স্বাধীনতার ৫০ বছর: রানির উঠোনে বাঙালি রানীর কিস্তিমাত

নাজমুল হক তপন
Published : 22 Feb 2021, 04:59 PM
Updated : 22 Feb 2021, 04:59 PM

দাবা নিয়ে সাংবাদিকরা লেখেন না। বছরে হাতে গোনা দু-চার দিন বাদ দিলে পত্রিকায় এক ইঞ্চি জায়গাও হয় না দেশীয় দাবার-টেলিফোনে হাসতে হাসতে কথাগুলো বললেন রানী হামিদ। পাল্টা বললাম, রানী হামিদ তো মোটামুটি নিয়মিতই সংবাদ শিরোনাম। আগের অভিজ্ঞতা থেকে জানি, যুক্তিতে দাবার রানিকে হারানো ভীষণ কঠিন। ব্যতিক্রম হলো না এবারও। অপ্রান্ত থেকে বললেন, "এখনো চ্যাম্পিয়ন হই। তাই খবরে আসে (হাসি)।"

ক্রীড়াঙ্গনে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সংবাদ শিরোনামের শুরুটা যে দাবার কল্যাণে, তা আর নতুন করে বলার কিছু নাই। ১৯৮৩ সালে ব্রিটিশ দাবায় চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মধ্য দিয়ে পথটা দেখিয়ে দেন রানী হামিদ। এর তিন বছরের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়ার গৌরব অর্জন করেন নিয়াজ মোরশেদ। দাবার কাঠামো বলতে তখনো কিছু ছিল না; এখনও নাই। স্পন্সর, মিডিয়া সবকিছু থেকেই উপেক্ষিত দাবা। কেবল বড় ব্যক্তিগত অর্জন হলেই দাবা একটু আলোচনায় আসে। এই সত্যিটাই মনে করিয়ে দিলেন রানী হামিদ, "স্পন্সর নাই। টাকা নাই। মিডিয়াতেও নাই। যার কারণে দাবায় প্লেয়ারও আসছে না সেভাবে।"

মেয়েদের সর্বশেষ জাতীয় চ্যম্পিযনশিপেও ( ২০১৯) অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন রানী হামিদ। এটা যতটা না আনন্দ দেয়, তার চেয়েও অনেক বেশি দুঃখ দেয় দাবার রানিকে, "৭৬ বছর বয়সেও আমি চ্যাম্পিয়ন হচ্ছি। দাবাতে সেভাবে নতুন মেয়েরা উঠে আসছে না।" ব্যক্তিগত উদ্যোগে মাঝে মধ্যে সাফল্য এলেও সেটা স্থায়ী হয় না, ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দিলেন সেটাও, "দাবাতে প্রাইজমানির কথা শুনলে যে কেউ হাসবে। আবার মিডিয়াতে দাবা নাই। ধরুন একটা নতুন মেয়ে যথেষ্ট প্রতিশ্রুতিশীল। একটা ছবি ছাপালেও মেয়েটা অনুপ্রাণিত হতে পারে।"

জাতীয় চ্যাম্পিয়নশীপে সব মিলিয়ে শিরোপা জিতেছেন ২০ বার। প্রথমবার চ্যাম্পিয়ন ১৯৭৯ সালে। এরপর টানা ছয়বার। ব্রিটিশ দাবায় চ্যাম্পিয়ন হওয়ার কৃতিত্ব দেখিয়েছেন তিন-তিনবার (১৯৮৩, ১৯৮৫ ও ১৯৮৯)। কমনওয়েলথ দাবায় স্বর্ণপদক জিতেছেন ২০১৫ সালে। ১৯৮৩ সালে কোন বড় পরিকল্পনার অংশ থেকে ব্রিটিশ দাবায় অংশ নেননি। এ প্রসঙ্গে জানান, "দাবা নিয়ে খুব বড় পরিসরে চিন্তা-ভাবনা করার সুযোগ ছিল না। লন্ডনের প্রতি আমার সবসময়ই আকর্ষণ আছে। কেননা, ওখানে আমাদের অনেক আত্মীয়-স্বজন আছে।" তবে ব্রিটিশ দাবায় চ্যাম্পিয়ন হওয়াটাকে বিশেষ ঘটনা হিসেবেই দেখেন রানী হামিদ, "১৯৮৩ সালে প্রথমবার ব্রিটিশ চ্যাম্পিয়নশিপে জেতাটা ভীষণভাবে উপভোগ করেছিলাম। ব্রিটিশরা দুশো বছর আমাদের শাষণ করেছে আর আমি তাদের হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছি। বিষয়টাতে মানসিকভাবে খুবই আনন্দ পেয়েছিলাম। এ আয়োজন প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হয়। সব দেশের দাবাড়ুরাই অংশ নিতে পারে। তবে পুরস্কার দেয় হয় শুধু কমনওয়েলথভুক্ত দেশের প্রতিযোগীদের। তাই একবার আমি তৃতীয় হয়েও চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম।"

ব্রিটিশ দাবায় চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর 'রানির' সমার্থক হয়ে উঠেছিলেন রানী হামিদ। ১৯৮৩ সালের নভেম্বর মাসে ঢাকা সফরে এসেছিলেন ইংল্যান্ডের রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ। রানি আসা উপলক্ষে চারিদিকে তখন সাজ সাজ রব। বর্ণিল সাজে সাজানো হচ্ছে ঢাকাকে। হাটে-ঘাটে-মাঠে সর্বত্রই রানির খবর। এমন একটা সময়ে দাবার রানির বড় বোনের বাড়ির কাজের ছেলে বলল একটা মজার কথা। শোনা যাক দাবার রানির মুখ থেকেই, "বাজার থেকে হন্তদন্ত হয়ে ফিরে এসে বড় বোনকে কাজের ছেলেটি জানাল, খালাম্মা চারিদিকে খুব হইচই । সবাই বলছে রানী খালাম্মা আইব। তার জন্যই এতসব কিছু হচ্ছে!"

রানী হামিদ দাবা খেলার কতবড় কন্ঠস্বর, সেটাও আলাদাভাবে ব্যাখ্যার দাবি রাখে। স্কুলে পড়াকালীন তার লেখা, 'মজার খেলা দাবা' বইটি হাতে পাই। ওই বইয়ে ভূমিকা'য় যে কথাগুলো লেখা আছে, তা যে কাউকেই ভাবাবে। বলে নেয়া ভাল, বইটিতে বেশ বড় কলেবরে ভূমিকা লেখা ছিল। তার অংশবিশেষ তুলে ধরছি, "বহু গবেষণার পর ঐতিহাসিকগণ একমত হন যে দাবা খেলার আদি উৎপত্তি স্থল ভারত উপমহাদেশ। আধুনিক যুগে বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিদের মধ্যে দাবা খেলতেন তলস্তয়, কার্ল মার্ক্স, লেনিন, আব্রাহাম লিংকন, রুশো, শের-ই বাংলা ফজলুল হক, কাজী নজরুল ইসলাম, বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎচন্দ্র।" এর পরের লাইন, "বাংলাদেশের দুজন জাতীয় অধ্যাপক ডক্টর কিউ এম হোসেন ও আব্দুর রাজ্জাক ছিলেন দাবার দুই দিকপাল।"

রুশ দাবার উত্থানের প্রসঙ্গ টেনে বইয়ের ভূমিকায় লেখেন, "আনাতলী কারপভ বিশ্ব দাবা চ্যাম্পিয়নশিপ লাভ করায় সোভিয়েত সরকার তাঁকে সর্ব্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান 'অর্ডার অব লেনিন' খেতাবে ভূষিত করে। সোভিয়েত সাংবাদিকগণ কারপভকে ১৯৮১ সালের 'বর্ষসেরা ক্রীড়াবিদ' নির্বাচিত করে। আশা করি, দাবা খেলাকে যারা ছেলেখেলা মনে করেন তাদের ভ্রান্তি কাটবে।" আরও লেখেন, বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনে ফুটবল সংস্থা ফিফার পরই খেলাধুলায় বৃহত্তম সংস্থা দাবা (ফিদে)।

'মজার খেলা দাবা' বইটি নতুন দাবাড়ুদের জন্য বাইবেল হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। ১৯৮২ সালে প্রথম প্রকাশিত হওয়া বইটি ২০১৮ সালে দশম সংস্করণ হয়েছে। শুধু বাংলাদেশ নয়, কলকাতায়ও এই বইটির ব্যাপক চাহিদা আছে। এছাড়াও দাবা খেলার আইন-কানুন নামে আরও একটি বই আছে দাবার রানির।

রানী হামিদ দাবা খেলা শুরুই করেছিলেন ত্রিশ বছর বয়সে এসে! প্রতিযোগিতামূলক দাবায় আসার বিষয়ে বলেন, "বলতে পারেন ভাগ্য আমার সহায় ছিল। প্রতিবেশী হিসাবে পেয়েছিলাম তখনকার চ্যাম্পিয়ন ডক্টর আকমল হোসেনকে। তার কাছ থেকে দাবাটা ভালমত শিখতে পেরেছিলাম। ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশে প্রথমবারের মত মহিলা দাবা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা সংক্রান্ত একটা বিজ্ঞাপন দেয়া হয় পত্রিকাতে। আমার স্বামী আমাকে বললেন, তোমার তো দাবা খেলায় খুব উৎসাহ। অংশ নেবে নাকি? আমি তো ভীষণ অবাক। কেননা, আমি পুরোদস্তুর হাউজওয়াইফ। বাসা থেকেই তেমন একটা বের হই না। যাই হোক, অংশ নিলাম এবং চ্যাম্পিয়নও হলাম। ওই সময়ের রেকর্ড অফিসিয়ালি স্বীকৃত নয়। কেননা তখন পর্যন্ত বাংলাদেশ ফিদে (ওয়ার্ল্ড চেস ফেডারেশন) সদস্যপদ পায়নি।" বাংলদেশ ফিদের অফিসিয়াল সদস্যপদ লাভ করে ১৯৭৯ সালে। এরপর থেকেই রেকর্ড স্বীকৃত হয়ে আসছে।

১৯৪৪ সালে জন্মগ্রহণ করা রানী জাতীয় চ্যাম্পিয়নশীপে প্রথমবার শিরোপা জেতেন ৩৫ বছর বয়সে। নিজের অভিজ্ঞতার কথা মনে করিয়ে দেন বারবার, "দাবা খেলা শুরুর কোন বয়স নাই। খেলাটি খুব সহজ আর সাশ্রয়ী। মাঠ-ময়দান প্রয়োজন হয় না। সারা জীবন খেলা যায়।" নিজের ছেলেদের প্রসঙ্গ টেনে জানালেন, "আমার ছেলে জাতীয় দলে খেলেছে। কিন্তু রিটায়ার করেছে। আর আমি এখনও খেলছি।"

কৃতি ফুটবলার কায়সার হামিদের জননী তিনি। দাবার রানির ছোট ছেলে ববি হামিদও ঢাকার ফুটবলে একটা সময়ে ছিল প্রতিষ্ঠিত নাম। অন্তত খেলার ভুবনে তার সন্তানরা অতীত হয়ে গেলেও রানী হামিদ এখনও চ্যাম্পিয়ন এবং আগামীতেও নতুন চ্যালেঞ্জ নেয়ার জন্য তৈরি রেখেছেন নিজেকে।

রানীর পরিবারের সবাই ক্রীড়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। স্বামী লে. কর্নেল এম এ হামিদ ছিলেন বাংলাদেশ হ্যান্ডবল ফেডারেশনের প্রতিষ্ঠাতা। ছেলে কায়সার হামিদ বাংলাদেশ ফুটবলের এক জ্বলজ্বলে নাম। কায়সারের অনুজ ববিও ঢাকা লিগের পরিচিত নাম। সবাই তাদের জায়গায় সেরা। মজাটা হত, ঢাকা লীগে কায়সার-ববি মুখোমুখি হলে। পরিবারেও এর উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ত। দাবার রানির ভাষায়, "একবার মোহামেডান আর ওয়ারী ম্যাচ। মানে কায়সার আর ববি প্রতিদ্বন্দী। খেলায় আমি ছোট দলের পক্ষে থাকি। ববির গোলে কায়সাররা হারল। আমি তো খুশি। কিন্তু পরে কেউ কেউ বলত, কায়সার না-কি ইচ্ছা করে হেরেছে! খেলায় আবার এমনটা হয় না-কি?"

একটা সময় ঢাকার ফুটবলে আবাহনীর 'কিলার' হিসাবে খ্যাতি ছিল ওয়ারীর। আবাহনীকে মাঝে মধ্যেই ঘোল খাওয়াত দলটি। ববির কল্যাণে ওয়ারী একবার ডুবিয়ে দিয়েছিল মোহামেডানকেও। জোড়া গোল করেছিলেন ববি। কায়সারকে বোকা বানিয়ে লক্ষ্যভেদ করেছিলেন ববি। এই গোল নিয়ে ওই সময় অনেকেই বলত, কায়সার তার ভাইকে গোল করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন।

এখন পর্যন্ত জাতীয় মহিলা দাবা অনুষ্ঠিত হয়েছে ৩৯ বার। এর অর্ধেকের বেশিবার চ্যাম্পিয়ন রানী হামিদ। জাতীয় পর্যায়ে এভাবে চ্যাম্পিয়ন হতে একঘেয়েমি লাগে না এমন প্রশ্নের জাবাবে দাবার রানির ভাষ্য, "এখন আসলে খেলার আনন্দেই খেলি। আর প্রতিযোগিতামূলক খেলায় অংশ নিলে সবাই চ্যাম্পিয়ন হতেই চাইবে, এটাই স্বাভাবিক।"

খেলার আনন্দের সঙ্গে নতুন টার্গেটও স্থির করেছেন দাবার রানি। বলেছেন, জাতীয় পর্যায়ে ২০টা শিরোপা সম্ভবত একটা রেকর্ড, তাই না? যদিও আমি কনফার্ম না। ৭৬ বছর বয়সে একজন চ্যাম্পিয়ন হয়ে গিনেস বুক রেকর্ডসে নাম লিখিয়েছে। আমি ৭৭ বছর বয়সে চ্যাম্পিয়ন হয়ে গিনেস বুক রেকর্ডেস নাম তুলতে চাই।"

স্বপ্নটাকে কি আর একটু বড় করা যেত না? মানে আরও আগের থেকে চেষ্টা করলে হয়ত গ্র্যান্ডমাস্টার হতে পারতেন। অপ্রান্ত থেকে দাবার রানির জবাব, "এটা শুধু নিজের উপর নির্ভর করে না। এর জন্য সবকিছুর সাপোর্ট লাগে। এটা একটা সমন্বিত উদ্যোগের ব্যাপার। আমার যতটুকু অর্জন তা খেলার আনন্দ থেকেই। এখন নতুনদের এগিয়ে আসতে হবে। তবে এর জন্য সমর্থন কতটুকু মিলবে তা আপনারা মানে সাংবাদিকরাই ভাল বলতে পারবেন।"

দাবার বড় মঞ্চের পথটা কিন্তু দেখিয়ে দিলেন রানী!