বিশ্বমাতানো ফুটবল

সৌরভ সিকদার
Published : 11 June 2010, 02:16 PM
Updated : 11 June 2010, 02:16 PM
আমাদের শৈশব ছিল অন্যরকম, দুরন্ত শৈশব। একালের ফার্মের মুরগির মতো খাঁচাবন্দি জীবন নয়, মাটি এবং সবুজবিহীন বিদ্যালয় নয়। যে বয়সে আমরা দিগন্ত প্রসারিত মাঠে বর্ষার বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে কাদাজলে একাকার হয়ে ফুটবলের অভাবে জাম্বুরা (বাতাবী লেবু) খেলে পা ব্যথা করেছি, সেই বয়সে আমাদের সন্তানরা কম্পিউটারের মাউসে হাত রেখে হারিয়ে যায় একুশ শতকের যান্ত্রিক সংস্কৃতির অন্তর্জালে। আমাদের শৈশবের অভিধানে ক্রিকেট জাতীয় কোনো শব্দ ছিল না, ছিল ফুটবল। মফস্বল শহরে আমরা যারা বড় হয়েছি তারা তাও ব্লাডারওয়ালা ভারি ফুটবল খেলার সুযোগ পেয়েছি, গ্রামে শৈশবের জাম্বুরাই ছিল ভরসা। শুধু বড়রা যখন খেলতো বা কোনো টুর্নামেন্ট হতো তখন ব্লাডার ফুটবলই ছিল মূল আকর্ষণ। যদি কোনো গ্রামে কেউ নতুন ফুটবল কিনে আনতো তাহলে অন্য গ্রামের মানুষ সেই ফুটবল দেখতে আসতো। এই তো মাত্র ৩০-৪০ বৎসর আগের কথা।

আমাদের সে সময় মাঠের অভাব ছিল না, বলের অভাব ছিল। আর একালে ঘরে ঘরে বল আছে; মাঠ নেই কোথাও। আমাদের সেই বলগুলো এখন যাদুঘরে গেলেও পাওয়া যাবে না। খেলার সময় গোলপোস্টের পাশে পাম্পার থাকতো। বলের হাওয়া কমে গেলে পাম্পার দিয়ে ঘ্যাচাং ঘ্যাচাং করে পাম দিতে হতো। মাঝে মাঝে বল লিক হয়ে গেলে দৌড়াতাম যারা রিক্সা-সাইকেল মেরামত করেন তাদের কাছে। বলের উপরের চামড়ার সেলাই কেটে ইগলুর লাল ললির মতো ব্লাডার বের করতেন মিস্ত্রি। সেটিকে পাম দিয়ে পানিতে চুবিয়ে ফুটা বা লিক চিহ্নিত করা হতো। এরপর সেই লিকের ওপর ঝামা ইট আর শিরিষ কাগজ ঘষে রাবারের আরেকটি গোল টুকরা সলিউশন জাতীয় আঠা দিয়ে লাগিয়ে দেওয়া হত। এরপর ব্লাডার ভিতরে ঢুকিয়ে বল সেলাই করে পাম দিয়ে যথারীতি মাঠে 'গোল' 'গোল' চিৎকার। সে যে কী ঝামেলা! একালে হলে ছেলে-মেয়েরা হয়তো ফুটবলই ছেড়ে দিত।

যতদূর মনে পড়ে ফুটবলের এই অচল ব্লাডার কেটেই জীবনে প্রথম গুলতি বানিয়েছিলাম। প্রতি বছর স্কুলের প্রথম সাময়িকী পরীক্ষার পর আমপাকা গরমে আমরা অনেকেই গ্রামের বাড়ি যেতাম। যে-কদিন থাকতাম সেখানেই বৃষ্টি-রোদে ভিজে জাম্বুরা দিয়েই চলতো ফুটবল। সে এক অপার আনন্দের দিন গেছে আমাদের। আকাশে মেঘ দেখলেই স্বদেশী বিশ্বকাপ শুরুর আনন্দে আমরা আত্মহারা হতাম।

আমাদের শৈশবে বিভিন্ন বয়সের ছেলেদের মধ্যে পাড়ায় পাড়ায় স্কুলে স্কুলে ফুটবল খেলা হতো। খেলা না বলে টুর্নামেন্ট বলতাম আমরা। আট খাতা, ষোল খাতা, চব্বিশ খাতার খেলা। যে দল জিতবে তারা পাবে এই খাতাগুলো। কাপ-শিল্ডের খেলা শুরু হয়েছিল আরও পরে, আর ওগুলো বড়রা খেলতো। খাতা-কলমের প্রতিযোগিতাগুলো ছিল সে সময়ে খুবই আকর্ষণীয়; আমরা প্রায়ই এই টুর্নামেন্ট নিয়ে উৎসবে মেতে উঠতাম। শুধু মাঝে মাঝে দলবেঁধে মাঠের পাশে জড়ো হয়ে মন খারাপ করে থাকতাম যখন বল নষ্ট হয়ে থাকতো। আর একটি বল প্রাপ্তির পূর্ব পর্যন্ত এই মনখারাপ করা অলস বিকেল কাটতো আমাদের। সে ছিল বিষণ্নতায় ভরা শৈশব। সে যে কী কষ্টের, সম্ভবত বিরহের বেদনাও এর চেয়ে ভাল। কখনো চাঁদা তুলে, কখনো নিজেরা চাঁদা দিয়ে একটি বল কেনার চেষ্টা চলতো। তখন ভাল বল পাওয়া যেতো শুধু বড় শহরে; সব মফস্বল শহরে পাওয়া যেতো না। আমার শৈশব কেটেছে রাজবাড়ি জেলার কলেজ পাড়ায়। আমাদের বল কিনতে যেতে হতো কুষ্টিয়া কিংবা ফরিদপুরের নীলটুলি-ঝিলুটলিতে। একালে আমাদের সন্তানদের দিকে তাকালে ঈর্ষা এবং করুণা হয়। ঈর্ষা হয় একারণে যে ওদের সবার হাতেই বল থাকে, অন্যদিকে, আমরা পাড়ার সব ছেলেরা একটি বলের জন্য অপেক্ষা করতাম মাসের পর মাস। করুণা হয় এজন্য যে, আমাদেরই মতো শৈশব ওদের আছে, বলও আছে, শুধু মাঠ নেই। মুক্তাবাজার অর্থনীতি আর রমরমা আবাসন ব্যবসার কল্যাণে যেখানে পুকুর খাল বিল ভরাট হয়ে বহুতল ভবন ঢেকে দিচ্ছে আমাদের দৃষ্টিপথকে, সেখানে খেলার মাঠ তো সোনার হরিণ।

আমাদের ছোটবেলায় খেলা দেখা দূরের কথা টিভিই তো ছিলো না। অথচ আজ আকাশ-সংস্কৃতির কল্যাণে ঘরে ঘরে টিভির পর্দায় চোখ রেখে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা কিংবা ফ্রান্স-জার্মানির খেলা যেন আমরা জোহানেসবার্গের মাঠে বসে দেখছি। প্রিয় দলের জার্সি গায়ে, পতাকা হাতে হয়ে উঠছি যেন বিশ্বনাগরিক। প্রতি চার বছর পর পর বিশ্ব কাপ এলেই সেন্ট মার্টিন থেকে ভুরুঙ্গামারি পর্যন্ত সারদেশে ফুটবল জ্বর শুরু হয়। ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-বয়স-লিঙ্গ ভেদে আমরা সবাই প্রিয় দল নিয়ে জয়-পরাজয়ের হিসাব মিলাতে থাকি। কখনো আনন্দ, কখনো বেদনায় দ্রবীভূত হই। প্রতিদিন যেখানে সংবাদপত্র বা ইন্টারনেট খুলে প্রধান প্রধান সংবাদের সন্ধান করি সেখানে বিশ্বকাপের মাস জুড়ে শুধু ফুটবল ফুটবল আর ফুটবল। আমার মাঝে মাঝে মনে হয় পৃথিবীর মতো দেখতে এই গোল বায়ুময় বস্তুটির মধ্যে কী এমন যাদু আছে যা লাদেন থেকে টনি ব্লেয়ার পর্যন্ত সবাইকেই একই উত্তেজনা-আনন্দ দিতে পারে? শুধুমাত্র ফুটবল খেলে পেলে-ম্যারাডোনার মতো জনপ্রিয় পৃথিবীতে আর কজন আছেন?

পৃথিবীর সবচেয়ে আকর্ষণীয় এবং প্রত্যাশিত উৎসব–ফুটবলের বিশ্ব কাপ শুরু হলো। খেলা হবে দক্ষিণ আফ্রিকায়, অথচ ঢাকা নিউমার্কেটের পাশ দিয়ে যেতে যেতে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার পতাকা দেখে মনে হয় এখানেই কি শুরু হবে? নীল-হলুদ গেঞ্জি গায়ে বিশ্বকাপের আগে আনন্দে মেতে উঠেছে বিশ্ববাসী। নুন আনতে পানতা ফুরানো আমাদের এই দেশেও কি কম আনন্দ-উচ্ছ্বাস? আমরাও মেতে উঠেছি পেলে-ম্যারাডোনা-জিদানের দল নিয়ে। ফুটবল নিয়ে গণমাধ্যম আর বহুজাতিক কোম্পানির রমরমা অবস্থা আজ। বিশ্ব যেন ফুটবল ভাইরাসে আক্রান্ত এখন। ফুটবল নিয়ে আয়োজনের যেন শেষ নেই। যে দিকে তাকাই কিংবা কান পাতি একই রব, একই ধ্বনি–ফুটবল, ফুটবল, ফুটবল! এখন পাখি কিংবা মুঠোফোনের ডাকে আর ঘুম ভাঙছে না, ভাঙছে ফুটবলের ডাকে, রাত জাগা–সে-ও এই ফুটবলের কারণে।

আমাদের এই হানাহানি, রক্তপাত, ঈর্ষা আর বিভেদের গ্রহে এখন চারিদিকে ফুটবল ফুটবল। কিছু সময়ের জন্য হলেও আমাদের সবার কণ্ঠে আজ ধ্বনিত হচ্ছে গোল গোল–ফুটবল ফুটবল। জয় হোক তাহলে পা-বলের।