মদ, মির্জা গালিব এবং সৃষ্টিশীলতা

আহসান কবিরআহসান কবির
Published : 24 Feb 2021, 01:45 PM
Updated : 24 Feb 2021, 01:45 PM

পৃথিবী বিখ্যাত কবি ও দার্শনিক মির্জা গালিবকে নিয়ে বাজারে অনেক 'শের সায়েরি' এবং 'গল্প' প্রচলিত আছে। একটা গল্প এমন– মির্জা গালিবের কোন কাজ নেই। ঘরে বসে থাকার কারণে বিরক্ত এবং ক্লান্ত হয়ে তার স্ত্রী বললো– যাও না গালিব, সৃষ্টিকর্তাকে ডাকো, কাজ তো পেয়েও যেতে পারো। গালিব স্ত্রীর কথা রাখতে ঘরের বাইরে বের হলেন। মাঝরাতে ফিরছেন না দেখে তাকে খুঁজতে লোক পাঠানো হলো। গালিবকে পাওয়া গেল শঁড়িখানায়। বাসায় ফেরার পর বউ জানতে চাইলে গালিব বললেন– গিয়েছিলাম সৃষ্টিকর্তার ঘরেই। উনি মুখ তুলে চাইলেন। কাজের নিশ্চয়তা পেয়ে মনটা আনন্দে ভরে উঠল। এরপর গেলাম শুঁড়িখানায় ঘটনাটা সেলিব্রেট করার জন্য! ওরা আজ আমাকে বিনে পয়সায় খাইয়েছে!

মানুষের সৃষ্টিশীলতার অন্যতম অনুষঙ্গ নাকি মদ! (এ নিয়ে বিতর্ক আদিকাল থেকেই ছিল, আছে এবং থাকবেও! পান করবেন কী করবেন না তা আপনার একান্ত ব্যক্তিগত অভিরুচি! ইচ্ছে হলে খাবেন নাহলে ছুঁড়ে ফেলবেন) তবে এদেশে বাংলা নামে অনেক কিছুই আছে। শুধু যে ভাষা বা দেশ আছে তাই-ই নয়, এই নামে এদেশে মদও পাওয়া যায়। এদেশে জায়গার নাম আছে বাংলামোটর কিংবা বাংলাবান্ধা। বিদেশি সিগারেট ফাইভ ফিফটি ফাইভের এদেশীয় সংস্করণকে বলা হতো বাংলা ফাইভ! সাধারণ হোটেলে খাবার পরে হাত মোছার জন্য পত্রিকা কেটে যে কাগজ দেয়া হতো (হয়তো এখনও দেয়া হয়) তার নাম বাংলা টিস্যু। আছে অগণিত বাংলা স্কুল কিংবা বাংলা কলেজ। ক্রিকেটের বিজয়ী পরিশব্দ 'হোয়াইট ওয়াশ'-এর বাংলা সমন্তরাল শব্দ হচ্ছে 'বাংলা ওয়াশ'। পড়ালেখার মাধ্যম বা ভার্সন হচ্ছে ইংরেজি কিংবা বাংলা! বিদেশি মদের সহজলভ্যতার কারণে বাংলা বা কেরু কোম্পানির মদকে অনেকে আগে নাক সিটকাতেন! তবে এদেশে বঙ্গ বা বাঙালার আগে ঐতিহ্যবাহী নাম 'গৌড়' নাকি এসেছে গুড় থেকে! গুড় থেকে প্রাচীনকালে যে মদ বানানো হতো তার নাম নাকি 'গৌড়া'! বৃটিশ আমল থেকে এখনও 'কেরু কোম্পানি' আখের রস বা চিনি থেকে মদ বানায়।

পুলিশের বাগড়া, আমদানি রফতানির ক্ষেত্রে ঘাপলা কিংবা বিবিধ কারণে বিদেশি মদ দুষ্প্রাপ্য হলে আলোচনায় চলে আসে 'বাংলা'! এর একটি বিদেশি পরিশব্দ আছে যাকে বলা হচ্ছে 'কান্ট্রি জুস'! মানুষ কিংবা সভ্যতার শুরু থেকে যেমন আছে পাপ-পূণ্য, ভাল-মন্দ, আনন্দ-বেদনা, আদিমতম ব্যবসা শরীর, তেমনি আছে আনন্দের প্রাচীনতম বাহন 'মদ'! মানুষ নাকি পৃথিবীতে এসে রেডিমেড পেয়েছিল ফল! সেই ফলের গাজন থেকেই নাকি মানুষের সাথে আছে মদ। বিয়ে, যে কোন উৎসব, যুদ্ধজয়, ব্যবসায়ে মুনাফা অর্জন, রাজ্যে অভিষেক কিংবা অন্য রাজ্য দখল, উৎসবের ফোয়ারা যেন ছোটাত মদ! গোলাপকে যে নামে ডাকা হোক গন্ধ সে যেমন বিলাবেই তেমনি দারু, সুরা, চোয়ানি, ড্রিংকস, শারাব যে নামেই ডাকা হোক মদ নাকি তার মাদকতা ছড়াবেই!

মদের ফিরিস্তি দিতে কিংবা মদ্যপানের পক্ষে সাফাই গাইতে এই লেখা তৈরি হয়নি। মদ নিয়ে মানুষের সৃষ্টিশীলতার অভাব নেই! গালিবকে নিয়ে লেখাটা শুরু হয়েছিল। গালিবের একটা শের এমন– 'তুমি ভুলে যাচ্ছ তোমার অতীত। তাই পান করো। তুমি জানো না তোমার ভবিষ্যত। সুতরাং পান করো। জীবন শেষে কোথায় যাবে তুমি জানো না। তাই পান ছেড়ো না!' বাংলা সাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয় উপন্যাস 'দেবদাস'! দেবদাস সাহেব আগাগোড়া মদগ্রস্থ! ভারত উপমহাদেশে মদ্যপায়ীরা নাকি কখনও ভালবাসা পায়নি। দেবদাসের মতো তারা নাকি আজীবন উপেক্ষিতই থেকেছে, দুর্ব্যবহার পেয়েছে! করোনাভাইরাস অতিমারী কালে দেশে বিদেশে মদের দুষ্প্রাপ্যতা নিয়ে নেটাগরিকদের (নেট আসক্ত নাগরিক) কোটি কোটি মন্তব্য রয়েছে। পত্রিকা বা টেলিভিশনে চাল-ডাল-তেল স্বল্পমূল্যে কিনতে যেমন দীর্ঘলাইন দেখা যায় তেমনি এসব মাধ্যমে খবর হয়ে আসে মদ কেনার জন্য দীর্ঘলাইনেরও! আমেরিকা বা ইউরোপের কথা বাদ দিলেও ভারত, বার্মা, ভিয়েতনাম কিংবা থাইল্যান্ডে মদের জন্য এমন লাইন দেখা গেছে! নিরাপত্তা বা শৃংখলার স্বার্থে পুলিশকে ডাকতে হয়েছে।

মদের বিবরণ আছে গ্রীকপুরাণ কিংবা মহাভারতেও! গ্রীকপুরাণে মদের দেবতা হচ্ছেন দিউনোসাস। দিউনোসাসের হাসি কিংবা কান্নার সব ঘটনা থেকে কমেডি বা ট্রাজেডির জন্ম হলেও বিলক্ষণ মদ ছিল তার সাথে! দিউনোসাসের মদে উচ্ছাস বা উদ্দামতা দু-ই থাকলেও ভারত উপমহাদেশে মদ ছিল বরাবরই 'আড়ালের খাবার'! 'সোমরস' কথাটা এসেছে দেবতা সোমের কাছ থেকে। কিশোর কুমারের জনপ্রিয় গানের কথা এমন– সমুদ্রমন্থনে ওঠে অমৃতেরই ভান্ড/তাই নিয়ে দেবাসুরে তুলকালাম কাণ্ড/অমৃতের ফোটা থেকে গজালো যে ঘাস/সেখান থেকে পৃথিবীতে এলো গাঁজার চাষ! অমৃত হচ্ছে নাকি মদ আর মদের ফোঁটা থেকে এসেছে গাঁজা! গানে যাই-ই থাকুক এই উপমহাদেশের মানুষ হুইস্কি বা ব্রান্ডি খেতে শিখেছিল বৃটিশদের কাছ থেকে। তখনও সেটা 'আড়ালের খাবার'ই ছিল এবং এটা ছিল একান্তই পুরুষ নির্ভর! বলা হতো গোয়ালা বাড়ি বাড়ি যেয়ে দুধ দিয়ে আসে কিন্তু পুরুষরা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকে শুঁড়িখানায় মদ পানের জন্য। শুঁড়িখানার ইংরেজি নাম 'বার' হলেও নারী-পুরুষ একসাথে বারে যেয়ে মদ খাবার ইতিহাস এই তল্লাটে একবারেই বেশিদিনের নয়!

দেবদাস উপন্যাস জনপ্রিয় হবার পর মদ্যপায়ীদের তকমা জুটে যায় 'ব্যর্থপ্রেমিক' হিসেবে। সহজ সমীকরণ হয়ে দাঁড়ায় 'ব্যর্থতা ভুলতে মদপান'! এই সমীকরণের মধ্যে এসে দাঁড়ায় গালিবের 'শের' যেখানে বলা আছে– 'উহারা তো অন্য জাতের লোক যারা সুরা পান করে জীবনকে ভুলে যাবার জন্য! আমার তো সুরাপানের প্রয়োজন হয় জীবনকে ফিরে পাবার জন্য'!

জীবনকে ফিরে পাবার জন্য মদের দরকার হয় কিনা, সৃষ্টিশীলতায় মদ আদৌ কোন প্রভাব ফেলে কিনা, ফেনসিডিল, গাঁজা, চরস, ইয়াবা, হেরোইন বা প্যাথেড্রিন বন্ধ করে দিয়ে পরিমিত পরিমাণ মদ পান বৈধ করে দেয়া যায় কিনা, পরিমিত মদ পান মানুষের শরীর বা স্বাস্থ্য ভালো রাখে কিনা – পৃথিবীর শুরু থেকেই এইসব বিতর্কের কোন সুরাহা হয়নি। বরং এইসব বিষয়ে পরস্পরবিরোধী তথ্য বা রিপোর্ট বিতর্ক আরো উসকে দিয়েছে। মোটাদাগে বলা যায় সব ধর্ম এবং রাষ্ট্র সাধারণত প্রকাশ্যে মদ্যপানকে গুরুত্ব দেয় না। স্বাস্থ্য, পারিপার্শ্বিক পরিবেশ আর ইহকাল পরকালের কথা ভেবে মদ না খেলেও কোন ক্ষতি নেই!

তবে ক্ষতি থাকতে পারে অন্যকে ছোট করার ভেতর। নিজ প্রেমিকাকে ছোট করতে গিয়ে বলা হয়– যতবার তোমার চলে যাবার কথা ভাবি ততবার মনে হয় পোষা কুকুরটার প্রতি ভালোবাসা বাড়িয়ে দেই। মানুষ প্রতারণা করে বা বেদনা দেয়, কুকুর কখনো দেয় না! তেমনভাবে বলা হয়– প্রিয়তমা তুমি বেঈমানি করতে পারো এই মদ কখনো বেঈমানি করে না! মদ কখনো বেঈমানি না করুক, মদ খেয়ে কতজন ভালো থাকে আর কতজন লিভার পচিয়ে ফেলার পর মারা যায় তারও সঠিক কোন পরিসংখ্যান নেই! 'নো রিস্ক নো গেইন' বলে একটা কথা আছে কিন্তু মদ পান করার ঝুকি নিতে যাবার ভেতর কোন গেইন বা প্রাপ্তি আছে কিনা সেটা না ভাবলেও চলবে।

তবে ভাবতে হবে বিদেশি মদ দুষ্প্রাপ্য হলে কারা বিদেশি মদের নামে ভেজাল মদ বিক্রি করে এবং সেসব খেয়ে কেন মানুষ মারা যায়। আনন্দ বা ফুর্তি করতে গিয়ে লাশ হয়ে যাওয়া কারো কাম্য নয়। বুঝতে হবে রেক্টিফায়েড স্পিরিট ও আসল মদের পার্থক্য। মানুষ চেনার মতো এসব চিনতে পারাটাও হয়তো যোগ্যতা। ভেজাল মদ খেয়ে মরে যাওয়ার পর স্বজনদের ভোগান্তিটাও মাথায় রাখতে হবে। মাথায় রাখতে হবে সবাই জগৎ বিখ্যাত লেখক আর্নেস্ট হোমিংওয়ের মতো মদ খেতে পারে না কিংবা ক্রমাগত খাবার পর 'ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি' লিখতে পারে না। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ধন ফুরিয়ে যাওয়া কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তকে মাঝে মাঝে অর্থ সাহায্য দিতেন কারণ তিনি ব্যতিক্রমী ছিলেন। শুধু মধুসূদনের পক্ষেই 'মেঘনাদ বধ' কাব্য লেখা সম্ভব। মদের হয়তো নিজস্ব বিচার প্রথা আছে এবং এটা সম্ভবতঃ সবাইকে সৃষ্টিশীল হতে সাহায্য করে না!

মদ নিয়ে হাজারো গল্প বা সিনেমা আছে। সবশেষে যে সৃষ্টিশীলতা কাজে লাগে না তেমন একটা গল্প শুনে বিদায় নেই! পুলিশ এক রাতে শহরের বিখ্যাত এক পানশালা বা 'বার' রেইড দিলো। যারা লাইসেন্স বা পারমিট নিয়ে কথিত বাংলা খাচ্ছিল (মদের পারমিট বা লাইসেন্স থাকলেও সেটা দেখিয়ে বিদেশি মদ হয়তো খাওয়া যায় না বা বহন করা যায় না!) তারা কোনরকমে পার পেয়ে গেল। কেউ কেউ গ্রেফতার হলো। শুধু রবার্ট নামের একজন ছুটে পালাতে পারল। ঐ পানশালার সবচেয়ে বড় গ্রাহকদের একজন ছিল রবার্ট। পুলিশ রবার্টের পিছু ধাওয়া করল। রবার্ট ছুটতে ছুটতে দেখল রাস্তার ধারে উঁচু এক দেয়াল। উপায়ান্তর না দেখে সে দৌড়ের গতির ওপর লাফ দিয়ে দেয়াল ডিঙাল। পুলিশ সদস্যদের একজন সামান্য কিছু সময় পর মইয়ের সাহায্য নিয়ে দেয়ালের উপরে দাঁড়িয়ে দেখল রবার্ট কবরস্থানে ঢুকেছে এবং সে একটা কবরের পাশে দাঁড়িয়ে প্রার্থনা করছে। পুলিশ সদস্য টর্চ লাইটের আলো ফেলে জানতে চাইল– এখানে কী করো তুমি?

'বাবার কবর জেয়ারত করি' উত্তর দিল রবার্ট। পুলিশ সদস্য বলল– ভালো করে খেয়াল করো এটা একটা আট বছরের বাচ্চার কবর। মুহূর্তেই সৃষ্টিশীল হয়ে উঠল রবার্ট। পুলিশ সদস্যের প্রশ্নের উত্তর দিলো এভাবে-'স্যার আপনি ঠিকই বলেছেন। আমার বাবা খুবই অল্প বয়সে মারা গিয়েছিলেন'!

মদ আপনাকে আর্নেস্ট হোমিংওয়ে না বানিয়ে গল্পের রবার্টও বানিয়ে ফেলতে পারে! মদ নিয়ে আরো অনেক লেখার পরিকল্পনা আছে। আজ এতটুকুই থাক!

বিশেষ দ্রষ্টব্য: ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ এসে যাচ্ছে বলে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। কোন এক টেলিভিশনে ঈদের অনুষ্ঠানের রেকর্ডিং হচ্ছে। অনুষ্ঠানের অতিথিরা কৌতুক বলছে যে যার মতো। আমি বললাম বাংলাদেশের সর্বকালের অন্যতম সেরা অভিনেতা হুমায়ুন ফরীদির কাছ থেকে ধার করা একটা কৌতুক–

এক লোক গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছিল। গাড়ির এসি নষ্ট। সে ফার্মগেটের জ্যামে আটকা পড়ে আছে। বউ তাকে ডিভোর্স দিয়েছে। মেজাজ চরম খারাপ। এমন সময় ফকির এসে ভিক্ষা চাইল। ফকির বলল– স্যার দশ টাকা দেন। দোয়া করমু আপনি বেহেশতে যাইবেন। লোকটা দাতে দাত চেপে জানতে চাইল–

-সিগারেট খাস?

-(ফকির) না স্যার।

-তাহলে কী গাঁজা খাস?

-না স্যার। ভিক্ষা না চাইলে দিয়েন না। কিন্তু কী কন এসব?

-তাইলে নিশ্চয় মদ খেয়ে মেয়েদের সাথে লটরপটর করস?

-কসম আল্লাহর স্যার আমি এসব করি না।

-তাইলে গাড়িতে ওঠ।

-কেন স্যার? আপনার গাড়িতে উঠমু কেন?

-তোরে স্যাম্পল হিসেবে আমার বউয়ের কাছে উপস্থাপন করব আর বলব যারা এসব করে না তাদের জীবন তোর মতো ভয়াবহ ভিক্ষার জীবন হয়!

আমার কৌতুক বলা শেষ হলে অনুষ্ঠান প্রযোজক এসে বললো– ভাই উপরের নির্দেশে কৌতুকটা অনএয়ার করা যাবে না। কারণ কৌতুকটাতে মদ খাওয়াকে প্রমোট করা হয়েছে! দয়া করে অন্য একটা বলুন!

সন্ত্রাসকে প্রমোট করা হয় কথিত অ্যাকশান ছবিতে। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এ যুগে দেবদাস লেখার আগে কী কয়েকবার ভাবতেন?