প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ইংরেজি ভার্সন, উন্নাসিক আচরণ ও প্রাথমিক শিক্ষায় ভাষা

গোলাম কিবরিয়া পিনুগোলাম কিবরিয়া পিনু
Published : 16 Feb 2021, 11:34 AM
Updated : 16 Feb 2021, 11:34 AM

ভাষা মাসের শুরুর আগের দিনে ভয়াবহ কথা আমাদের শুনতে হলো, খবর বেরিয়েছে (৩১ জানুয়ারি, ২০২১) – 'সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ইংরেজি ভার্সন চালু করা হবে'। খবর থেকে আরও জানা গেল, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন জানিয়েছেন, দেশের প্রতিটি জেলায় একটি করে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ইংরেজি ভার্সন চালু করা হবে। এ জন্য সংশ্লিষ্ট স্কুলে দুজন আলাদা ইংরেজি শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হবে। রাজধানীর ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে একটি অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের এসব তথ্য জানান তিনি। তিনি আরও জানান, সরকারি স্কুলে ইংরেজি ভার্সন চালু করার জন্য শিগগিরই পাইলটিং শুরু হবে। এরপর সারসংক্ষেপ প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হবে। প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন পেলেই আমরা এটা শুরু করতে চাই। প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষকদের কোয়ালিটি অনেক বেড়েছে। এটাকে কাজে লাগিয়ে আমরা শিক্ষার্থীদের ইংরেজিতে আরও দক্ষ করতে চাই। ব্রিটিশ কাউন্সিলের সহযোগিতায় ১ হাজার প্রাথমিক শিক্ষককে ৯টি পিটিআই'র (প্রাইমারি ট্রেনিং ইনস্টিটিউট) মাধ্যমে ইংরেজির বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব গোলাম মো. হাসিবুল আলম, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর মহাপরিচালক আলমগীর মুহম্মদ মনসুরুল আলমসহ ব্রিটিশ কাউন্সিল এবং বৃটিশ হাইকমিশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

ব্রিটিশ কাউন্সিল ও বৃটিশ হাইকমিশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা চাইবেন, ইংরেজির আধিপত্য ও প্রসার! আমরা তাদের প্রস্তাব, টাকা ও অন্যান্য সহযোগিতা পেলেই একচক্ষু হরিণের মতো গ্রহণ করতে থাকব? আমাদের কোনো স্বাধীন মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গি থাকবে না। ভাষা বিষয়ে হঠাৎ হঠাৎ এসব ঘোষণা ও পদক্ষেপ গ্রহণ করে – আমাদের ভাষা ও শিক্ষাকে কোথায় নিচ্ছি এবং তা নিলে আমাদের ভাষা ও শিক্ষায় কী প্রভাব ফেলবে, তা বিবেচেনা করব না? আমরা আমাদের ভাষা নিয়ে সংবিধানের বিধি, শিক্ষানীতি ও ভাষার বিকাশের দিকসমূহ বিবেচনায় নেব না?

'ইংরেজি মিডিয়াম'কে আরও প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে সরকার ও আমরা পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে ইংরেজিকে বাংলাদেশের সর্বক্ষেত্রে 'লিডিং' অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করব? সেটা এক বড় প্রশ্ন! প্রয়োজনে আমরা ইংরেজি শুধু নয় – ফরাশি, রুশ, জর্মান, জাপানি, চীনা, আরবিসহ অন্যান্য ভাষা শিখব। বিদেশি ভাষা কখন শিখব, কোন পর্যায়ে শিখব, কখন শেখা জরুরি? তা বিবেচনা করব না? আমরা কোনো ভাষাকে অবজ্ঞা করি না – কিন্তু পাশাপাশি নিজের ভাষার মর্যাদা অক্ষুণ্ন রাখব, সে বিষয়ে কোনো ছাড় দেওয়া কোনোভাবেই যুক্তিযুক্ত নয়। এমনিতে বাংলা ভাষা বিভিন্ন চাপ ও প্রতিযোগিতার মধ্যে রয়েছে!

দেশের প্রতিটি জেলায় একটি করে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ইংরেজি ভার্সন চালু করা হলে – প্রাথমিক শিক্ষাকে আরও খণ্ডিত করা হবে, ব্যবধান সৃষ্টি করে প্রাথমিক স্তরে ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে ভেদাভেদের দেওয়াল তুলে দিয়ে আলাাদা আলাদা গোত্রে পরিণত করার হীনচেতা-ভাবনা শুধু ক্ষতিকরই হবে না, তা হবে উন্নাসিক ও ক্ষতিকর আয়োজন। এখনই এই উদ্যোগ বাতিল করা প্রয়োজন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছর পূর্তি ও ভাষা আন্দোলনের প্রায় ৭০ বছর হওয়ার সময়ে – সবদিক বিবেচনা করে এখনই এমন সিদ্ধান্ত বাতিল করার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হচ্ছে – আমরা জানি। কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে বিষয়বস্তু (কনটেন্ট)। আর প্রাথমিকের শিশুদের বোঝা কমাতে বই কমিয়ে দেওয়ার চিন্তাভাবনাও করা হচ্ছে। নতুন বিবেচনায় – বই কমিয়ে দেওয়া, শিশুদের কাছে বই যেন বোঝা না হয়, পাঠে যেন তারা আনন্দ পায়, পরীক্ষার চাপও কমানো, সেসবদিকেও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এনসিটিবি বলছে, ২০২১ সাল থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে শিক্ষার্থীদের নতুন পাঠ্যক্রমের বই হাতে তুলে দেওয়া হবে। এতে করে পাঠ্য বিষয়ও কমে যাবে। ধারাবাহিক মূল্যায়নকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে পরীক্ষার নম্বর কমিয়ে দেওয়া হবে। ফলে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার বোঝাও কমবে। সেই দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীতে –  সরকারি স্কুলের ইংরেজি ভার্সন চালু করার জন্য শিগগিরই পাইলটিং শুরু করা কেন?

এনসিটিবি সূত্রে পত্রিকায় খবর এসেছে – শিক্ষাক্রমে বড় পরিবর্তনের মধ্যে রয়েছে, মাধ্যমিক স্তর থেকে বিভাগ তুলে দেওয়া হবে। নবম শ্রেণি থেকে বিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষা ও মানবিক বিভাগ – এসব বিভাজন আর থাকছে না। নবম ও দশম শ্রেণিতে সবাইকে একই শিক্ষাক্রমে একই পাঠ্যবই পড়তে হবে। এতে একজন শিক্ষার্থী মাধ্যমিক স্তরে সব বিষয়ে জ্ঞান লাভ করবে। আর সেখানে – দেশের প্রতিটি জেলায় একটি করে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ইংরেজি ভার্সন চালু করা হবে!

আমরা আমাদের প্রিয় শিশুদের শিক্ষার নামে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দিয়ে প্রাথমিক পর্যায়ে মাতৃভাষার মূল ছায়া থেকে ভিন্ন ভাষার চোরাস্রোতে ভাসিয়ে দিতে চাই না, যা নৈতিক দিক থেকে শিক্ষামূলক মনোভঙ্গির পরিপূরক নয়। সীমিত সংখ্যক উচ্চাভিলাষী পরিবার বা লোকদের স্বার্থে সমগ্র দেশের পুরো শিক্ষাব্যবস্থার ওপর অপ্রয়োজনীয় ও যুক্তিহীন চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। এদের উচ্চাকাঙ্খা মেটানোর জন্য প্রাথমিক শিক্ষাস্তরের সকল শিশুদের ওপর ইংরেজি বা আরবি চাপিয়ে দেওয়া সমর্থনযোগ্য নয়। মাধ্যমিক স্তরের আগ পর্যন্ত মাতৃভাষা ছাড়া ভিন্ন ভাষা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। ভিন্ন ভাষা অন্যস্তরে বা অন্যভাবে শেখা যেতে পারে। মাতৃভাষার শিক্ষা সাবলীল হলে অন্য ভাষা ভালো করে আয়ত্বে আনা সম্ভব। অন্য ভাষা শিখবার আগে মাতৃভাষায় প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জনের পথ প্রশস্ত করার বিকল্প নেই।

প্রাথমিক স্তরে একমাত্র মাতৃভাষার মাধ্যমেই শিক্ষা দেওয়া উচিত। এ ব্যাপারে কারো দ্বিমত থাকা উচিত নয়। প্রায় সব দেশে প্রাথমিক শিক্ষা মাতৃভাষায় বা একমাত্র ভাষার মাধ্যমে দেওয়া হয়ে থাকে। উন্নত দেশ হিসেবে পরিচিত দেশসমূহে – বিশেষত ইংল্যান্ড, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, জাপান, ফ্রান্স, জার্মানীতে প্রাথমিক স্তরে প্রথম ভাষা ছাড়া দ্বিতীয় কোনো ভাষায় শিক্ষা দেওয়া হয় না। অথচ আমাদের দেশে ভাষা বিষয়ে বিভিন্নমুখী বিভ্রান্তি ছড়িয়ে বাংলাভাষাকে সর্বক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত না করার মানসিকতা অনেক ক্ষেত্রে আমরা লক্ষ করছি। শিক্ষা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে ভাষা বিষয়ক নীতি বারবার পরিবর্তনের ফলে জনসাধারণের মধ্যেও এ বিষয়ে নানা বিভ্রান্তি ছড়িয়ে পড়ছে। এর ফলে প্রাথমিক শিক্ষা ক্ষেত্রেও বাংলাভাষাকে কোণঠাসা করার প্রক্রিয়া লক্ষ করা যাচ্ছে। এ এক বেদনা-বিহ্বল পরিস্থিতি। এ পরিস্থিতির শিকার হচ্ছে কোমলমতি শিশুরা।

শিক্ষাকে আজ ছেড়ে দেওয়া হয়েছে – লাগামহীন ঘোড়ায় পরিণত করে। আর এ ঘোড়ায় চড়ে শিশুরা কোথায় যাচ্ছে? মুনাফালোভী কায়েমী স্বার্থবাদীদের আওতায় নানামুখী ভিন্নভিন্ন শিক্ষা-পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন পরিধিতে, বিভিন্ন ভাবে। প্রাথমিক শিক্ষায় মাতৃভাষাকে গুরুত্বহীন করে কোথাও কোথাও ইংরেজি ও আরবি ভাষাকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে বেশি। নানা রকমের প্রাথমিক শিক্ষা বাণিজ্য ভেবে বাজারজাত করা হচ্ছে। 'ইংরেজি মাধ্যম', 'কিন্ডারগার্টেন', 'প্রি-ক্যাডেট মাদ্রাসা' নামের তথাকথিত প্রাথমিক শিক্ষালয় নগর-শহর-বন্দরে ব্যবসায়ী মনোবৃত্তিতে গড়ে উঠেছে। যার বেশির ভাগই প্রাথমিক শিক্ষার মূল দর্শন থেকে বহু দূরবর্তী অবস্থানে রয়েছে। এসব শিক্ষালয়ের পাঠ্যসূচির কেনো সামঞ্জস্য নেই, নেই শিশু মনস্তত্ত্বের প্রতি লক্ষ রেখে শিক্ষা। এসব তথাকথিত শিক্ষালয়ে বাংলাভাষাকে অনেকাংশে অবজ্ঞা আর অবহেলায় টেনে নিয়ে এক কোণায় রাখা হচ্ছে। শিক্ষার প্রাথমিক স্তরে বাংলা ও ইংরেজির মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে এক উদ্ভট পরিবেশ সৃষ্টি করা হচ্ছে। এর জন্য দায়ী আমাদের অবৈজ্ঞানিক এবং অযুক্তিপূর্ণ মন-মানসিকতা।

ভাষাবিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ ও শরীর-বিজ্ঞানীরা বহু পরীক্ষা করে অভিমত দিয়েছেন যে – প্রাথমিক স্তরে মাতৃভাষাই শিক্ষার একমাত্র বাহন হওয়া উচিত। জাতিসংঘের ইউনেস্কোর পক্ষ থেকে প্রাথমিক শিক্ষার ওপর অনেক গবেষণা ও সমীক্ষা করা হয়েছে। এসব গবেষণা ও সমীক্ষায় প্রাথমিক স্তরে একটি মাত্র ভাষায় শিক্ষাদানের নির্দেশনা রয়েছে। 'প্লানিং ইন দ্য প্রাইমারি স্কুল কারিকুলাম' – গ্রন্থে মাতৃভাষায় শিক্ষাদান যুক্তিযুক্ত বলা হয়েছে। ইংল্যান্ডের রিডিং বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা বিজ্ঞানের সাবেক প্রধান অধ্যাপক ড. ডি এ উইলকিনস, ভাষা সম্পর্কিত বহু গবেষণা গ্রন্থের লেখক ড. ফ্রাংক গ্রিটনার, হারভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা বিজ্ঞানের সাবেক অধ্যাপক জি বি ক্যারোল, জার্মানীর ইংরেজি ভাষার শিক্ষক পিটার ডয়ী, ভারতের ভাষা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক পট্টনায়ক প্রমুখ প্রাথমিক স্তরে মাতৃভাষা ভিন্ন দ্বিতীয় কোনো ভাষা শিক্ষার পক্ষে যুক্তি দেননি। স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয়ের মনস্তত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক স্টাফ ডরনিক, ভাষাবিদ জে পপারসন প্রমুখ বলেছেন– প্রাথমিক স্তরে দু'টি ভাষায় শিক্ষা শিশুকে নিম্নমানের শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত করে দেয়, শিশুর স্মৃতিশক্তি হ্রাস পায়, উপলব্ধির ক্ষমতা কমিয়ে দেয়, শব্দ ভাণ্ডারের ওপর দখল বাড়ায় না, শিশুর বিকাশের পথ বাধাগ্রস্ত হয়। প্রাথমিক স্তরে মাতৃভাষা ভিন্ন অন্য কোনো ভাষা শেখালে শিশুর অন্যান্য বিষয়ে শিক্ষার ক্ষমতা ও দক্ষতা হ্রাস পায়।

শরীর-বিজ্ঞানীরাও তাদের গবেষণালব্ধ অভিমত দিয়ে বলেছেন যে, প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার বাহন একমাত্র মাতৃভাষা হওয়া উচিত। তারা বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে, শিক্ষার ওপর স্নায়ুতন্ত্রের সম্পূর্ণ আধিপত্য থাকে। স্নায়ুজগৎ ছাড়া ভাষা শিক্ষা অসম্ভব। স্নায়ুতন্ত্রের এলাকাগুলো খুব প্রণালীবদ্ধ, একের সঙ্গে অন্য পরস্পর জড়িত। মানব শিশুর শিক্ষায় যদি এ প্রণালী নষ্ট হয়, তবে তাতে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। শিশু ভাষা শেখে পরিবেশ-প্রতিবেশ থেকে। শিশুর পরিবেশে থাকে স্বাভাবিকভাবে তার মাতৃভাষা। মা ও পরিবারের অন্যান্যরা শিশুদের আদর করে, কথা বলে, ঘুম পাড়ায়, এটা-ওটা চিনিয়ে দেয় মাতৃভাষায়। মানব শিশুর কান দিয়ে শোনার এলাকা ও কথা বলার এলাকা খুবই কাছাকাছি। মাতৃভাষায় পরিচিত ধ্বনিরাশি সংজ্ঞাবহতন্ত্র দিয়ে শ্রবণনিয়ন্ত্রণ এলাকা হয়ে কথা বলার এলাকায় অনায়াসে মুদ্রিত হয়। শিশু শুনে, বোঝে ও বলে ভাব প্রকাশের দক্ষতা অর্জন করে। এভাবে স্নায়ুতন্ত্রের সাথে মাতৃভাষাগত পরিবেশের সম্পর্ক রয়েছে। ভিন্ন ভাষা চাপিয়ে দিলে প্রাথমিক পর্যায়ে শিশুর শিক্ষা শুধু বাধাপ্রাপ্ত হয় না, শিশুর বুদ্ধিমত্তার বিকাশও বিলম্বিত হতে পারে।

প্রাথমিক শিক্ষা অন্যান্য দেশের মত আমাদের দেশেও মাতৃভাষায় আরো উন্নত করতে হবে। নিরক্ষরতা দূরীকরণ ও প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত লক্ষ-কোটি শিশুকে শিক্ষার আওতায় নিয়ে আসার জন্য মাতৃভাষার বিপরীতে অন্য ভাষা অবলম্বন কোনোক্রমেই যুক্তিযুক্ত নয়। এতে দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের ধারা ব্যাহত হবে। কিছু লোক আছেন, যারা ভাবেন যে, ইংরেজি ভাষার দক্ষতার অভাবেই আমাদের দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু প্রায় দুইশত বৎসর ইংরেজি শেখা-বলা-লেখার শতচেষ্টা করেও আমরা এখনো অন্যান্য দেশের তুলনায় শুধু শিক্ষার ক্ষেত্রে নয়, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও উন্নয়নের পিছনের সারিতেই রয়েছি। দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য অনেক ব্যবস্থারই উন্নয়ন প্রয়োজন। ইংরেজি শিক্ষার মান নিচু হয়ে গেছে বলে অনেকে কাতরান! কিন্তু তারা কি জানেন না যে, শুধু ইংরেজি কেন, মাতৃভাষার মান কি শিক্ষা ক্ষেত্রে বেড়েছে? অথবা শিক্ষার সামগ্রিক মান কি আমরা এখনো উন্নত পর্যায়ে কাঙ্খিতভাবে নিয়ে আসতে পেরেছি? শিক্ষাসংক্রান্ত বহু সমস্যা এখনো অনেকক্ষেত্রে আমরা দূর করতে পারিনি।

ইংরেজি ভাষায় অজ্ঞ থেকেও চীন ও জাপান আজ জ্ঞান-বিজ্ঞানসহ শিল্প-বাণিজ্যে বিশ্বে শীর্ষস্থানীয় অবস্থানে রয়েছে। সর্বাধুনিক কম্পিউটার, জৈবপ্রযুক্তি থেকে শুরু করে জ্ঞান বিজ্ঞানের এমন কোনো শাখা নেই, যেখানে চীনা ও জাপানিরা বিদেশি ভাষার ওপর নির্ভরশীল হয়ে থেকেছে। সেখানে প্রয়োজনে অনুবাদব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। জাপানি ও চীনা ভাষার ধারণশক্তি বাংলা ভাষার চেয়ে বেশি নয়। বাংলা ভাষার শক্তি অনেক উন্নত ভাষার চেয়েও বেশি। কিন্তু তা আমরা ভুলে যাই! আরও ভুলে যাই যে – বাংলা ভাষার সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের বাঙালিত্ব, জাতীয় স্বত্তা, মুক্তিযুদ্ধের দর্শনগত অবস্থান ও ভাষা আন্দোলনের অঙ্গীকার।

উন্নত দেশ চীন, জাপানের উদাহরণ শুধু না দিয়ে আরো উদাহরণ যোগ করি; যেসব দেশ আমাদের মতোই অনুন্নত ও পশ্চাৎপদ ছিল। থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, কোরিয়া, হংকং, ইন্দোনেশিয়া – কয়েক বছরে বেশ উন্নত হয়েছে – আমাদের দেশের চেয়ে অনেক এগিয়ে গেছে। এসব দেশে মাতৃভাষার মাধ্যমেই নিরক্ষরতা দূর করা হয়েছে, আধুনিক প্রযুক্তিবিদ্যাসহ অন্যান্য ব্যবস্থার উন্নতি ঘটেছে। কিন্তু তারা ইংরেজি বা ভিনদেশি ভাষার ওপর নির্ভরশীল হয়ে উন্নতি করেনি। তবে আমরা কেন ভাষা বিষয়ে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে উন্নয়নের অন্যান্য শর্ত পূরণ না করে বাংলাভাষাকে দূরে ঠেলে রেখে – ইংরেজি জানা কিছু লোকের ইচ্ছেপূরণের দাবিতে – ভিনদেশি চশমা পরে ভাবব – ইংরেজি ছাড়া আমাদের ভবিষ্যৎ ধুলোমাখা ও বিবর্ণ! ইংরেজি ভাষায় খানিকটা ব্যুৎপত্তি লাভ করা মানেই শিক্ষিত হওয়া নয়। আর সকল শিক্ষিত মানুষকে ইংরেজিতে ব্যুৎপত্তি অর্জন করতে হবে – এ ধরনের উন্নাসিক মানসিকতা সমর্থন করা যায় না। শিক্ষার সকল স্তরে ইংরেজি চাপিয়ে দিয়ে ছাত্রদের শিক্ষার মূলভিত্তিতে সম্পর্কিত না করে শুধুই বিব্রত করার কোনো যুক্তি নেই। রবীন্দ্রনাথ তার জীবন-অভিজ্ঞতা দিয়ে বলেছেন: "আমি সম্পূর্ণ বাংলা ভাষার পথ দিয়েই শিখেছিলাম ভূগোল, ইতিহাস, গণিত, কিছু পরিমাণ প্রাকৃত বিজ্ঞান, আর সেই ব্যাকরণ যার অনুশাসনে বাংলা ভাষা সংস্কৃত ভাষার আভিজাত্যের অনুকরণে সাধুভাষার কৌলিন্য ঘোষণা করত। এই শিক্ষার আদর্শ ও পরিমাণ বিদ্যা হিসেবে তখনকার ম্যাট্রিকের চেয়ে কম দরের ছিল না। আমার বারো বৎসর বয়স পর্যন্ত ইংরেজি-বর্জিত এই শিক্ষাই চলেছিল। তার পরে ইংরেজি-বিদ্যালয়ে প্রবেশের অনতিকাল পরেই আমি ইস্কুল-মাস্টারের শাসন হতে উর্দ্ধশ্বাসে পলাতক। এর ফলে শিশুকালেই বাংলা ভাষার ভাণ্ডারে আমার প্রবেশ ছিল অবারিত। সে ভাণ্ডারে উপকরণ যত সামান্যই থাক, শিশুমনের পোষণের ও তোষণের পক্ষে যথেষ্ট ছিল।"

আমাদের শিশুদের শিক্ষিত করার লক্ষ্যে শিক্ষার প্রাথমিক স্তরে একমাত্র মাতৃভাষা-বাংলার মাধ্যমেই শিক্ষার সুযোগ অবারিত করা প্রয়োজন। মাতৃভাষা বাংলার মাধ্যমেই মানবিক-নৈতিক-বৈজ্ঞানিক শিক্ষার বাধামুক্ত পথ উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর করতে হবে, সেই উজ্জ্বলতায় শিশুরা হয়ে উঠবে একেকজন আলোকিত মানুষ। আর এই আলোকিত মানুষেরা কখনো মাতৃভাষাকে অবজ্ঞা করবে না, অবজ্ঞা করবে না দেশ ও দেশের ভবিষ্যতকে।