একজন আবদুল কাদের মির্জা এবং কথার লড়াই

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 19 Jan 2021, 10:02 PM
Updated : 19 Jan 2021, 10:02 PM

আমাদের দেশের প্রধান দুই দলের কয়েকজন নেতা প্রতিদিনই নিয়ম করে কথার লড়াই চালিয়ে যান। এদের মধ্যে আওয়ামী লীগের পক্ষে ও  বিএনপির পক্ষে কারা নিয়মিত কথার লড়াইয়ে অংশ নেন তা মোটামুটি সবাই জানেন। দেশে সদ্যসমাপ্ত দ্বিতীয় দফা পৌরসভা নির্বাচনে আমরা আরও একজন 'কথাবিদ'-এর দেখা পেয়েছি। তিনি হচ্ছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের ছোট ভাই নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার বসুরহাট পৌরসভা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত মেয়র আবদুল কাদের মির্জা। পৌরসভা নির্বাচনকে ঘিরে করা কিছু মন্তব্যের কারণে তিনি হঠাৎই চলে আসেন সংবাদ শিরোনামে৷

আব্দুল কাদের মির্জার সরাসরি বলেছেন, "দেশে এখন অপরাজনীতি চলছে। সব কিছু বলা যায় না৷'' নির্বাচনী প্রচার চালাতে গিয়ে তিনি যেসব কথা বলেছেন তার মধ্যে অন্যতম হলো: ''নোয়াখালী এলাকায় সুষ্ঠু নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগের অনেক এমপি পালাবার পথ পাবেন না।'' ''শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তা বেড়েছে, নেতাদের কমেছে।'' ''৫-১০ লাখ টাকা ঘুষ নিয়ে যারা চাকরি দেয়, তারা নেতা হয়।'' ''প্রকাশ্য দিবালোকে যারা পুড়িয়ে মানুষ হত্যা করে, তারা নেতা হয়।''

সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের তাকে বড় নেতা হতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছেন বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি। বলেছেন, ''ছাত্র জীবনে আমি ঢাকায় ভর্তি হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু, তিনি আমাকে চট্টগ্রামে ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন।… ওবায়দুল কাদেরের ধারণা ছিল আমি ঢাকায় পড়াশোনা করে রাজনীতি করলে হয়তো তার চেয়ে বড় নেতা হয়ে যাব। তাই তিনি চাননি আমি ঢাকায় পড়াশোনা করি।'' ''আমি যখন বলি ওবায়দুল কাদের সাহেবের ঘরে ঘরে চাকরি দেওয়ার কথা বলছে, সে চাকরি কোথায়? আমি যখন প্রতিবাদ করি তখন বলে আমি নাকি পাগল, আমি উন্মাদ।''

যাহোক, কথামালার রাজনীতি দিয়ে আবদুল কাদের মির্জা গণমাধ্যমের নজর কাড়তে সক্ষম হয়েছেন। দেশব্যাপী খ্যাতি পেয়েছেন। নির্বাচনেও জয়ী হয়েছেন। কথাই তাকে আপাতত সাফল্য এনে দিয়েছে।

আসলে আমাদের দেশের মানুষ বড় বড় কথা বলায় ওস্তাদ। আর এ ব্যাপারে রাজনীতিবিদরা সবসময় অগ্রগণ্য। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা-বসন্ত কোনো ঋতুতেই তাদের মুখ বন্ধ থাকে না। কোকিল কেবল বসন্তে গায়। কিন্তু আমাদের রাজনীতির 'কোকিল'রা বারো মাস গেয়ে যান, নানা কথা, নানা সুর, নানা বুলি। এসব কথা শুনে আমরাও আনন্দ পাই। অনেক সময় বিনোদিত হই।

আমাদের দেশের মানুষ দুটি জিনিস খুব ভালো পারে। এর একটি হচ্ছে লড়াই আর অন্যটি হচ্ছে কথার বড়াই। এদেশের মানুষকে লড়াই করেই বেঁচে থাকতে হয়, টিকে থাকতে হয়। ক্ষুধা-দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াই, রোগ-শোক-হতাশার বিরুদ্ধে লড়াই। পদ-পদবি-ক্ষমতা-দাপট-সুনাম-খ্যাতির জন্য লড়াই। অন্যের ষড়যন্ত্র-ফাঁদ থেকে রেহাই পেতে লড়াই, নিজের প্রবৃত্তি ও দুষ্ট স্বভাবের বিরুদ্ধে লড়াই। অন্যায়-অবিচার-দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই। শব্দ-দূষণ-বায়ুদূষণের বিরুদ্ধে লড়াই। নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিরুদ্ধে লড়াই। এমনি অসংখ্য লড়াই। রাজনৈতিক দলগুলো তাই স্লোগান দেয়- 'লড়াই লড়াই লড়াই চাই, লড়াই করে বাঁচতে চাই!' আমাদের রাজনীতিবিদরা অবশ্য এখন খুব একটা লড়াই করেন না। তবে তারা যাদের জন্য লড়াই করার ঘোষণা দেন, সেই 'জনগণ' কিন্তু একা একা ঠিকই লড়াইটা চালিয়ে যান।

অবশ্য কথার লড়াই চালিয়ে যাওয়ার জন্য রাজনীতিকদের দোষারোপ করাটা ঠিক নয়। মানুষমাত্রই তা করে। কথা না বলে থাকতে পারে না। বাক-প্রতিবন্ধী ছাড়া কম-বেশি সবাই কথা বলে। কেউ বেশি কথা বলে কেউ বা কম। পৃথিবীতে এমনও মানুষ আছে যারা হয়তো একদিন না খেয়ে থাকতে পারবে কিন্তু কথা ছাড়া থাকতে পারবে বলে মনে হয় না! একদিক থেকে দেখলে আসলে কথাই মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। সুখের কথা যদি আমরা কাউকে না বলি সে সুখের মূল্য কী? আবার যখন দুঃখ আসে তখন কারো মুখের দুটো কথাই বাঁচার আশা জাগায়। কথাই অনেক সময় আনন্দ, আবার কথাই দুঃখ। কথার কারণেই ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়, আবার কথা দিয়েই তা ভাঙানো হয়। কথাই মানুষকে বড় করে, কথাই আবার মানুষকে নিচে নামায়। কথাতেই সত্য প্রকাশ পায় আবার মিথ্যাও কথার মাধ্যমেই আসে। সবটা আসলে নির্ভর করে আমাদের মর্জির ওপর। আমরা কোন কথা মুখ দিয়ে বলার জন্যে বেছে নেব। আর কোন কথাটা এড়িয়ে চলব।

অনেকে কম কথা বলেন, কাজ বেশি করেন। কেউ কথা বেশি বলেন, কাজ কম করেন। অনেকে যতটুকু বলেন, ততটুকু করেন। কেউ আবার না করেও বলেন। আর কেউ না বলেও করেন। এই কথা ও কাজের ক্ষেত্রে কে ভালো কে মন্দ, তা সবাই জানেন। তার পরও একটা মান বা স্ট্যান্ডার্ড বোধহয় আমাদের চারপাশ থেকেই বোঝার আছে।

তবে কথা বড় মারাত্মক জিনিস। কবি লিখেছেন: 'মধুবাবুর কথার বিষে, পাড়ার লোকে হারায় দিশে' অর্থাৎ কথায় সত্যি বিষ আছে। নাম 'মধু' বাবু হলে কি হবে, কথার জ্বালায় সবাইকে অতিষ্ঠ করতে পারেন তিনি। কথায় কী হয়? এ কথার জবাবটা বোধহয় সহজ নয়। কথায় অনেক কিছু হয়। হতে পারে। আবার নাও হতে পারে। মূল ব্যাপার হলো কোন কথা, কেমন কথা, কে বলছেন, কাকে বলছেন! ভাবুকরা বলে থাকেন, 'কথা শতধারায় বয়'।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বিখ্যাত একটি কবিতা আছে 'কেউ কথা রাখেনি'। 'কেউ কথা রাখেনি, তেত্রিশ বছর কাটল, কেউ কথা রাখেনি'- এটা হলো কবিতার প্রথম লাইন। আর কবিতার শেষে আছে, মোক্ষম কথাটা, 'কেউ কথা রাখে না'! কবিতাটিতে বেশ কতক কথা-না-রাখার ছোট-ছোট গল্প বলেছেন কবি। বলেছেন অসাধারণ চিত্রকল্প সহযোগে। বৈষ্ণবী, নাদের আলি, বরুণা কথা প্রত্যেকেই দিয়েছিল, কেউই কথা রাখেনি। মানুষের জীবন কি তাহলে এই রকমই কথা না-রাখার পঞ্জিকা?

তা হলে, সেই কবিতা, এমন নেতিবাচক কবিতা যুগযুগান্তর ধরে এমন প্রসিদ্ধ হয় কী করে? আসলে এ কবিতা বলতে চায়, মানুষের কথা রাখা উচিত, তাই কথা রাখার ব্যাপারে এক আশ্চর্য আকুলতা সৃষ্টি করে কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের এ কবিতা। কবিতাটা নেগেটিভ, নট ফর নেগেটিভ। নেগেটিভ ফর পজিটিভ।

অপর এক কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন অন্য কথা। বলেছিলেন, 'আগে কথায় কাজ হত'। কথাটার মানে হলো, আগে কথা হত, কাজও হত। আর এখন কথা হয়, কাজ হয় না। কথা শব্দটির নানান মানে। সুনীলের কবিতায় কথা মানে প্রতিশ্রুতি। কিন্তু সুভাষের বাক্যে কথা মানে বাণী। বা কথা মানে সত্যকথা বা কথা মানে মানুষের সুচেতনার অভিব্যক্তি। কথার আরো নানা অর্থ হতে পারে, হয়। কথা বলতে অনেক সময় আখ্যান বা জীবন-আখ্যান বোঝায়। কথাসাহিত্য শব্দজোটে কথা বলতে গল্প বা আখ্যান বোঝায়। ফের ধর্মকথা বলতে আমরা যেমন ধর্মের কাহিনি বুঝি, ধর্মের উপদেশও বুঝি, ফের আধ্যাত্মিক আদর্শও বুঝি। কিন্তু যখন আমরা বলি মুখের কথা, তখন কখনো কখনো আমরা মুখের বাক্যকে তুচ্ছ করি।

কথা দিলে কথা রাখতে হয়, এটা মূল্যবোধ, কথায় কাজ হয়, এটাও মূল্যবোধ। দাগা খেয়েও মানুষ কথাতেই ভরসা রাখে। এর কারণ কী? কারণ কথায় বিশ্বাস না রাখলে গরিব তার আহত-মলিন জীবনটাকে সামনের দিকে ঠেলে ঠেলে নিয়ে যেতে পারে না। কথা বলতে হবে। কথা বলতে দিতে হবে। কথা যেন বিশ্বাসযোগ্য ও যৌক্তিক হয়, সেদিকটাও খেয়াল লাখতে হবে। কথা যেন মানুষের মুখশ্রী হয়, মুখোশ নয়।

পরিশেষে কবির ভাষায় নিবেদন: 'সবাই শুধু কথা বলে/কাজ করে না কেউ/মিটিং সিটিং চারিদিকে/কথার কেবল ঢেউ।/টকশোতে হয় নানান কথা/দেয় উপদেশ হাজার/কেমন করে হাঁটতে হবে/করতে হবে বাজার/কথার মেলা, কথার খেলা/কথার কত রং/কথায় কথায় বাড়ছে শুধু/কথারুদের ঢং।/সবকিছু তাই 'কথার কথা'/হচ্ছে বুঝি আজ/কথা ছেড়ে আসুন সবাই/করি নিজের কাজ—(জাহিদ রহমান, কথার কথা)।