নিরন্তর অন্যকরণ ও বৈশ্বিক রঙ্গমঞ্চে সাম্প্র্রদায়িকতার পরিবেশন

নাসরিন খন্দকার
Published : 18 Feb 2011, 05:56 AM
Updated : 23 Oct 2012, 12:00 PM

দুঃখজনক হচ্ছে আজকের দিনে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রত্যয়টি হয়ে উঠেছে একটা মিথ, একটি বাগাড়ম্বর। এটা দিনের আলোর মতো সত্য যে আমরা কোনো সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মধ্যে বাস করছি না। যদিও এটা আকস্মিক কিছু নয়, তবু সাম্প্রতিককালে ঘটে যাওয়া রামু ও রাঙামাটির আক্রমনের কারণে আমাদের অনেকের মধ্যেই এই অনুধাবন নতুন করেই তৈরি হচ্ছে। কিন্তু আমি এর সাথে এটিও বলতে চাই আমরা কোনো সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিশ্বে বাস করছি না। সাম্প্রদায়িক অসম্প্রীতি নতুন কোনো ঘটনা নয়। কিন্তু এই 'অসম্প্রীতি' সাম্প্রদায়িক হামলা হিসেবে যখন দৃশ্যমান হয় তখন এর সাথে যুক্ত হয় আরো কিছু। নতুন করে এর উঠে আসার পেছনেও থাকে আরো কিছু। রামুর বৌদ্ধ মন্দিরে হামলার ঘটনাটির তাই দুটি স্পষ্ট স্তর আমি চিহ্নিত করতে চাই। একটি হচ্ছে গোষ্টীগত বিদ্বেষ, এই ক্ষেত্রে যা ধর্ম বিশ্বাসের নামে, অন্য অনেক ক্ষেত্রে তা জাতিগত,বর্ণ বা লিঙ্গীয় বিদ্বেষের পাত্রে সমাজে জারি থাকে, চর্চিত বা পুনরুৎপাদিত হয়। এটা বর্ণবিদ্বেষ, জাতিগত বিদ্বেষ বা নারীবিদ্বেষের মতোই অন্য যেকোনো 'অন্যকরণ' প্রক্রিয়ার অনুরূপ, ধর্মের লেবাসে পরিবেশিত। এই বিদ্বেষ বা অন্যকরণ প্রায়শই প্রকটভাবে দৃশ্যমান থাকে না। কিন্তু এর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ স্তর হচ্ছে এই বিদ্বেষের দৃশ্যমান দলগত প্রায়োগিক চেহারা। যা আমরা সাম্প্রতিক এই ঘটনাগুলোতে দেখতে পাচ্ছি। অদৃশ্য পর্যায় হতে দৃশ্যমানতার এই পর্যায়ে আসার জন্যে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ভীষণ সক্রিয় হয়ে ওঠে। আমার বক্তব্য, এই সক্রিয়তা আপনা থেকে ঘটে না। এর পেছনে আরো সক্রিয়, আরো অদৃশ্য এবং আরো শক্তিশালী একটি পক্ষ থাকে, সাম্প্রদায়িক অসম্প্রীতির অধিক আর্থ-রাজনৈতিক আগ্রহ থাকে।

গত কয়েক বছরে আমাদের দেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সংখ্যা আরো লঘু হয়েছে। কিছুদিন আগে বেশ নিরীহভাবে পরিবেশিত এবং অবহেলিত সংখ্যাহ্রাসের এই খবরটি যখন পত্রিকার পাতায় পড়ি , তখন নিরন্তর নিপীড়ন ও প্রান্তিকীকরনের অভিজ্ঞতা দৃশ্যপটের মতো চোখের সামনে ভেসে উঠে। এই সংখ্যাহ্রাসের অনেক কারণ থাকতে পারে, কিন্তু যে কোনোভাবেই হোক এই দেশ যে সংখ্যালঘুদের জন্যে বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে তা এই পরিসংখ্যান প্রকাশ করে। এই লঘুত্ব শ্রেফ ধর্মগত নয়, যে কোনো ক্ষেত্রেই সংখ্যাগরিষ্ঠ বা ক্ষমতাশালীদের দাপটে সবধরনের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে এই দেশে, এই বিশ্বও। কিস্তু যে অসম্প্রীতির তাপে পোড়া কাঠকয়লা হয়ে আমরা থাকি, সে তাপ কিন্তু ব্যক্তিক নয়, প্রাতিষ্ঠানিক। আর সেই পোড়া কাঠকয়লায় ধরা আগুনে আজ বৌদ্ধ মন্দিরের আগুন জ্বলেছে। আমরা আগুন দেখেছি। আগুন দেখে আজ আমরা আমাদের সাম্প্রদায়িক চরিত্র অনুধাবন করতে পারি। নিজেদের এই প্রতিমূর্তিতে নিজেদের ছিঃ ধিক্কার দিতে পারছি। কিন্তু এখন এই ধিক্কারই কি যথেষ্ট? বরং প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সামাজিক-সাংস্কৃতিক এবং এই সংবাদটি ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ায় কিভাবে আমরা নামে ও চরিত্রে 'সাম্প্রদায়িক' হয়ে উঠি তা খতিয়ে দেখবার বিষয়। এর উত্তর না পেলে এমন ভয়ংকর ঘটনায় কিছুদিন প্রতিবাদের এলোপাথারি গুলি ছুড়ে মৌসুমী দায়িত্ব সেরে আবারো আমরা সেই মরা মানুষের সারিতে চলতে থাকবো। ক'দিন পর আবার কোনও এক প্রয়োজনে, কোনও এক উছিলায় আবার এমন ঘটবে, ঘটতেই থাকবে, তারপর ধীরে ধীরে নিজেদের এই চেহারাও সয়ে যাবে আর আড়ালেই রয়ে যাবে এই চেহারা নির্মাণের ইতিহাস।

বিদ্বেষের প্রাতষ্ঠানিক ভিত
আমরা সাম্প্রদায়িক, অনেক কাল ধরেই। কিন্তু কিভাবে তা হয়ে উঠি? সাম্প্রদায়িক হয়ে কি আমরা জন্মাই? 'অন্য'র প্রতি বিদ্বেষ কি প্রাকৃতিক? আধিপত্যশীল মনস্তত্ত্ব কি ব্যক্তিক? প্রকৃতির দোহাই দিয়ে নিজ থেকে ভিন্ন মানুষকে 'অন্য' করে, হেয় করে উপস্থাপন করে সাদা মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা নৃবিজ্ঞান একটা সময়ে করেছে। ঔপনিবেশিক আগ্রহের হাত ধরে সাদা বা পশ্চিমার বাইরে অন্য যে কোনো জাতিসত্ত্বাকে 'আদিম' হিসেবে খাটো করে, নেতিবাচক করে পরিবেশন করেছে। শরীর, রং, ধর্ম, লিঙ্গ, জাতিসত্ত্বা ইত্যাদি ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের সাথে মূল্যমান আরোপের মাধ্যমে জ্ঞানজগতের পথে আমাদের চেতনে ভিন্নতার প্রতি বিদ্বেষ ঢুকে। কিন্তু কেন এই বিদ্বেষ নির্মাণ? কিসের প্রয়োজনে? ইতিহাসের বুনটে বোনা আছে শাসনকাঠামো টিকিয়ে রাখবার স্বার্থে শাসিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিভেদ-বৈষম্য তৈরি করা, টিকিয়ে রাখার নক্সা। ইউরোপীয় উপনিবেশের পূর্বেও শাসকবর্গ প্রান্তিক ধর্মগোষ্ঠীর উপর হামলা চালিয়েছে, কিন্তু অন্যকরণের মাধ্যমে আধিপত্য ও আক্রমনকে বৈধ হিসেবে মতাদর্শিক প্রলেপ দেয়া আধুনিক শাসনতন্ত্রের ঐতিহ্য। বৃটিশ বা বৃটিশ পূর্ব ইউরোপীয় উপনিবেশ বা শোষণমূলক রাষ্ট্র সবসময়ই বৈষম্যকে বৈধ করতে হেজিমনি তৈরি করে এসেছে। সামাজিকতার প্রতিটি স্তরে তাই একদিকে যেমন মানবাধিকার, ধর্মনিরপেক্ষতা, বহুসাংস্কৃতিক অধিকার আর সমঅধিকারের ম্লোগান, অন্যদিকে সংখ্যালঘু, আদিবাসী, নারী বা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর হীন পরিবেশন সহাবস্থান করে।

আধুনিক রাষ্ট্রের প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠান এই বৈষম্য-বিদ্বেষকে মতাদর্শিক স্তরে টিকিয়ে রাখে, স্তরায়িত সমাজ টিকিয়ে রাখার স্বার্থে। সমাজবিজ্ঞানী বা সচেতন নাগরিক হিসেবে এগুলো বিশ্লেষণ করা ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের মাধ্যমে একে মোকাবেলা করার দায়িত্বও আমাদের সার্বক্ষনিক। আমরা তা করিও, তাই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অজস্র উদাহরণও এখানে পাওয়া যাবে। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্বেষের বিপরীতে আমাদের প্রতিরোধের শক্তি বড়ই কম। আধিপত্যশীল কাঠামোতে নিজের রুটিরুজি সামলিয়ে ক্রমশ মিইয়ে পড়া স্বরে মিনমিন করে আমরা খড়কুটোর মতো হারিয়ে যাই, খাপ খাইয়ে নেই। আর জাতি-ধর্ম-লিঙ্গ বিদ্বেষের তাপ আমাদের গ্রাস করে। কয়লা হয়ে জমতে থাকি, প্রয়োজন মাফিক আগুন তৈরিতে ব্যবহ্রত হবো বলে। আর সেকারণেই আমরা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের দ্রুত সংখ্যা হ্রাসের পরিসংখ্যানেও নির্বিকার থাকি, পত্রিকার পাতা থেকে চোখ সরিয়ে জীবন যুদ্ধে নামি। সংখ্যালঘু আরো সংখ্যালঘু হয়, হিন্দু আরো হিন্দু, মুসলিম আরো মুসলিম, বৌদ্ধ আরো বৌদ্ধ, আদিবাসী আরো আদিবাসী, বাঙ্গালী আরো বাঙ্গালী, নারী আরো নারী, পুরুষ আরো বেশি পুরুষ হয়ে রেডি থাকি প্রয়োজনমতো কারো আগুন জ্বালাবার অপেক্ষায়। মানববিদ্বেষী, আধিপত্যবাদী মানসিকতা নিয়ে আমরা শাসকের হাতিয়ার হয়ে রই।

বিদ্বেষের বিশ্ব রাজনৈতিক মানচিত্র
বিদ্বেষের বারুদ নির্মাণ বিভাজিত ও স্তরায়িত সমাজব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার একটি বিশ্ব ব্যবস্থা। বৈশ্বিক ইতিহাসে আমরা একসময় দেখেছি ইহুদী নিধন, এখন তারই আরেক রূপে আরো তীব্রভাবে দেখছি পশ্চিমের নির্মিত ইসলামোফোবিয়া। ধর্মকে ভিত্তি করে এই বিদ্বেষ নির্মিত হলেও আমরা জানি, এর ভিত ধর্মীয় নয়, আর্থ-রাজনৈতিক। এই আর্থ-রাজনৈতিক মানচিত্রে আমাদের দেশ দুর্বলতম দেশের একটি। মোহম্মদের চলচ্চিত্র নিয়ে সারা বিশ্বে মুসলিমরা তাদের প্রত্যাশিত 'মৌলবাদী'/জঙ্গী' রূপে আবির্ভূত হয়, যুক্তরাষ্ট্রের দুতাবাসের সামনে বিক্ষোভ করে। বাংলাদেশ যদিও তা করার সাহস রাখেনা, কিন্তু সেও তার প্রত্যাশিত সাম্প্রদায়িক চেহারা দেখায় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর উপর আক্রমন করে। সিরিয়ার গনহত্যা বিশ্ব মিডিয়ার এখন রুটিন পরিবেশনা, কিন্তু মায়ানমারের হত্যা-নির্যাতন নিয়ে তাদের মাথাব্যাথা নাই, উপরন্তু এর সরকারপ্রধান যুক্তরাষ্ট্র থেকে শান্তি পদক পান। মায়ানমারের সাথে সমুদ্র বিজয় আর রোহিঙ্গা শরনার্থী ইস্যুর কুটনৈতিক সম্পর্কে বাংলাদেশের যখন নুন আনতে পান্তা ফুরায়, ঠিক তখুনি পাহাড়ে-বৌদ্ধবিহারে জাতিগত, সাম্প্রদায়িক সংঘাত প্রকট হয়ে উঠে। আবার ঐ রোহিঙ্গাদেরই দোষ দেয়া হয় এর জন্যে। পরিকল্পিত ভাবে ছড়ানো এই বিদ্বেষের আগুনে তাই যে যার মতো পুড়ে, অপর পক্ষকে পোড়ায়। এই আগুনের আর্থ-রাজনীতি তাই শ্রেফ সাম্প্রদায়িকতা নয় বরং ইঙ্গিত দেয় আরো বড় এক বৈশ্বিক রাজনীতির। পার্বত্য এলাকার এই মানচিত্রের রাজনীতিতে, এর নীল নক্সায় আমরা এখন কার দাবার ঘুঁটিতে কোথায় আছি তা বুঝে না নেবার বিকল্প আর নাই।

মোকাবেলা কার সাথে?
বৌদ্ধ মন্দিরে আগুন বা পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর প্রতি হত্যা নিপীড়ন সাম্প্রদায়িকতার চুড়ান্ত চেহারা যার মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার সাথেও আরো অনেক কিছু থাকে, নিজেদের কুৎসিত অমানবিক রূপ ছাড়াও অনেক কিছু দেখায়। দেখায় কি প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়ায় আমরা যে কোনো শক্তির প্রয়োজনে আগুনে জ্বলে উঠবার জন্যে তৈরী থাকি এবং সময়মতো নিজেদেরকে পোড়াতে জ্বলেও উঠি। তাই এই দৃশ্যমান আগুনের যদি শুধুই ধর্মভিত্তিক অসম্প্রীতির ব্যক্তিক ব্যাখ্যা দেই তাহলে তা হবে ডালে ডালে দেখা, পাতায় পাতায় একে নিয়ে কি খেলা চলে, সে আমাদের চোখের আড়ালেই রয়ে যাবে। সাম্প্রদায়িকতা আর বিদ্বেষের বিষ আমরা আমাদের সমাজ চেতনায় বহন করি। সেটা নিরন্তর ঘটে। ঘটায় শাসক শ্রেণী তার শোষণকাঠামো টিকিয়ে রাখার স্বার্থে, সামাজিকীকরণের প্রতিটি স্তরে। কিন্তু এটি প্রাকৃতিক বা ব্যক্তিক নয়, প্রাতিষ্ঠানিক। এর প্রতিরোধও তাই শক্তিশালী হতে হবে। কিন্তু রামু, উখিয়ার বৌদ্ধ মন্দিরে বা রাঙামাটির পাহাড়ের সাম্প্রতিক সহিংস ঘটনার ভয়াবহত্ব আরো বেশী কিছু দেখার, আরো জোড়ালো প্রতিবাদের দাবীদার। এখন চিনে নিতে হবে কোন বৈশ্বিক সাম্রাজ্যবাদী আর্থ-রাজনৈতিক মানচিত্রে আমরা কোন খাদের কিনারায়, কিভাবে, কি নামে আছি। বিশ্বমঞ্চনাটক ইসলামোফোবিয়ায় কে কোন চরিত্রে নির্মিত, পরিবেশিত হচ্ছি। এই নাটকের নিদের্শক, প্রযোজক বা পরিবেশকই বা কারা। তাই প্রতিবাদের নিশানা শুধু নিজেদের সাস্প্রদায়িক বা জাতিগত বিদ্বেষের দিকে নয়, বরং এই বিদ্বেষ নির্মাণ, টিকিয়ে রাখা তা ব্যবহারের ক্ষমতা যাদের তাদের দিকে আরো জোড়ালোভাবে তাক করতে হবে। সাম্প্রদায়িকতার এই দলগত রূপ সে দানবের একটি নির্মিত মতাদর্শিক পোশাক। শুধু পোশাকের দিকে আঙুল তুললে পোশাক হয়তো বদলে যাবে, ধর্মের লেবাস ছেড়ে বর্ণ, জাতি বা সংস্কৃতির লেবাস ধরবে, কিন্তু সে দানব বহাল তবিয়তেই থাকবে। আশু মোকাবেলা তাই সে দানবের সাথে।

নাসরিন খন্দকার :শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।