প্রেক্ষিত মোদীর আগমন ও হেফাজতে ইসলাম

শুভংকর বিশ্বাস
Published : 29 March 2021, 05:06 PM
Updated : 29 March 2021, 05:06 PM

ভারত ইস্যুতে প্রয়াত এন্ড্রু কিশোরের কণ্ঠে গাওয়া একটি গানের কথা প্রায়ই মনে পড়ে যায়-

"ভালোবাসা দিলাম শুধু, ভালোবাসা পেলাম না,

আশায় আশায় দিন যে কাটে, আশা পূরণ হলো না"

আমরা বাংলাদেশিরা ভারতকে শুধু ভালোবাসা দিয়েই গেলাম, তাদের কাছ থেকে ভালোবাসা পেলাম না। কথাটা কিন্তু মোটেও মিথ্যা না। আবার শতভাগ সত্যও নয়। ভারতকে সড়ক পথে ট্রানজিট দেওয়া, চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্র বন্দর ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমনে সহায়তা করা ইত্যাদিকে দেওয়ার খতিয়ানে লিপিবদ্ধ করলে স্থল ও সমুদ্র-সীমা নির্ধারণ, ছিটমহল বিনিময় এগুলোকে পাওয়ার খাতায় লিখতে হবে। তবে প্রশ্নাতীতভাবে আমরা লেনদেনে পিছিয়ে আছি। চুক্তি অনুযায়ী তিস্তার পানি আমরা পাচ্ছি না। আর বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে ভারত বাংলাদেশে ৯.২১ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানির বিপরীতে আমরা মাত্র ১ দশমিক ০৪ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি করতে পেরেছি। প্রতিবেশী একটা বড় দেশ, যাদের বাজার অনেক বড়, তাদের সাথে বাণিজ্যের আনুপাতিক হার কেমন হওয়া উচিত, সেটা অর্থনীতিবিদদের উপর ছেড়ে দিয়ে অন্য বিষয়ে একটু আলোকপাত করতে চাই।

ভারতের ব্যাপারে আমাদের এই যে এলার্জি, এটা কি শুধুই বিষয়ভিত্তিক, নাকি এর পেছনে অন্য কোনও বেদনা কাজ করে? আসুন গোটা দুয়েক উদাহরণ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাক।

এক

২০১২ সালের ২৯ জানুয়ারি বাংলাদেশের জাতীয় বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড ও ভারতের জাতীয় তাপবিদ্যুৎ করপোরেশন যৌথভাবে বাগেরহাট জেলার রামপালে সুন্দরবন থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে একটি কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে চুক্তি স্বাক্ষর করে। তারপর থেকেই পরিবেশ সংরক্ষণবাদীরা সুন্দরবন রক্ষার্থে বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরির বিপক্ষে আন্দোলন করে আসছেন। এই চুক্তির একটা অংশ ভারত হওয়ায় পরিবেশ সংরক্ষণবাদীরা খুব সহজেই বোনাস হিসেবে দেশের মানুষের বিরাট একটা অংশের সমর্থন পাচ্ছেন। উল্লেখ্য যে, আন্দোলনকারীরা সবাই কিন্তু সুন্দরবন বাঁচানোর নামে আন্দোলন করছেন।

এবার পাঠক বন্ধুদের দৃষ্টি একটু অন্যদিকে ঘোরাবো। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বিখ্যাত নেচার সাময়িকীতে প্রকাশিত প্রবন্ধে যুক্তরাজ্যের গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক উল্লেখ করেন যে, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে প্রতি বছর যে হারে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে তা অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সালের মধ্যে সুন্দরবনের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যেতে পারে। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ক্ষতিকর দিকগুলো কারও অজানা নয়। এই বৈশ্বিক উষ্ণতা মোকাবেলায় সুইডেনের ১৬ বছরে বালিকা গ্রেটা থুনবার্গের নেতৃত্বে ২০১৯ সালের ২০ সেপ্টেম্বর পৃথিবীর ইতিহাসে সর্ববৃহৎ গ্লোবাল ক্লাইমেট স্ট্রাইক অনুষ্ঠিত হয়েছিল যেখানে বিভিন্ন দেশের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের লাখ লাখ ছাত্রছাত্রীসহ সচেতন জনগণ ওইদিন রাস্তায় নেমে এসেছিল ক্লাইমেট মুভমেন্টকে সমর্থন জানাতে। সুইডেন, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশ যারা জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তুলনামূলক কম ক্ষতিগ্রস্ত, তারা যেভাবে অন্দোলনে সমর্থন জোগাতে রাস্তায় নেমেছিল, অস্তিত্বের হুমকিতে থাকা বাংলাদেশের মানুষ উক্ত আন্দোলনে কিন্তু সেভাবে সাড়া দেয়নি কয়েকটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের শিক্ষার্থী ছাড়া। অথচ আমাদেরই উচিত ছিল সবার আগে এই আন্দোলনের সাথে সর্বাত্মক একাত্মতা ঘোষণা করা।

আমার প্রশ্ন, রামপালে বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের বিরোধীতাকারীরা কি আসলেই সুন্দরবন বাঁচাতে চান নাকি সুন্দরবনকে ইস্যু করে রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করাই আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য?

দুই

বাংলাদেশে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও মুজিব জন্মশতবর্ষের অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে বাংলাদেশ সরকার যে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল, শুরু থেকেই তা বাতিল করার আহ্বান জানিয়ে আসছিল হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ।

তাদের বক্তব্য ছিল, "স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও মুজিববর্ষ উদযাপনে এমন কাউকে বাংলাদেশে নিয়ে আসা উচিত হবে না, যাকে এদেশের মানুষ চায় না বা যার আগমন এদেশের মানুষকে আহত করবে। কারণ নরেন্দ্র মোদী একজন মুসলিম বিদ্বেষী হিসাবে সারা বিশ্বে পরিচিত।"

মোদীর বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ হলো, গুজরাটের হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় সক্রিয় উস্কানি দেওয়া। ২০০২ সালের হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় গুজরাটে দু-হাজারেরও বেশি লোক প্রাণ হারিয়েছিলেন বলে ধারণা করা হয়, যাদের বেশিরভাগই ছিলেন মুসলিম। ওই ভয়াবহ দাঙ্গার সময় গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।

গুজরাটের এ দাঙ্গার ঘটনায় সরকারিভাবে গঠিত অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি জি টি নানাবতী ও অক্ষয় মেহতার কমিশন ২০১৪ সালে পনের শ পৃষ্ঠার চূড়ান্ত রিপোর্ট প্রকাশ করেছে নয়টি ভলিউমে। নানাবতী ও মেহতা কমিশন তাদের চূড়ান্ত এই প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে যে, রাজ্যের কোনো মন্ত্রী দাঙ্গায় প্ররোচনা বা উসকে দিয়েছে- এমন কোনো প্রমাণ নেই। ২০০২ সালের গুজরাটে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় নরেন্দ্র মোদী কোনোভাবে সম্পৃক্ত নয় বলে তদন্ত কমিশন তার প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে। একই সঙ্গে দায়িত্বে অবহেলা ও মানুষের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছে কমিশন। তিন দিন ধরে চলা দাঙ্গা রুখতে না পারায় পুলিশের 'অদক্ষতা ও দায়িত্বে আগ্রহের অভাব' ছিল বলে মন্তব্য করেছে কমিশন। তবে কমিশন এটিও বলেছে, পর্যাপ্ত সংখ্যক লোকবল ও অস্ত্রের অভাবেও পুলিশ পদক্ষেপ নিতে পারেনি।

অর্থাৎ, একটা অযৌক্তিক বা অনুমাননির্ভর বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে হেফাজতে ইসলাম মোদীকে আতিথেয়তা দেওয়া ব্যাপারে আপত্তি করে আসছিল। তার পরবর্তী ঘটনা আমরা সবাই জানি। এই ঘটনা এখন চলমান, তাই এই বিষয়ে এখনই কোনো শক্ত যবনিকা টানা যাচ্ছে না।

এখানে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। হেফাজত কিন্তু শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসের বাংলাদেশে আসার বিষয়ে একেবারে নীরব ভূমিকা পালন করেছে। যদিও সম্প্রতি শ্রীলংকা সরকার জাতীয় নিরাপত্তার যুক্তি দেখিয়ে সম্প্রতি জনসমক্ষে বোরকা ও নিকাবসহ সব ধরনের মুখ ঢাকা পোশাক পরা নিষিদ্ধ করার গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে। এটা নিশ্চয় হেফাজতের নীতির সাথে যায় না!

বিবিসির বরাতে আমরা জানতে পেরেছি দেশটির জননিরাপত্তা মন্ত্রী সারাত উইরাসেকারা বলেছেন, বোরকা নিষিদ্ধ করার এক নির্দেশে তিনি সই করেছেন। সেটি কার্যকর করতে পার্লামেন্টের অনুমোদন লাগবে। মন্ত্রী বলেন, খুব দ্রুত এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হবে বলে তিনি আশা করছেন।

উল্লেখ্য যে, প্রায় দুই বছর আগে খ্রিস্টানদের ইস্টার সানডের পরের দিন শ্রীলঙ্কায় হোটেল ও কয়েকটি গির্জার ওপর সমন্বিত কয়েকটি হামলার পর দেশটির সরকার এই উদ্যোগ নিচ্ছে। ওই হামলায় আত্মঘাতী বোমা হামলাকারীরা ক্যাথলিকদের গির্জা ও পর্যটকদের হোটেল টার্গেট করে হামলা চালায়। ২০১৯ সালে এপ্রিল মাসের ওই হামলায় প্রাণ হারায় আড়াই শ রও বেশি মানুষ।

দেখুন, এই সোজা বিষয়গুলোকে রাবারের মতো টেনে বড় না করে এ উপসংহার টানা যায় যে, হেফাজত ইসলাম আর যাই-ই হোক না কেন, সংগঠনটি ইসলামের প্রতিনিধিত্ব করে না। তারা শুধু মাদ্রাসার কোমলমতি শিশু-কিশোরের শক্তিকে পুঁজি করে অন্যের ভাড়াটিয়া এজেন্ট হিসেবে কাজ করছে। না হলে তারা সহিংসতায় জড়াত না বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। তাছাড়া হেফাজতকে এখন কারা সমর্থন করছে, তাদের বর্তমান বা অতীত পদ-পদবি বিবেচনায় নিলেই তা স্পষ্ট হয়ে যাবে। হেফাজতের নির্বুদ্ধিতা আজ তাদেরকে স্রেফ ভাড়ায় খাটা এক প্রাইভেট কোম্পানিতে পরিণত করেছে। পরিতাপের বিষয় হলো, বর্তমান ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগও এদেরকে ব্যবহার করতে ছাড়েনি!

লেখার শুরু করেছিলাম এন্ড্রু কিশোরের গান দিয়ে। শেষও করব সেই একই গান দিয়ে, কিন্তু ভিন্ন অর্থে। ভারতের সংখ্যালঘু মুসলিমদের নির্যাতিত হতে দেখে ব্রাদারহুড হেফাজতের কলিজা ফেটে যায়, যদিও তারা নিজ দেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন করে বা করার জন্য উস্কানি দেয়! বর্তমানে মোদীর কারণে সৃষ্ট সরকারের সাথে সহিংসতায় হেফাজতের এই দুর্গতি দেখে ভারতের ব্রাদারহুড মুসলিমরা কিন্তু সামান্য সহানুভূতিটুকুও দেখাচ্ছে না। অন্তত ভারতের কোনো পত্র-পত্রিকায় এই বিষয়ে ভারতের কোনো মুসলিমদের বিবৃতি চোখে পড়েনি। তাই হেফাজতে ইসলাম এখন ভারতের মুসলিমদের উপর আক্ষেপ করে বলতেই পারেন-

"ভালোবাসা দিলাম শুধু, ভালোবাসা পেলাম না

আশায় আশায় দিন যে গেল, আশা পূরণ হলো না।"