মুজিব চিরন্তন

কামাল চৌধুরী
Published : 16 March 2021, 06:00 PM
Updated : 16 March 2021, 06:00 PM

বাঙালি জাতির মুক্তি ও স্বাধীনতার অবিসংবাদিত নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৭ মার্চ ১৯২০ সালে– সে অনুযায়ী ২০২০ সালকে সামনে রেখে উৎসবমুখর পরিবেশে দেশে-বিদেশে তার জন্মশতবার্ষিকী আয়োজনের ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। প্রাথমিকভাবে ১৭ মার্চ ২০২০ থেকে ২৬ শে মার্চ ২০২১ পর্যন্ত সময়কে মুজিববর্ষ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। কিন্তু এ উদ্‌যাপনের প্রস্তুতিমূলক কাজ শুরু হয়েছিল তারও আগে, ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে। সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করে জন্মশতবার্ষিকী উদ্‌যাপন যাত্রার প্রাক-মুহূর্তে শুরু হয় বৈশ্বিক মহামারী কোভিড-১৯। এরূপ প্রতিকূল পরিস্থিতিতে কিছু কর্মসূচির বাস্তবায়ন কাজ অসমাপ্ত থাকার বিষয়টি বিবেচনায় এনে সম্প্রতি সরকার এ সময়কে ১৬ই ডিসেম্বর ২০২১ পর্যন্ত বৃদ্ধি করেছে। 

মুজিব শতবর্ষ উদ্‌যাপন প্রতিটি বাঙালির জীবন অভিজ্ঞতার অসাধারণ একটি অংশ। তাই এ আয়োজনে বাংলাদেশ এবং বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী বাঙালিরা যার যার অবস্থান থেকে বিপুলভাবে সম্পৃক্ত হয়েছেন। কোভিড-১৯ মহামারী পরিস্থিতিতেও সারা পৃথিবীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে নিয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে নানা রকম আয়োজন চলছে। মুজিববর্ষের লোগো দেশে-বিদেশে এখন দৃশ্যমান। অন্তর্জালে নানা আয়োজনে সংযুক্ত হচ্ছেন দেশ-বিদেশের বিশেষজ্ঞজন। সারা পৃথিবীতে বাঙালির সংখ্যা প্রায় ৩০ কোটি। বাংলাদেশ, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরাসহ বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে আছে তারা। সর্বত্রই বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধা জানিয়ে নানা অনুষ্ঠান আয়োজন করা হচ্ছে। তাদের আলোচনায়, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর জীবন, কর্ম, আত্মত্যাগ ও জীবনব্যাপী আন্দোলন-সংগ্রাম উদ্ভাসিত হচ্ছে। মুজিববর্ষে করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলা করে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের ব্যাপকভাবে এবং স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের ফলে এটি স্পষ্ট যে বঙ্গবন্ধু বাঙালির হৃদয়ে অবিনশ্বর এক আসন নিয়ে আছেন যা বাঙালির হাজার বছরের অতিক্রান্ত ইতিহাসে অন্য কোনো নেতা নিতে পারেনি। বাঙালির সবচেয়ে প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু, এটি আজ প্রতিষ্ঠিত সত্য। 

১৯৭১ সালের ১২ এপ্রিলে প্রকাশিত নিউজ উইক পত্রিকায় সাংবাদিক লরেন জেনকিন্স বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সম্পর্কে লিখেছেন:

তার তেজস্বিতা দুর্দান্ত; পূর্ব পাকিস্তানিরা তাকে 'মুজিব' নামে চেনে। তিনি আমাদের বিদেশি সাংবাদিক দলটির সঙ্গে তাঁর বাড়ির বাগানে মুখোমুখি হলেন এবং আবেগদীপ্ত ভাষায় বললেন, "আমার জনসাধারণ ঐক্যবদ্ধ। তাদেরকে দমিয়ে রাখতে পারবে না। আপনারা কি মনে করেন, মেশিনগান আমার জনসাধারণেরে আত্মা ও চেতনা আদৌ নিশ্চিহ্ন করতে পারবে?

বঙ্গবন্ধুর অন্য সকল দূরদর্শী মন্তব্য ও ভবিষ্যদ্বাণীর মতো এই কথাও সঠিক প্রমাণিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে শারীরিকভাবে তার প্রিয় বাঙালির কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তার চেতনাকে হত্যা করতে পারেনি। এটি আজ তার শাহাদত বরণের এত বছর পর আরও স্পষ্ট হয়েছে যে বঙ্গবন্ধু বাঙালির হৃদয়ে চিরন্তন আলোকশিখা হিসেবে আছেন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর ১৬ অগাস্ট সকালে বঙ্গবন্ধুর মরদেহ নিয়ে টুঙ্গিপাড়ার উদ্দেশে যখন হেলিকপ্টার যাত্রা করে, ঘাতক কবলিত বাংলাদেশের সেই শোকাবহ শ্বাসরুদ্ধকর সময়ে কোটি কোটি মানুষ ঘটনার আকস্মিকতায় তাদের শোক ও অশ্রুকে চাপা দিয়ে রেখেছিল। সেই মৃত্যুপুরীতে বঙ্গবন্ধুর শবযাত্রা সম্ভব হয়নি। টুঙ্গিপাড়ায় খুব তাড়াহুড়ো করে বাঙালির সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তানকে দাফন করা হয়েছিল। কিন্তু বাঙালির হৃদয়ে বঙ্গবন্ধুর অন্তিমযাত্রা চিরবেদনার অংশ হয়ে আছে। যেন এখনও জাতি বহন করে চলেছে তার প্রিয়তম সন্তানের মরদেহ; বহন করবে চিরকাল। 

আব্রাহাম লিংকন, মহাত্মা গান্ধী কিংবা জন এফ কেনেডির মৃত্যুর পরে তখন পরিস্থিতি প্রতিকূল ছিল না। জনগণ প্রকাশ্যে শোক প্রকাশ করার সুযোগ পেয়েছিল। ১৮৬৫ সালের ১৫ এপ্রিল আততায়ীর গুলিতে আব্রাহাম লিংকনের মৃত্যু ঘটে। আব্রাহাম লিংকনের মৃত্যু আমেরিকাকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল। মৃত্যুর পরে তার মরদেহ ওয়াশিংটন থেকে ইলিনয়ের স্প্রিংফিল্ডে নিয়ে যাওয়া হয়। এই দীর্ঘ যাত্রায় ২২ এপ্রিল থেকে ৪ মে পর্যন্ত প্রায় দুই সপ্তাহ সময় লেগেছিল– ১৯৪৮ সালে মহাত্মা গান্ধীর হত্যাকাণ্ডের পর পণ্ডিত জওহর লাল নেহেরু তার স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলেন, "The light has gone out"। আমাদের জাতীয় জীবনেও নেমে এসেছিল ঘোর অমানিশা যা থেকে আলোর পথে উত্তরণ ছিল সুকঠিন ও শ্বাপদসংকুল পথযাত্রা।

১৯৭৫ সালের ১৫ই অগাস্টের সেই কালরাতে তারা শুধু বঙ্গবন্ধুকে যে হত্যা করতে চেয়েছিল তা নয়, তারা চেয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বিনাশ করতে– মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত আমাদের সকল শুভ বোধ, শুভ অর্জনকে ধ্বংস করতে। বিদেশে থাকায় ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর দুইকন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা, সেই সঙ্গে বেঁচে যায় বাংলাদেশ। দীর্ঘ নির্বাসন শেষে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আসার পর শুরু হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে প্রতিষ্ঠিত করার লড়াই। বহু মানুষ জীবন দিয়েছিল, কিন্তু শেষাবধি ২১ বছর পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সরকার রাষ্ট্র পরিচালনায় ফিরে এসেছে।

প্রতিবছর বঙ্গবন্ধু নবভাবে উদ্ভাসিত হচ্ছেন। এবার, জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর যুগপৎ মহা-আয়োজনের অনন্য অভিজ্ঞতার সাক্ষী হতে চলেছে সমগ্র বাঙালি জাতি। এজন্য ১৭-২৬শে মার্চ ২০২১ 'মুজিব চিরন্তন' শীর্ষক দশদিনব্যাপী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর জীবন, কর্ম, জীবনব্যাপী আন্দোলন-সংগ্রাম এবং সর্বোপরি তার বৈচিত্র্যময় জীবনের নানান অনুষঙ্গকে উপজীব্য করে প্রতিদিন ভিন্ন ভিন্ন প্রতিপাদ্য নিয়ে আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানমালা সাজানো হয়েছে। ১৯২০ সালের ১৭ মার্চের শুভক্ষণে বঙ্গবন্ধুর জ্যোতির্ময় আবির্ভাবকে উপজীব্য করে ১৭ মার্চ ২০২১ তারিখে জাতির পিতার জন্মতিথির জন্য প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে কবিগুরু রবিঠাকুরের মহানায়কের প্রার্থনায় রচিত অমর পঙ্‌ক্তি, 'ভেঙেছ দুয়ার, এসেছ জ্যোতির্ময়'।

বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের সেই ঐতিহাসিক ও কালজয়ী ভাষণ, যা বাঙালির জাতীয় জীবনে চূড়ান্ত বাঁকবদল ঘটিয়েছিল, সেটির উপর ভিত্তি করে ১৮ মার্চের অনুষ্ঠানের প্রতিপাদ্য ঠিক করা হয়েছে 'মহাকালের তর্জনী'। বঙ্গবন্ধু, বাঙালি ও বাংলাদেশ এক ও অভিন্ন সত্তা। বাংলাদেশের প্রকৃতি-সংস্কৃতি থেকে শুরু করে প্রতিটি অনুষঙ্গে জড়িয়ে থাকা বঙ্গবন্ধু শাশ্বত মহিমাকে উপজীব্য করে ১৯ মার্চের নির্ধারিত থিম কবি অন্নদাশঙ্কর রায়ের সেই অমর পঙ্‌ক্তি 'যতকাল রবে পদ্মা যমুনা'। বঙ্গবন্ধুর যে সাহসী তারুণ্য বাঙালি জাতিকে মুক্তির আন্দোলনে প্রজ্জ্বলিত করেছিল তার ভিত্তিতে 'তারুণ্যের আলোকশিখা'কে ২০ মার্চের প্রতিপাদ্য হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে।

এছাড়াও জাতির পিতার স্বদেশ নির্মাণের নিরলস প্রচেষ্টা ও সাফল্যগাথার ভিত্তিতে ২১ মার্চে 'ধ্বংসস্তূপে জীবনের গান'; বাংলা ও বাঙালির প্রতি বঙ্গবন্ধুর গভীর ভালোবাসা ও মমত্ববোধকে উপজীব্য করে ২২ মার্চে 'বাংলার মাটি আমার মাটি'; নারীমুক্তির জন্য জাতির পিতার অসমান্য ভূমিকার ভিত্তিতে ২৩ মার্চে 'নারীমুক্তি, সাম্য ও স্বাধীনতা'; বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় জাতির পিতার বলিষ্ঠ ভূমিকাকে উপজীব্য করে ২৪ মার্চে 'শান্তি, মুক্তি ও মানবতার অগ্রদূত'; পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যার নির্মমতা এবং বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাকে উপজীব্য করে ২৫ মার্চে 'গণহত্যার কালরাত্রি ও আলোকের অভিযাত্রা' এবং মহান স্বাধীনতার অতিক্রান্ত ৫০ বছর ও অজস্র ষড়যন্ত্র-প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রার বিভিন্ন দিককে উপজীব্য করে ২৬শে মার্চে 'স্বাধীনতার ৫০ বছর ও অগ্রগতির সুবর্ণরেখা'কে প্রতিপাদ্য হিসাবে নির্ধারণ করা হয়েছে। 

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সম্প্রতি দেশে-বিদেশের বরেণ্য ব্যক্তিবর্গ অনেক লিখেছেন; তার জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোকপাত করার চেষ্টা করেছেন। যতকাল যাবে তাকে নিয়ে, তার দর্শন, অসাম্প্রদায়িকতা ও মানবতাবোধ নিয়ে আরও লেখা হবে। মূলত মৃত্যুর পরে বাঙালির হৃদয়ে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে শোক ও বিনম্র শ্রদ্ধার যে যাত্রা এখন শুরু হয়েছে তা 'মুজিব চিরন্তন'-এর যাত্রা। তাই মুজিব জন্মশতবার্ষিকী উদ্‌যাপনের মাধ্যমে বাঙালির এ যাত্রা শেষ হবে না। এটি অন্তহীনভাবে চলবে এবং জাতির সৃজনে, মননে, দর্শনে এবং চিন্তায় বঙ্গবন্ধুর জীবন, কর্ম এবং আত্মত্যাগের মহিমা আরও উদ্ভাসিত হবে। বুলেট বাঙালির মুক্তির মহানায়কের চেতনা ও আত্মাকে ধ্বংস করতে পারেনি। বঙ্গবন্ধুর সেই অবিনাশী চেতনাই মুজিববর্ষে আমাদের 'মুজিব চিরন্তন' যাত্রায় আমাদের অসীম প্রেরণা।