আমরা কি বিচার পাবো না?

সঙ্গীতা ইমামসঙ্গীতা ইমাম
Published : 6 March 2021, 07:30 AM
Updated : 6 March 2021, 07:30 AM

"আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে"– এটাই ছিল বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর দ্বাদশ জাতীয় সম্মেলনের স্লোগান। ১৯৯৯ সালের ৪, ৫ এবং ৬ মার্চ যশোরের ঐতিহাসিক টাউন হল মাঠে অনুষ্ঠিত তিনদিনব্যাপি অনুষ্ঠিত জাতীয় সম্মেলনের শেষ দিনে এক ভয়াবহ আক্রমণের শিকার হয় বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গন। এই দিন মৌলবাদী গোষ্ঠী উদীচীর সম্মেলনে বোমা মেরে ১০টি তাজা প্রাণ কেড়ে নেয়। উদীচীর ওপর বোমা হামলার মাধ্যমেই বাংলাদেশে জঙ্গীবাদের ভয়াবহ বোমাবাজির নজির শুরু হয়।

উদীচীর একাদশ জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ঢাকাতে। সে সময় প্রথম সাংগঠনিক দিক থেকে শ্রেষ্ঠ জেলা নির্বাচন শুরু হয়। সাংগঠনিক যোগ্যতার ভিত্তিতে শ্রেষ্ঠ জেলা হিসেবে নির্বাচিত হয় যশোর জেলা। দ্বাদশ জাতীয় সম্মেলনের দায়িত্ব অর্পন করা হয় যশোর জেলার ওপর। সেবারই প্রথম ঢাকার বাইরে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। যশোর জেলায় আয়োজিত প্রতিনিধি সম্মেলনে সারা বাংলাদেশ থেকে প্রায় ১,৫০০ সাংস্কৃতিক কর্মী ও উদীচী'র ভাই-বোনেরা আসেন। এই সম্মেলন হয়ে উঠে সাংস্কৃতিক কর্মীদের এক অপূর্ব মিলন মেলা। ৬ মার্চ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলছিল। ভারতের মেদিনীপুর থেকে আসা সাংস্কৃতিক সংগঠন 'ষড়ভূজ'সহ আরও বেশ কয়েকটি সাংস্কৃতিক দলের পরিবেশনা চলছিল মঞ্চে। অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করছিলেন বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর যশোর জেলা সংসদের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ডি এম শহিদুজ্জামান। শহিদ ভাই আজ আর আমাদের মাঝে নেই।

তখনই পর পর দুটি শক্তিশালী বোমা বিস্ফোরিত হয় অনুষ্ঠানস্থলে। উদীচীর ১০ জন সাংস্কৃতিক কর্মী এতে প্রাণ হারান, আহত হন প্রায় দুই শতাধিক। নিহত ১০ জন হলেন— নূর ইসলাম, নাজমুল হুদা তপন, সন্ধ্যা রাণী ঘোষ, ইলিয়াস মুন্সী, শাহ আলম বাবুল, বুলু, রতন রায়, বাবুল সূত্রধর, শাহ আলম ও রামকৃষ্ণ। 

এ নৃশংস হামলার ২২ বছর পেরিয়ে গেছে। এই ২২ বছর বিচারহীনতার ২২ বছর, জঙ্গীবাদী, মৌলবাদী গোষ্ঠীর নৃশংস আক্রমণের ক্ষতচিহ্ন বয়ে বেড়ানোর ২২ বছর, ১০ জন সাংস্কৃতিক কর্মী ও সহযোদ্ধা হারানোর ২২ বছর। গত ২২টি বছর ধরে উদীচী'র ভাই-বোনেরা এই নৃশংস ঘটনার বিচার দাবি করে আসছে। কোনো বিচার হয়নি কিন্তু বারবার হামলা হয়েছে উদীচীসহ দেশের প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর। কী কারণে এই হত্যা মামলাটির বিচার হচ্ছে না, তাও আমাদের জানা নেই। বারবার সরকার ও তার প্রশাসনের কাছে এই বিচারের দাবি জানালেও কোনো প্রতিকার পাচ্ছে না উদীচী।

এ ভয়াবহ হামলার পর সারাদেশের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন উদীচী'র পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। এ হামলা কেবল উদীচী'র উপর হামলাই নয়, এ হামলা ছিল বাংলাদেশের প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক রাজনৈতিক আন্দোলনের উপর এক ন্যাক্কারজনক হামলা। তাই আমরা যেমন হারিয়েছিলাম আমাদের সাংস্কৃতিক সহযোদ্ধাদের, তেমনি সারাদেশের প্রগতিশীল সংগঠনগুলো ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল এ হামলার প্রতিবাদে। সকলে মিলে এ জঘন্য হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছিলেন। আজও বিচারের দাবিতে আমরা রাজপথে মিছিল করছি, আহতরা আঘাতের চিহ্ন নিয়ে বিচারের প্রতীক্ষায় আছেন। 

উদীচী-র দ্বাদশ সম্মেলনে সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক হিসেবে পুনর্নিবাচিত হয়েছিলেন যথাক্রমে নাট্যজন সৈয়দ হাসান ইমাম এবং গণসঙ্গীত শিল্পী মাহমুদ সেলিম। বোমা হামলায় আহতদের উদ্ধার এবং সুচিকিৎসার জন্য উদীচী'র তৎকালীন সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদকের নেতৃত্বে সারা বাংলাদেশের উদীচী-র ভাই-বোনরা একসঙ্গে কাজ শুরু করেন। উদীচী তো আমাদের কাছে কেবলই একটি সংগঠন নয়; এ আমাদের এক পরিবার। সারা বাংলাদেশের উদীচী'র শিল্পী-কর্মীরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেছেন তখন। এখানেই একটি সংগঠনের শক্তি।

ঘটনার পরদিন মারাত্মকভাবে আহতদের যশোর থেকে হেলিকপ্টারে করে খুলনায় এবং ঢাকা এনে চিকিৎসার বন্দোবস্ত করা হয়। নিহত ১০ জনের পরিবারের সমস্ত দায়িত্ব নিয়েছে উদীচী। নিহত ১০ জনের মধ্যে উদীচী পরিবারের সদস্য ছিলেন ৫ জন আর বাকি ৫ জন ছিলেন অনুষ্ঠানের দর্শক-শ্রোতা। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিহতদের প্রত্যেকের পরিবারের নামে পোস্ট অফিসে ৫০,০০০ টাকা জমা করে দেন। নিহতদের মধ্যে যাঁদের পরিবারের কোনো সদস্য চাকুরির উপযুক্ত, তাকে চাকরির বন্দোবস্ত করে দেয়া, কাউকে দোকান করে দেয়া, রিকশা বা ভ্যান কিনে দেয়া থেকে শুরু করে সার্বিক দায়িত্ব তৎকালীন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নেতৃত্বে পালন করেছে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী। 

যাদের অঙ্গহানী ঘটেছে, তাদের কৃত্রিম অঙ্গ সংস্থাপনের উদ্যোগও নিয়েছে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী। আহতদের মধ্যে ৪ জন তাদের পা হারান। এ চার জনেরই কৃত্রিম পা সংযোজনের উদ্যোগ নেয় উদীচী। তৎকালীন সভাপতি সৈয়দ হাসান ইমাম প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে অর্থ সংগ্রহ করে জার্মান থেকে কৃত্রিম পা এনে তা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে সংযোজনের কাজ সম্পন্ন করেন। কৃত্রিম পা সংযোজনের পর উদীচীর ভাই-বোনদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় তাদের হাঁটার প্রশিক্ষণ দেয়া হয় এবং সুস্থ হবার পর বাড়ি পাঠানো হয়। এই ২২ বছর ধরে উদীচী যেমন যশোর হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে আন্দোলন করছে, তেমনি এই বোমা হামলায় আহতদের পাশে আজও উদীচী দাঁড়িয়ে আছে তার মানবিক আদর্শ নিয়ে। সংগঠনের ওপর যে বিপর্যয় নেমে এসেছিল সেদিন, তাতে আমরা চূড়ান্তভাবে আহত হয়েছিলাম ঠিকই কিন্তু ভেঙে পড়িনি। কারণ, 'সত্যেন রণেশের আঁকা পদচিহ্ন' আমাদের শিখিয়েছে নিদারুণ দুর্যোগও সহযোদ্ধাদের নিয়ে কী করে মোকাবেলা করতে হয়।