বাংলাদেশ ২০২০: পরিবেশগত পর্যালোচনা

রাইসুল ইসলাম
Published : 11 Jan 2021, 12:13 PM
Updated : 11 Jan 2021, 12:13 PM

বিগত বছরের শুরু থেকেই ভাইরাস সৃষ্ট রোগ, কোভিড-১৯, বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে যাকে পরবর্তীতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মহামারী হিসেবে ঘোষণা করে। এই রোগ সর্বপ্রথম মানুষের শরীরে শনাক্ত হয় ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে চীনের উহান শহরে। বাংলাদেশে ৮ মার্চ ২০২০ সর্বপ্রথম এই ভাইরাস শনাক্ত হয়। বিশ্বব্যাপী বন উজাড়, বণ্যপ্রাণী নিধন, বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল বিনাশ, পরিবেশ দূষণ ও অন্যান্য মানবসৃষ্ট বিপর্যয় সৃষ্টির ফলস্বরূপ এরকম ভাইরাস অভিযোজিত হয়ে মানুষের শরীরের সংস্পর্শে এসেছে। পরিবেশের উপর বিরূপ আচরণের ফলে পৃথিবীব্যাপী যে অস্থিরতা ও অনিশ্চিয়তা সৃষ্টি হতে পারে কোভিড-১৯ মহামারী তার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। পরিবেশবিদরা তাই বিশ্বব্যাপী পরিবেশ দূষণ ও অবক্ষয় রোধ, জীববৈচিত্র্য বিনাশ ও তাদের আবাসস্থল বিনষ্ট বন্ধ করার ওপর জোর দিচ্ছে। এবারে বিশ্ব পরিবেশ দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করা হয়েছিল 'প্রকৃতির জন্য সময়'। আবার প্রকৃতরি ওপর গুরুত্বারোপ করেই ২০২০ সালের আন্তর্জাতিক জীববৈচিত্র্য দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল 'প্রকৃতিতেই রয়েছে আমাদের সমাধান'। 

বিশ্বের বিভিন্ন দেশ মহামারী বিস্তার নিয়ন্ত্রণের জন্য ভাইরাস বিস্তারের শুরুর দিক থেকেই বিভিন্ন মেয়াদে 'লকডাউন' ঘোষণা করে আসছে। বাংলাদেশ সরকারও ভাইরাসের বিস্তৃতির গতিবিধি পর্যালোচনা করে ২৬শে মার্চ ২০২০ থেকে  ৩০ মে ২০২০ পর্যন্ত সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে। এ সময় অর্থনৈতিক কার্যাবলী সীমিত থাকার কারণে ঢাকাসহ সমগ্র বাংলাদেশে বায়ুদূষণ প্রশমিত হয় এবং বায়ুমান সূচকে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশেরও উন্নতি ঘটে। 

বিখ্যাত প্রকাশক 'স্প্রিনজার' এর 'এয়ার কোয়ালিটি, অ্যাটমোস্ফিয়ার অ্যান্ড হেল্থ' সাময়িকীতে প্রকাশিত এক গবেষণায় উল্লেখ করা হয় যে, লকডাউনের সময়কালে বাংলাদেশের বায়ুদূষণ কবলিত প্রধান প্রধান শহর সমূহের বায়ুমন্ডলে নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড, সালফার ডাই অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড ও ওজোন গ্যাস লকডাউনের ঠিক পূর্বের সময়কালের তুলনায় যথাক্রমে ৪০, ৪৩, ৪ এবং ৩ শতাংশ কমেছিল যেখানে সর্বাধিক দূষণ কবলিত শহর ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ শহরের বায়ুমণ্ডলে নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড, সালফার ডাই অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড ও ওজোন গ্যাসের গড় শতকরা হ্রাসের পরিধি ছিল যথাক্রমে ৬২ দশমিক ৮৪-৬৯ দশমিক ২৪ শতাংশ, ৪০ দশমিক ৫০ থেকে ৬৬ দশমিক ৬১ শতাংশ, ৫ দশমিক ২০ থেকে ৭ দশমিক ১৭ শতাংশ এবং ২ দশমিক ৬২ থেকে শতাংশ ২ দশমিক ৯৭ শতাংশ. একই সময় ঢাকা নগরীতে বাতাসে ভাসমান বস্তুকণা (পিএম২.৫) এর গড় মান ৬৫ মাইক্রোগ্রাম/মিটার৩ থেকে কমে দাঁড়ায় ৫০ মাইক্রোগ্রাম/মিটার৩ যা পূর্ববর্তী বছরের গড় মানের তুলনায় ২৩ শতাংশ কম ছিল। 

অন্য এক গবেষণায় উল্লেখ করা হয় যে, ২০২০ এর এপ্রিল-মে মাস সময়কালে ঢাকা শহরে বায়ুমান সূচকের মান ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস পায় পূর্ববর্তী বছরের তুলনায়, যদিও একই সময়ে ঢাকায় দূষণের গড় শতকরা হ্রাসের পরিমাণ বিশ্বের অন্যান্য দেশের বিভিন্ন শহরের তুলনায় কম ছিল, এমনকি দিল্লীতে শতকরা দূষণ হ্রাসের পরিমাণ ঢাকার চেয়ে বেশি ছিল। 

নদ-নদীকে 'জীবন্ত সত্তা' হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার পর এ পদক্ষেপকে আরও বেগবান করার জন্য দেশের নদ-নদী, খাল-বিল, জলাশয়, জলাধার, হাওর, বাওর ও সমূদ্র উপকূলের দূষণ, অবৈধ দখল এবং এদের স্বাভাবিক গতি-প্রকৃতি ও প্রবাহ রক্ষা করার জন্য ২০১৩ সালের জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন আইন সংশোধন করে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন আইন ২০২০ এর খসড়া প্রণয়ন করা হয়েছে। এ আইন সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা হলে নদ-নদীর স্বভাবিক প্রবাহ ও নাব্যতা রক্ষা, নৌপরিবহন ব্যবস্থার উন্নতি, দখল ও দূষণ রোধ এবং সর্বোপরি আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন সম্ভব হবে। শিল্প কারখানায় পানির সুষম ব্যবহার নিশ্চিতকরণ, কারখানা থেকে নিঃসৃত বর্জ্য পানি কর্তৃক আশেপাশের নদ-নদী, খাল-বিল, জলাভূমি ও জলাশয় দূষণ রোধ এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষার উদ্দেশ্যে পানি সম্পদ পরিকল্পনা সংস্থা (ওয়ারপো) 'শিল্প খাতে পানি ব্যবহার নীতি' প্রণয়ন করেছে। আবার বাংলাদেশ পানি বিধিমালা ২০১৮ তে উল্লেখিত জেলা/উপজেলা/ইউনিয়ন পর্যায়ে সমন্বিত পানি ব্যবস্থাপনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ওয়ারপো জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন সমন্বিত পানি ব্যবস্থাপনা গাইডলাইন, ২০২০ প্রণয়ন করেছে। 

পরিবেশ সংরক্ষণের চিন্তায় গত কয়েক বছরে বেশ কিছু অঞ্চলকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তর ও বন অধিদপ্তর এসব অঞ্চলগুলো নিয়ে নানারকম কার্যক্রম নিয়ে থাকে। এবছর এরকম বেশ কিছু স্থানকে ঘিরে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় উচ্ছেদ অভিযান অব্যাহত ছিল। স্থানীয় প্রভাবশালী, ক্ষমতাধর ও অন্যান্য ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান কর্তৃক নদ-নদী, খাল-বিল, জলাভূমি ও জলাধার অবৈধ দখল হলে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক ও পরিবেশ অধিদপ্তরকে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক একটি দাপ্তরিক আদেশও জারি করা হয়েছে। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ হাইকোর্টের আদেশ অনুযায়ী ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ নদী বন্দরের আওতাধীন বুড়িগঙ্গা, তুরাগ ও শীতলক্ষা নদীর সীমানা পিলারের অভ্যন্তরে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করে মোট ৩৩১৪টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে এবং ১০৬ একর তীরভূমি উদ্ধার করে। তাছাড়া বিগত অর্থবছরে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক দেশের নৌপরিবহন ব্যবস্থার উন্নতি ও নদীগুলোর নাব্যতা ধরে রাখার জন্য বিভিন্ন নৌপথ ও নদীতে মোট ৩০০ কিলোমিটার খনন কাজ পরিচালনা করেছে। অনিয়ন্ত্রিত পর্যটন এবং দূষণের ফলে দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেইন্ট মার্টিনে পরিবেশ বিপর্যয় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে এবার মহামারির কারণে সাধারণ ছুটির সময়কালে সেন্টমার্টিনসহ অন্যান্য জায়গায় পর্যটক কিছুটা কম ছিল, যদিও পরবর্তী সময়ে তা আবার বেড়েছে। আরেক সংকটাপন্ন এলাকা কক্সবাজার এবং তার আশপাশের অঞ্চলে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সমাগমের পরিবেশ নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। তবে ইতিমধ্যে কক্সবাজার থেকে বেশ কিছু রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে স্থানান্তর করা হয়েছে। এতে পরিবেশগত সমস্যা কিছুটা কমার আশা করা হচ্ছে। 

বাংলাদেশ বন অধিদপ্তর ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে দেশজুড়ে বনায়ন কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ১২ হাজার হেক্টর ব্লক বাগান, ৬ হাজার হেক্টর ম্যানগ্রোভ বাগান এবং ১ হাজার ৩৫০ কিলোমিটার স্ট্রিপ বাগান সৃষ্টি করা হয়েছে। এছাড়াও বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও জাতীয় বৃক্ষরোপন অভিযান ২০২০ উপলক্ষে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক সারাদেশে ১ কোটি গাছের চারা রোপণ কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, বাংলাদেশে বর্তমানে মোট বৃক্ষ আচ্ছাদিত ভূমির পরিমাণ (বনের অভ্যন্তর ও বাইরে) দেশের মোট আয়তনের তুলনায় ২২ দশমিক ৩৭ শতাংশ, যা ২০২৫ সালের মধ্যে ২৪ শতাংশে উন্নীত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে, যেখানে মোট বনভূমির পরিমাণ (শুধু বনের অভ্যন্তরে) দেশের মোট আয়তনের ১২ দশমিক ৮ শতাংশ। বাংলাদেশে প্রথমবারের মত উদ্ভিদ প্রজাতির একটি 'রেড লিস্ট' প্রণয়ন এবং ক্ষতিকর বিদেশি উদ্ভিদ প্রজাতি ব্যবস্থাপনা কৌশল নিরূপণের উদেশ্যে বাংলাদেশ বন অধিদপ্তর একটি প্রকল্প নিয়েছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে বিদেশি ক্ষতিকর প্রজাতি ফলপ্রসূ ব্যবস্থাপনা কৌশল নিরূপণের মাধ্যমে দেশীয় প্রজাতির উদ্ভিদকূলের বিপন্নতার হাত থেকে উত্তরণের একটি উপায় নির্ণয় সম্ভব হবে।

বিভিন্ন গবেষণার ফলাফল থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, এ বছর দেশে ৫০ টিরও বেশি নতুন প্রজাতির বন্য উদ্ভিদ ও প্রাণীর দেখা মিলেছে। নতুন প্রজাতি সমূহের মধ্যে সামুদ্রিক মাছের প্রজাতি পাওয়া গিয়েছে ২০টি, কাঁকড়ার প্রজাতি রয়েছে ৫টি, পাখির প্রজাতি রয়েছে ৭টি যার মধ্যে সামুদ্রিক পাখিই রয়েছে ৬টি, ১৪টি সাপ ও ব্যাঙের প্রজাতি যেখানে ব্যাঙের একটি প্রজাতি R. rezakhani, বিজ্ঞানে নতুন যেটার নামকরণ করা হয়েছে বাংলাদেশের ওয়াল্ড লাইফ বায়োলজির অন্যতম পথিকৃৎ ড. রেজা খানের নামানুসারে। আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ ও জাতীয় ঔষধিশালা বাংলাদেশ এর যৌথ গবেষণায় লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে বন্য কচুর ৪টি নতুন জাতের সন্ধান মিলেছে। আবিষ্কৃত বেশিরভাগ প্রাণীই সমুদ্রকেন্দ্রিক বাস্তুসংস্থানে পাওয়া গিয়েছে, বিশেষ করে সেন্ট মার্টিন দ্বীপে। 

বাংলাদেশের সমুদ্র ও তার উপকূলীয় জীববৈচিত্র্য যে অনেক সমৃদ্ধ তা এ প্রতিবেদন থেকে অনুমান করা যায়। বন্য প্রাণী সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ৪৮টি সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণা করা হয়েছে যা দেশের মোট আয়তনের ৪ দশমিক ২৬ শতাংশ। বিগত বছরেও ডলফিন সংরক্ষণের জন্য পানখালী বন্যপ্রাণী (ডলফিন) অভয়ারণ্য, শিবশা বন্যপ্রাণী (ডলফিন) অভয়ারণ্য ও ভদ্রা বন্যপ্রাণী (ডলফিন) অভয়ারণ্য নামের ৩টি নতুন ডলফিন অভয়ারণ্য ঘোষণা করা হয়েছে। বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট 'বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও আবাসস্থল উন্নয়ন প্রকল্প' এর অধীনে নিয়মিতভাবে অভিযান কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে; যার ধারাবাহিকতায় ২০১৯-২০ অর্থবছর পর্যন্ত তারা ৩১ হাজার ১৯৭টি বন্যপ্রাণী উদ্ধার করে প্রকৃতিতে অবমুক্ত করতে সক্ষম হয়। আবার বন্যপ্রাণীর আক্রমনে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিধান প্রণীত হওয়ার পর থেকে সরকার নিয়মিতভাবে ক্ষতিগ্রস্থদের মাঝে ক্ষতিপূরণ দিয়ে আসছে, যেখানে ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে ১২৩ জন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের মাঝে মোট ৫৪ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়।  

প্রতিবছরের ন্যায় বিগত বছরেও বন্যা ও ঘুর্ণিঝড়ের কবলে পড়ে বাংলাদেশ। গত বছরের মে মাসে ঘূর্ণিঝড় আম্পান বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে আঘাত হানে। ঘূর্ণিঝড় আম্পানের প্রভাবে দেশের ৩৬টি জেলা আক্রান্ত হয় এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্য অনুসারে আম্পান ১০ জনের জীবন কেড়ে নেয়। রাস্তা-ঘাট, বাড়ি-ঘর, কৃষি, মৎস্য ইত্যাদির প্রায় ১ হাজার ১০০ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাপ করা হয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে। এবারও বাংলাদেশের ফুসফুস খ্যাত সুন্দরবন আম্পানের গতিবেগ কমিয়ে দিয়ে দেশকে বড় ধরনের ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করেছে। ২০২০ সালের বন্যাকে শতাব্দীর দীর্ঘস্থায়ী বন্যা বলা হয়েছে যা ১৯৯৮ সালের পর বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি সময়, প্রায় দেড় মাসব্যাপি স্থায়ী ছিল। এ বন্যায় ৩৩ জেলা প্রত্যক্ষভাবে আক্রান্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। 

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের হিসাব মতে, এ বন্যায় ৫ হাজার ৯৭২ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। তাই এই সকল অবকাঠামো নির্মাণকে আরও টেকসই করার উদ্দেশ্যে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর দেশে সড়ক ও মহাসড়ক নির্মাণের ক্ষেত্রে প্রথমবারের মত প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তন জনিত ঝুঁকির বিবেচনায় নিয়ে একটি মূলনীতি প্রণয়নের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ বিষয়ে উক্ত অধিদপ্তর উপকূলবর্তী এলাকার মহাসড়কের জন্য 'জলবায়ু পরিবর্তন ও রেজিলিয়েন্ট ডিজাইনের প্রভাব' শীর্ষক একটি পাইলট প্রকল্প হাতে নিয়েছে।

করোনাবাইরাস মহামারীর কারণে এ বছর মেডিকেল বর্জ্যের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছিল। তবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক করোনাকালীন মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য আলাদা একটি নীতিমালা প্রণয়ন করায় এ সংক্রান্ত ঝুঁকি অনেকটাই কমানো সম্ভব হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিধিমালা ২০১৯ এর খসড়া প্রণয়ন করা হয়েছে। বিধিমালা বাস্তবায়নের প্রথম বছরেই উৎপাদিত বর্জ্যরে ১০ শতাংশ সংগ্রহের লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে যা বিধিমালা বাস্তবায়নের পঞ্চম বছরে ৫০ শতাংশে উন্নীত করার কথা বলা হয়েছে। তাছাড়া এ বিধিমালায় কিছু বিপজ্জনক পদার্থ ব্যবহারের ক্ষেত্রে মানমাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। 

দুর্যোগপ্রবণ এ দেশে সমন্বিত ও টেকসই উন্নয়ন পরিকল্পনা ছাড়া উন্নয়নকে দীর্ঘস্থায়ী করা সম্ভব না। সেই লক্ষ্যেই সরকার শতবর্ষী 'ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০' হাতে নিয়েছে। তাছাড়া টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সরকারের বিভিন্ন বিভাগ তাদের প্রকল্পসমূহকে শতবর্ষী 'ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০' এর সাথে সমন্বয় করে নিচ্ছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ তার 'এসডিজি অগ্রগতি প্রতিবেদন ২০২০' প্রকাশ করেছে, যেখানে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক ঝুঁকি ও দূর্যোগ মোকাবেলা, সাগর ও সামুদ্রিক সম্পদের সংরক্ষণ ও এর সুষ্ঠ ব্যবহার, বন ও সংরক্ষিত এলাকার সম্প্রসারণ ইত্যাদি বিষয়ে লক্ষ্য অর্জনে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। 

২০২০ সালে পরিবেশ রক্ষার জন্য বড় কোন আন্দোলন আলোচনায় আসেনি। আবার গ্লাসগোতে অনুষ্ঠিতব্য জলবায়ু সম্মেলন বৈশ্বিক করোনা মহামারীর কারণে স্থগিত করা হয়েছে যা ২০২১ সালের নভেম্বরে আয়োজনের কথা বলা হয়েছে। এক্ষেত্রে জাতিসংঘ সচিবালয় 'জাতীয়ভাবে নির্ধারিত অবদান' প্রতিবেদন জমা দিতে বলেছিল; যেখানে বাংলাদেশ নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই এই প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। এদিকে ২০২০ সালে প্রকাশিত জার্মান ওয়াচের জলবায়ু ঝুঁকি সূচকে ১৯৯৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সময়ে জলবায়ু সংশ্লিষ্ট দূর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশ সপ্তম স্থানে রয়েছে। ইয়েল ও কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রকাশিত এনভারনমেন্টাল পারফরমেন্স সূচকে বাংলাদেশ ১৭ ধাপ এগিয়ে এখন ১৬২ তম স্থানে রয়েছে, যদিও দক্ষিণ এশীয় দেশসমূহের মধ্যে বাংলাদেশ শুধু ভারত ও আফগানিস্তানকে পেছনে ফেলতে পেরেছে। 

পরিবেশ সংরক্ষণ, দূষণ নিয়ন্ত্রণ, পরিবেশ বিষয়ে শিক্ষা ও গবেষণার প্রচারে ভূমিকা রাখার জন্য প্রতিবছর 'জাতীয় পরিবেশ পদক' দেওয়া হয়। এছাড়া বন্যপ্রাণী এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে বঙ্গবন্ধু জাতীয় পুরস্কার বিধিমালা ২০১৯ এর অধীনে প্রতিবছর ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানিক পর্যায়ে সম্মানজনক  'বঙ্গবন্ধু অ্যাওয়ার্ড ফর ওয়াইল্ড লাইফ কনজারভেশন' পদক দেওয়া হচ্ছে। আবার নদী রক্ষায় অবদানের জন্য প্রতি বছর জেলা পর্যায়ে একটি ও জাতীয় পর্যায়ে তিনটি করে 'বঙ্গবন্ধু নদী পদক' দেওয়া হয়। এবারে পরিবেশগত বিষয়ে ন্যায়বিচার প্রচার ও পরিবেশ বান্ধব আইনশাস্ত্র বিকাশে ভূমিকা রাখার জন্য বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবি সমিতি (ইঊখঅ) আরও দুইটি সংগঠনের সাথে যৌথভাবে আইনের শাসনে আন্তর্জাতিক টাং পুরস্কার ২০২০ লাভ করে।