জন্মবার্ষিকী: মাইকেলের ফ্রান্সের বাড়িতে

পার্থ প্রতিম মজুমদার
Published : 25 Jan 2021, 12:43 PM
Updated : 25 Jan 2021, 12:43 PM

বিভিন্ন চিঠিতে দেখা যায় তিনি ফরাসি দেশ ও এদেশের মানুষকে অসম্ভব পছন্দ করতেন ও ভালোবাসতেন। ভালোবাসতেন এদেশের শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি ও ফরাসিদেশের মানবতা বোধ। তিন সন্তান স্ত্রী হেনরিয়েটাকে নিয়ে যখন এখানে তীব্র দারিদ্রতার মধ্যে বাস করেছেন, দেনার দায়ে জেলে যাবার উপক্রম ফরাসি মানুষের ও প্রতিবেশিদের বদান্যতায় উনাকে ও স্ত্রী সন্তানকে বার বার রক্ষা করেছেন। উনি ছিলেন তাদের কাছে কৃতজ্ঞ। বিভিন্ন চিঠিতে তাই উল্লেখ করেছেন- "এই গ্রহের শ্রেষ্ঠ জায়গা এই ফ্রান্স ও এদেশের মানুষ, আমি শিক্ষায়-সংস্কৃতিতে এতো উচ্চমানের দেশ ও মানবদরদী মানুষ কোথাও দেখিনি।" 

আমার সৌভাগ্য হয়েছিল ১৯৮২ সালে উনার বাসকরা ফ্ল্যাটে প্রবেশ করার। এতো ছোট দুটি ঘরের ফ্ল্যাটে তিন সন্তান স্ত্রীসহ কী করে বাস করতেন ভাবলেও অবাক লাগে। আলাদাভাবে বাথরুম ও রান্না ঘরও চোখে পড়েনি। তার মতো মেজাজি ও ধনী মানুষ, যিনি শুনেছি ঘোড়ার গাড়িতে চেপে কোথাও গেলে গুনে পয়সা দিতেন না, কী করে যে এ বাড়িতে বছর তিনেক বাস করেছেন বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। 

এ দারিদ্রতা কিন্তু তার প্রতিভাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। ফ্রান্সে ও এর আগে গ্রেজ ইনে ইংল্যান্ডে আসার আগেই উনি বাংলা সাহিত্যে নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে এসেছেন। বাংলা সাহিত্যে তিনি উচ্চমানের কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। ১৮৬১ সনে সংস্কৃত রসায়ন থেকে লোকগাঁথা 'মেঘনাদ বধ কাব্য' রচনা করে আলোড়ন তোলেন। এক চিঠিতে গর্ব করে লেখেন- "এমন কবিতার জন্ম দিয়েছি যে যার চরিত্রগুলো দৃঢ় ন্যায়নীতি নিয়ে দাঁড়িয়েছে, বাঙালি সমালোচক কেন, যদি ফরাসি সাহিত্য সমালোচক এর চোখে পড়লেও এর কোন ভুল সে ধরতে পারবে না।" 

যে তিন তলার বাড়ির প্রথম তলায় বাঁ দিকের ফ্ল্যাটে তিনি বাস করতেন তার ঠিকানা ছিল- 12 rue des chantiers-78000 Versailles. বাড়িটি আড়াইশ থেকে তিনশ বছরের পুরোনো এখন ২০২১ সালের হিসেবে। ভার্সাই শহরের নতুন করে পরিকাঠামো পরিবর্তন ও রাস্তার নতুন নামকরণ করার ফলে বর্তমানে রাস্তাটি নাম হয়েছে- 12 rue des Etats Generaux -78000 Versailles. 

ভার্সাইতে অনাহার এবং অর্ধাহারের মধ্যেও নতুন ভাষা শিক্ষার প্রথম সাহিত্য চর্চার উৎসাহ কখনই তিনি হারাননি। ভার্সাই থাকার সময়ে তার জীবনের একটি মুখ্য রচনা 'চতুর্দ্দশপদী কবিতাবলী' রচনা করেন। তিনি এখানে বেশ কিছু সনেট ও রচনা করেন যা ইতালিয়ান সনেট থেকে অনুপ্রাণিত এবং নীতিগত কিছু কবিতাও রচনা করেন যা ফরাসি সাহিত্য ও কবিতা থেকে অনুপ্রেরণা পাওয়া। ফরাসি বিখ্যাত কবি লা ফঁতেন এর 'দ্য ফেবলস অব লা ফঁতেন' কবিতার আদর্শে এগুলি সে সময় ভার্সাইতে রচনা। ভার্সাইতে বসবাসকালে ইটালিয়ান বিখ্যাত কবি দন্তের ষষ্ঠ জন্ম শতবার্ষিকী উপলক্ষে একটি সনেট রচনা করে ইটালীয় ও ফরাসি নিজকৃত অনুবাদসহ ইটালির রাজা ভিক্টর ইমানুয়েলের কাছে পাঠিয়ে দেন। আন্তর্জাতিক সংস্কৃতির ঐক্যের দিক থেকে উনবিংশ শতাব্দীতে কবির এই প্রচেষ্টা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। 

এ ষষ্ঠজন্মা মহাকবির জন্ম হয়েছিল আমাদেরই এ বাংলাদেশের যশোর জেলার সাগরদাঁড়ি গ্রামে ২৫ শে জানুয়ারি ১৮২৪ সালে। এবছর তার ১৯৭ জন্মদিন।  

"এই গ্রহের শ্রেষ্ঠ স্থান হচ্ছে ফ্রান্স ও এর মানুষ। আমি শিক্ষায়-সংস্কৃতিতে এতো উচ্চমানের দেশ ও মানবদরদী মানুষ কোথাও দেখিনি।" 

মাইকেল মধুসূদন দত্ত

ভার্সাই এর জাতীয় আর্কাইডের নথিপত্রে দেখা যায়, ৩ জুলাই ১৯৬৭ ভার্সাই শহরের টাউন হলে ডেপুটি মেয়র মঁসিও অঁন্ত্রে কাদোরেত মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের (১৮২৪-১৮৭৩) স্মরণে একটি ব্রোঞ্জের প্লাগ স্মারক উম্মোচন করেন। যিনি এ শহরে বাস করে গেছেন ১৮৬৩-১৮৬৬ সনে। যে বাড়িতে উনি বাস করেছেন সেই বাড়ির দেওয়ালে পরবর্তীতে এটি স্থাপন করা হয়। এই স্মারক প্লাগ দিল্লী ইউনির্ভাসিটির ভাইস চ্যান্সেলর এর তরফে পণ্ডিত রবীন্দ্র কুমার দাশগুপ্ত ভার্সাই এর মেয়রকে হস্তান্তর করে। এ বিশেষ অনুষ্ঠান উপলক্ষে ভারতবর্ষের তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট ভি ভি গিরিসহ প্রতিটি মন্ত্রণালয় বাণী পাঠায়। 

অনুষ্ঠানে ভারতীয় দূতাবাসের সি ই পুষ্প দাস (প্রথম সেক্রেটারি ইনফরমেশন), দিল্লীর সাহিত্য একাডেমীর তরফে পণ্ডিত রবীন্দ্র কুমার দাশগুপ্ত, শ্রী লোকনাথ ভট্টাচার্য্যসহ প্যারিস ইউনির্ভাসিটির তৎকালীন বাংলা বিভাগের প্রফেসর কিলিবার্ট উপস্থিত ছিলেন। প্রথম এ স্মারক প্লাগ লাগানোর আবেদন করা হয় ২৫ নভেম্বর ১৯৫৭ সালে; অথচ অনুষ্ঠানে পৌঁছাতে লেগে যায় প্রায় দশ বছর। 

ভার্সাই শহরের ডেপুটি মেয়র মঁসিও অঁন্ত্রে কাদোরেত তার ভাষণে বলেন- "আমরা ভার্সাইাবাসী গর্বিত যে মাইকেল মধুসূদন এর মতো এক মহাকবি একদিন এ শহরের নাগরিক ছিল। যিনি ভারতীয় সংস্কৃতির সাথে ফ্রান্স তথা ইউরোপীয় সংস্কৃতিকে এক মেলবন্ধনে আবদ্ধ করে গেছেন। যিনি ফরাসীদেশকে মনে করতেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ স্থান হিসেবে।