জন্মশতবর্ষে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনচর্চা ও তার সোনার বাংলার স্বপ্ন বাস্তবায়নের সংগ্রাম

শামসুজ্জামান খান
Published : 25 March 2021, 06:00 PM
Updated : 25 March 2021, 06:00 PM

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জন্মেছিলেন ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ তৎকালীন ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে। তাঁর পিতা শেখ লুৎফর রহমান, মাতা সায়েরা খাতুন। মা-বাবা তাঁদের চোখের মণি পুত্রটিকে আদর করে বলতেন 'খোকা'। খোকা প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাগ্রহণ করেন টুঙ্গিপাড়া, মাদারীপুর ও গোপালগঞ্জে। মাত্র বার তের বছর বয়সে চাচাতো বোন রেণুর সঙ্গে তাঁর বিয়ে দেন অভিভাবকেরা। রেণুর বয়স তখন তিন বছর। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন: "আমি শুনলাম আমার বিয়ে হয়েছে"।

তার বাল্যকাল সম্পর্কে 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী'-তে তিনি লিখেছেন, "ছোটবেলায় আমি খুব দুষ্টু প্রকৃতির ছিলাম। আমি খেলাধুলা করতাম, গান গাইতাম এবং খুব ভালো ব্রতচারী করতে পারতাম, ফুটবল, ভলি ও হকি খেলতাম। খুব ভালো খেলোয়াড় ছিলাম না, তবুও স্কুলের টিমের মধ্যে ভালো অবস্থান ছিল। এই সময় আমার রাজনীতির খেয়াল তত ছিল না।"

বাল্যকাল সম্পর্কে তিনি আরও বলছেন: "আমি ভীষণ একগুঁয়ে ছিলাম। আমার একটা দল ছিল। কেউ কিছু বললে আর রক্ষা ছিল না। মারপিট করতাম। আমার দলের ছেলেদের কেউ কিছু বললে একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়তাম।"

কিন্তু ১৯৩৪ সালে যখন তিনি সপ্তম শ্রেণিতে পড়েন, তখন বেরিবেরি রোগে আক্রান্ত হওয়ায় তাঁর পিতা তাকে কলকাতায় নিয়ে চিকিৎসা করান। তাদের পরিবার অর্থবিত্তে বেশ স্বচ্ছল ছিল। এ কারণে স্থানীয়ভাবে চিকিৎসা না করে কলকাতা নিয়ে তাঁর চিকিৎসা করানো সম্ভব হয়। তাঁর চিকিৎসক ছিলেন ডা. শিবপদ ভট্টাচার্য, ডা. এ কে রায় চৌধুরী প্রমুখ। প্রথম দুজন ছিলেন কলকাতার বিখ্যাত চিকিৎসক। এ থেকেই বোঝা যায়, তাঁর পিতামাতা তাঁকে বিশেষ স্নেহ-যত্নে প্রতিপালন করেন।

শৈশব জীবনে বঙ্গবন্ধুর শিক্ষক ছিলেন কাজী আবদুল হামিদ এম এস সি। তিনি তাঁর তরুণ ছাত্রের ওপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। হামিদ মাস্টারের মতো দেশপ্রেমিক শিক্ষকের স্বাদেশিকতার শিক্ষা শেখ মুজিবকে বাল্যকালেই স্বদেশ চিন্তায় উদ্দীপ্ত করে। ওই সময় তাঁর পিতা ওই সৎ, সজ্জন ও দক্ষ শিক্ষক বাড়িতে রেখে ছেলেকে ভালোভাবে পড়ানোর ব্যবস্থা যেমন করেছিলেন, তেমনি নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় প্রধান শিক্ষক রসরঞ্জন সেনগুপ্তের বাড়িতে গিয়েও পড়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। বিশেষ করে ইংরেজি ও অংকের শিক্ষার জন্য। তাই বলা যায়, তাঁর শিক্ষার ক্ষেত্রে তাঁর শিক্ষকদের যেমন প্রভাব রয়েছে, তেমনি আধুনিক ও সমাজ সচেতন মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার ব্যাপারে তাঁর পিতার একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।

শেখ লুৎফর রহমান গোপালগঞ্জে চাকরি করতেন। ১৯৩৬ সালে তিনি মাদারীপুর মহকুমায় সেরেস্তাদার হিসেবে বদলি হয়ে যান। এই প্রথম তিনি বদলি হন এবং তাঁর স্নেহের পুত্র শেখ মুজিব অসুস্থ থাকায় তাঁর মাকেও সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়। এর আগে বঙ্গবন্ধুর মা কখনো টুঙ্গিপাড়ায় নিজেদের ঘর সংসার আগলানো ছেড়ে স্বামীর কর্মস্থলসঙ্গী হননি। সায়েরা খাতুন ও পুত্রের সেবা-যত্নের জন্য প্রথমবারের মতো স্বামীর কর্মস্থলবাসিনী হলেন। পুত্রের সুস্থতার জন্যে এতে তাদের সবিশেষ উদ্বেগ ও সতর্কতার পরিচয় লক্ষ করি।

সায়েরা খাতুন সবসময় বাড়িতে থেকেই পরিবার দেখাশোনা করতে পছন্দ করতেন। ১৯৩৬ সালে মুজিবের দুচোখে গ্লুকোমা ধরা পড়ায় দ্বিতীয় বার তাঁকে আবার কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হয়। তখন সেখানকার বিখ্যাত চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ ছিলেন ডা. টি আহমেদ। চোখ পরীক্ষা করে তিনি বলেন, "এই ছেলের দুটো চোখই আশঙ্কাজনক অবস্থায় পড়েছে, জরুরি ভিত্তিতে অপারেশন করানো দরকার; না হলে আজীবনের জন্য অন্ধ হয়ে যেতে পারে।"

অপারেশনের কথা শুনে দুরন্ত স্বভাবের কিশোর মুজিব পালাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পালাতে পারেননি। তাকে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করিয়ে দশ দিনের মধ্যে তার দুই চোখেই অপারেশন করানো হয়। বিশেষ যত্ন, সেবা ও ওষুধপত্রে তিনি দ্রুতই সুস্থ হয়ে ওঠেন। সফল অপারেশন এবং সুস্থ হয়ে ওঠার পর তাকে চশমা দেওয়া হয়। সেই থেকে তিনি আজীবন চোখে চশমা পরেছেন।

চোখের চিকিৎসায় সুস্থ হওয়ার পর মুজিব আবার ফিরে এলেন মাদারীপুরে। শেখ লুৎফর রহমান প্রিয় পুত্রের জন্য বাড়িতে দৈনিক সংবাদপত্র শুধু নয়, কয়েকটি সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক সাময়িকীও রেখে দিয়েছিলেন। কিশোরকাল  থেকে পত্রপত্রিকা পড়াশোনায় দেশ-দুনিয়া সম্পর্কে সচেতনতা নিয়েই পড়েতে গেলেন স্বদেশি আন্দোলনের কেন্দ্র মাদারীপুরে; সখ্য ও সংযোগ গড়ে উঠলো স্বদেশি আন্দোলনের বিপ্লবী রাজনৈতিক সক্রিয়বাদীদের সঙ্গে। ফলে এ কথা বলা যায়, ১৯৩৭ সাল থেকেই শেখ মুজিব দেশের রাজনীতি, বিশেষ করে উপনিবেশবিরোধী সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে মানসিকভাবে সংযুক্ত হলেন, এবং কলকাতার দৈনিক আনন্দবাজার, বসুমতী, আজাদ এবং মাসিক সাহিত্যসংস্কৃতি বিষয়ক সাময়িকী সওগাত, মোহাম্মদী প্রভৃতিরও নিষ্ঠাবান ও সতর্ক পাঠক হয়ে উঠলেন। তা হলে আমরা লক্ষ করছি, একই সঙ্গে রাজনীতি সাহিত্য-সংস্কৃতি এবং বিশ্ব-পরিস্থিতি সম্পর্কে ধ্যান-ধারণা কিশোরকাল থেকেই তিনি লাভ করেন – পরবর্তীকালে যিনি স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ইতিহাস সৃষ্টিকারী নেতা হবেন তা&র উপযোগী মানস তৈরির জন্য এ ছিল সুচিন্তিত ব্যবস্থাপনা ও বিচক্ষণ পদক্ষেপ। পুত্রের এই অনন্য ইতিহাস সৃষ্টিতে দূরদর্শী ভূমিকাটি ছিল তাঁর পিতা শেখ লুৎফর রহমানের।

দুই

মাদারীপুর তখন স্বদেশী আন্দোলনের এক শক্তিশালী কেন্দ্র। ইংরেজ উপনিবেশবিরোধী আন্দোলনে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাত্রা যোগ করছিল স্বদেশি আন্দোলন। সেই স্বদেশী আন্দোলনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতা ছিলেন মাদারীপুরের। বিশেষ করে অধ্যক্ষ পূর্ণচন্দ্র দাসের নাম করা যায়। তাকে ইংরেজ সরকার কারাগারে নিক্ষেপ করে। পরে তার কারামুক্তি উপলক্ষ্যে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম পূর্ণ অভিনন্দন শীর্ষক কবিতা লিখে তাকে শ্রদ্ধা জানান। কিশোর মুজিব যখন সেখানে পড়াশোনা করতেন, তখনই স্বদেশীদের সঙ্গে তার একটা তাৎপর্যপূর্ণ সংযোগ ঘটে। চোখের চিকিৎসার পর তিনি যখন সম্পূর্ণ সুস্থ, তখন তাদের সঙ্গে সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হয়। একই সময় মাদারীপুরে বিপ্লবী জাতীয় নেতা বোসের শক্তিশালী সমর্থকগেষ্ঠী ছিল। কৈশোরকাল থেকেই শেখ মুজিবের নেতাজী বসুর প্রতি ছিল তীব্র আকর্ষণ। আমরা যদি বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির সূচনা পর্ব উল্লেখ করি, তা হলে বলা যায় ১৯৩৭ সালেই তার রাজনীতিতে হাতেখড়ি। তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠার পর তার পিতা আবার বদলি হয়ে গোপালগঞ্জ ফিরে আসার পরও কিশোর মুজিব গোপালগঞ্জ থেকে মাদারীপুর গিয়ে স্বদেশি আন্দোলন বা নেতাজি চন্দ্র বসুর সমর্থকদের মিটিংয়ে যোগ দিতেন। তাই আমরা মনে করি, কৈশোরকালেই উপনিবেশবাদবিরোধী বিপ্লবী রাজনীতির সঙ্গে শেখ মুজিবের সম্পৃক্তি। ফলে কৃষক, হতদরিদ্র দিনমজুর, দাওয়াল প্রভৃতি প্রান্তিক মানুষ- তাঁর ভাষায়, 'আমার দুঃখী মানুষ' ছিল তাঁর রাজনীতির কেন্দ্রে। এটা ছিল ইংরেজ ঔপনিবেশিকতার নিগর থেকে দেশ-মুক্তির মৌলিক রাজনীতি; প্রান্তিক অর্থ-বিত্তহীন মানুষের জীবনে স্বাধীনতাকে অর্থপূর্ণ করে তোলার রাজনীতি। যেহেতু ইংরেজ উপনিবেশের বিরুদ্ধে তখন সংগ্রাম করছে বাংলার মানুষ, আর সেই সংগ্রামে স্বদেশি আন্দোলনকারীরা এবং নেতাজি বসুর নেতৃত্বে গোটা ভারতবর্ষের জনগণ একাট্টা, কিশোর মুজিব তখন থেকেই সেই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত।

১৯৪০ সালে কলকাতায় ইংরেজসৃষ্ট কুখ্যাত হলওয়েল মনুমেন্ট অপসারণে নেতাজীর নেতৃত্বে ছাত্রনেতা এম এ ওয়াসেক, মাহমুদ নূরুল হুদাদের সঙ্গে অন্যতম অংশগ্রহণকারী ছিলেন সদ্য তারুণ্যে উত্তীর্ণ মুজিব। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর ধর্মকে শোষণের হাতিয়ার করে যে  শোষণমূলক স্বৈর সামরিকতন্ত্রী পাকিস্তানি শাসকদের সঙ্গে জান বাজি রেখে বছরের পর বছর জেলজুলুম সহ্য করেও মানবমুক্তির লক্ষে প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক, জাতীয়তাবাদী, ধর্মনিরপেক্ষ, সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় তিনি যে একনিষ্ঠ হলেন, সে বিষয়টি কিন্তু এই জায়গাটা না বুঝলে উপলব্ধি করা যাবে না।

তিন

১৯৩৮ সালেই অবিভক্ত বাংলার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, শ্রমমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও সমবায় মন্ত্রী কুমুদ বিহারী মল্লিক-এ তিন মন্ত্রী গোপালগঞ্জ সফরে এসেছিলেন। গোপালগঞ্জে তাদের সভা-সমিতিতে কিশোর শেখ মুজিব ছিলেন কর্মব্যস্ত নেতৃস্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক। ওই সময় এক তুচ্ছ ঘটনায় তিনি গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন। ওই তিন মন্ত্রীর সংবর্ধনা সভা নিয়ে সাম্প্রদায়িক হিন্দু মহাসভার সঙ্গে সংঘর্ষ হলে তিনি তাঁদের একজনকে ওঁদের কাছ থেকে ছিনিয়ে এনেছিলেন। এতে তারা মামলা করলে শেখ মুজিবকে সাত দিন কারাবরণ করতে হয়। ১৯৩৮ সাল মাত্র ১৮ বছর বয়সেই তাঁর প্রথম জেল খাটার অভিজ্ঞতা। অর্থাৎ, ১৯৩৭ সালে রাজনীতিতে হাতেখড়ির মাত্র এক বছরের মাথায় তাঁর জেল জীবন শুরু। এর এক বছর পরই তাঁর মূল ধারার রাজনীতির সঙ্গে প্রাথমিক সংযোগ।

শেরেবাংলা ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সংবর্ধনা অনুষ্ঠান শেষে শেরেবাংলা চলে গেলেন টাউন হল দেখতে, সোহরাওয়ার্দী এলেন মিশন স্কুলে। শেখ মুজিব তখন এ স্কুলেই পড়েন। তাদের স্কুলে সোহরাওয়ার্দীর আগমন উপলক্ষ্যে অনুষ্ঠানের আয়োজনে তাঁর সক্রিয় ভূমিকা ছিল। কিশোর মুজিব ছিলেন রোগা-পাতলা এবং লম্বা। তবে তাঁর মধ্যে দৃঢ়চেতা নেতৃত্বগুণ লক্ষ করে ফিরে যাওয়ার আগে সোহরাওয়ার্দী তাঁর সঙ্গে আলাপ করার সূত্রে গোপালগঞ্জ মুসলিম লীগ আছে কিনা জানতে চাইলেন এবং তাঁর নোটবুকে মুজিবের নাম ঠিকানা লিখে নিলেন এবং কলকাতায় গেলে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে বললেন। ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলকাতায় ফিরে যাওয়ার কিছু দিনের মধ্যেই শেখ মুজিবুর রহমান স্কুলে সংবর্ধনা অনুষ্ঠান অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন করার জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে সোহরাওয়ার্দী সাহেবের চিঠি পেলেন। এরই সূত্র ধরেই ১৯৩৯ সালে কলকাতায় গিয়ে এবং সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সঙ্গে তাৎপর্য সাক্ষাৎ এবং ধীরে ধীরে তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে মূলধারার রাজনীতিতে যুক্ত হলেন।

চার

১৯৪১ সালের ম্যাট্রিক পাস করার পর তিনি পড়াশোনার জন্য কলকাতা যান এবং ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন। ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হওয়ার স্বল্পকালের মধ্যেই তিনি কলকাতায় মুসলিম সমাজের বিখ্যাত ছাত্রনেতা হয়ে উঠলেন। তাঁর নেতৃত্বটা প্রভাবশালী যে ছিল তার প্রমাণ ১৯৪৩ সালে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের কাউন্সিল সভায় বঙ্গীয় মুসলিম লীগের নতুন কাউন্সিলর হিসেবে যোগ দিয়ে স্বল্প বয়সেই নিখিল ভারত রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সম্মান লাভ করেন। এটা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি আবুল হাশিম সে বছরেই বঙ্গীয় মুসলিম লীগ সম্পাদক হয়ে মুসলিম লীগকে নবাব-নাইট-জমিদার ও সম্প্রদায়িদের কব্জা মুক্ত করে জনগণের মুসলিম লীগ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য যে প্রয়াস চালান, নব প্রজন্মের জনপ্রিয় নেতা শেখ মুজিব তার সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় মুসলিম লীগ নতুন নেতৃত্বে জনসমর্থনধ্য সম্ভাবনাময় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়ে ওঠে।

তৃণমূল পর্যায় থেকে মুসলিম লীগ পুনর্গঠনের সূত্রে আবুল হাশিম সাহেব শেখ মুজিবকে বললেন, "শুধু স্লোগান দিলে হবে না, পড়াশোনাও করতে হবে। সেমিনার, সিম্পজিয়াম করতে হবে। রাজনীতির মডার্নিটি বুঝতে হবে, সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে রাজনীতিকে যুক্ত করতে হবে। সমাজের প্রান্তিক মানুষের দুঃখ-দুর্দশা দূরীকরণের কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে আমরা মুসলিম লীগকে নতুন করে গড়ে তুলব। এজন্য আর্থ-সামাজিক বিষয়ে পড়াশোনা-জানা-বোঝার জন্য একটি স্টাডি সার্কেল এবং পাঠাগার গড়ে তুলে নব প্রজন্মের কর্মীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করছি। তোমাকেও তাতে থাকতে হবে।"

শেখ মুজিব বললেন, "কলেজে ছাত্র রাজনীতির সাংগঠনিক ও প্রাতিষ্ঠানিক কাজ শেষ করে আমি তাতে যুক্ত হব।"

কিন্তু সমস্যা হল, হাশিম সাহেব মুসলিম লীগের গণমুখী রূপান্তরে যে উদ্যোগ গ্রহণ করেন, মওলানা আকরম খাঁ ও তাঁর দৈনিক আজাদ পত্রিকা এবং তাদের সহযোগী প্রতিক্রিয়াশীল চক্র তখন তার প্রবল বিরোধিতা করছিলেন। এ অবস্থায় মুসলিম লীগের নবরূপান্তরবাদীদের এগোনো কঠিন হয়ে যায়। আর্থ-রাজনৈতিক বিষয়ে আধুনিক চিন্তাচেতনার প্রসার বিষয়ে এই প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলায় তারা একটি পত্রিকা বের করার সিদ্ধান্ত নিলেন এবং তরুণ রাজনৈতিক কর্মীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করলেন।

আবুল হাশিম ও তার সহযোগীরা ভাবলেন, এ দুটি ব্যবস্থা মুসলিম লীগকে জনসম্পৃক্ত করতে এবং রাজনীতিকে অর্থপূর্ণ করে তুলতে সহায়তা করবে। এই আলোচনার সূত্রে হাশিম সাহেব বললেন, "আমাদের পত্রিকাটি দ্রুতই বের করতে হবে। এখন গণযোগাযোগের যুগ। একালে সংবাদপত্র ছাড়া একটি দলের মতামত প্রচার করা কঠিন। তাছাড়া দৈনিক আজাদের অপরাজনীতির বিরুদ্ধে সুস্থ জনমত তৈরির জন্য আমাদের অন্তত একটি সাপ্তাহিক তো থাকতে হবে।"

এই পত্রিকার আর্থিক সহায়তার জন্য তিনি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে আলোচনা করে তাঁকে রাজি করাতে সক্ষম হলেন এবং তার অর্থায়নে প্রকাশ করা হলো, 'মিল্লাত'  নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা। মুসলিম লীগ অফিসের নিচতলায় আবুল হাশিম সাহেবের সম্পাদনায় প্রকাশিত হলো প্রগতিশীল মতামতসমৃদ্ধ কাগজটি। এই নতুন দৃষ্টিভঙ্গির সাপ্তাহিকের সম্পাদনার যুক্ত হলেন দক্ষ সাংবাদিক কাজী মোহাম্মদ ইদ্রিসসহ কতক তরুণ প্রগতিশীল সাংবাদিক। প্রকাশিত হয়েই পত্রিকাটি আধুনিক ও উদার দৃষ্টিভঙ্গির জন্য বাঙালি হিন্দু বুদ্ধিজীবীদের মধ্যেও আলোড়ন সৃষ্টি করে।  শেখ মুজিবুর রহমান তরুণ বয়স থেকেই ছিলেন কর্মপাগল মানুষ। তিনি পত্রিকাটির সঙ্গে থাকলেন শুধু প্রকাশের আয়োজনের ব্যাপারে নয়, লেখা সংগ্রহ, এমনকি হকার হিসেবে পত্রিকাটি বিক্রির সঙ্গেও নিজেকে যুক্ত করে। এ  থেকে বোঝা যায়, বাল্যকাল থেকে প্রান্তিক মানুষের সঙ্গে, উপনিবেশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সঙ্গে, স্বদেশি আন্দোলনকারীদের সঙ্গে মেশা উদার চিন্তাধারার তরুণ উদ্দীপনার মানুষটি যখন মুসলিম লীগকে অর্গানাইজ করতে নামেন তখন তার রাজনৈতিক সম্ভাবনা কতটা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। প্রাজ্ঞ আবুল হাশিম আর দারুণ সম্ভাবনাময় মুজিব ও তাঁর উদ্যমী সাথীদের সম্মিলনে মুসলিম লীগ নতুন করে জেগে উঠল।

সেই ১৯৪৩ সালেই খাজা নাজিমউদ্দীনের প্রধানমন্ত্রীত্বের আমলে বাংলায় ইতিহাসের নজিরবিহীন দুর্ভিক্ষ হয়। সেই দুর্ভিক্ষে ১৫ লক্ষ আদম সন্তানের অনাহারে মৃত্যু ঠেকানো গেলেও অন্যদের বাঁচাতে রাতদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করেন তরুণ দেশপ্রেমিক নেতা শেখ মুজিব। রাত দিন কঠিন পরিশ্রম, উদ্বেগ, মানবসন্তানের বেঘোরে মৃত্যুর মিছিল দেখতে দেখতে ক্লান্তবিধ্বস্ত মুজিব অসুস্থ হয়ে পড়েন।

প্রবাদ বলে, দুর্ভাগ্য কখনো একা আসে না। ১৯৪৬ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর প্রধানমন্ত্রীত্বের আমলে ভারত ভাগের উন্মত্ততায় কলকাতায় যখন হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা লেগে গেল, তখন তরুণ ছাত্র শেখ মুজিবের অসাধারণ ভূমিকা সম্পর্কে ইসলামিয়া কলেজে তাঁর বিখ্যাত শিক্ষক, অধ্যাপক ভবতোষ দত্ত তাঁর আত্মজীবনী 'আট দশক'-এ লিখেছেন: "ছাত্ররা আমাদের অত্যন্ত সমাদরে গ্রহণ করেছিলেন। আমরা মুসলমান নই বলে যেন কোনো আঘাত না পাই, তার চেষ্টা করতেন।

"দাঙ্গার কারণে আমরা যখন ইসলামিয়া কলেজে যাতায়াতে জীবনের নিরাপত্তা খুঁজছি, তখন আমাদের ছাত্র শেখ মুজিব- আমরা যারা ইসলামিয়া কলেজে হিন্দু শিক্ষক ছিলাম, তাদের নিজ নেতৃত্বে নিরাপদ এলাকায় পৌঁছে দিয়ে আসতো। আবার পরদিন কলেজে নিয়ে আসতো। তাঁর সঙ্গে নারী কর্মীরাও ছিলেন, যারা পরবর্তীকালে পূর্ব-বাংলার ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর বাংলা ভাষাকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দিতে সক্ষম হয়েছিলেন।"

তরুণ শেখ মুজিবুর রহমান একজন অসাম্প্রদায়িক, দাঙ্গাবিরোধী নেতা হিসেবে এবং দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষকে বাঁচাতে শুধু বাংলা নয়, বিহারে গিয়েও যে কাজ করেছিলেন, তাতেই বোঝা যায় মানবিক দায় এবং নেতৃত্বের গুণে তার অনন্যতা ছিল উদাহরণীয়। এসব বিষয় নিয়েই তাঁর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও দর্শন গড়ে ওঠে। এ কারণে তিনি মুসলিম লীগকে যেমন আধুনিকায়ন করার অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন, তেমনই পরবর্তীকালে পাকিস্তান আমলে মুসলিম লীগ যখন স্বৈরাচারী দলে পরিণত হলো, সেই দল থেকে পদত্যাগ করে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করার প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হলেন। মওলানা ভাসানী, শামসুল হক, ইয়ার মোহাম্মদ খানরা ঢাকার রোজ গার্ডেনে এই নতুন বিরোধী দল গঠন করলেন ১৯৪৯ সালের ২৩শে জুন তারিখে। তখন তিনি জেলে। মওলানা ভাসানী হলেন এই নতুন দলের সভাপতি, শামসুল হক সাধারণ সম্পাদক এবং শেখ সাহেব জেল থেকে হলেন এই দলের যুগ্ম সম্পাদক।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পূর্ববাংলায় যে নতুন শিক্ষিত মুসলিম মধ্যবিত্ত সমাজ গড়ে উঠতে থাকে তাদের নেতৃত্বে বাঙালি জাতিসত্তার আন্দোলন একটি সুস্পষ্ট রূপ পেতে থাকে। ১৯৪৮ সালে প্রথম ভাষা আন্দোলনে তার প্রকাশ ঘটলো। এই জাতিসত্তা ও অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রধান নেতা শেখ মুজিব।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তিনি ছিলেন জেলে। জেলে থাকা অবস্থায়ও হাসপাতালে রাতের বেলায় পাহারাদার পুলিশ ঘুমিয়ে গেলে আন্দোলনরত নেতাদের সঙ্গে পরামর্শ করে আন্দোলনের রূপরেখা নির্ধারণ করে দেন।

১৯৪৮ সালে যখন পূর্ব-পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ গঠিত হয়, তখন ছাত্রনেতা অলি আহাদ বলেছিলেন, "আমরা 'মুসলিম' নাম দিয়ে কোনো সাম্প্রদায়িক সংগঠন করব না।"

উত্তরে শেখ মুজিব বললেন, "সবে মুসলিম লীগের নেতৃত্বে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। জনমানসিকতা, তাদের মনস্তত্ব ও ইতিহাস বুঝতে হবে। এখনই যদি এর বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করি, সরকার আমাদের ওপর আগ্রাসী আক্রমণ শুরু করবে এবং জনগণও এ মুহূর্তে আমাদের মত মেনে নেবে না। আমাদের অপেক্ষা করতে হবে, ধীরে ধীরে জনগণকে আস্থায় নিতে হবে।"

যা হোক, সরকার পক্ষই সুযোগটা করে দিল। ১৯৪৮ সালে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় এসে তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানের (এখনকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) আয়োজিত জনসভায় বললেন, "উর্দু অ্যান্ড অনলি উর্দু শ্যাল বি দ্য স্টেট ল্যাঙ্গয়েজ অব পাকিস্তান।"

নো, নো বলে চিৎকার করল ছাত্ররা। পরের দিন কার্জন হলে করলেন একই উচ্চারণ। সেই থেকে শুরু বাঙালির মাতৃভাষা বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা এবং অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতিসত্তার উদ্বোধনের আন্দোলন। এই আন্দোলনের ধারায় শুরু হল বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও পূর্ব বাংলার মানুষের ভাষার অধিকারের সংগ্রাম। এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে শেখ মুজিব বছরের পর বছরই জেলবন্দি হয়েছেন।

১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক সাধারণ নির্বাচনে হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দী নেতৃতাধীন যুক্তফ্রন্ট বিপুল বিজয় লাভ করায় মুসলিম লীগের অস্তিত্ব পূর্ব বাংলায় বিলুপ্ত হয়। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ দলটি অসাম্প্রদায়িক চরিত্র গঠনের লক্ষে ১৯৫৫ সালে দলের নাম থেকে 'মুসলিম' শব্দ বর্জন করে।

কিন্তু পূর্ব-পাকিস্তানকে দাবিয়ে রাখার জন্য ১৯৫৮ সালে জারি হলো জেনারেল আইয়ুব খার মার্শাল ল এবং ৯২-ক ধারা। এর বিরুদ্ধে শেখ মুজিব সংগ্রাম করেছেন ১৯৫৮ সাল থেকেই। ১৯৬০ সাল থেকে শেখ মুজিব শুরু করেন সংহত ও রূপান্তরধর্মী বাঙালি জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম। ১৯৬১ সাল থেকে তা গুণগত পরিবর্তনধর্মী উত্তরণ লাভ করে।

ফলে পাকিস্তানিরা পূর্ববাংলায় অশান্তি, বিভেদ ও ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি করে সামাজিক সংহতি নষ্ট করার লক্ষে ১৯৬৪ সালে ঢাকায় দাঙ্গা বাধায়। দাঙ্গা প্রতিরোধ এবং দুর্গতদের আশ্রয়কেন্দ্র, খাদ্য, চিকিৎসা ও সেবা-শুশ্রূষার ব্যবস্থা করলেন জননেতা শেখ মুজিব। অধ্যাপক অজিতকুমার গুহ এবং সেকালের তরুণ নাট্যকর্মী রামেন্দু মজুমদারের পরিবারকে বিপজ্জনক জায়গা থেকে নিয়ে এসে সেদিনের মত নিজ বাড়িতে রেখে অন্যত্র নিরাপদ আশ্রয়ে রাখার ব্যবস্থা করলেন। জগন্নাথ কলেজে দুর্গতদের আশ্রয় কেন্দ্রে খাদ্য ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করলেন। তোপখানা রোডের বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন ভবনে অফিস খুললেন। স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করলেন। এই ভূমিকায় একদিকে তার সামাজিক দায়িত্ব প্রতিপালন, অন্যদিকে বিপন্ন মানুষের দুঃসময়ে তাদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে বিপদ মোকাবিলায় সক্রিয়তার প্রমাণ পাই। একে রাজনৈতিক সংগ্রামের অংশে পরিণত করে ধীরে ধীরে গণমানুষের রাজনৈতিক চেতনার স্তরকে অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদী ধারার দৃঢ়মূল গভীরতায় নিয়ে আসেন।

গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রশাসন ব্যবস্থা আর সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মৌলিক পার্থক্য আছে। পাশ্চাত্য বিশ্বে গণতন্ত্র শিকড় গেড়েছে। তবে সে গণতন্ত্র পুঁজিবাদী অর্থনীতির গণতন্ত্র-অর্থাৎ ধনীক বা বিত্তবানের স্বার্থরক্ষার শাসন ব্যবস্থা। তারই বিকল্প হিসেবে মার্কস- অ্যাঙ্গেল- লেনিন হোচিমিন- ফিদেল কাস্ত্রো সমাজতন্ত্রের তত্ত্ব উদ্ভাবন করেন। এবং রাশিয়ায় ১৯১৭ সালে বিপ্লবের মাধ্যমে বিশ্বের প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। পরে মাও জে দং চীনে এবং হোচিমিন ভিয়েতনামে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। কিউবায় সমাজতান্ত্রিক শাসন মার্কিন হুমকির মুখেও প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন বীর্যমান বিপ্লবী ফিদেল কাস্ত্রো। বঙ্গবন্ধুও তাঁর প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রে গণতন্ত্রকে অন্যতম রাষ্ট্রনীতি রেখেও সমাজতন্ত্রকেও অন্যতম রাষ্ট্রনীতি করেছিলেন। শুধু তাই নয়, সংবিধানেও ভারতের আগে সমাজতন্ত্র কথাটি যুক্ত করেন।

হঠাৎ করে একজন জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক নেতা কি সমাজতন্ত্রের কথা বলেন, বা বললেও মুখে বলেন বটে, বুক থেকে বলেন না। ভারতেও তো সমাজতন্ত্রের কথা বলা হয়েছে, কিন্তু সেখানে তো সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সে দেশে আট-দশজন বিশাল পুঁজিপতি ৯৫ শতাংশ সম্পদের মালিক; সাধারণ জনগোষ্ঠীর নিত্য ভিক্ষা তণু রক্ষা। আমাদের বাংলাদেশেও বঙ্গবন্ধুর লোকান্তরের পর সমাজতন্ত্র সামাজিক সাম্যে পরিবর্তিত হয়েছে, যথারীতি আর্থিক বৈষম্য বাড়ছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু সমাজতন্ত্রের নীতি ও আদর্শ প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেন। এজন্যই তিনি ১৯৭৫ সালে রাষ্ট্র শাসন ব্যবস্থায় মৌলিক পরিবর্তন আনার লক্ষে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ সংক্ষেপে বাকশাল প্রতিষ্ঠা করেন। দেশদ্রোহী ভাড়াটে সৈনিক ও তাদের পেছনের শক্তিশালী চক্র তাঁকে হত্যা করতে না পারলে হয়তো বাংলাদেশে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার এক স্বকীয় মডেল তৈরি হত।

বর্তমান বিশ্বে যে পুঁজিবাদী অর্থনীতি ও সমাজব্যবস্থা, তা কোনোভাবেই শোষণমুক্ত সমাজ নির্মাণের জন্য নয়। বিশ্বায়নের নাম দিয়ে একে আরও সূক্ষ্ম, জটিল বৈষম্যমূলক ব্যবস্থায় রূপান্তরিত করা হয়েছে। এ জন্য আমাদের নববিন্যাসকৃত এবং ত্রুটিমুক্ত সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় যে কোনোভাবেই হোক যেতেই হবে। আমাদের অঞ্চলের শিক্ষা ও সামাজিক পশ্চাদপদতায় ধর্মান্ধতার যে বাড়বাড়ন্ত, তাতে রাজনীতিকেও বঙ্গবন্ধু যেভাবে গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিতে বিন্যন্ত করে অসাম্প্রদায়িক শোষিতের গণতন্ত্রে রূপ দিতে চেয়েছিলেন, মুজিববর্ষে তা নিয়ে গভীর পর্যালোচনা, বিশ্লেষণ সৃজনশীল তর্কতদন্ত (discourse) হওয়া জরুরি।

একইসঙ্গে আমাদের গণতান্ত্রিক চেতনা ও অর্থনৈতিক বিকাশে, পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ধারায় হবে না, কী রূপ নেবে সে সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, "বর্তমান বিশ্ব আজ দু'ভাগে বিভক্ত; একদিকে শোষক, অন্যদিকে শোষিত, আমি শোষিতের পক্ষে। আমি শোষিতের গণতন্ত্র চাই।"

তিনি বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক ক্ষেত্রে স্বয়ম্ভতার পথে এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১-এ দেশ স্বাধীন হবার পর নতুন স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশে যে বিশৃঙ্খলা, অস্ত্রের ব্যবহার এবং দুর্নীতির প্রকোপ বাড়ে তা প্রতিরোধ করে নতুন সমাজ ও রাজনীতি প্রতিষ্ঠার লক্ষে সকলকে নিয়ে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) গঠন করেছিলেন।

স্বাধীনতা লাভের পর বঙ্গবন্ধু উপলব্ধি করেছিলেন, নতুন স্বাধীন দেশে বিকাশকামী মধ্যবিত্তের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নব আশায় উদ্দীপ্ত কৃষক, নিম্নবিত্তের মানুষ ও নির্বিত্ত প্রান্তিক মানুষ ও নানা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী। এরা বাঙালির নিজস্ব রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়ায় যুক্ত হওয়ায় তা বৈপ্লবিক চরিত্র অর্জন করেছে। এই অবস্থায় বহু ব্যবহৃত এবং গতানুগতিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় গুণগত সামাজিক পরিবর্তন সম্ভব নয়। স্বাধীনতার পর সামজিক অস্থিরতা এবং পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে তাঁর নেতৃত্ব বহুক্ষেত্রে যে বিস্ময়কর অগগ্রতি ঘটে, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নবগঠিত পার্লামেন্টের মাধ্যমে বিশ্বনন্দিত শাসনতন্ত্র প্রস্তুত, অনুমোদন ও গ্রহণ করা হয় তা ছিল ইতিহাস সৃষ্টিকারী। কূটনেতিক ক্ষেত্রেও বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের অনন্য প্রভায় দ্রুত স্বীকৃতি আসে বহু দেশের। এই সবই ছিল নতুন রাষ্ট্রের ভিত্তিমূল শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে অসামান্য অর্জন।

বঙ্গবন্ধু বলেছেন: আগে ছিল ৬ দফা, এখন বলি ৪টা স্তম্ভ। এই দফা বা মৌলিক স্তম্ভগুলো হচ্ছে: জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই পর্যায়ে এক নতুন রাষ্ট্র ভাবনার সূত্রপাত করেন। এক নতুন প্যারাডাইমের জন্ম দিলেন। ১৯৭১ সালের পূর্বে ছিল ৬ দফার সংগ্রাম, ১৯৭১ সালের পরে শুরু হয়েছে ৪ দফার সংগ্রাম।

আমাদের দুর্ভাগ্য যে, পাকিস্তানিরা তাকে হত্যা করতে সাহস না দেখালেও কতিপয় দেশদ্রোহী বাঙালি, মুক্তিযুদ্ধের প্রতি যাদের ছিল গোপন জীঘাংসা, গণতান্ত্রিক বা মানবিক চেতনা, বাংলাদেশে চার রাষ্ট্রনীতি; গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতি যাদের আস্থা ছিল না, তারাই উদ্ভট ধর্মবাদী রাষ্ট্র পাকিস্তান ও আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তকারীদের ভাড়াটে হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে আমাদের নবউত্থিত বাংলাদেশকে পঙ্গু করে দিতে চেয়েছিল।

আমাদের সৌভাগ্য, জাতির পিতার কন্যা এত বছর পরে স্বৈরশাসকদের অত্যাচার, নির্যাতন সহ্য করে বাংলাদেশকে আবার আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ফিরিয়ে এনেছেন। এখন তৃণমূলের শোষিত নির্যাতিত ও প্রান্তিক মানুষের কল্যাণে লুটেরাদের দুর্নীতির ভয়াবহতা দূর করার লক্ষে তাদের বর্জন করে সুশাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করে আধুনিক বিজ্ঞান ও নবপ্রযুক্তিভিত্তিক মানবিক ও উদ্ভাবনাময় শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ ও চার রাষ্ট্রনীতির আলোকে গড়ে ওঠা নতুন প্রজন্মের মাধ্যমেই বাংলাদেশকে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলায় পরিণত করতে হবে। তবেই বাঙালি বিশ্বের একটি নন্দিত জাতি ও স্বাধীন রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে মাথা উঁচু করে দাড়াতে পারবে। সেটাই হবে শতবর্ষে বঙ্গবন্ধুর প্রতি প্রকৃত ও শ্রেষ্ঠ শ্রদ্ধার্ঘ্য। এবং এজন্য চাই শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ধান্ধাবাজ, চাটুকার, রাজাকার ও অর্থলোভমুক্ত জেনুইন আওয়ামী লীগার থাকা, যারা আর্থ-সামাজিক বিষয়ে গভীর পাঠে অভ্যস্ত এবং বঙ্গবন্ধুর প্রকৃত রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী।

অর্থনীতির ক্ষেত্রে বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যে অর্জন, তা অসাধারণ। বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার বিশ্বের বিস্ময়। আমাদের অর্থনৈতিক উন্নতি বিশ্বের এখন রোল মডেল। এ জন্য আমরা আনন্দিত। একই সঙ্গে বাংলাদেশে সামাজিক স্তরে মানুষে মানুষে যে অর্থনৈতিক বৈষম্য বেড়ে যাচ্ছে, তার রাশ টেনে ধরতে হবে।

আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিক শিক্ষায় দক্ষ দুর্নীতিমুক্ত মানসিকতায় গড়ে তুলতে হবে। বঙ্গবন্ধুর তিনটি বই আওয়ামী লীগ, যুব লীগ এবং মহিলা লীগ কর্মীদের জন্য পাঠ বাধ্যতামূলক করতে হবে। রাজনৈতিক দলের কেন্দ্র থেকে থানা এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়েও বঙ্গবন্ধুর বইগুলো পড়া আছে কিনা সেটা পরীক্ষা করেই নেতৃত্ব দিতে হবে।

বাংলাদেশ এখন বদলে যাওয়া বাংলাদেশ- স্বল্পোন্নত দেশ হতে উন্নয়শীল দেশে রূপান্তরিত। এ অবস্থায় ছাত্র সংগঠনকে রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠন করা সমীচীন হবে না। এটা করা হলে রাজনীতি সুস্থ ও সুন্দর হবে।

করোনাভাইরাসের মহামারীর সুযোগ নিয়ে দেশব্যাপী দুর্নীতির যে ভয়াবহ বিস্তার ও অপকৌশল ঘটেছে এবং সরকারি দলের শাখা-প্রশাখার কোনো কোনো দুর্বৃত্ত ব্যাংক লুটপাট এবং খাস ও সরকারি এমনকি দুর্বলের জমি দখলের যে অভাবনীয় অবস্থা সৃষ্টি করেছে তা শক্ত হাতে এখনই নির্মূল করতে হবে। এছাড়া কিছু লোক বেপরোয়াভাবে এবং কতিপয় ধূর্ত কর্তৃত্ববাদী যা করছে, তা দূর করার জন্য দরকার হলে বঙ্গবন্ধুর ভাষায়, 'লালঘোড়া দাবড়াইয়া দিতে হবে।' কারণ, এ ধরনের পুকুর চুরির ঘটনায় বহু দেশে সরকারের অস্তিত্ব ঝুঁকির মুখে পড়ে।

বাংলাদেশকে সত্যিকার অর্থে গণতান্ত্রিক, সেক্যুলার শোষণহীন স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য দেশকে নতুন করে মুক্তিযুদ্ধের দৃঢ়পণ চেতনায় উদ্দীপ্ত করে গড়ে তুলতে হবে। মনে রাখতে হবে স্বাধীন সেক্যুলার বাংলাদেশের অস্তিত্ব রক্ষার তিনটি রক্ষা প্রাচীর আছে। তা হলো হাজার বছরের সমন্বয়বাদী লোকজসংস্কৃতি, রবীন্দ্র-নজরুল চর্চা; এবং শেখ মুজিবের রাজনৈতিক দর্শন- অর্থাৎ ৬ দফার পর স্বাধীন বাংলাদেশের ৪ রাষ্ট্রীয় স্তম্ভ।

এই তিনটি রক্ষা প্রাচীরে সাম্প্রদায়িকতা (জঙ্গিবাদ], মধ্যযুগীয় ধর্মান্ধতা ও মৌলবাদ বার বার আঘাত করে প্রতিহত ও পরাজিত হচ্ছে। সেই ধারাকে আরো শক্তিশালী করতে হবে।

নতুন প্রজন্মের প্রশাসনিক ক্যাডারের কর্মকর্তাদের যারা পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক বৈষম্য ও ধর্মান্ধতাকে সমর্থন করছে, তাদের নিষ্ক্রিয় করে একটি শক্তিশালী সুষম অর্থনীতির দেশ ও মানবিক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে হবে। মনে রাখতে হবে, বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে সেক্যুলার রাষ্ট্রদর্শন ও সংস্কৃতির ভিত্তিতে বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী এবং বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে এটাই হোক আমাদের একমাত্র লক্ষ ও প্রত্যাশা।