। রাস্তায় শুধু মানুষ মানুষ। অনেকের বুকে-পিঠে লেখা 'খুশীতে শহীদ হব'!

নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে জয়ের পর মানসিক জোর অনেক বেড়ে গিয়েছিল জানিয়ে আকরাম খান বলেন, "নেদারল্যান্ডসকে হারানোর পর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী টেলিফোন করেছিলেন। এটা আমাদের ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল। তখনও কিন্তু আমাদের বিশ্বকাপ খেলা নিশ্চিত হয়নি। ওইদিন সন্ধ্যায় আমরা একটা মিটিং করেছিলাম। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ফোন, দেশবাসীর চাওয়া, এসব নিয়ে আমরা আলোচনা করলাম। টিম ম্যানেজার লিপু ( গাজী আশরাফ হোসেন চৌধুরী) ভাই অনেক পরামর্শ দিলেন। কোনভাবেই এই সুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না, এই বিশ্বাসে আমরা সবাই একাত্ম হলাম। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী আমাদের ফ্যাক্স করে অভিনন্দন বার্তা পাঠান। সেটি আমি যত্ন করে রেখে দিয়েছি।"

দেশে ফিরলেন আইসিসি বিজয়ী বীরেরা। গণসংবর্ধনায় উপস্থিত হলেন লক্ষাধিক মানুষ। প্রত্যেক ক্রিকেটারকে ৫ কাঠা করে জমি ও গাড়ী দেওয়ার ঘোষণা দিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পুরো বিষয় নিয়ে আকরাম খানের ভাষ্য, "আইসসি ট্রফিতে যখন খেলতে গেলাম, তখন দেশের দ্বিতীয় খেলা ক্রিকেট। আর দেশে ফেরার পর ক্রিকেট পরিণত হল এক নম্বর খেলায়।"

১৯৯৭ সালের আইসিসি বিজয়কে একটা ধারাবাহিক প্রয়াসের ফল হিসাবেই দেখেন আকরাম খান, "১৯৯৪ এর আইসিসি ট্রফিতে ব্যর্থ হওয়ার পর আমাদের মানে ক্রিকেটারদের অনেক ভোগান্তিতে পড়তে হয়। অনেক কটু কথা, সমালোচনা হজম করতে হয় ক্রিকেটারদের। এখান থেকে উঠে আসাটা সহজ ছিল না। সম্মিলিত চেষ্টাতেই আমরা উঠে দাঁড়াতে পেরেছিলাম।"

উদাহরণ হিসেবে টানলেন ১৯৯৪ সালে অধিনায়কত্ব পাওয়ার কথা, "এর আগ পর্যন্ত ঘরোয়া ক্রিকেটে নেতৃত্ব দেয়ার কোন অভিজ্ঞতা আমার ছিল না। দলে বেশ কয়েকজন সিনিয়র ছিলেন। কিন্তু আমাদের কোন সমস্যা হয়নি। আমরা দেশের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েছি। আইসসিতে যাওয়ার আগে আমরা সাফল্যের ধারাতেই ছিলাম। ১৯৯৪ সালে সার্ক ক্রিকেটে রানার্সআপ ট্রফি জিতি। ওই আসরে 'এ' দল পাঠিয়েছিল ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা। রবিন লিগে ভারত ও শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে আমরা ফাইনালে উঠি। পাকিস্তানের সঙ্গে হেরেছিলাম ১ উইকেটে।" ভারতের ওই দলটিতে ছিলেন রাহুল দ্রাবিড়, প্রাভিন আম্বরে , ভেঙ্কটেশ প্রসাদেও মত ক্রিকেটার। ফাইনালে বাংলাদেশকে হারিয়ে শিরোপা জেতে ভারত। 

আইসিসিতে ট্রফিতে যাওয়ার আগে মালয়েশিয়াতে এসিসি ট্রফিতে জেতার কথাও উল্লেখ করে আকরাম বলেন, "১৯৯৬ সালে মালয়েশিয়াতে এসিসি ট্রফি জেতাটা অনেক দিক থেকেই ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ওই ট্রফি জিতে দেশে ফেরার পর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাদের প্রত্যেককে এক লাখ টাকা করে দেন। ক্রিকেটে এটাই ছিল প্রথমবারের মত আর্থিক প্রণোদনা পাওয়ার ঘটনা।" 

ওই আসরের আগে, আইসিসিতে টানা পাঁচবার অংশ নিয়েও কাঙ্ক্ষিত ফল পায়নি বাংলাদেশ। বিশেষ করে ১৯৯৪ সালে বিদায় নেয়াটা দেশের ক্রিকেটের জন্য ছিল খুব বড় একটা ধাক্কা। এখান থেকে বাংলাদেশ ক্রিকেট উঠে দাঁড়াতে পারবে কি-না এনিয়ে অনেকেই ছিলেন সংশয়ে। তবে ক্রিকেট ম্যানেজম্যান্ট উদ্যম হারায়নি বলে জানান বিসিবির অন্যতম পরিচালক আহমেদ সাজ্জাদুল আলম ববি, "আইসিসিতে সফল হব এই বিশ্বাস আমাদের ছিল। গর্ডন গ্রিনিজকে কোচ হিসাবে আনা হল। একটা বিষয় খেয়াল করেন। ১৯৯৭ এর বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয়েছিল মালয়েশিয়াতে। ওখানে ক্রিকেট খেলা হত অ্যাস্ট্রোটার্ফে। আমাদের অ্যাস্ট্রোটার্ফ ছিল না। আইসিসি ট্রফিকে মাথায় রেখে অ্যাস্ট্রোটার্ফ আনার ব্যবস্থা করা হয়। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম ও আবাহনী মাঠে বসানো হয় টার্ফ। আইসিসিতে যাওয়ার আগে দুটো মৌসুম এই টার্ফে খেলেছে আমাদের ক্রিকেটাররা।"

একটা বড় উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে ক্রিকেট সংশ্লিষ্টরা সবাই যার যার জায়গা থেকে সম্মিলিতভাবে চেষ্টা করে গেছে এবং একইসঙ্গে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে থেকে সহযোগিতা এসেছে, তারই সুফল ১৯৯৭ এর আইসিসি শিরোপা, পুরো বিষয়টাকে এভাবেই দেখেন আকরাম খান। 

এখন ক্রিকেট বোর্ডের অপারেশন্স প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন আইসিসি জয়ের এই মহানায়ক। তবে সেই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করার মানসিকতা যে নাই সেটা বুঝতে কারো বিশেষজ্ঞ হওযার প্রয়োজন পড়ে না। বোর্ড-প্লেয়ার দ্বন্দ্ব এখন অনেক বেশি প্রকাশ্য। অভিযোগ পাল্টা অভিযোগ নৈর্মিত্তিক ঘটনা। এসব নিয়ে আর ঘাঁটাঘাঁটি করতে চাইলাম না।

আকরাম খান শুধু বললেন, "এক পরিবারের আমরা তিনজন টেস্ট খেলেছি। দেশের জন্য সর্বোচ্চটাই দেয়ার চেষ্টা করেছি। তারপরও অভিযোগ শুনতে হয়। যারা জানে না, তাদের কথা না হয় বাদ দিলাম। কিন্তু জেনে বুঝেও যারা সমালোচনাকে উসকায়, সেটা খুবই দুঃখজনক। আমার কারণে তামিমকেও (তামিম ইকবাল) অকারণেই অনেক কথা শুনতে হয়। এসব দেখে শুনে ভীষণ কষ্ট হয়। মনে হয়, ক্রিকেটের জন্য আমরা আর কী করতে পারতাম?"