সাতই মার্চের ৫০ বছর

নাসার আহমেদ চৌধুরী
Published : 6 March 2021, 07:17 PM
Updated : 6 March 2021, 07:17 PM

ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ৫০ বছর হয়ে গেল। কিন্তু এখনো আমার চেতনায়, আমার হৃদয় জুড়ে রয়েছে অসম্ভবকে সম্ভব করার সেই দিনটি। ঘোষণা ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিবেন রেসকোর্স ময়দান থেকে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দি উদ্যান) এবং তা সরাসরি প্রচারিত হবে রেডিও ও টেলিভিশন থেকে। ঐতিহাসিক ভাষণ প্রচারের উদ্দেশ্যে আমরা সবাই প্রস্তুত হলাম ৭ই মার্চ সকাল থেকে। রেডিও-র পরিচালক জনাব আশরাফুজ্জামান খান আমাদেরকে ডেকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিলেন। বেতার ভবনে দায়িত্বে থাকবেন আশফাকুর রহমান খান ও বাহারাম উদ্দিন সিদ্দিকী, এবং জাহিদুল হক ডিউটি রুমে। রেসকোর্স মাঠে থাকবেন শামসুল আলম ও কাজী রফিক। এবং স্টেজে থাকবেন পরিচালক আশরাফুজ্জামান খান, সহকারী পরিচালক আহমেদ জামান খান এবং অনুষ্ঠান সংগঠক আমি নাসার আহমেদ চৌধুরী। ভাষণ সরাসরি প্রচার এর জন্য উপস্থিত ছিলেন প্রকৌশল বিভাগের কর্মচারীরা। ঐতিহাসিক ভাষণ শুরু হওয়ার মুহূর্তে বাহারাম উদ্দিন সিদ্দিকী আমাদেরকে টেলিফোনে জানালেন, পাক আর্মির মেজর সালেক জানিয়েছেন ভাষণ প্রচার করা যাবে না। ভাষণ প্রচার করা হলে বোমা মেরে রেডিও উড়িয়ে দেওয়া হবে। ততোক্ষণে বঙ্গবন্ধু ভাষণ প্রচার শুরু করে দিয়েছেন। সঙ্গে সঙ্গে সরাসরি প্রচার বন্ধ করে দেওয়া হলো। সারা দেশ তখন পাক আর্মির দখলে। এক টুকরো ছোট কাগজে লিখে বঙ্গবন্ধুর হাতে দেওয়া হলো আপনার ভাষণ পাক আর্মি প্রচার করতে দিচ্ছে না।

সারা দেশ সারা জাতি বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ডাক শোনা থেকে বঞ্চিত হয়ে গেল। আমি তখন জীবনের পুরোপুরি ঝুঁকি নিয়ে আমার সঙ্গে নেওয়া ছোট উহার রেকর্ডারে লুকিয়ে সমস্ত ভাষণ রেকর্ড করে ফেললাম। বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে রেডিও-টেলিভিশন অফিস-আদালত বন্ধ ঘোষণা করলেন এবং প্রস্তুত থাকতে বললেন। আমরা তার কথামতো সমস্ত ভিডিও প্রচার বন্ধ করে দিলাম এবং আমরা হাতিরপুলে কাজী রফিকের বাসায় আত্মগোপন করে রইলাম। রেডিও প্রচার বন্ধ হওয়ায় পাকিস্তানি সরকার এবং সেনাবাহিনী হতভম্ব হয়ে গেল। পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ থাকলো না। যার ফলে সেনাবাহিনী রেডিও-র কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হলো।

তৎকালীন সেনাপ্রধান রাও ফরমান আলী আশরাফুজ্জামান খানকে অনুরোধ করলেন, দয়া করে আপনারা রেডিও প্রচার শুরু করুন এবং শেখ মুজিবের ভাষণ প্রচার করুন। তখন সেই ভাষণ, যা আমি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রেকর্ড করেছিলাম, সেটাই পরের দিন প্রচার করা হলো। সেই ভাষণ শুনে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলো। নয় মাস লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রাণ দিয়ে দেশ স্বাধীন করলো। কিন্তু দুঃখের বিষয় আমাদের সেই সময়ের অবদানের মূল্যায়ন কিন্তু আজও হলো না। এদিকে মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই অসহযোগ আন্দোলন, ৭ই মার্চের ভাষণ প্রচার, এবং রেডিও পাকিস্তানের নাম পরিবর্তন করে ঢাকা রেডিও করার জন্য আমাদের ওপর শুরু হলো পাকিস্তান আর্মির স্টিমরোলার চালানো।

পরিচালক আশরাফুজ্জামান সাহেবকে সরিয়ে তার স্থলে আনা হলো প্রাক্তন রেডিও পরিচালক সৈয়দ জিল্লুর রহমানকে। একদিন পাকিস্তান আর্মির কর্নেল কাশেম রেডিওতে এসে হাজির হলেন। একে একে আমরা যারা যারা অসহযোগ আন্দোলনে জড়িত ছিলাম তাদের মধ্যে পরিচালকরা নুরুন্নবী খান, দিলরুবা বেগম, শামসুল আলম, কাজী রফিক সবাইকে সাসপেন্ড করা হলো। আর আমাকে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো ক্যান্টনমেন্টে। পরিচালক জিল্লুর রহমান সাহেব আমাকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন ও খুব ভালোবাসতেন। রেডিওতে চাকরি তিনিই আমাকে দিয়েছিলেন। কর্নেল কাশেম জিল্লুর রহমান সাহেবের কক্ষে বসা। সেখানে আমার ডাক পড়লো। আমার সব সহকর্মী আমার প্রাণের জন্য দোয়া শুরু করলো। দুরু দুরু বুকে আমি পরিচালকের কক্ষে হাজির হলাম। জিল্লুর রহমান সাহেব তার চেয়ারে বসা। কর্নেল কাশেম তার পাশে হাতে ব্রিফকেস কোমরে পিস্তল নিয়ে বসে আছেন। জিল্লুর রহমান সাহেব কর্নেল কাশেমকে আগেই বলে রেখেছিলেন যে আমার কোন অফিসারকে ধরে নিতে পারবেন না। এদের ছাড়া আমি রেডিও চালাতে পারবো না।

কর্নেল কাশেম আমার জেরা শুরু করলেন। জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নাম নাসের চৌধুরী? আমি বললাম, জি স্যার। তুমি শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ আমাদের নিষেধ সত্ত্বেও রেকর্ড করেছিলে? আমি বললাম, জি। কেন করেছিলে? আমার উত্তর দেওয়ার পূর্বে জিল্লুর রহমান বললেন, পরিচালকের নির্দেশে রেকর্ড করেছিল। পরের প্রশ্ন, তুমি শেখ মুজিবকে চিরকূট লিখে জানিয়েছিলে তার ভাষণ প্রচার করা হচ্ছে না। আমি বললাম, "না আমি চিরকূট লিখিনি।" কর্নেল বললেন, "আমার কাছে চিরকূটের ছবি আছে তুমি সেটা শেখ মুজিবের হাতে দিচ্ছো।" আমি বললাম, "আমি লেখিনি, আমি দিইনি।" বললেন, "তোমাকে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে গেলে তুমি সবই বলবে।" আমার মনে পড়ে তখন জিল্লুর রহমান সাহেব আমাকে বাঁচাতে কর্নেলকে বললেন, "ও অত্যন্ত ভালো ছেলে। সে একজন ভালো অফিসার ও ভালো গান গায়। মেহেদী হাসানের গান গজল খুব সুন্দর গায়। ওর মামা আলী হাসান পাকিস্তানের সিএসপি অফিসার। সেক্রেটারি। কর্নেল, আমি তার দায়িত্ব নিজে নিচ্ছি।"

আমি আবার আসবো বলে কর্নেল চলে গেলেন। কর্নেল চলে যাওয়ার সাথে সাথে জিল্লুর রহমান আমাকে একদিনের নোটিশে চট্টগ্রাম রেডিওতে বদলি করে দিলেন। আমার প্রাণরক্ষা পেল। চট্টগ্রামে সাতদিন থাকার পর আমি ঢাকায় ফিরে এলাম। তবে রেডিওতে আর যোগদান করলাম না। ততদিনে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। আমি দেশাত্মবোধক গানের টেপ মুক্তিযোদ্ধা জালাল উদ্দিন রুমির মাধ্যমে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে পাঠাতাম। মুক্তিযোদ্ধা মায়া গ্রুপের সিরাজ উদ্দিন ভূঁইয়া আমার বন্ধু। শেরাটন হোটেলে ও আজিমপুর গার্লস স্কুলে বোমা ফাটাতে তাকে সাহায্য করলাম। ১৬ই ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলো। ১৭ ডিসেম্বর আবার রেডিওতে দিলাম। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দৈনিক পত্রিকায় আমার নাম প্রকাশিত হলো। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে কোনো স্বীকৃতি আমি আজও পাইনি।