কার হাতে নেই নদী হত্যার দাগ!

হাসান ইমাম
Published : 17 Jan 2021, 02:30 PM
Updated : 17 Jan 2021, 02:30 PM

নদ-নদী হত্যায় অস্ত্র থাকে না মানুষের হাতে, মনে থাকে লোভ। এই লোভে সে তো ডোবেই, পুরো জনপদকেও ডুবিয়ে ছাড়ে। এই ডুবও পানিতে নয়, প্রাকৃতিক ভারসাম্য ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সঙ্গে নান্দনিকতাকে টেনে পাতালে নামানো। নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা কৃষি, বাণিজ্য, যোগাযোগ সব হারায়, কোপ পড়ে জীবন-জীবিকায়। নৌকাবাইচ, ভাটিয়ালি গান ইত্যাদি নদীমুখী মানুষের সচল সংস্কৃতিরও মৃত্যু ঘটে। মাঝিকে নিয়ে বিশেষত এ জনপদে কথাসাহিত্যের যে রোমান্টিক বয়ান, বেদে বহরের ভাসমান সংসারের আকুল আখ্যান, নদী পারাপারের সঙ্গে আধ্যাত্মিকতার যে রূপক সেতুবন্ধ, পারের কড়ি—সব মিছে হয়ে যায়। নদীকে বাঁচতে না দেওয়ার মানে তাই কেবল এর জলধারা বন্ধ করাই নয়, সভ্যতার ধারাপ্রবাহও রুদ্ধ করা।

অথচ এই বঙ্গদেশে নদ-নদী দখল-দূষণের যে বিপুল বিঘ্নহীন 'আয়োজন', তাতে বিষয়টি কেবল 'স্বাভাবিকতার' রূপই পায়নি, উৎসবের আবহও যেন যুক্ত হয়েছে এতে! যদিও নদ-নদী সংশ্লিষ্ট অবৈধ দখল, দূষণ, নাব্যতা হরণসহ পানিপ্রবাহে প্রতিবন্ধকতা তৈরি পরিষ্কারভাবে ফৌজদারি অপরাধ।

পানি আইন, দণ্ডবিধি ও পরিবেশ সংরক্ষণ আইনেও আছে শাস্তির বিধান। তবে ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড দেওয়ার সুযোগ আইন থাকলেও কোনো 'নদীখোর' এখন পর্যন্ত ১০ দিনও কারা ভোগ করেছে, এমনটা জানা যায় না। অথচ নদী রক্ষা কমিশনের হিসাবে সারা দেশে নদী দখলদারের সংখ্যা ৬৩ হাজার ২৪৯। অবশ্য কমিশনের ২০১৯ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে ১৮ হাজার ৭৮২ দখলদারকে উচ্ছেদেরও দাবি করা হয়েছে।

হাইকোর্ট সবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, কীভাবে নদ-নদী 'জীবন্ত সত্তা'। মানুষ বা প্রাণী যেভাবে আইনি অধিকার পায় তেমনই অধিকার পাওয়ার দাবিদার নদ-নদীও। প্রতিবেশী ভারত, কলম্বিয়া, নিউজিল্যান্ড ইতাদি দেশেও একই ধরনের স্বীকৃতির সিলমোহর পড়েছে আগেই।

'জীবন্ত সত্তা' ঢাকার বুড়িগঙ্গার পাড়ে নাক না চেপে অবশ্য দুদণ্ড দাঁড়ানো যায় না। মরদেহে পচন ধরলে দুর্গন্ধ ছড়ায় বৈকি। বসতবাড়িতে, অফিস-কাছারিতে, কলকারখানায় মানুষের পক্ষে যত ধরনের বর্জ্য তৈরি সম্ভব, তার সবই গিয়ে মিশছে নদীতে। ভাগাড়ের নাম বুড়িগঙ্গা বলে কেউ চ্যালেঞ্জ ছুড়লে তাকে মোকাবিলা করার 'সাহস' কি নগরপিতাও দেখাবেন? নদীটিকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে বছরের পর বছর ধরে, সবার চোখের সামনে। অথচ ঢাকার জন্ম হয়েছে শুধু এর চারপাশে ছয়টি নদ–নদী আছে বলে; প্রাচীন রাজধানী সোনারগাঁওসহ সব নগর-বন্দরের জন্ম নদীর কারণেই। এই অঞ্চলের সভ্যতার উদ্ভব নদীকে কেন্দ্র করে। 

পৃথিবীর বৃহত্তম বদ্বীপ বাংলাদেশের অধিকাংশ ভূমিও তো গঠিত পলি মাটি দিয়ে৷ এই ভূমির উর্বরাশক্তিও ধরে রেখেছে পলি মাটি, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ৷ ভূমি গঠনের এই পলি বহন করে এনেছে নদী, আনছে এখনও৷ অথচ নদী গঠিত সেই ভূমিতে দাঁড়িয়ে আমরা কিনা নদীর গলা টিপে ধরছি! 

ধনী-গরিব, শিক্ষিত-নিরক্ষর, রাজনীতিক-ব্যবসায়ী,  জনপ্রতিনিধি—সমাজের কোন শ্রেণি-পেশার মানুষ, প্রভাবশালী থেকে ক্ষমতাহীন নদ-নদী দখল-দূষণে যুক্ত নয়? উদ্ভিদ, প্রাণী, মানুষ, প্রকৃতি, বায়ুমণ্ডল, অক্সিজেন—এর কোনটিই বা নদীর সঙ্গে সম্পর্কিত নয়? অথচ মানুষ ভাবছে, পলিথিনে মুড়ে ময়লা-আবর্জনা যা কিছু নদী-নালায় ফেলছি তা বুঝি তার কাছে ফেরত আসবে না! যতটা যা পারছি নদ-নদীর জায়গা বুজিয়ে স্থাপনা গড়লে বুঝি তা আর ধসে পড়বে না! নদীর প্রাণসংশয় মানে জীববৈচিত্র্য ও বাস্তুসংস্থানের ভারসাম্য টলমল। নদীর মৃতু্য মানে জনপদেরও মরণদশা। অক্সিজেনে টান পড়লে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্রে ফুসফুস সচল থাকবে না।  

বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা ও কর্ণফুলী ইত্যাদি নদীর দখল-দূষণ রোধে বিভিন্ন সময়ে নির্দেশনা চেয়ে উচ্চ আদালতে রিট হয়েছে। আদালত রায়-নির্দেশনাও দিয়েছেন। কিন্তু নদীর শুশ্রূষা হয়নি। ঢাকার নদীগুলোর সীমানা নির্ধারণ করতে গিয়ে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) ভুল জায়গায় পিলার বসানোর খবরে তাই বিস্ময় জাগে না! অবশ্য নদী ও পরিবেশবিষয়ক গবেষণা সংস্থা রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিচার্স সেন্টারের (আরডিআরসি) এই ভুল ধরিয়ে দেওয়ার 'এখতিয়ার' নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বিআইডব্লিউটিএ। দেশবাসী এর আগে একই ধরনের প্রশ্ন তুলতে দেখেছে সংসদ সদস্য আসলামুল হককেও। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের প্রতিবেদনেই তার বিরুদ্ধে বুড়িগঙ্গা ও তুরাগ নদের মোট ৫৪ একর জায়গা দখল করে অর্থনৈতিক অঞ্চল ও বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করার তথ্য উঠে এসেছে। কমিশন বলছে, এই দখল পরিবেশ ও প্রতিবেশের ওপর মারাত্মক বিরূপ প্রভাব ফেলছে। অথচ তিনি এর এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তোলার পাশাপাশি আদালতেরও দ্বারস্থ হন।

নদ-নদীর মালিকানা ও স্বত্ব জনগণের, এমনকি রাষ্ট্রেরও নয়—দেশের সর্বোচ্চ আদালত এই অভিমত ব্যক্ত করে বলেছেন, এই মালিকানা ও স্বত্ব রক্ষা করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের এবং রাষ্ট্রের অধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার। এরপরও নদ-নদী দখল-দূষণের মচ্ছবে এতটুকু লাগাম পড়েনি। তবে 'কাগুজে' অগ্রগতি হয়েছে বৈকি। 

নদীর সীমানা নির্ধারণ, দখলমুক্তকরণসহ নাব্যতা বৃদ্ধি, জনসচেতনা তৈরিতে সব মিলিয়ে ১২২টি সুপারিশ করেছে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন। আইনের খসড়াও প্রস্তুত। বাংলাদেশের সব নদ-নদী, জলাধার, খাল-বিল, সমুদ্র উপকূল, হাওড়-বাঁওড়, জলাভূমি, জলাশয়, ঝরনা, হ্রদ, পানির উৎস সব কিছুই এই আইন ও কমিশনের আওতায় থাকার কথা বলা হয়েছে। বলা হয়েছে নদ-নদী, জলাধার, পানির উৎস রক্ষা করা, অবৈধ দখল মুক্তকরণ, নদীর তীরে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ বন্ধ, বিলুপ্ত বা মৃতপ্রায় নদী খননের বিষয়ে পরিকল্পনা তৈরির কথা। প্রতিটি বিভাগে স্থাপন করা হবে এক বা একাধিক 'নদী রক্ষা আদালত'।

এক কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে আরেক কর্তৃপক্ষের কাছে 'হাতবদলে' নদ-নদীকে বাঁচানো যাবে না। দরকার কর্তৃপক্ষের 'হাত' সক্রিয় হওয়ার। তাহলেই নদী হত্যার দাগ আর কেউ নদীর জলে ধুয়ে পার পাবে না। হাতে রক্তের দাগ না থাকা মানে নির্দোষ হয়ে যাওয়া নয়। দোষীদের ধরতে পারে কেবল আইনের হাত।