টিকা টিপ্পনী

সায়ীদুল হক খানসায়ীদুল হক খান
Published : 6 March 2021, 08:38 AM
Updated : 6 March 2021, 08:38 AM

কোভিড-১৯ এর আপদ থেকে বাঁচার জন্য, "সুরক্ষা" ওয়েব-সাইটে নথিভুক্ত হয়ে, ওটিপি-র শিহরণ সয়ে, এসএমএস দিয়ে দিন গুজরান করছি, হঠাৎ মেসেজ এসে মুচড়ে দিল। বিএসএসএমইউ-তে যেতে হবে, "টিকাকার্ড ও  জাতীয় পরিচয়পত্র অবশ্যই নিয়ে"। বিএসএসএমইউ দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতায় এক বিরাট এলাকা, সেটার ঠিক কোথায় যেতে হবে, তা লেখা নেই। বন্ধুদের শরণাপন্ন হয়ে, জিজ্ঞেস করলাম

বিএসএসএমইউ কোথায়

আরে ওই যে পিজি। পিজি কোথায়

আরে ওই যে শাহবাগ হোটেল। শাহবাহ হোটেল কোথায়

আরে ওই যে যেখানে খানা-পিনা চলে। খানা-পিনা কোথায় চলে? "বাপু, তোমার কিছু খেতে হবে না, তুমি শুধু 'পিয়ে' যাও, তবেই চোখ খুলবে"। "এমনধারা ধমক দিলে, কেমন করে শিখবো সব…"। শেষে, একজন বললেন, "ঘোড়ার-পশ্চাৎদেশ-সোজা"! কথা নিয়ে আর এগুনো হয় না! 

আ-কনুই প্রায়-অনাবৃত রেখে স্যান্ডো-গেঞ্জি ও মেক্সিকান-পঞ্চো দিয়ে শরীরের ঊর্ধ্বাংশ এবং নিম্নাংশে 'তহ্‌বন' বেষ্টন করে, নীলক্ষেত থেকে কিছু পথ রিক্সা ও বাকী পথ, 'সঙ্কুচিত-প্রাকৃতিক-গ্যাস' (সিএনজি) চালিত ত্রি-চক্রযানে, ঘোড়া-র খোঁজে কিঞ্চিৎ ঘোরাঘুরির পর হঠাৎ- জুড়ি-গাড়ি, চাবুক-উদ্যত-সহিস, ঘোড়ারা এবং তাদের পশ্চাৎদেশ এবং সেই পশ্চাৎ নিরিখ করে বিএসএমএমইউজ এর সন্মেলনস্থল। Voila! Eureka! এখানেই 'দেয়া-নেয়া' হবে। 

সামনে বেশকিছু গাড়ি, কমকিছু ছটফটে-নিরাপত্তা-কর্মী, যারা সিএনজি দেখেই 'ধুর' 'ধুর' ভাব নিয়ে 'দূর' 'দূর' করছে। সিএনজি-টির বাঁয়ের দরজা খুলছিল না, কিন্তু ফুটপাথ বাঁয়ে। ডানে নামা মুশকিল কারণ, সড়াৎ সড়াৎ করে গাড়ি পেরিয়ে যাচ্ছে। বেশ কসরতের পর বা-দরজা খুলে সোজা ফুটপাথ। যে গেট দিয়ে ভবনে ঢুকতে হয়, তা গাড়িচারীদের জন্য, পথচারীদের গেইটটি বন্ধ। নিরাপত্তা-কর্মীদের ডিঙ্গিয়ে, "বাঁয়ে বাঁচিয়ে, ডাইনে রুখে" সিঁড়ির প্রথম ধাপের গোঁড়ায় পৌঁছানো হল। বেশ কয়েকটা সিঁড়ি বেয়ে, চারপাশের চিত্রকর্মী ও অন্যান্যদের ডানে রেখে, বাঁয়ে কেটে, দ্বিতীয় প্রস্থ নিরপত্তা কর্মী: একজন এসএমএস দেখতে চান, অন্যজন নিবন্ধন পত্র চান, এগুলি সেরে সন্মেলনস্থলে সেঁধনো গেল। 

এবার কোন্‌দিকে

ভিড়ের দিকে এগিয়ে, অনেক মানুষজন: কারো গলায় আইডি কার্ড, দু-পেয়েদের কাঁধে ও তে-পেয়েদের মাথায়, জেল্লায়, পেল্লায়-ক্যামেরা, প্রায় সবার হাতে সেলফোন, সংখ্যার ও ধরনের অযুত ভিআইপি 'বাঁধো' 'বিদ্ধ'সামাজিক দূরত্ব? মোট্টেও নেই। উল্লম্ব-ভাবে ঈশ্বরের সাথে অ-নে-ক দূরত্ব, কিন্তু আনুভূমিক-ভাবে ঈশ্বরের-খলিফাদের সাথে দূরত্ব বারো-ইঞ্চিও নয়! এই খলিফাদের 'সেলফোনে'র তার এড়িয়ে, ডেস্কের কাছে যেয়ে নিজের নাম ও পত্র দেখানোর মুহূর্তে, একজন পরিচিত স্বেচ্ছাসেবক এসে নিজের 'নাকানি' নামিয়ে: 

"আমাকে চিনতে পারলেন না?" 

আমিও নাকানি নামিয়ে "আরে হ্যা, তাইতো"। তিনি 'তিড়ছি-নযরিয়া' হেনে আমার 'পরিস্থিতি-বান্ধব' বেশ-ভুষা দেখে, নিবন্ধন-পত্রটি অন্য এক তরুণী-সেবিকার হাতে দেয়ার পূর্বে "এখানে সই করুন, তারিখ বসান, ফোন নম্বর লিখুন"। "ওহ্‌, কলম আনেন নি?" 

পরপরই "আপনিএখানে, … না না, এখানে বসুন"। লাইনে বসে গেলাম। আগের জন পর্দাচ্ছাদিত হয়ে নিচ্ছেন, শেষ হওয়া মাত্রই, "আপনি আসুন"। বললাম- "আমি বে-পর্দাই করতে চাই"। পর্দা হটিয়ে, এগিয়ে এসে বল্লেন, "খুব সহজ হয়ে নিজেকে ছেড়ে ও ছড়িয়ে রাখুন"। যদ্দুর সম্ভব ছড়িয়ে যেতে যেতে উনি আমার কক্ষতল আকর্ষণ করা মাত্র, কাতুকুতু বোধ করে কুঁচিয়ে যেতেই, দুটি অনুভূতি: একটি স্থাপনের, অন্যটি প্রবেশের অর্থাৎ সুঁই কাঁখের চামড়ায় স্থাপিত হবার এবং পেশী-তে প্রবেশ করার। কিন্তু বের করার কোনও অনুভূতি নেই, সুঁই-কে ধন্যবাদ দেবার সময়ও পাওয়া গেল না। বস্তুত প্রবেশান্মুখ-কে আমরা যতটা নজর করি, প্রস্থানোদ্যত-কে মোটেই ততটা নয়। তাই না? ফুটানিওয়ালী বললেন, "হয়েছে"। কোনও বামাকণ্ঠে এই প্রথম "হয়েছে" শব্দটা শুনে, বললাম- 'আলহামদুলিল্লাহ্'‌, তারপর "পরিস্থিতি-বান্ধব" বেশভূষা কে শুঁকরিয়া, তারপর 'উনাকে' ধন্যবাদ, Quicki-র জন্য! 

নিবন্ধন-পত্রটি ফেরত পাবার সময় একটু 'মিলমিশ' হয়ে যেয়ে, এক ম্যডামের-টা এসেছে আমার হাতে, আমারটা গিয়েছে উনার হাতে। হস্তান্তর ও হস্তগত দুটোই হোল। 

"স্যার, বিশ মিনিট শ্রান্তি-বিনোদনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে, দো-তলায় ভিআইপি বসার জায়গা, ওই যে লিফট্‌"। 

এর মধ্যেই ভুঁইফুঁড়ে "আরে, আপনার ফটু তো তুলতেই পাল্লাম না, মিডিয়াও কেঁদে ফিরে গেল, যাক, পরেরবার হবে"।একনাগাড়ের বলে চলে গেলেন ওই ফ্লোরের মুস্কিল-আছান, আমাদের তল্লাটের ভুঁইয়া। 

লিফটে টিপ মেরে, দ্বিতীয় টিপের পর, দোতলা। (লিফটগুলিতে টেপাট্যাপি করার জন্য, সাথে দেড়-ইঞ্চি মাপের চন্দন কাঠের টুকরা রেখেছি- হস্তস্পর্শবিবর্জিত-লিফট-টেপা!) ছড়িয়ে-ছিটিয়ে কেউ বসে, কেউ দাঁড়িয়ে, কেউ আড়িয়ে- বিশ-মিনিট-কা-মামলা। কোনও 'বিনুদন' নেই। চা'কফি খুব জমতো, সিগারেট হলে তো কথাই নেই, কিসের বিশ মিনিট? বিশ-মিনিটে কি বিষক্ষয় হয়

সোফায় হেলিয়ে হঠাৎ মনে এলো, সুকান্তের লিখা, হেমন্তের গাওয়া "রানার, রানার, কী হবে এ বোঝা বয়ে, কী হবে ক্ষুধার ক্লান্তিতে সয়ে সয়ে"। কিন্তু কেচাং শব্দে সমস্ত শ্রান্তি বিঘ্নিত হয়ে, ফিরে দেখি 'স্খলন-স্খালন কুঠুরি' থেকে এক জেনানা বেরিয়ে এলেন, ভাবলাম 'জেনানা-কুঠুরি' যেহেতু,'মরদ-কুঠুরি' অন্য কোথাও নিশ্চয় আছে। Nope! এটা লিঙ্গ-নিরপেক্ষ-কুঠুরি, যার তিলকে সাঁটানো কাগজে লিখা "টয়লেট(ভিআইপি)" কিন্তু উপরের চৌকাঠে ছোট-কাগজে ততোধিক ছোট ছোট করে লিখা "প্রতিবন্ধী-টয়লেট"। 

মার গুল্‌লি! 

ভিআইপি-রা কি তবে ভেতরে ভেতরে প্রতিবন্ধীও বটেন, আর সে কারণেই তাদের গতায়াতে এত্ত এত্ত সেপাই-সান্ত্রী? তাহলে আমি কোন্‌ ধরনের ভিআইপি? কোথায় পিওন, সেপাই, আর্দালি, চাপরাশি, ধ্যাদ্ধেরা হুটার, ভোম ভোম গাড়ি, পতপতে নিশান, তিরতিরে নারী আর সিরসিরে স্যুট। পরিচয় নিয়ে অনুক্ষণ ধন্ধে থাকার কারণেই হয়তো আমাকে এক অণুজীববিজ্ঞানী সন্মেলনস্থলের পথ বাত্‌লিয়েছেন: 'মিন্টু রোডের আগায় যেয়ে, ঘোড়ার 'পাছা' তথা 'হোগা' যেদিকে, সেদিকে যাবেন। উত্তর-দক্ষিন খুঁজতে যাবেন না, আপনার কি মিয়াঁ কম্পাস আছে? আছে এক ক্যম্পাস, সেটা বেঁচে আর কত খাবেন হে'? 

জ্ঞানতাপস বলেছিলেন, কোনও জাত-কে বুঝতে হলে বই ও কাঁচা বাজারের দোকান ঢুঁড়তে, সাথে টয়লেট ও রান্নাঘর যুক্ত করেছি। বিএসএমএমইউ সন্মেলনস্থলের-দোতলার প্রতিবন্ধী-টয়লেটটি একটি আয়তকার কুঠুরি, দক্ষিণ-উত্তরে লম্বা; নৈঋত-কোণে বেসিন; বায়ু-কোণে ফ্লোর থেকে ছাঁদ পর্যন্ত বদ্ধ কাঁচ, ঈশান-কোণে কমোড, পুশ-শাওয়ার, টিস্যু-হোল্ডার, অগ্নি-কোণে দরজা। বেসিন থেকে কমোডের দূরত্ব নীলক্ষেত থেকে ফার্মগেট, বিশ্বাস না হলে, মেপে আসতে পারেন। কমোড-টি দামী এবং সে কারণেই হয়তো, তলানিতে "এই নশ্বর জীবনের মানে শুধু তোমাকেই চাই…"গেয়ে গেয়ে, বর্ণযুক্ত-গন্ধহীন-ঐতিহাসিক-স্মৃতিচিহ্ন, কমোডের গলা জড়িয়ে বসে আছে। 

ইতিমধ্যে বিশ-মিনিটে পেরিয়ে যেতে যেতে মাথার চুলাবৃত অংশে খুব হাল্কা একটা বিকিরণ-বোধ, যা ব্যথা নয়, কিন্তু কিছু একটা। এই মাথাটা, কোনও মুণ্ডু কোনোদিন বুঝতে দিল না, সাথে থেকেও বন্ধু হতে পারলো না! বেহুদা, একে বয়ে বেড়ানো। অপসৃয়মান-বিকিরণ বয়েই নিচে নামতে নামতে দেখি, এক কর্মকর্তা একটি সেলফোনের উপর অন্যটি চেপে কথা বলছেন, বড়টা নিচে, ছোটটা উপরে। এই ভদ্রলোক সম্ভবত তার ভুঁড়ির উপর দুই-বাচ্চাকে নিয়েও এভাবেই কথা বলেন। 

বিএসএমএমইউ নামটি নিয়ে আমার আপত্তি আছে, কারণ: যেহেতু, বঙ্গবন্ধু-মানেই-শেখ-মুজিব, আর শেখ-মুজিব-মানেই-বঙ্গবন্ধু সেহেতু 'বঙ্গবন্ধু-শেখ-মুজিব' কথ্যভাবে ঠিক হয়ে গেলেও, লিখ্যভাবে ঠিক নয়। এ তো আর লঞ্চের নাম নয় যে, আক্কু-১ অথবা আক্কু-২! তাই বঙ্গবন্ধু-শেখ-মুজিব লিখে আমরা 'অন্য/২য়' বঙ্গবন্ধুর সুযোগ রেখে দিচ্ছি, অর্থাৎ বোঝাতে চাইছি, এই বঙ্গবন্ধু মানে, শেখ-মুজিব-বঙ্গবন্ধু, অন্য কোনও বঙ্গবন্ধু নন! 

তেমনি, জাতির-পিতার ফটোর নিচে বাংলায় উনার নাম লেখার পর লেখা আছে, 'বাংলাদেশ'আচ্ছা বলুন তো, বাঙালি তথা বাংলাভাষী ছাড়া আর কোন্‌ জাতির পিতা হবার ঠ্যাকা উনার পরেছে? এ সমস্ত বাগাড়ম্বরের আর শেষ নেই! খন্দকার মোস্তাক কথিত "সূর্য সন্তানদের" গুলিতে নিহত, নিজের আত্মজর মৃত্যু-চিৎকার শোনার পর-পরই, নিজেও গুলিবিদ্ধ-হয়ে-সিঁড়িতে-পড়ে-থাকা, শেখ লুৎফর রহমানের "খোকা মিয়াঁ" কে, 'খোকা' বলে আদর করার অধিকার আমরা পেয়েই উঠছি না! আসলে, কাউকেই না- কি খুদা তা'লা, কি পয়গম্বর, কি ঠাকুর মিয়াঁ… কাউকেই নিজেদের মত করে পাওয়াই যাচ্ছে না, শুধু "নামাজ পড়িস ব্যাটা…" মার্কা-ধমক। 

ফিরতি পথের চালকটি, কমবয়সী, লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছে অথবা দিতে বাধ্য হয়েছে। নিজস্ব বোধ থেকে লেখাপড়া যদি ছেড়েই থাকে, তবে সেলাম পাবার যোগ্য। অত কথা জিগানোর সময় হয় নি। 

গৃহস্থ হবার পর, হাল্কা প্রশ্ন, জিজ্ঞাসু চোখ, কিন্তু আমি তখন পিপাসিত চা-সিগারেটের জন্য। অন্যদিকে, বন্ধুরা আমার এই 'প্যরা'র পর শুধু 'সিটামল', 'সিটামল' করেই চলছে ও সেইসাথে পরামর্শ, আজ রাতে অন্তত 'অন্যকিছু' খাবেন না এবং আর্জিঃ "রাতের বরাদ্দটুকু আমাদের দিয়ে দেবেন"। 

আহ্লাদের কথা! 

দু,একটা ত্যাঁদড়, খুব নিষ্পাপ ভাব নিয়ে আশ্বাস দিল, "রাতে ফোন করে খবর নিব, স্যার"। 

"কাইকে? কাইকে, ঘুমের সময় পুতুপুতু করতে হবে? একদম ঠ্যাং ভেঙে নেব"। 

ওদের ঠ্যাং এখনও অক্ষত ও যথাস্থানে রয়েছে