সেনা প্রহরায় মার্কিন গণতন্ত্র

সাঈদ ইফতেখার আহমেদসাঈদ ইফতেখার আহমেদ
Published : 31 Jan 2021, 07:07 AM
Updated : 31 Jan 2021, 07:07 AM

রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিকে কঠোর নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়েছেন জোসেফ বাইডেন জুনিয়র। এ শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান নির্বিঘ্ন করবার জন্য মোতায়েন করতে হয়েছে ২৬ হাজার সেনা সদস্য (আর্মি ন্যাশনাল গার্ড)। এছাড়া ছিল পুলিশসহ আরো ১০ হাজার অন্যান্য আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী।

ওয়াশিংটন ডিসির পাশাপাশি বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের রাজধানীতেও জারি করা হয়েছিল জরুরি অবস্থা। সেসব জায়গায় রহিত করতে হয়েছে মিছিল, সভা, সমাবেশ করবার গণতান্ত্রিক অধিকার। শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের সময় পুরো রাজধানী ছিল ফাঁকা, শুনশান নীরব। দেখে মনে হচ্ছিল কোন শত্রু দেশ বোধহয় রাজধানী আক্রমণ করতে যাচ্ছে, তাই এত সামরিক প্রস্তুতি।

এ ধরনের সামরিক প্রস্তুতির কারণ বহিঃশত্রু বা কোন সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীকে ঠেকান নয়। এর মূল কারণ বর্তমানে বিরোধী দল, সাবেক প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের রিপাবলিকান পার্টির সমর্থকরা যাতে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের দিন বিক্ষোভ প্রদর্শন না করতে পারে সেজন্য।

বিশ্বের আর কোন দেশে এভাবে সেনা নিরাপত্তার বলয়ে থেকে প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেবার নজির সাম্প্রতিক ইতিহাসে নেই। গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত তো দূরের কথা, এমনকি যারা কারচুপি করেও নির্বাচিত হয়েছেন বা অবৈধপন্থায় ক্ষমতা দখল করেছেন, তাদেরকেও এত নিরাপত্তা নিশ্চিত করে শপথ নিতে দেখা যায় না।

একটি ব্যবস্থা কতটা গণতান্ত্রিক সেটা নির্ভর করে রাজনৈতিক ব্যবস্থায় বিরোধীদলের অবস্থান কতটা শক্তিশালী তার ওপর। অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে, রিপাবলিকান পার্টির সমর্থকদেরকেই মূলধারার মিডিয়া অভিহিত করেছে জঙ্গি বা সন্ত্রাসী হিসাবে—যা কিনা এতদিন পর্যন্ত করা হয়েছে অস্ত্র নির্ভর বিভিন্ন "ইসলামপন্থী" গোষ্ঠীর সদস্যদের।

রাষ্ট্র কতটা গণতান্ত্রিক তা মাপার নানা প্যারামিটার পশ্চিমা রাষ্ট্র চিন্তাবিদরা উদ্ভাবন করেছেন। সে প্যারামিটার অনুযায়ী একটি নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে কিনা সেটা নির্ভর করে প্রধান বিরোধী দল নির্বাচনকে সুষ্ঠু বলে গ্রহণ করে নিয়েছে কিনা তার উপর।

পাশ্চাত্য যেটাকে তৃতীয় বিশ্ব বলে, সেই তৃতীয় দুনিয়ার অনেক দেশেই পরাজিত পক্ষ নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ এনে নির্বাচনের ফল গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়। তাদের এ অস্বীকৃতি জানাবার ফলেই পাশ্চাত্য এ সমস্ত রাষ্ট্রে গণতন্ত্রহীনতার অভিযোগ আনে। এ অভিযোগ অবশ্য নির্মোহ ভাবে আনা হয় না। পাশ্চাত্যের সাথে এ রাষ্ট্রগুলির সম্পর্কের নিরিখে অভিযোগের তীব্রতার পারদ ওঠানামা করে।

যে সমস্ত রাষ্ট্রে প্রধান বিরোধী দল নির্বাচনের ফল মেনে নেয় না সে সমস্ত রাষ্ট্রে ক্ষমতাসীন দলগুলিকে ক্ষমতায় টিকে থাকবার জন্য সেনাবাহিনী এবং পুলিশের ওপর নির্ভর করতে হয়। সাথে থাকে বেসামরিক আমলাতন্ত্রের সমর্থন।

ক্ষমতাসীন দলের সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের ওপর নির্ভরশীল হবার ফলে সে সমস্ত দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার "গভীর রাষ্ট্রে" রূপান্তর ঘটে। ফলে ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ রাজনৈতিক দলের হাতে না থেকে সেনা নির্ভর আমলাতন্ত্রের হাতে চলে যায়।

এবারে শুরু থেকেই ট্রাম্প বলে আসছিলেন নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি হবে। কারচুপি করে তাকে নির্বাচনে হারান হবে। নির্বাচনের ফল প্রকাশিত হবার পর তিনি এবং তার দলের অনেকেই কারচুপির অভিযোগ এনে ফল মেনে নিতে অস্বীকার করেন। তিনি তার আনা অভিযোগে অনড় থেকে প্রথা ভেঙ্গে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে যোগদান থেকেও বিরত থাকেন।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ এবারেই প্রথম নয়। সাম্প্রতিক সময়ের নির্বাচনগুলিতে প্রায়ই অনিয়মের অভিযোগ আনা হচ্ছে। কেন্দ্রীয় কোন নির্বাচন কমিশনের অধীনে এখানে নির্বাচন হয় না। নির্বাচনে ডাক যোগে যেমন ভোট দেয়ার ব্যবস্থা রয়েছে, তেমনি রয়েছে আগাম ভোট দেয়ার ব্যবস্থা। আগাম ভোট দিনের পর দিন বেশ লম্বা সময় ধরে চলে। এ ধরনের বহুমুখী ব্যবস্থার নির্বাচনে কারচুপির নানা সুযোগ রয়েছে।

এবারের নির্বাচনে একেবারে কোন কারচুপি হয়নি এটা বলা যাবে না। তবে কারচুপি সে মাত্রায় হয়নি যে ভোটের ফল পুরো উল্টে ট্রাম্প জিতে আসতেন। করোনাভাইরাস মোকাবেলায় রিপাবলিকান প্রশাসনের ভয়াবহ ব্যর্থতা এবং এর উপজাত হিসাবে গভীর অর্থনৈতিক সঙ্কট– ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা আগের চেয়ে হ্রাস করেছে।

নির্বাচনে পরাজিত হবার পর ট্রাম্প কোন অবস্থাতেই যাতে বাইডেনকে বিজয়ী ঘোষণা করা না হয়, তার জন্য আইনী/বেআইনী সর্বোচ্চ চেষ্টা চালান। সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ হবার পরে নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে গায়ের জোরে ফল প্রকাশ স্থগিত করবার উদ্যোগ নেন।

ইলেকটোরাল কলেজ ভোটের ফল যেদিন আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করবে সেদিন, অর্থাৎ ৬ জানুয়ারি রাজধানীতে বিক্ষোভ করবার জন্য ট্রাম্প তার সমর্থকদের আহবান জানান। এ আহবানে সাড়া দিয়ে সারা দেশ থেকে তার সমর্থকরা বিপুল সংখ্যায় রাজধানীতে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন। বিক্ষোভে কিছু সাবেক ও বর্তমান সেনা এবং পুলিশ সদস্যও যোগ দেন। ট্রাম্প তাদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবার পর তারা ক্যাপিটাল হিলের (মার্কিন সংসদ) দখল নেয়, যাতে ভোটের ফল প্রকাশ করা না যায়।

মার্কিন রাজনীতিতে নিঃসন্দেহে এটি ছিল দক্ষিণপন্থী, নব্য-ফ্যাসিবাদী গোষ্ঠীর একটি ব্যর্থ প্রতিবিপ্লব। এ গোষ্ঠীটি চেষ্টা করেছিল সংবিধানকে পাশ কাটিয়ে প্রতিবিপ্লব ঘটিয়ে তাদের ক্ষমতা অব্যাহত রাখবার। তারা যখন ক্যাপিটাল হিলের দখল নিতে যান তখন সেখানে দায়িত্বরত পুলিশদের তেমন একটা বাধা দিতে দেখা যায় নাই। অথচ সেই একই পুলিশকে বামপন্থীরা বা Black Lives Matter কর্মীরা মিছিল বের করলে কঠোর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দেখা যায়। এ ঘটনার সাথে যুক্ত হাতে গোনা কিছু ব্যক্তি ছাড়া প্রায় কাউকে গ্রেফতারও করা হয়নি।

গত চার বছরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দক্ষিণপন্থার রাজনীতির বিশাল উত্থান ঘটেছে। এরা চাচ্ছে খ্রিস্ট ধর্মনির্ভর, শ্বেতাঙ্গ প্রাধান্য ভিত্তিক আমেরিকার পুনরুত্থান ঘটাতে—যাকে তারা বলছেন Make America great again। অর্থাৎ তারা আমেরিকাকে পেছনের দিকে নিয়ে যেতে চাচ্ছেন। ট্রাম্প পরিণত হয়েছেন এ দক্ষিণপন্থার রাজনীতির প্রতীকে। এ রাজনীতিকে অভিহিত করা হচ্ছে ট্রাম্পবাদ হিসাবে।

মার্কিন রাজনীতিতে খ্রিস্ট ধর্মের ব্যাপক প্রাধান্য সব জায়গায় রয়েছে। খ্রিস্ট ধর্মের এ প্রাধান্যের কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে আদৌ সেক্যুলার রাষ্ট্র বলা যায় কিনা সেটা নিয়েই বিতর্ক রয়েছে—যদিও এসব সত্ত্বেও আমেরিকা বিশ্বে নিজেকে সেক্যুলার রাষ্ট্র হিসাবে তুলে ধরতেই স্বাছন্দ্য বোধ করে। দক্ষিণপন্থীরা চাচ্ছেন এ স্ববিরোধিতা থেকে বেরিয়ে এসে পুরো ধর্মভিত্তিক শ্বেতাঙ্গ প্রাধান্যের আমেরিকাতে রূপান্তর।

গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ওপর আমেরিকা গড়ে তোলা হলেও সেক্যুলার মূল্যবোধ এখানে তেমন ভাবে গড়ে উঠেনি। ফলে তুলনার বিচারে এরদোগানের তুরস্ক বা মোদি নেতৃত্বের ভারত আমেরিকা থেকে অধিক সেক্যুলার রাষ্ট্র।

আমেরিকাতে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির শিকড় গভীরে প্রোথিত হবার পিছনে ডেমোক্র্যাটিক এবং রিপাবলিকান দুই দলেরই ভূমিকা রয়েছে। দুটি দলই সেক্যুলার সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নকে ঠেকাবার নীতি হিসাবে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ধর্মের ব্যাপক ব্যবহার করেছে। ফলে খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই আজ ধর্মভিত্তিক দক্ষিণপন্থার রাজনীতির শিকড় গভীরে প্রোথিত হয়েছে।

রাজনৈতিক দলের বাইরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন রাজনৈতিক গোষ্ঠীর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচন এবং আন্দোলন সংগঠনে এরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গত কয়েক বছরে রাজনীতিতে খ্রিস্ট ধর্ম নির্ভর দক্ষিণপন্থী নব্য-ফ্যাসিবাদী গোষ্ঠীর ভূমিকা বৃদ্ধি পেয়েছে। এ গোষ্ঠীগুলির কিছু আবার সশস্ত্র মিলিশিয়া গ্রুপ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র খুব সম্ভবত বিশ্বের একমাত্র রাষ্ট্র, যেখানে নাগরিকদের অস্ত্র বহন এবং সশস্ত্র মিলিশিয়া গোষ্ঠী গঠনের সাংবিধানিক অধিকার রয়েছে।

দক্ষিণপন্থী গোষ্ঠীর কতগুলো আবার এতটাই রক্ষণশীল যে, নারীদের সে সমস্ত গোষ্ঠীর সদস্যপদ দেওয়া হয় না। Proud Boys হচ্ছে তেমনই একটি সংগঠন। তবে সাম্প্রতিক রাজনীতিতে সবচেয়ে প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে QAnon। সেনাবাহিনী, পুলিশসহ রিপাবলিকান দলের অনেকেই QAnon এর সদস্য বা সমর্থক। এমনকি এদের ব্যাজ পরেই অনেক পুলিশ এবং সেনা সদস্যকে তাদের সরকারি কর্তব্য পালন করতে দেখে গেছে। ক্যাপিটাল হিল দখলের পর এ গোষ্ঠীর সদস্যরা– যাদেরকে অনেকে কাল্ট হিসাবে অভিহিত করেন–ভবনের উপরে তাদের পতাকা উড়িয়ে দেয়।

QAnon ধর্ম ভিত্তিক কাল্পনিক ষড়যন্ত্র তত্ত্বে বিশ্বাসী। তাদের অদ্ভুত কাল্পনিক বিশ্বাস হল শয়তানের উপাসকদের গোপন নেটওয়ার্ক রয়েছে যারা বিশ্বে শিশু পাচারের সাথে যুক্ত। এরা মানুষের মাংস খায় এবং শিশুদের সাথে যৌন সম্পর্ক করে। এ শয়তানের উপাসকরাই ষড়যন্ত্র করে ট্রাম্পকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে কেননা তিনি তাদের গোপন নেটওয়ার্ক ভেঙ্গে দেয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন। এ ষড়যন্ত্র তারা দীর্ঘদিন ট্রাম্পের বিরুদ্ধে চালিয়ে আসছিল। QAnonসহ অন্য আরো অনেক ধর্মনির্ভর নব্য-ফ্যাসিবাদী গোষ্ঠীর সদস্যরা ডেমোক্র্যাটিক দলের নেতাকর্মীদের শয়তানের উপাসক এবং এ নেটওয়ার্কের সদস্য মনে করেন।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এখন বাস্তবতা বিবর্জিত, ধর্মনির্ভর অদ্ভুত কাল্পনিক ষড়যন্ত্র তত্ত্বের ডালপালা বিস্তার লাভ করছে। ট্রাম্প নিজে এ ধরনের তত্ত্ব বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি রাজনীতিতে দুটো প্রত্যয় নিয়ে এসেছেন। এর একটি হল "বিকল্প সত্য," এবং আরেকটি হল "বিকল্প বাস্তবতা"।

এখন সমস্যা হল রিপাবলিকান দলের অনেকেসহ দক্ষিণপন্থী গোষ্ঠীর সদস্যরা বাস্তবতা থেকে বের হয়ে "বিকল্প বাস্তব" জগতে বাস করতে শুরু করেছেন। ফলে তারা বিশ্বাস করেন ট্রাম্প আসলে নির্বাচনে পরাজিত হন নাই। তাকে ষড়যন্ত্র করে শয়তানের উপাসকরা পরাজিত দেখাচ্ছেন। এখন তাদের দায়িত্ব হল এ শয়তানের উপাসকদের কাছ থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং বিশ্বকে রক্ষা করা।

দক্ষিণপন্থার রাজনীতির উত্থানের ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সমস্যা তৈরি হয়েছে অন্য জায়গায়। বড় বড় কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে মূলধারার প্রায় সব প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক এবং সোশ্যাল মিডিয়ার কর্ণধাররা এককাট্টা হয়েছেন ট্রাম্পকে ক্ষমতা থেকে হটাতে।

দক্ষিণপন্থার উত্থানে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলির সমস্যা হবার কথা নয়। কিন্তু তারা এ দক্ষিণপন্থার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন ট্রাম্প মুক্তবাজার অর্থনীতির বিরুদ্ধে যেয়ে সংরক্ষণবাদী অর্থনীতির পক্ষে অবস্থান নেবার কারণে। বড় কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলির বিশ্বব্যাপী বাণিজ্যিক নেটওয়ার্ক রয়েছে। ফলে ট্রাম্পের নেতৃত্বাধীন দক্ষিণপন্থা তাদের বাণিজ্যিক স্বার্থের প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। তাই তারা মরিয়া হয়ে উঠেছিল যেকোন মূল্যে ট্রাম্পকে হঠাবার জন্য।

এদের সাথে যোগ দিয়েছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কর্ণধাররা। তারা ট্রাম্পসহ তার বহু সমর্থকের একাউন্ট বন্ধ করে দেয়া থেকে শুরু করে তাদের বিভিন্ন পোস্ট মুছে দেয়। রাজনৈতিক বিতর্কে যেখানে এ প্ল্যটফরমগুলির কর্ণধারদের নিরপেক্ষ ভূমিকায় থাকার কথা, সেখানে তারা প্রকাশ্যে একটি রাজনৈতিক পক্ষ নিয়ে নেন। শুধু অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেই নয়, আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রেও তাদের অপছন্দের বক্তব্যগুলিকে তারা এর অনেক আগে থেকেই সেন্সর করা শুরু করে।

মত প্রকাশের স্বাধীনতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্যের অনেক দেশের সংবিধানই নিশ্চিত করেছে। কিন্তু এসব দেশে মত প্রকাশের প্রায় সমস্ত ক্ষেত্র (প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক মিডিয়া এবং সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম) কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলির নিয়ন্ত্রণে। ফলে কোন মত বা কার মত প্রকাশিত হবে তার প্রায় পুরো নিয়ন্ত্রণ এখন চলে গেছে এ সমস্ত প্রতিষ্ঠানের হাতে।

মত প্রকাশের সাংবিধানিক স্বাধীনতা থাকলেও বাস্তবে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলি সে সমস্ত মত প্রকাশিত হতে দিচ্ছে যেগুলি তাদের চিন্তাধারা বা স্বার্থের সাথে মেলে। উদারনৈতিক গণতন্ত্রের দাবিদার রাষ্ট্রগুলিতে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান অত্যন্ত শক্তিশালী হবার ফলে সেখানে এমন কোন মেকানিজম সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হয়নি, যা মিডিয়া প্ল্যটফরমগুলিতে মত প্রকাশের অবাধ স্বাধীনতা নিশ্চিত করবে। এতে বাস্তবে সে সমস্ত রাষ্ট্রে মত প্রকাশের ক্ষেত্র ক্রমশঃ সংকুচিত হচ্ছে, যা অনেক উদারনৈতিক চিন্তাবিদকে ভাবিত করে তুলছে।

কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলির পাশাপাশি মার্কিন স্টাবলিশমেন্টও চাচ্ছিল যেকোন মূল্যে ট্রাম্পকে ক্ষমতা থেকে বিদায় করতে। আপাতঃ অবাক হবার বিষয় হলেও এদের সাথে এক কাতারে মিলেছিল মার্কিন কমিউনিস্ট পার্টিসহ সমস্ত ঘরানার বামপন্থীরা।

বার্নি স্যান্ডার্সসহ আরো অনেকের ভূমিকার ফলে মার্কিন রাজনীতিতে দক্ষিণপন্থার বিপরীতে বামপন্থার একটি শক্তিশালী ভিত্তি তৈরি হয়েছে, যেটা মার্কিন রাজনীতির সম্পূর্ণ নতুন একটি উপাদান। ফলে ভোটের রাজনীতিতে সম্মিলিত বামপন্থীদের ভোট এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর।

ট্রাম্পের আন্তর্জাতিক রাজনীতির কিছু বিষয় নিয়ে বামদের দ্বিমত না থাকলেও তারা ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে তাকে ঘিরে ধর্মভিত্তিক, নব্য-ফ্যাসিবাদী রাজনীতির যে ব্যাপক উত্থান হয়েছে, তার বিরুদ্ধে সংগ্রামের অংশ হিসাবে। অর্থাৎ মার্কিন অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে কর্পোরেট আমেরিকা এবং বামপন্থীদের স্বার্থ ও ঐক্য একই জায়গায় মিলে গেছে। যদিও কিছু বামপন্থী একই সাথে বাইডেনের নীতিকে বলছে "উদারনৈতিক সাম্রাজ্যবাদ," অর্থাৎ উদারনৈতিক রেটোরিকের ক্যামোফ্লাজে সাম্রাজ্যবাদী নীতি বজায় রাখা।

আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাইডেন "সাম্রাজ্যবাদী নীতি" কতটুকু অনুসরণ করতে পারবেন সেটা নির্ভর করছে অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি মোকাবেলা করে অর্থনীতির তিনি কতটা পুনুরুদ্ধার করতে পারবেন তার ওপর। অনেক বিষয়ে বিশ্ব রাজনীতিতে ট্রাম্পের চেয়ে বাইডেনের ভিন্ন নীতি থাকলেও চীন, ইসরায়েল, সৌদি আরবের ক্ষেত্রে তিনি যে অনেকটাই ট্রাম্প প্রশাসনের নীতি অনুসরণ করবেন সেটা বলাই বাহুল্য। তবে রাশিয়ার ক্ষেত্রে তার পররাষ্ট্রনীতি ট্রাম্প প্রশাসন থেকে কঠোর হবে।

পররাষ্ট্রনীতিতে আর একটা বড় পার্থক্য বাইডেনের সময়ে আসতে পারে। সেটা হল, সুন্নী "ইসলামপন্থার" রাজনীতিকে দাবার ঘুঁটি হিসাবে ব্যাবহারের দীর্ঘ মার্কিন ঐতিহ্যকে তিনি আবার ফিরিয়ে আনতে পারেন, যার থেকে ট্রাম্প প্রশাসন বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেছিল।

সুন্নী "ইসলামপন্থার" রাজনীতি যারা করেন পাশ্চাত্যের সাথে তাদের নানাবিধ সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। তারা নিজেদেরকে বারংবার তাদের দাবার ঘুঁটি হিসাবে ব্যাবহার করতে দিয়েছেন। এ দ্বিচারী নীতির ফলে সুন্নী মুসলমানদের কাছে এ রাজনীতি সেভাবে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি, যেভাবে শিয়া "ইসলামপন্থার" রাজনীতি শিয়াদের মাঝে পেয়েছে ।

পার্থক্য যে শুধু আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তা নয়, অভ্যন্তরীণ রাজনীতির নানা বিষয়েও রিপাবলিকান এবং ডেমোক্র্যাটিক দলের বিভাজন গত কয়েক বছরে বিশেষতঃ ট্রাম্পের আমলে তীব্র হয়েছে। এ বিভাজনের প্রক্রিয়া অবশ্য ট্রাম্পে আমলের আগে থেকেই শুরু হয়েছিল।

রাষ্ট্র চিন্তাবিদদের মতে প্রধান বিরোধী দলগুলির মাঝে গুরুত্বপূর্ণ জাতীয়/আন্তর্জাতিক বিষয়গুলিতে মৌলিক ঐক্যমত গতিশীল গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার জন্য জরুরি। এ ঐক্যমত যখন থাকে না তখনই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সঙ্কটে নিপতিত হয়। বাংলাদেশসহ তৃতীয় দুনিয়ার অনেক দেশের মূল সংকটটা এখানেই।

আজ মার্কিন রাজনীতিও অনেকটা সে ধরনের সঙ্কটে নিপতিত। আর এ সঙ্কটের মাঝেই ৯ ফেব্রুয়ারি সিনেটের অধিবেশন বসতে যাচ্ছে ট্রাম্পকে দ্বিতীয়বারের মত ইমপিচ করবার জন্য যাতে তিনি আবার প্রেসিডেন্ট পদে দাঁড়াতে না পারেন এবং তাকে বিচারের আওতায় আনা যায়। এ ইমপিচমেন্ট প্রক্রিয়াটিও হতে যাচ্ছে সেনা প্রহরায়। যে ২৬ হাজার সেনা সদস্যকে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের দিন রাজধানীতে ডাকা হয়েছিল তাদের থেকে ৭ হাজার জনকে মার্চ মাস পর্যন্ত রেখে দেওয়া হচ্ছে ক্যাপিটাল হিল পাহারা দেবার জন্য। সাথে থাকছে পুলিশসহ অন্যান্য আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী।

ইমপিচমেন্ট প্রক্রিয়া মার্কিন বিভাজিত রাজনীতির বিভাজনের মাত্রা আরো বাড়াবে বলেই অনেকের ধারণা। এ বিভাজনের মাত্রা বাড়ার সাথে সাথে বাইডেন সরকার যদি করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলা এবং অর্থনীতি পুনুরুদ্ধার করতে ব্যর্থ হন, তাহলে ধর্মভিত্তিক নব্য-ফ্যাসিবাদী ধারার রাজনীতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আরো শক্তিশালী হবে।

ডেমোক্র্যাটিক সমর্থকদের মতে তাদের দলের নির্বাচনী বিজয় গণতন্ত্রকে রক্ষা করেছে। তবে ফ্যাসিবাদী রাজনীতি যত জোরালো হবে, ডেমোক্র্যাটিক দলকে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য—যেটাকে তারা গণতন্ত্র রক্ষা বলছে—সেই গণতন্ত্র রক্ষার জন্য সেনা প্রহরা তত বাড়াতে হবে।