সুনীলের প্রয়াণ: “ভালোবাসার মুঠোয় ফেরা”

শবনম নাদিয়া
Published : 23 Oct 2012, 12:35 PM
Updated : 23 Oct 2012, 12:35 PM

নীললোহিতকে আমি প্রথম আবিষ্কার করি কৈশোর বইটি পড়ে । কে দিয়েছিল এখন মনে নেই, কিন্তু জন্মদিনে উপহার পেয়েছিলাম, একদম মোক্ষম বয়সে। তের কি চৌদ্দ তখন আমার। তখন জানি না, আমার বইয়ের তাকে আধা তাক জুড়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের যে বইগুলো কবিতা-উপন্যাস মিলিয়ে, সেইখানে জায়গা দেয়া উচিত কিনা বইটিকে। মনে আছে দীর্ঘদিন হেলায় ফেলে রেখেছিলাম কৈশোর। অজানা লেখক, কম পাত্তা পাচ্ছিল আমার কাছে। শেষ পর্যন্ত যখন পড়লাম, মনের গহীন একদম নিঃঝুম হয়ে গেল। মনে হলো কোথাও ছুটে যাই, কোথাও বসে হুহু করে কাঁদি, আর কিছু না হোক ঘরের চৌহদ্দি পেরোই। চটি বই,সাদা মলাট, দুই-তিন ঘন্টার বেশি বোধয় লাগেনি শেষ হতে। স্কুল-নেই এক দুপুরে শেষ করলাম; ঘরে আর থাকা গেল না। বাড়ির কাছে লেক, তার সবুজ পানির ধারে গিয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত বসে রইলাম, তেমন কোনো কারন ছাড়াই। বসলাম গাছের আড়ালে, চেনা কেউ যেন দেখে কথা বলতে না আসে। জাহাঙ্গীরনগরের কৃষ্ণচূড়াগুলোর কান্ডগুলো চওড়া, অনেক কিছুই তারা আড়াল করেছে এ জীবনে, সেদিনকার চোখের জলও তারা ঢাকা দিয়ে রাখল।

কেন যে কাঁদছিলাম, আজকে ঠিক জানি না। কিছু একটা বিষাদ প্রছন্ন হয়ে ছিল, সেটা বলবার বা বুঝবার ভাষা ছিল না। কৈশোর বইটি যতদুর মনে পড়ে, তেমন কোনো ঘটনা নিয়ে নয়, যাতে আমার কোনো কৈশোর-কষ্ট সেখানে স্পষ্ট ছায়া কাড়বে। কিন্তু কিছু একটা অনুরণন তো ঘটেছিল, কোন একটা সুর তাতে ছিল যা শুনতে পেয়ে আমার মন বলেছিল, এই লোকটি, এই নীললোহিত, এ ঠিক বুঝবে! আমার বোঝাতে হবে না, আমার বলবার ভাষা তৈরি করতে হবে না, সে আপনিই বুঝে নেবে! ওই বয়সটি তো সেরকম বয়সই বটে।

তারও বেশ কদিন পর আবিস্কার করি, বইয়ের শেষ মলাট পড়ে, নীললোহিত আসলে সুনীল। আমার বইয়ের তাক থেকে আবার নতুন করে নামালাম সুন্দরের মন খারাপ মাধুর্যের জ্বর, স্মৃতির শহর, এসেছি দৈব পিকনিকে। মনে হলো চেনা মানুষের সাথে আবার হলো নয়া আলাপ। কাকাবাবু আর সন্তুর অভিযানগুলো গোগ্রাসে গিলে যে পরিচয় হয়েছিল, কবিতা আবিষ্কার করে যে পরিচয় পোক্ত হয়েছিল, নিলোলোহিতকে আবিষ্কারে সব হয়ে গেল একদম নিজস্ব অর্জন।

নীললোহিত বিষয়টি যেন আমার আর সুনীলের গোপন কথা, আর কারো সেখানে জায়গা নেই। যেন আমি ছাড়া কেউ আর এই কথা জানে না, আমি ছাড়া নীললোহিতের প্রকৃত পাঠক আর কেউ নেই। কবিতাগুলো তো তাই–একান্তই আমার জন্য লেখা: সুনীল আমার মত পাঠকের চোখে চোখ রেখেই তো ঐসব পংক্তি লিখেছিলেন! ওই বয়সটি তো সেরকম বয়সই বটে।

বই কেনাবাবদ বছরে একবারই বড় গোছের টাকা পেতাম, বই মেলাতে। আর বাপ-মার মেজাজ ভালো দেখলে চেয়ে-চিন্তে মাঝেসাঝে আরো কিছু বইয়ের সংস্থান। তাতেও তো সংবত্সরের খোরাক জোটে না। তখন আরেকটু বর হয়েছি, পাখনা গজিয়েছে। কলেজে লাঞ্চ খাওয়া বাদ দেয়া শুরু করলাম প্রায়ই, রিক্সা নিতাম কালেভদ্রে। আরেক নরম জমিন পেয়ে গেলাম, আমার দিদিমা। নাতিনের বই কেনার আবদার কখনো ফেরাতেন না। আবিষ্কার করলাম আমার বন্ধু কনা, সেও সুনীল আর নীললোহিত বললে হুমড়ি খেয়ে পরে। ঠিক করলাম বুঝেশুনে বই কিনতে হবে। এক বই দুজন কেনা পয়সা নষ্ট, একজনের তাকে থাকলেই তো কেল্লা ফতে। নিউ মার্কেটের বই পাড়ায় আমাদের যৌথ অভিযান নিয়মিত হয়ে উঠলো।আমাদের বই বাছাইয়ের পয়লা হিসাব ছিল দাম: আনন্দ পাবলিশার্সের ছোট্ট আকারের বইগুলো আমাদের জন্য সহজ। তখন ভারতীয় বই লেখা দামের ঠিক আড়াই গুনে ঢাকায় বিক্রি হত। কিন্তু ওই চটি বইগুলো একশ পাতার গন্ডিও ছাড়াতো না সহজে, ওতে আমাদের মোটেই খায়েশ মিটত না।

পূর্ব-পশ্চিম, সেই সময়, প্রথম আলো–এই বইগুলো হাতে পাবার কি আকাঙ্খা! ক্ষ্যামতা ছিল না। 'দেশ' কেনা হত বাড়িতে, সুতরাং পূর্ব পশ্চিম পড়া হলো । পাশের বাড়ির ময়না চাচা সেই সময় কিনলেন। বেনু চাচির অনুমতি নিয়ে তাঁদের বাড়ি দুপুর গিয়ে গিয়ে দুই খন্ড শেষ করলাম। প্রথম আলো পেলাম ছোটো খালার কাছে। তার অনেক অনেক দিন পর, খালা তার তাক খালি করতে গিয়ে অনেক বই দান করে দিল, তার মধ্যে ছিল সেই সময়। কি যে জয়ের আনন্দ! সেই বই শেষে আমার বাম-রাজনীতি করা চালচুলোহীন তুতো ভাইটি ধার নিল, নিয়ে আর ফেরত দিল না। এখনো তার দাবি আমি প্রাণে ধরে আছি।

ছবির দেশে কবিতার দেশে পড়ে আইওয়ার নাম জানলাম। গিন্সবার্গকে চিনলাম। অধ্যাপক বাপের তাক ঘেঁটে মার্কিন কবিতা সঙ্কলনে Jessore Road খুঁজে পেলাম। পাড়ার চাচা মোহাম্মদ রফিক কবি–তা জেনেছিলাম নব্বইয়ের গণআন্দোলনের সময় খোলা কবিতা পড়ে, রফিক চাচাও সুনীলের মত আইওয়াতে International Writing Program-এ গেছেন শুনে বেশ পুলকিত হলাম। বাবার সাথে এক বিভাগে কাজ করেন, তার ছেলে শুদ্ধকে তো আমি চিনি! এই তো ছিল আমার ছোট গন্ডি। সেই ক্ষুদ্রতার পরিসর যারা স্বততই বিশাল করে তুলছিলেন, মফস্বলী মনটিকে তামাম দুনিয়ার দিকে নজর করতে শেখালেন,তাদের মধ্যে সুনীল ছিলেন।

সুনীল, তুমি চলে গেলে? তাতে ক্ষতি আছে, কিংবা ক্ষতি নেই। সেই একটা সময় গেছে, সাদা পৃষ্ঠায় কথা হত। সেই কথা তো রয়ে গেল।

শবনম নাদিয়া: লেখক ও অনুবাদক।