উৎসবের অর্থনীতি

মোহাম্মদ আবদুল মজিদ
Published : 23 April 2015, 07:46 PM
Updated : 1 Nov 2012, 02:17 PM

ঈদ-উল-আযহা উদযাপন উপলক্ষে অর্থনীতিতে ব্যাপক মুদ্রা সরবরাহ, শিল্প উপাদন ও ব্যবসা বাণিজ্যসহ নানান অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রসার ঘটে। এ উৎসবে প্রধানত পাঁচটি খাতে ব্যাপক আর্থিক লেনদেনসহ বহুমুখ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডি পরিচালিত হয় যা গোটা অর্থনীতি তথা দেশজ উৎপাদ ব্যবস্থাপনায় শনাক্তযোগ্য প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।

১.

হজ্জ পালন উপলক্ষ্যে বৈদেশিক মুদ্রাসহ বিপুল সংখ্যক অর্থ লেনদেন হয়ে থাকে। এ বছর বাংলাদেশ থেকে ১ লক্ষ ১০ হাজার ৫৭৬ জন হজ্জে গিয়েছেন। প্রতিজনে গড়ে ৩ লক্ষ টাকা ব্যয় নির্বাহ করলে এখাতে মোট অর্থব্যয়ের পরিমান দাড়ায় ৩ হাজার ৩১৭ কোটি ২৮ লক্ষ টাকা, বৈদেশিক মুদ্রায় ৪১৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। হাজীদের যাতায়াত সহ সেখানকার ব্যয় বৈদেশিক মুদ্রাতেই নির্বাহ হবে । এর সাথে এই হজ্জের ব্যবস্থাপনা ব্যয়েও উল্লেখযোগ্য পরিমান বাংলাদেশী টাকা ও বিদেশী মুদ্রা ব্যয়ের সংশ্লেষ রয়েছে। ব্যাংকিং সেক্টরে এ উপলক্ষে লেনদেন ও সেবা সূত্রে ব্যয় বেড়েছে। গোটা সৌদী আরবের অর্থনীতি সেই প্রাচীন কাল থেকেই হজ্জ মওশুমের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বা ব্যবসা বাণিজ্যকে ঘিরে বা অবলম্বন করে আবর্তিত হত এবং বর্তমানেও তার ব্যাপ্তি বাড়ছে বৈ কমছে না।

২.

পশু কোরবানী উপলক্ষে জাতীয় অর্থনীতিতে এক ব্যাপক আর্থিক কর্মকান্ড পরিচালিত হয়ে থাকে। গত বছরের হিসাব অনুযায়ী প্রায় ৭৮ লক্ষ গরু ও খাশী কোরবানী হয়েছিল। বাংলাদেশ ট্যানার্স এসোসিয়েশনের ( বি টি এ) ধারণা এবার ৩০ লক্ষ গরু ও ৫৫ লাখ খাশী কুরবানী হবে। গরু প্রতি গড় মূল্য ৩০ হাজার টাকা দাম ধরলে এই ৩০ লক্ষ গরু বাবদ লেনদেন হবে ৯ হাজার কোটি টাকা এবং ৫৫ লক্ষ খাশি (গড়ে ১৫০০ টাকা দরে) ৮২৫ কোটি টাকা অর্থাৎ পশু কোরবানীতে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হবে। ৮৫ লক্ষ কোরবানীর পশুর মধ্যে প্রায় ৪৫ লক্ষ পশু (গরু ২০ লক্ষ খাশি ভেড়া ২৫ লক্ষ) আমদানী হবে প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে। ভারতীয় সুত্র থেকেই জানা গেছে প্রায় ৪,৭০০ কোটি টাকার রপ্তানী তাদের এবারের প্রত্যাশা। এর একটা বড় অবশ অবশ্য চোরাই পথে বা পদ্ধতিতে আদান প্রদান হবে, যদ্দরুন পশুর সংখ্যা ও টাকার পরিমান অবশ্যই অনুমান নির্ভর।

যে পদ্ধদিতেই হোক না কেন বাংলাদেশের প্রায় ৫,০০০ কোটির টাকার বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হবে এ খাতে। ২০ লক্ষ গরু আমদানীর জন্য বাংলাদেশের শুল্ক রাজস্ব (গরু প্রতি ৫০০ টাকা হিসেবে) ১০০ কোটি টাকা অর্জিত হওয়ার কথা। কোরবানীকৃত পশুর সরবরাহ ও কেনাবেচার শুমার ও পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করলে দেখা যায় চাদা , টোল , বখশিস, চোরাকারবার, ফড়িয়া, দালাল, হাশিল,পশুর হাট ইজারা , চাদিয়া, বাঁশ খুটির ব্যবসা, পশুর খাবার , পশু কোরবানি ও বানানো এমন কি পশুর সাজগোজ বাবদও এক বিপুল পরিমান অর্থ হাতবদল হয়ে থাকে অর্থাৎ অর্থনীতিতে ফর্মাল ইনফর্মাল ওয়েতে আর্থিক লেনদেন বা মুদ্রা সরবরাহ বেড়ে যায়।

৩.

কোরবানীকৃত পশুর চামড়া আমাদের অর্থনীতিতে রপ্তানী বাণিজ্যে, পাদুকা শিল্পে পোষাক, হস্তশিল্পে এক অন্যতম উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এই চামড়া সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াকরণ, বিক্রয় ও ব্যবহার উপলক্ষে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষের ও প্রতিষ্ঠানের কর্মযোজনা সৃষ্টি হয়। এই চামড়া সংগ্রহ সংরক্ষণ প্রক্রিয়াকরণের সাথে ১০০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ ও ব্যবসা জড়িত। রাস্ট্রায়াত্ত ব্যাংকগুলো প্রতি বছর প্রায় ৫০০ কোটি বিশেষ ঋণ দিয়ে থাকে, বেসরকারী ব্যাংকগুলো ৮০-১০০ কোটি টাকা। চামড়া নিম্ন দামে পাচার হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি মোকাবেলার বিষযটি গুরুত্বপূর্ণ। দেশী বিদেশী সিন্ডিকেটের কবল থেকে চামড়া ব্যবসাকে উদ্ধারের কোন বিকল্প নেই।

পত্রিকান্তরে প্রতিবেদনে প্রকাশ প্রতিবেশী দেশ থেকে বাকীতে গরু সরবারাহ করা হয় কম দামে কাচা চামড়া পাচারের প্রত্যাশায়। সেই চামড়া প্রক্রিয়াকরণ করে বেশী দামে বিদেশে রপ্তানীর মুনাফা অর্জন করে তারা। দেশে নিজেদের চামড়া প্রক্রিয়াকরণ এবং উপযুক্ত মূল্যে তা রপ্তানীর প্রণোদনা সৃষ্টি করেই এ পরিস্থিতি থেকে নিষ্কৃতিলাভ ঘটতে পারে। লবন চামড়া সংরক্ষনের একটি অন্যতম উপাদান। সরকারকে ৪০ হাজার টন লবন শুল্কমুক্ত আমদানীর উদ্যোগ নিতে হয়েছে যাতে সিন্ডিকেট করে লবনের কৃত্রিম সংকট তৈরি না হয়।

৪.

কোরবানীর পশুর মাংশ আমিষ জাতীয় খাদ্যের উপাদান এবং এই মাংশের বিলি বন্টন প্রক্রিয়ায় রয়েছে আর্থসামাজিক তাৎপর্য। ধনী দরিদ্র নির্বিশেষে বৎসরের একটি সময়ে সকলে আমিষ প্রধান এই খাদ্যের সন্ধান/সরবরাহ লাভ করে থাকে। মাংশ রান্নার কাজে ব্যবহৃত মশলা বাবদ প্রায় ৩০০০ কোটি টাকার ব্যবসা হয়ে থাকে এ সময়ে। মশলার দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যেয়ে ঈদ উদয়াপনের ব্যয় ব্যবস্থাপনাকে বেচাইন পরিস্থিতির সামনে দাড় করায়। সংবাদ মাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে শুধু মায়ানমার থেকে প্রায় ৭০০ কোটি টাকার মশলা অবৈধভাবে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশে।

৫.

উপরে উল্লেখিত লেনদেনে দেশের ব্যাংকিং খাতে ব্যাপক কর্মচাঞ্চল্য বেড়ে , তারল্য সংকটে পড়ে যায় আর্থিক খাত, কল মানি মার্কেট থেকে চড়া সুদে ধার কর্জে নামে ব্যাংকগুলো । চামড়া ঋণ থেকে শুরু করে ঈদের বোনাস বাবদ বাজারে মুদ্রা সরবরাহ বেড়ে যায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংককেও এগিয়ে আসতে হয়। জাল নোট বিশৃঙখল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে। সে জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে নতুর নোট সরবরাহে নামতে হয়।

মোদ্দা কথা হজ্জ ও কোরবানী উপলক্ষে মুদ্রা সরবরাহ ব্যবস্থায় যে ব্যঞ্জনা সৃষ্টি হয় ব্যাংকিং খাতে তা তারল্য সংকট সৃষ্টি করে এবং কলমানি মার্কেটে সুদের সূচকের ওঠা নামা দেখে তা আঁচ করা যায়।

এ সময়ে অবধারিতভাবে রেমিট্যান্স বৃদ্ধি পায়- বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবমতে রিজার্ভ ১২ বিলিয়ন ছাড়িয়ে যাওয়ার তথ্য আমাদেরকে উল্লসিত করে- হজ্জ উপলক্ষে সর্বাধিক বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেন সত্বেও। কোরবানীর পশু আমদানী ব্যয় হয়– চামড়া রপ্তানী সূত্রেও। ঈদ উপলক্ষে পরিবহন ব্যবস্থায় বা ব্যবসায় ব্যাপক কর্মতৎপরতা বেড়ে যায়। শহরের মানুষ আপনজনের সাথে ঈদ উদযাপনের জন্য গ্রামে ছোটে। একমাস আগে থেকে ট্রেন বাস লঞ্চের টিকিট বিক্রির তোড়জোড় দেখে বোঝা যায় এর প্রসার ও প্রকৃতি। নির্ধারিত ভাড়ার চাইতে দ্বিগুন দামে ফর্মাল টিকিট আর ইনফর্মাল টাউট দালাল ও বিবিধ উপায়ে টিকিট বিক্রির সার্বিক ব্যবস্থা বোঝা যায় – এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় পরিবহন খাতে সাকুল্যে ২০০০ কোটি টাকার বাড়তি ব্যবসা বা লেনদেন হয়ে থাকে। এটিও অর্থনীতিতে প্রাণপাঞ্জল্য সৃষ্টি করে।

এটি প্রণিধানযোগ্য যে, অর্থনীতিতে মুদ্রা সরবরাহ মুদ্রা লেনদেন, আর্থিক কর্মকান্ডের প্রসারই অর্থনীতির জন্য আয়। কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং মুদ্রা সরবরাহ গতিশীলতা আনয়ন। ঘুর্ণায়মান অর্থনীতির গতিপ্রবাহে যেকোন ব্যয় অর্থনীতির জন্য আয়। দেশজ উৎপাদনে এর থাকে অনিবার্য অবদান। যেকোন উৎসব অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে গতিশীলতা আনয়ন করে, মানুষ জেগে উঠে নানান কর্মকান্ডে, সম্পদ বন্টন ব্যবস্থায় একটা স্বতঃপ্রনোদিত আবহ সৃষ্টি হয়। এই আবহকে স্বাভাবিক গতিতে চলতে দেয়ায় এবং দেখ ভাল করতে পারলে অর্থাৎ সামাষ্টিক ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা ও পারঙ্গমতা দেখাতে পারলে এই কর্মকান্ড, এই মুদ্রা সরবরাহ, ব্যাংকের এই তারল্য তারতম্য, পরিবহন খাতের এই ব্যয় প্রবাহ–একে স্বাভাবিক গতিতে ধরে রাখতে পারলে অর্থনীতির জন্য তা পুষ্টিকর প্রতিভাত হতে পারে। এখানে বিচ্যুতি, বিভ্রান্তি ও বিপত্তি সৃষ্টি হলে একটা স্বাভাবিক সিস্টেম লস এর সাফল্যকে ম্লান করে দিতে পারে।

হজ্জ ব্যবস্থাপনায় নিজেদের সক্ষমতা বাড়িয়ে ( পরিবহন ও আবাসনে নিজেদের অবকাঠামো গড়ে উঠলে এবং কার্যকর ভূমিকায় পাওয়া গেলে, বর্ডার ট্রেডে বাঞ্ছিত নিয়ন্ত্রণ ও পরিবীক্ষণ জোরদার করে, ঘাটে ঘাটে চাঁদা , দুর্নীতি ও দালালী, সকল প্রকার সিন্ডিকেট নিয়ন্তণ করে, চামড়া পাচার রোধ কল্পে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করে উৎসবের অর্থনীতিকে জিডিপিতে যোগ্য অবদান রাখার অবকাশ নিশ্চিত হতে পারে।