স্বাধীনতার ৫০ বছরেও আমরা শঙ্কিত

সঙ্গীতা ইমামসঙ্গীতা ইমাম
Published : 24 March 2021, 12:07 PM
Updated : 24 March 2021, 12:07 PM

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বাংলার মানুষ উদযাপন করছেন তার অর্জনের পঞ্চাশ বছর। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে বাঙালি তার প্রাণপ্রিয় নেতাকে স্মরণ করছে আদর্শে আর কর্মে। এই সত্য যেমন স্পষ্ট, তেমনি স্পষ্ট স্বাধীনতাবিরোধীদের আষ্ফালন। আজ থেকে ৫০ বছর আগে যে রাজনৈতিক অপশক্তি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল, নির্মমভাবে হত্যা করেছিল মুক্তিকামী জনসাধারণকে, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিভৎস জেনোসাইডকে প্রত্যক্ষ মদদ দিয়েছিল যারা; অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এই রাজনৈতিক অপশক্তি আজও বাংলাদেশে তাদের রাজনৈতিক হিংস্রতা চালু রেখেছে। তাই স্বাধীনতার ৫০ বছরে বা জাতির পিতার জন্মশতবর্ষ উদযাপনের এই লগ্নে তারা অতীতের মতোই পাকিস্তানি ভাবাদর্শের মহড়া অব্যাহত রেখেছে। 

হায় জাতির পিতা! তোমার জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনে দেশ যখন উৎসবমুখর, ঠিক তোমার জন্মদিনের দিনটিতে তোমার সোনার বাংলায় মানুষের ঘর বাড়িতে হামলা করা হয়। ভাঙচুর নির্যাতনের ঘটনা ঘটায় সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসীগোষ্ঠী হেফাজতে ইসলাম। তুমি যে সোনার বাংলাকে সাংবিধানিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ আর অসাম্প্রদায়িক করেছ, সেই সোনার বাংলা আজ বিভেদের কাঁটায় জর্জরিত, রক্তাক্ত, ছিন্নভিন্ন। তোমার বাহাত্তরের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা একটি স্তম্ভ ছিল। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর তুমি গর্ব করে বলেছিলে, "আমার বাঙালি আজ মানুষ হয়েছে"। স্বাধীনতার ৫০ বছরে সেই গৌরব আর নেই। তোমার সোনার বাংলার জনতা এখন শুধুই মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান অথবা ক্ষুদ্রনৃগোষ্ঠী বা শুধুই সংখ্যালঘু বা সংখ্যাগুরু। মানুষ নয়। 

২০১২ সালে ২৯ সেপ্টেম্বর কক্সবাজারের রামুতে মসজিদের মাইকে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘোষণা দিয়ে শত শত বছরের পুরনো প্রত্ন ঐতিহ্যের বুদ্ধমূর্তি, বৌদ্ধমন্দিরসহ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে, লুটপাট চালিয়েছিল ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক মৌলবাদীগোষ্ঠী। সে সময় রামুতে গিয়ে এক শিশুর সাথে কথা হয়েছিল, যে সারারাত ধানক্ষেতে বসে আগুনের লেলিহান শিখা দেখেছে আর দেখেছে নিজ ঘর, পাড়া, প্রতিবেশীদের পুড়ে ছাই হতে। এরপরে বহুদিন সে নির্বাক ছিল। 

২০১৬ সালের ৩০ অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরেও সেই একই ঘটনা ঘটানো হয়েছিলো। ফেসবুকে কোনো লেখার জের ধরে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের উপর জঘন্য হামলা হয়েছে। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ৫টি উপাসনালয় ও বহু ঘরবাড়ি ধ্বংস করা হয়েছিল।

এর এক বছরের মাথায় ২০১৭ সালের ১০ নভেম্বর রংপুরের গঙ্গাচড়ার সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের ঘটনায় একজনের মৃত্যু হয়েছিল গুলিতে। এক্ষেত্রেও কৌশল সেই পুরোনো। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কথিত 'ধর্ম অবমাননাকে' হাতিয়ার বানিয়ে নির্বিচারে নির্যাতন চালানো হয়েছে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ওপর।  

একই ফর্মুলায় হামলা হয়েছে ভোলার বোরহানউদ্দীন উপজেলা সদরে। ২০১৯ সালের ২০ অক্টোবর 'তৌহিদী জনতা'র ব্যানারে সংগঠিত এই সাম্প্রদায়িক হামলাটি মুসল্লিদের একটি সমাবেশ থেকে ছড়ানো হয়। চারজন নিহত হন, আহত হন আরও অনেকে।

এই কদিন আগেই ফেইসবুকে ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওতে দেখলাম উন্মত্ত মৌলবাদীরা কুড়িগ্রামে একজনকে পুড়িয়ে মারলো মসজিদে। সুনামগঞ্জের দিরাইয়ে পুড়িয়ে দিল বাউল রণেশ ঠাকুরের গানঘর। পুড়ে গেল কতশত গান, বাদ্যযন্ত্র। ইসলাম নাকি শান্তির ধর্ম! তবে এ কোন ইসলামের দোহাই দিয়ে মানুষের জান-মালের ওপর হামলা করে এই ইসলামের ধ্বজাধারীরা?

দুই

এই সেদিন বঙ্গবন্ধুর ১০১-তম জন্মদিনে সুরের দেশ হাওড়ের দেশ, যেখানে বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমের জন্ম, সেই সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার নোয়াগাও গ্রামের একজন যুবক সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসী মামুনুল হকের ওয়াজের সাস্প্রদায়িক বক্তব্য ও উস্কানির বিষয়ে সমালোচনা করে ফেইসবুকে কিছু লিখলে গ্রামবাসী হামলার ভয়ে সেই যুবককে পুলিশে সোপর্দ করেন। তারা পুলিশের কাছে আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে, তাদের গ্রামে হামলা হতে পারে। পুলিশ তাদের সাবধানে থাকতে বলে দায়িত্ব শেষ করে। যে ভয়ে গ্রামবাসী ঘরের ছেলেকে পুলিশে দিলো সে ভয়ই তাদের সত্যি হলো। ঘোষণা দিয়ে আশপাশের গ্রাম থেকে লোক ডেকে এনে হামলা করলো সনাতন ধর্মাবলম্বীদের আবাসস্থলে। লুটপাট চালালো। এমনকি মহা মূল্যবান কষ্টি পাথরের বিগ্রহ, সেটি নিতেও তাদের ঈমানে আটকায়নি। নির্মম মারপিটের মুখে বীর মুক্তিযোদ্ধা অনিল চন্দ্র দাস যখন নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা বলে পরিচয় দেন, তখন আরো বেশি করে তাকে প্রহার করে হেফাজতে ইসলামের অনুসারীরা। আক্রমণের সময় তারা সিলেটি ভাষায় বলে, "মালাউন অখল আমরার বড় হুজুররে অসম্মান খরছত, উবা। তরারে দ্যাশ ছাড়া খরতাম" এই বাংলাদেশের মুক্তির সংগ্রামে দেয়া মুসলমানের রক্ত আর হিন্দুর রক্ত কি আলাদা করা যাবে এ মাটি থেকে? এটা কি শুধুই মুসলমানের দেশ! বীর মুক্তিযোদ্ধারা কি এই অসম্মানের জন্য জীবন বাজি রেখেছিলেন?

আরো আশা হারাই তখন যখন বঙ্গবন্ধুর প্রাণপ্রিয় আওয়ামী লীগের অনেক কর্মীরা মুজিব কোট গায়ে এইসব সাম্প্রদায়িক হামলা আর লুটপাট তদারকি করে। আজকের আওয়ামী লীগ কি তাদের বিরুদ্ধের এই নীলনকশা বুঝতে পারে না? বিএনপি-জামাত-হেফাজতসহ নানা সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর পাকিস্তানি ভাবধারার ও যুদ্ধাপরাধীদের সন্তানরা, দোসররা নানা ছলে আওয়ামী লীগে ঢুকছে। তাদের ফুলের মালায় বরণ করতেও দেখি পত্রিকার পাতায়। কেউ আত্মীয়তার সূত্রে, কেউ টাকার খেলায় ঢুকে পড়ছে। এইসব অনুপ্রবেশকারীরা কিন্তু নিজেদের সাম্প্রদায়িক আদর্শ নিয়েই আওয়ামী লীগে ঢুকছে। তাই বঙ্গবন্ধুর প্রাণপ্রিয় দলে এখন মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তির পদচারণা দেখি। এই সুঁচ হয়ে ঢোকারাই ফাল হয়ে সর্বনাশ করবে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী ইতিহাসের উজ্জ্বল নক্ষত্রসম এই দলটির। তাই তো সুনামগঞ্জের শাল্লার নোয়াগাওয়ে ছাতা মাথায় হামলা তদারক করতে দেখি মুজিব কোট পরা যুবলীগ নেতা শহিদুল ইসলাম স্বাধীনকে। স্বাধীনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কিন্তু অতীতের ঘটনাগুলো লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, গ্রেপ্তার হলেও ক্ষমতার কারণে ছাড়া পেয়ে যায় নানা অজুহাতে। বিচার হয় না, শাস্তিও হয় না। 

মামুনুল হকের ওয়াজে বিভিন্ন সময় মন্ত্রী ও গণ্যমান্যদের দেখা যায়। কে এই মামুনুল হক? কে এদের বড় হুজুর? কেন তার এই দোর্দণ্ড প্রতাপ? সে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য বুড়িগঙ্গায় ভাসিয়ে দেয়ার হুমকি দেয়ার স্পর্ধা দেখায়। তার উস্কানিতে জাতির পিতার ভাস্কর্য ভাঙা হয়। নানা জায়গায় হামলা হয়। তার বিরুদ্ধে তো একটা মামলাও হয় না। ইউটিউবে ওয়াজগুলোতে কী সব নোংরা কথা বলে, নারীদের অবমাননা করে। জেহাদের ডাক দেয়, কই তার বিরুদ্ধে তো কোন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রয়োগ দেখি না। আইন কি শুধু নিরীহ মানুষের ওপর প্রয়োগ করা হয়? সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে জাস্টিসিয়া ভাস্কর্য অপসারণের প্রতিবাদ করার মামলা নিয়ে বিচারালয়ের চৌকাঠে এখনো ঘুরছে ছাত্ররা। কার্টুনিস্ট কিশোর কার্টুন আঁকার দায়ে এক বছর থাকেন কারা অভ্যন্তরে। আইনের দুই চোখ বাঁধা জানতাম পক্ষপাত না করার জন্য।

রাষ্ট্র কেন এই দুরাচারদের এমন নিরবে সহ্য করছে অল্প বুদ্ধিতে বুঝতে পারি না। প্রশাসন কেন সহায়তা করছে এই হামলাবাজদের, এই দাঙ্গাবাজদের? রাষ্ট্রের আইন কেন এমন এক চোখা বুঝি না। এই যে ধর্মকে ব্যবহার করে একের পর এক মহাসমাবেশ, মহা ওয়াজ মাহফিল চলছে; এখন করোনা আতঙ্ক কোথায়? পুলিশের অনুমতি পায় কী করে এরা। আমরা তো একটা সাংস্কৃতিক আয়োজনের অনুমতি পাই না। পুলিশের দরজায় ঘুরতে ঘুরতে জুতার তলা খসে যায়। তাহলে এ বাংলাদেশ কার? বাংলার আউল বাউলরা দেশ ছাড়বে মামুনুলদের মতো সন্ত্রাসীদের দৌরাত্ম্যে আর দেশটায় রাজত্ব করবে মামুনুল হকদের মত সাম্প্রদায়িক মাস্তানরা? এই কি সুজলা সুফলা সোনার বাংলা? এই কি স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরের সুবর্ণ অর্জন?  বাংলাদেশ, তোমার সাধারণ শান্তিপ্রিয় সন্তানেরা আজ তোমার আগামীর ভাবনায় শঙ্কিত।