রামু যা শিখিয়েছে

ড. আনিসুজ্জামান
Published : 29 Oct 2012, 11:21 AM
Updated : 29 Oct 2012, 11:21 AM

আজ শুভ প্রবারণা পূর্ণিমা। বৌদ্ধসম্প্রদায়ের বড় একটি উৎসব। চট্টগ্রামের বৌদ্ধসম্প্রদায় একটি অনিশ্চিত পরিবেশে উৎসবটি উদযাপন করছেন। ঠিক এক মাস আগে ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১২-তে কক্সবাজারের রামু-উখিয়া-টেকনাফসহ চট্টগ্রামের কিছু এলাকায় বৌদ্ধদের বাড়িঘর ও ধর্মীয় স্থাপনার ওপর বর্বরোচিত হামলা হয়েছে। এ হামলার ক্ষত ওদের মন থেকে এত দ্রুত শুকিযে যাওয়ার প্রশ্ন্ই উঠে না। পাশাপাশি তীব্র অনিশ্চয়তার বোধ তাদের নিশ্চয়ই তাড়া করছে। তাই গত কয়েক যুগ ধরে আমাদের এ ভূখণ্ডে এ সম্প্রদায় যে স্বতঃস্ফুর্ততার সঙ্গে উৎসবটি পালন করছে তা এবার দেখা যাওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই।

আমার কাছে সবচেয়ে বেশি দুঃখজনক বলে যে বিষয়টি মনে হয় তা হল, রামুর ঘটনা আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে যে, বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতাকে আমরা নির্মূল করতে পারিনি বরং এটা ভালোভাবেই রয়ে গেছে। সাম্প্রদায়িকতা এখানে নতুন করে শক্তি সঞ্চয় করছে।

কেউ কেউ বলেছেন এটি বিচ্ছিন্ন একটি ঘটনা। আমি তা মনে করি না। এটা বিচ্ছিন্ন নয়। এর আগে সাতক্ষীরাতে সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটেছে। তারপর চট্টগ্রামে। এরপর রামু, উখিয়া, পটিয়াসহ আশেপাশের এলাকায়। দেখা গেছে, মাঝে-মাঝেই বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ওপর এ রকম সাম্প্রদায়িক হামলা হয়েছে, হচ্ছে। এমনকী এবার দূর্গাপূজায় সামগ্রিকভাবে কোনও সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ বা হামলার ঘটনা না ঘটলেও, কোথাও-কোথাও পূজামণ্ডপে ঢুকে প্রতিমা ভাঙ্গা হয়েছে, কিছু মন্দিরও আক্রান্ত হয়েছে। এ সবই প্রমাণ করে যে, সাম্প্রদায়িক শক্তি এখানে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে আছে। সময়-সুযোগ পেলেই এ শক্তি এ দেশে অস্থিরতা তৈরি করছে। ওরা দেশে এবং বিদেশে আমাদের দেশের সাম্প্রদায়িক চরিত্র সম্পর্কে একটি ভুল ধারণা তৈরি করেত চাচ্ছে।

রামুর ঘটনা নিয়ে পরে তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছিল। রিপোর্টও পাওয়া গেছে। কিন্তু সে রিপোর্টে দায়ীদের সম্পর্কে যে তথ্য পাওয়া গেছে তা আরও দুঃখজনক। জানা গেছে, বাংলাদেশের প্রধান তিনটি রাজনৈতিক দল- আওয়ামী লীগ, বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামীর সদস্যরা এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত। এর চেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার আর কী হতে পারে?

তার ওপর দেখুন, প্রশাসনও ঘটনার সময় ছিল নির্বিকার। একে কি প্রশাসনের ব্যর্থতা বলা যায়? অবশ্যই তা বললে ভুল হবে। বরং এতে বোঝা যায় প্রশাসন এ ঘটনাকে প্রশ্রয় দিয়েছে। যে দেশের সরকারের ঘোষিত নীতি হল অসাম্প্রদায়িকতা- সে দেশের প্রশাসন কীভাবে এ ধরনের ঘটনা ঘটতে দিতে পারে?

আমাদের মনে রাখতে হবে, ভারত-বিভাগের পর গত পঁয়ষট্টি বছরে বৌদ্ধসম্প্রদায়ের ওপর কোনও ধরনের সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটেনি। এর কারণ ওরা খুবই শান্তিপ্রিয় একটি জনগোষ্ঠী। বাংলাদেশের সবাই এটা জানেন। আর এ জন্যই বলতে হবে, এই নিরীহ শান্তিপ্রিয় জনগোষ্ঠীর ওপর হামলা একটি ভয়াবহ মানসিকতার পরিচায়ক।

তবে এত বড় একটি ঘটনার পরও, আমার এখনও মনে হয় না যে, সরকার যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে এর তদন্তের কাজ করছেন। অপরাধীদের ধরতে এবং সাজা দিতে তৎপর হচ্ছেন। এটাও খুবই দুঃখজনক।

আমি এখানে একটি কথা বলব, এত বড় কাণ্ড যারা ঘটিয়েছে তাদের বুঝিয়ে দিতে হবে যে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতার জায়গা নেই। এ রকম ঘটনা ঘটালে কারও ক্ষমা পাওয়ার কোনও সুযোগও নেই। যতদিন না ভুক্তভোগীদের সন্তোষ-অনুযায়ী দুর্বৃত্তদের শাস্তি দেওয়া যাবে- ততদিন পর্যন্ত এই ক্ষত আমাদের মনে রয়ে যাবে। পাশাপাশি, আক্রান্ত বৌদ্ধসম্প্রদায়ের মধ্যে নিজেদের নিরাপত্তা সম্পর্কে যে প্রশ্ন, ভীতি ও অস্থিরতা তৈরি হয়েছে, তার পুরোপুরি নিরাময় দরকার। এ জন্য সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে।

এ ব্যাপারে শুধু সরকারের দায়িত্ব রয়েছে তা নয়, নাগরিক সমাজেরও বড় ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে। আমি বলব, আমাদের নাগরিক সমাজে এ ক্ষেত্রে দৃঢ় ভূমিকা রাখতে পারেনি। এ দেশে অসাম্প্রদায়িকতার পক্ষে, শুভবুদ্ধি ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠার পক্ষে তাদের আরও সংগঠিতভাবে কাজ করতে হবে। সমাজের সব স্তরে অসাম্প্রদায়িক চেতনা তৈরির বিকল্প নেই।

রাজনীতিবিদরাও তাদের দায়িত্ব এড়াতে পারেন না। বরং তাদের দায়িত্ব অনেক বেশি। রামুর ঘটনায় অভিযোগের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হচ্ছে প্রধান প্রধান দলের নেতা-কর্মী-সক্রিয সমর্থকদের। তাই প্রতিটি দলের উচিত তাদের কর্মীদের মধ্যে অসাম্প্রদায়িক চেতনা জাগ্রত করা। শুভশক্তি ও ন্যায়ের পক্ষে লড়াইয়ের জন্য তাদের উদ্বুদ্ধ করতে না পারলে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখে লাভ নেই।

আনিসুজ্জামান : অধ্যাপক ও লেখক।