বাঙালির সন্দেহবাদ, নিন্দাবাদ ও পরশ্রীকাতরতা

সুভাষ সিংহ রায়
Published : 7 Dec 2020, 01:35 PM
Updated : 7 Dec 2020, 01:35 PM

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির পরশ্রীকাতরতা নিয়ে সবচেয়ে যথার্থ উক্তি করেছিলেন; 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী' থেকে সেটা আমরা জানতে পারি। তিনি লিখেছিলেন, 'আমাদের বাঙালির মধ্যে দুইটা দিক আছে। একটা হল 'আমরা মুসলমান, আর একটা হল, আমরা বাঙালি।'

পরশ্রীকাতরতা এবং বিশ্বাসঘাতকতা আমাদের রক্তের মধ্যে রয়েছে। বোধহয় দুনিয়ার কোন ভাষায়ই এই কথাটা পাওয়া যাবে না, 'পরশ্রীকাতরতা'। পরের শ্রী দেখে যে কাতর হয়, তাকে 'পরশ্রীকাতরতা' বলে। ঈর্ষা, দ্বেষ সকল' ভাষায়ই পাবেন, সকল জাতির মধ্যেই কিছু কিছু আছে, কিন্তু বাঙালিদের মধ্যে আছে 'পরশ্রীকাতরতা'। ভাই ভাইয়ের উন্নতি দেখলে খুশি হয় না। এই জন্যই বাঙালি জাতির সকল রকম গুণ থাকা সত্ত্বেও জীবনভর অন্যের অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে। সুজলা, সুফলা বাংলাদেশ সম্পদে ভর্তি। এমন উর্বর জমি দুনিয়ায় খুব অল্প দেশেই আছে। তবুও এরা গরিব। কারণ, যুগ যুগ ধরে এরা শোষিত হয়েছে নিজের দোষে। নিজকে এরা চেনে না, আর যতদিন চিনবে না এবং বুঝবে না ততদিন এদের মুক্তি আসবে না।

অনেক সময় দেখা গেছে, একজন অশিক্ষিত লোক লম্বা কাপড়, সুন্দর চেহারা, ভাল দাড়ি, সামান্য আরবি-ফার্সি বলতে পারে, বাংলাদেশে এসে পীর হয়ে গেছে। বাঙালি হাজার হাজার টাকা তাকে দিয়েছে একটু দোয়া পাওয়ার লোভে। ভাল করে খবর নিয়ে দেখলে দেখা যাবে এ লোকটা কলকাতার কোন ফলের দোকানের কর্মচারী অথবা ডাকাতি বা খুনের মামলার আসামি। অন্ধ কুসংস্কার ও অলৌকিক বিশ্বাসও বাঙালির দুঃখের আর একটা কারণ। আমার মনে হয়, বাঙালি শুধু পরশ্রীকাতর জাতি নয় , আত্মশ্রীকাতরও বটে। আবার বলা যায় 'কৃতঘ্নতা'ও একটি আদি ব্যাধি।

বাংলা ভাষায় 'অকৃতজ্ঞ ' শব্দের অর্থ হচ্ছে যে উপকারী উপকার স্বীকার করে না । আর 'কৃতঘ্ন' শব্দের অর্থ যে উপকারীর অপকার করে। শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তার 'পথের দাবী' উপন্যাসে লিখেছিলেন "পরাধীন দেশে সবচেয়ে বড় অভিসম্পাতই তো হল কৃতঘ্নতা।" শরৎ চন্দ্রের সময় বাংলাদেশ পরাধীন ছিল তাই সেটা তা হয় মেনে নেওয়া যায় । কিন্তু স্বাধীন সার্বভৌম রাস্ট্রে 'কৃতঘ্নতা'র অসংখ্য ভয়ংকর উদাহরণ রয়েছে। জ্যোতিষীর ভবিষ্যদ্বাণী উপেক্ষা করে সিজার খ্রিস্টপূর্ব ৪৪ সালের ১৫ মার্চ যখন সিনেট অধিবেশনে উপস্থিত হলেন, তখন সিনেটররা একে একে তাঁকে ছুরিকাঘাত করতে লাগলেন; সবশেষে তার বিশ্বস্ত বন্ধু ব্রুটাসকে ছুরিকাহস্তে এগিয়ে আসতে দেখে জুলিয়াস আর্তকণ্ঠে চিৎকার করে উঠেছিলেন, 'ব্রুটাস, তুমিও!'

বাঙালি চরিত্রে বিশ্বাসঘাতকতা একটা অন্যতম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য । 'নদী-শিকস্ত ও নদী-পয়স্ত' অঞ্চলের অধিবাসী বলেই বোধ করি বাঙালি চরিত্রে যুগপৎ এই বৈপরীত্য প্রায়ই পরিলক্ষিত হয়। নীহাররঞ্জন রায় বাঙালিকে শংকর জন (people অর্থে) বলে উল্লেখ করেছেন। ড. অতুল সুর বাঙালিকে বলেছেন মিশ্র জাতি। তিনি লিখেছেন, "বাঙালীকে মিশ্র জাতি বলা হয়। এ সম্পর্কে বলা প্রয়োজন যে অধুনা লুপ্তপ্রায় আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের অধিবাসীগণ ব্যতীত, জগতে এমন কোনো জাতি নাই, যারা মিশ্র জাতি নয়। অন্তত নৃতত্ত্ববিদগণের কাছে এমন কোনো জাতির নাম জানা নাই যারা বিশুদ্ধ রক্ত বহন করে। তার মানে, পৃথিবীর অন্যান্য জাতিরা যেমন মিশ্র জাতি, বাঙালীও তাই।"

এ কারণে কবিগুরু অন্যত্র বলেছেন, 'আমরা (বাঙালিরা) আরম্ভ করি, শেষ করি না; আড়ম্বর করি, কাজ করি না; যাহা অনুষ্ঠান করি, তাহা বিশ্বাস করি না; যাহা বিশ্বাস করি, তাহা পালন করি না; ভূরি পরিমাণ বাক্য রচনা করিতে পারি, তিল পরিমাণ আত্মত্যাগ করিতে পারি না;… পরের চক্ষে ধূলি নিক্ষেপ করিয়া আমাদের পলিটিকস এবং নিজের বাকচাতুর্যে নিজের প্রতি ভক্তিবিহ্বল হইয়া উঠাই আমাদের জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য।' কিন্তু এ কথাটা তিনি বলেছেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রশ্বস্তি গাইতে গিয়ে; আর বিদ্যাসাগর ছিলেন একজন বাঙালিই।

নীরদ চৌধুরীর 'আত্মঘাতী বাঙালি' শীর্ষক বইটিও বেশ কয়েকবার পাঠ করেছি । বইটির এক জায়গায় তিনি লিখেছেন, 'বাঙালির বাঙালি বলিয়া যত দিনের ইতিহাস আছে তাহার সবটুকু জুড়িয়া ভালো বাঙালি শুধু আপনভোলা বাঙালির মধ্যেই দেখা দিয়াছে। বাকি যাহারা ধন, মান, ঐহিক ক্ষমতা বা প্রতিষ্ঠা চাহিয়াছে, তাহাদের বাসনা যখন শক্তির অল্পতা বা সমাজের ভয়ের দ্বারা সংযত থাকে নাই তখন তাহারা নামে চোর-ডাকাত না হইলেও চরিত্র ধর্মে তাহাই হইয়াছে।'আপন মাংস যেমন হরিণের বৈরী, তেমনি বাঙালিই বাঙালির প্রতিদ্বন্দ্বী। সে সাবানের মধ্যে যেটি নিকৃষ্টতম সেটির নাম দিয়েছে 'বাংলা সাবান', মদের মধ্যে যেটি নিকৃষ্টতম সেটির নাম দিয়েছে 'বাংলা মদ', অতএব দুর্মুখেরা বলাবলি করবেই, 'এই নিরিখে জাতির মধ্যে সবচেয়ে মন্দ যে জাতি, সেটা হচ্ছে বাঙালি জাতি।' দুর্মুখদের এটা বলার সুযোগ করে দেওয়া সঠিক হয়নি। সব ধর্মতেই বলা হয়েছে পরনিন্দা, পরচর্চা করা মহাপাপ । কিন্তু বাঙালি শোনে না ধর্মের বাণী।

নবাব সিরাজউদ্দোলাকে নিয়ে অনেক কথাই আলোচনা করা যাবে না; বিস্তর সমালোচনার বিষয়ও আছে। কিন্তু তার বিরুদ্ধে ক্রমাগতভাবে প্রপাগন্ডা, বিদ্বেষ ছড়ানো হয়েছিল। তৎকালীন সুশীল সমাজের নেতা ইয়ার লতিফের নেতৃত্বে তা ছড়ানো হয়েছিল। এখনও তার ব্যতিক্রম দেখি না । যেমন ধরা যাক, পদ্মাসেতু নিয়ে বহুমুখী ষড়যন্ত্র হয়েছিল তখন আমাদের অনেক বিজ্ঞজনও দেশবিরোধীদের সঙ্গে তাল তাল মিলিয়ে কথা বলতে শুনেছি। পদ্মাসেতুর বিভীষণ হিসেবে কেউ কেউ অবস্থান নিয়েছিলেন। সাধারণ মানুষের ভেতরে একটা সন্দেহবাদের ভাইরাস ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তারা কি এখনও সক্রিয় না? কেন জানি মনে হয় আমাদের সংস্কৃতির সাথে সন্দেহবাদ আর নিন্দাবাদ গভীরভাবে প্রথিত হয়ে আছে।

আসুন আমরা একটু বিশ্লেষণ করি। জাপানের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা মোতাবেক পদ্মাসেতু প্রকল্পটি ছিল ১ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের প্রকল্প। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের চাপাচাপিতে কয়েকবার ডিজাইন পরিবর্তনের মাধ্যমে সেতু প্রকল্পকে ২ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলারের 'গ্র্যান্ড ব্রিজ প্রজেক্টে' রূপান্তরিত করে ফেলা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে সেতু-প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন চাওয়া হয়েছিল ৬০কোটি ডলার; কিন্তু বিশ্বব্যাংকই স্বতঃপ্রণোদিত হযে তাদের ঋণকে ১২০ কোটি ডলারে সম্প্রসারিত করেছিল; প্রকল্পে নিজেদের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণকে বাড়ানোর উদ্দেশ্যে। প্রথমে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকই ছিল প্রকল্পের প্রধান ঋণদাতা। এডিপির ওই ভূমিকাটি বিশ্বব্যাংক কেড়ে নিয়েছিল। এডিবি ওইসময় বেশ খানিকটা উষ্মা প্রকাশও করেছিল। এভাবে একটি সহযোগী সংস্থা থেকে প্রকল্পের নিয়ন্ত্রণ কেড়ে নেওয়াটা রহস্যজনক মনে হয়। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগে বিশ্বব্যাংক সুপারিশ করেছিল অন্য একটি কোম্পানির জন্য; কিন্তু অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন মূল্যায়ন কমিটি ওই কোম্পানির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল, ওই প্রতিষ্ঠানটি 'ব্ল্যাক লিস্টেড' হয়েছিল বলে। 'ব্ল্যাক লিস্টেড' করার কারণ ছিল, ওই কোম্পানি নিজেদের কাজের অভিজ্ঞতার ফিরিস্তি দিতে গিয়ে যে-সেতুর ছবি ও কাগজপত্র জমা দিয়েছিল, সেগুলো সবই ভুয়া প্রমাণিত হয়েছিল।

এতদসত্ত্বেও বিশ্বব্যাংক বারবার ওই প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিতে পীড়াপীড়ি করছিল, যার ফলে পরামর্শক নিয়োগ-প্রক্রিয়া বছরখানেক বিলম্বিত হয়। কমিটির দৃঢ় অবস্থানের কারণে যখন ওই 'ব্ল্যাক লিস্টেড' প্রতিষ্ঠানটি চূড়ান্ত বিবেচনায় প্রত্যাখ্যাত হয়, তখন ওই কোম্পানির বাংলাদেশি এজেন্ট প্রকাশ্যে হুমকি দিয়েছিল, কীভাবে পদ্মাসেতু হয়, সে দেখে নেবে। ওই এজেন্টকে দুদক আজও পাকড়াও করতে পারেনি। সে গায়েব হয়ে গেছে। বিশ্বব্যাংক একটি ব্ল্যাক লিস্টেড কোম্পানির পক্ষে কমিটির সঙ্গে কেন হাত-মোচড়ানোর খেলায় মেতে উঠেছিল, তারও তদন্ত হওয়া আবশ্যক। সেটা কি অনৈতিক কাজ হয়নি? এটাও একধরনের দুর্নীতি। যে ভদ্রলোক বিশ্বব্যাংকের হয়ে বাংলাদেশে দুর্নীতির তদন্ত করতে এসেছিলেন মেরোনা ওকাম্পো- তার সে কি আস্ফালন! কিন্তু কানাডার আদালত রায় দিয়েছে পদ্মাসেতুতে বাংলাদেশের কেউ দুর্নীতি করেননি । কথায় বলে, পাপ ছাড়ে না বাপেরে। সেই ওকাম্পোর বিরুদ্ধে এখন সারা পৃথিবীতে দুর্নীতির তদন্ত হচ্ছে।

প্রায় একটি বছর ওই ইস্যুতে নষ্ট করে ফেলা কি সময়ের অপচয় নয়? বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ শর্তে পুরো প্রকল্পের জন্য তাদের পক্ষে থেকে একজন 'প্রশাসক' নিয়োগের প্রস্তাব করা হয়েছিল। প্রকল্পটি যদি বাংলাদেশ সরকারের হয়, তাহলে বিশ্বব্যাংক কোন অধিকারে প্রকল্পের চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রণ নিজহাতে নিতে চেয়েছিল? বাংলাদেশকে যে ঋণ দেবে, তা সুদাসলে ফেরত নেবে। বাংলাদেশকে তারা কৃপা করছে না। বাঙালির নিন্দাবাদ, সন্দেহবাদ ও পরশ্রীকাতরতা রক্তে মিশে আছে । নোবেল বিজয়ী বাংলাদেশী যেভাবে বলা হোক না কেন কোমর বেঁধে নেমেছিলেন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে।

১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ নিয়ে নানান কিচ্ছা কাহিনী প্রচলিত থাকলেও কেউ ভুলেও বলে না যে, ভয়ংকর সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তের ফলাফলেই ছিল এই দুর্ভিক্ষ। বঙ্গবন্ধু দুর্ভিক্ষের দায়ভার নিয়ে কোনো ভণিতা করেননি। সকল ব্যর্থতার দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়েছিলেন। জাতীয় সংসদে দুর্ভিক্ষে প্রাণহানির সঠিক সংখ্যা প্রকাশ করেছিলেন। জোসেফ গোয়েবলস্ বলেছিলেন, "একটি মিথ্যা বারবার বলতে থাকলে মানুষ এক সময় তা বিশ্বাস করতে শুরু করবে, এমনকি এক সময় আপনিও তা বিশ্বাস করে বসবেন।" বুকার টি ওয়াশিংটন বলেছিলেন, "সংখ্যাগরিষ্ঠরা মেনে নিলেই মিথ্যা সত্য হয়ে যায় না, ভুল শুদ্ধ হয়ে যায় না এবং বদমাশ লোক ভাল হয়ে যায় না।"

২.
১৯৭৫ সালের ২১ জুলাই বাকশালের নবনিযুক্ত গভর্নরদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচির উদ্বোধনী ভাষণে বঙ্গবন্ধু কর্মপদ্ধতির বিশদ নির্দেশনা দিয়ে বলেছিলেন, "ডেভেলপমেন্ট ওয়ার্ক, ফ্যামিলি প্ল্যানিং আর আমার দ্বিতীয় বিপ্লবের যে চারটি প্রোগ্রাম আছে সেগুলো আপনারা করুন। ডেভেলপমেন্ট ওয়ার্কের জন্য পাম্প পেলামনা, এটা পেলাম না- এসব বলে বসে না থেকে জনগণকে মবিলাইজ করুন। যেখানে খাল কাটলে পানি হবে, সেখানে সেচের পানি দিন। সেই পানি দিয়ে ফসল ফলান। মবিলাইজ দ্য পিপল। পাম্প যদি পাওয়া যায় ভালো। যদি পাওয়া না যায় তবে স্বনির্ভর হন। বাঁধ বেঁধে পানি আটকান, সেই পানি দিয়ে ফসল ফলান। আমাদের দেশে আগে কি পাম্প ছিল? দরকার হয়, কুয়া কেটে পানি আনুন। আমাদের দেশে পাঁচ হাত, সাত হাত, আট হাত কুয়া কাটলেই পানি উঠে। সেখানে অসুবিধা কি আছে? যে দেশে পানি আটকে রাখলে পানি থাকে, সেখানে ফসল করবার জন্য চিন্তার কি আছে? আর এখন থেকে যে সমস্ত সার থানায় যাবে, তা যেন রেগুলারলি গরিব-দুঃখীরা পায়।"

কিন্তু বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে ক্ষেপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল । কেউ কেউ এখনও বলার চেষ্টা করেন 'বাকশাল' নাকি একদলীয় শাসন। বাকশাল ( বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ ' ছিল মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সকল রাজনৈতিক দলের প্লাটফর্ম। যেকারণে সে সময় সকল কীর্তিতে বিভ্রান্তি ছড়ানোর পাশাপাশি ওরা সুকৌশলে আরেকটি পদক্ষেপ নিয়েছিল তা হলো আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের মধ্যেও কিছু বিভ্রান্তি ঢুকিয়ে দেওয়া। তারা খুব মুনশিয়ানার সঙ্গেই এই কাজটি করেছিল ।

স্বৈরাচারী মৃত্যুর ছ'সাত মাস আগে জাতীয় পার্টির এক কর্মী সমাবেশে আওয়ামী লীগকে আবারো বাকশালী বলে কটাক্ষ করেছিল । আর বিএনপি'র নেতারা হরহামেশায় 'বাকশালী' শব্দের ব্যবহার করে থাকেন । আমি নিশ্চিত আজ যদি ইন্টারনেটে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করা হয় তবে অনেকগুলো ওয়েবসাইট পাওয়া যাবে যেখানে বলা আছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লাখ মানুষ মরেনি, শেখ মুজিবুর রহমান তিন লাখের জায়গায় বাড়িয়ে তিন মিলিয়ন বলেছিলেন। এইগুলো নিছক বিভ্রান্তি; শুধু বিভ্রান্তি নয় জাতিসত্ত্বার বিরুদ্ধে চক্রান্ত।

খুব কৌশলে এই সব বিভ্রান্তি বাংলাদেশের রাজনীতিতে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এই বিভ্রান্তিগুলো কিন্তু আবার রীতিমতো নামকরা গবেষকদের মুখ থেকে নিঃসৃত হয়েছিল, তা চারদিকে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। পাকিস্তানের আইএসআই অর্থায়নে গবেষণা পুস্তক করেছেন নেতাজি সুভাষ বসুর পরিবারের এক সদস্য, শর্মিলা বসু। সেখানে বলা হয়েছে- 'এখানে আসলে বিহারি ও বাঙালিদের জাতিগত দাঙ্গা চলছিল একাত্তরের শুরু থেকে। যেহেতু বাঙালিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ আর বাঙালিদের নেতৃত্ব দানকারী আওয়ামী লীগ মূলত 'গুন্ডাপান্ডার দল' (?) সেহেতু বিহারিরা ভয়ংকরভাবে কচুকাটা হচ্ছিল। এই অরাজকতা থামাতে বাধ্য হয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে অ্যাকশনে নামতে হয়েছিল। সেই অ্যাকশনে কিছু বাঙালি অস্ত্রধারী যাদের ভারত প্রশিক্ষণ দিচ্ছিল-তারা মারা গেছে। সংখ্যাটা খুব বেশি হলে ২৬ হাজার। বিহারিও কিন্তু মরেছে বাঙ্গালির হাতে হাজার হাজার। আর ধর্ষণ! দু-চারটা ঘটনা যে ঘটেনি, তা নয়। তবে বাঙালিদের, বিশেষ করে শেখ মুজিবের বাড়িয়ে বলার একটা বদভ্যাস ছিল।"

বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান অধ্যাপক নুরুল ইসলাম লিখিত ' বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কাছে থেকে দেখা' ( প্রকাশক প্রথমা প্রকাশন, মার্চ ২০২০) গ্রন্থে স্পষ্ট করে দিয়েছেন জিয়াউর রহমান কতটা 'কৃতঘ্ন' ছিল-

জিয়াউর রহমানের সঙ্গে আমার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ও মনে রাখার মতো সাক্ষাৎটি অনুষ্ঠিত হয় আমার পরিকল্পনা কমিশন ছেড়ে আসার সামান্য আগে। তখনো আমার ছেড়ে আসার বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত করা হয়নি, কিন্তু এ নিয়ে নানা খবর ছড়িয়ে পড়েছিল। এমনই একসময় জিয়াউর রহমান আমাদের দুজনেরই বন্ধু জিয়াউল হকের মাধ্যমে আমার সঙ্গে দেখা করার প্রস্তাব পাঠালেন। জিয়াউল হক আমাকে জানালেন যে জিয়াউর রহমান অনানুষ্ঠানিকভাবে দেশের সাধারণ স্বার্থসংশ্লিষ্ট কিছু বিষয় নিয়ে আমার সঙ্গে আলোচনা করতে আগ্রহী। জিয়াউর রহমান আমার পরিকল্পনা কমিশন ছেড়ে যাওয়ার দৃঢ় ইচ্ছার কথা শুনেছেন এবং যত দ্রুত সম্ভব আমার সঙ্গে একটি সাক্ষাতের ব্যবস্থা করার জন্য জিয়াউল হককে অনুরোধ করেছেন। যদিও জিয়াউর রহমানের সঙ্গে আমার আলাপ-পরিচয় ছিল এবং তিনি আমার অফিসেও এসেছেন এবং দেখা করেছেন, তারপরও তিনি একটি পরোক্ষ মাধ্যমে আমার সঙ্গে দেখা করার প্রস্তাবটি রাখেন। আমি এতে বেশ অবাক হয়েছিলাম এবং নিশ্চিত ছিলাম না যে কীভাবে আমি এই অনুরোধে সাড়া দেব। জিয়াউল হক আমাকে এটা বোঝানোর চেষ্টা করলেন যে আমার উচিত এ ধরনের একটি অনানুষ্ঠানিক বৈঠকের ব্যাপারে সম্মত হওয়া এবং এ ধরনের সাক্ষাতে সমস্যার কিছু নেই। জিয়াউল হক তার বাসাতেই এই সাক্ষাতের ব্যবস্থা করেছিলেন, যেখানে আমার এমনিতেই নিয়মিত যাতায়াত ছিল। রাজনীতির জগতে প্রকাশ্যে ও গোপনে কী হচ্ছে, সে ব্যাপারে আমার চেয়ে জিয়াউল হক অনেক বেশি খোঁজখবর রাখতেন। জিয়াউর রহমান কী বলতে চান, সে ব্যাপারে আমি খুবই কৌতূহলী ছিলাম। দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যাপারে জিয়াউর রহমানের যে গভীর ও ব্যাপক আগ্রহ ছিল, তার প্রমাণ আগেও পেয়েছি। এমনকি পরিকল্পনা কমিশনে কী হচ্ছে বা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যানের চলে যাওয়ার খবর- এসবও যে তাঁর জানার বা আগ্রহের বাইরে নয়, তা-ও বুঝতে পারলাম।…তবে তিনি আস্থাবান ছিলেন যে অদূর ভবিষ্যতেই পরিস্থিতির অনেক উন্নতি ঘটবে এবং বিরাজমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা দূর হবে। বাংলাদেশ সমৃদ্ধির পথেই এগোবে এবং দেশের স্বাধীনতার জন্য আত্মত্যাগ বিফল হবে না। ফলে আমার হতাশ হওয়ার কিছু নেই এবং আমার উচিত পুরো দায়িত্ব ও শীর্ষ নেতৃত্বের জোরালো সমর্থন নিয়ে দেশের পরিকল্পনা ও উন্নয়নের কাজ চালিয়ে যাওয়া।…জিয়াউর রহমান যে আস্থা নিয়ে দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধারের আশা প্রকাশ করলেন, তাতে আমি বিস্মিত হয়েছিলাম। খুব শিগগির আমি বাধাহীনভাবে আমার কাজে মনোযোগ দিতে ও দেশের কল্যাণে আমার নির্ধারিত কাজ করার সুযোগ পাব-তাঁর এ ধরণের দৃঢ় আস্থাপূর্ণ বক্তব্যেও আমি বেশ অবাক হয়েছিলাম । .." ( পৃষ্টা ৫৯ ,৬০)

বঙ্গবন্ধু তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন- 'একজন মানুষ হিসেবে সমগ্র মানব জাতি নিয়েই আমি ভাবি। একজন বাঙালি হিসাবে যা কিছু বাঙালিদের সঙ্গে সম্পর্কিত তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এই নিরন্ত সম্পৃক্তির উৎস ভালোবাসা, অক্ষয় ভালোবাসা, যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি এবং অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে।'

সুতরাং সুখী সমৃদ্ধ, আত্মনির্ভর, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাভিত্তিক, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করার জন্য তার জীবন ও সংগ্রাম নিয়ে গভীর গবেষণা, নিবিড় অধ্যয়ন ও তা থেকে অর্জিত শিক্ষা রাষ্ট্রীয় জীবনে প্রয়োগের কোনো বিকল্প নেই।


ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর যখন নারীশিক্ষা ও বিধবা বিবাহ প্রচলন করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন ঠিক তখনই আক্রান্ত হয়েছিলেন একদল দুর্বৃত্তের হাতে। সেদিন কয়েকজন সাহসী মানুষ এগিয়ে না আসলে বিদ্যাসাগর নির্ঘাৎ বেঘোরে মারা পড়তেন। ভেবে দেখুন বাংলার নারী শিক্ষা আরও একশ বছর 'ব্যাক গিয়ারে' চলে যেত। ইতিহাস বলছে, সেদিন বিদ্যাসাগরকে মারতে গুন্ডা পাঠিয়ে ছিলেন কলকাতার এক অতি বিশিষ্ট ভদ্রলোক। কেবল গুন্ডা লেলিয়ে দেওয়াই নয়, সেসময় বিদ্যাসাগর পথেঘাটে বেরোলে একদল বিধবা বিবাহ বিরোধী, নারীশিক্ষা বিরোধী বিদ্যাসাগরকে তাড়া করত। এ প্রসঙ্গে তৎকালীন হিতবাদী পত্রিকায় ডাক্তার অমূল্যচরণ বসু নামে জনৈক লিখেছেন, "বিদ্যাসাগর পথে বাহির হইলে চারিদিক হইতে লোক এসে তাঁকে ঘিরে ফেলতো, কেউ পরিহাস করত, কেহ গাল দিত, এমনকি মেরে ফেলারও ভয় দেখানো হয়েছিল।"

স্বামী বিবেকানন্দ জগৎখ্যাত হয়েছিলেন, সমগ্র জগদ্ব্যাপী তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। তখনও পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়ানো হয়েছিল। একদিকে মিশনারিরা, অন্যদিকে প্রতাপ মজুমদারের মতো কয়েকজন দেশওয়ালি বাঙালি। আমেরিকা প্রবাস কালে মিসেস ব্যাগলি নামে এক মহিলার গৃহে আশ্রয় পেয়েছিলেন বিবেকানন্দ। হঠাৎ রটিয়ে দেওয়া হল, ওই 'যুবতি ঝিয়ের সাথে বিবেকানন্দ নাকি ফস্টিনস্টি' করেছেন। শিকাগো ধর্ম সম্মেলনে বিবেকানন্দ ছাড়াও আরও কয়েকজন বাঙালি উপস্থিত ছিলেন। প্রতাপ মজুমদার তাদের অন্যতম। হল অব কলম্বিয়া ঘিরে বিবেকানন্দের জয়জয়কার স্বভাবতই তাদের পছন্দ হয়নি। প্রতাপ মজুমদার দেশে ফিরে এসে সবাইকে বলতে লাগলেন, "নরেন সেই ছোঁড়াটা ভ্যাগাবন্ডের মতন আমেরিকার পথে পথে ঘুরে বেড়িছে, সে এক লম্বা জামা পরে, মাথায়পাগড়ি বেঁধে শিকোগো পার্লামেন্টে গিয়ে হাজির।… ছোঁড়াটা এমনি অসভ্য, রমণীদের সম্মুখে বসে চুরুট টানে।"

প্রতাপ মজুমদার আরও বললেন, "সে লেখাপড়া কিছুই জানে না। বোধ হয় কোনো বিপদে পড়েই এখানে (আমেরিকায়) পালিয়ে এসেছে।"

প্রতাপ মজুমদারের তালে তাল দিয়েছিলেন আরও দুজন বিখ্যাত বাঙালি-অমৃতলাল বসু এবং দুর্গাদাস লাহিড়ী। রবীন্দ্রনাথের 'রবীন্দ্রনাথ' হওয়াটা বাস্তবিক সেসময় অনেক বিখ্যাত বাঙালি পছন্দ করেননি। বিবেকানন্দের যেমন প্রতাপ মজুমদার, শরৎচন্দ্রের যেমন প্রবোধ সান্যাল, সজনী দাশ, বিজয় চট্টোপাধ্যায়রা, রবীন্দ্রনাথের তেমনই- ডি এল রায়, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন, স্যার যদুনাথ, বিপিন পাল, সুরেশ সমাজপতি, শনিবারের চিঠির সজনী দাশেরা ছিলেন। একজন মানুষের বিরুদ্ধে কোমর বেঁধে কুৎসা রটানোর জন্য যত লোকের দরকার রবীন্দ্র-বিরোধীদের সংখ্যা তারও চেয়ে অধিক ছিল। আর এই দলের মধ্যমণি ছিলেন ডি এল রায়। চাছাছোলা ভাষায় রবীন্দ্র বিরোধিতা বলতে যা বোঝায় ডি এল রায় তাই করেছিলেন। রবীন্দ্র বিরোধীদের প্রধান মুখপত্র ছিল 'অর্চনা' নামে একটি পত্রিকা। এছাড়াও সুরেশ সমাজপতি সম্পাদিত সাহিত্য', 'বঙ্গবাসী', চিত্তরঞ্জন দাশের 'নারায়ণ' ও সজনীকান্তর 'শনিবারের চিঠি' তে প্রায় কুৎসিত ভাষায় রবীন্দ্রবিরোধিতার খবর ছাপা হত। কবি রবীন্দ্রনাথ এবং ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথ উভয়ই ছিলেন এই আক্রমণের লক্ষ্য। রবীন্দ্রনাথের কালোত্তীর্ণ কবিতা 'সোনার তরী' কে অর্থশূন্য বলে বাতিল করেছিলেন দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ।

তিনি রবীন্দ্রনাথের লেখায় ন্যাকামি, জ্যাঠামি, ভণ্ডামি ও বোকামি ব্যতীত কিছুই খুঁজে পাননি। রবীন্দ্র সংগীতের ভেতর 'লাম্পট্য ও চৌর্যবৃত্তি' লক্ষ করেছেন তিনি। এত কিছু করেও ক্ষান্ত দেননি দ্বিজেন্দ্রলাল। এর পরও তিনি যেটা করেছেন সেটা আরও ভয়ংকর। রবীন্দ্র বিরোধিতাকে আরও চূড়ান্ত জায়গায় পৌঁছে দেবার জন্য চটজলদি 'আনন্দ বিদায়' নামে একখানা প্যারোডি নাটক লিখে ফেললেন তিনি। কবি রবীন্দ্রনাথকে ছেড়ে এবার ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথকে লক্ষ্যবস্তু বেছে নেওয়া হল। রাজ্য নয়, রাজধানী নয়, এবার সরাসরি রাজপ্রাসাদ আক্রমণ। চরিত্র। খবরের কাগজে ছাপিয়ে দেওয়া হল রবীন্দ্রনাথ দ্বিতীয় বিবাহ করছেন। রাশি রাশি চিঠি আসতে লাগল রবীন্দ্রনাথের কাছে। কবে বিয়ে? কার সঙ্গে বিয়ে? অবস্থা এমন দাঁড়াল যে কাগজে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানাতে হল, বাবু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিয়ের খবর মিথ্যে- '…that the report is absolutely unfounded'।

শান্তিনিকেতন গড়তে গিয়ে সর্ব অর্থে দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের স্ত্রী মৃণালিনী দেবীর বিবাহের যৌতুক ছাড়াও শাশুড়ির পুরোনো আমলের ভারী সোনা গহনা পেয়েছিলেন অনেক। প্রথমে সেগুলি একে একে গেল শান্তিনিকতন গডতে। পুরীতে একখানা পৈতৃক কোঠাবাড়ি পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ, সেটাও বিক্রি হয়ে গেল শান্তিনিকেতনের খরচ মেটাতে। এবার হাত পড়লো আসবাবপত্রের ওপর। যাকে বলে থালাবাসন, ঘটি বাটি বিক্রি। রবীন্দ্রনাথের একখানা নিজস্ব লাইব্রেরি ছিল, প্রচুর পুরাতন ও দুষ্প্রাপ্য সংগ্রহ ছিল সেখানে। শান্তিনিকেতনে জন্য সেটাও জলের দরে বিক্রি হয়ে গেল। রবীন্দ্রনাথের একখানা নার পকেট ঘড়ি ছিল। ঘড়িটি বিবাহের যৌতুক হিসেবে পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। শান্তিনিকেতনের জন্য সেটিও বিক্রি হয়ে যায়।

বঙ্গবন্ধু জীবিত থাকা অবস্থায় তার কাছ থেকে যারা সবচেয়ে উপকৃত হয়েছিল তাদের একটা অংশ বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে নিন্দাবাদে সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকতেন।

তার সময়ের প্রপোগান্ডাগুলো দেখুন-

"ভারত বাংলাদেশের অর্থনীতি ধ্বংস করার মতলবে গোপনে বিপুল অংকের জাল নোট বাজারে ছেড়েছে"; "বাংলাদেশের শিল্প কারখানার কলকব্জা ভারতে পাচার করা হয়েছে"; "বাংলাদেশের সব গাড়িকে পাচার করা হয়েছে"; "বাংলাদশ হতে ৬০০০ কোটি টাকার সম্পদাবলী ভারতে স্থানান্তরিত করা হয়েছে"; ইত্যাদি ইত্যাদি।

"ভারতের সঙ্গে একটি গোপন চুক্তি স্বাক্ষর করে বঙ্গবন্ধুর সরকার বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিকিয়ে দিয়েছে"; "মুজিব ভারতের পুতুল সরকার এবং বাংলাদেশ ভারতের তাবেদার রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে"; "আওয়ামী লীগ নেতাদের লক্ষ লক্ষ টাকা ভারতে রয়েছে তা বদলানোর জন্যই এত দীর্ঘ সময় দেয়া হয়েছে";

বলাবাহুল্য, আন্তর্জাতিক বিশ্বে এসব প্রোপাগান্ডা চালাচ্ছিল পাকিস্তান, সৌদি, চীন মার্কিনসহ সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহ। বঙ্গবন্ধুবিরোধী শাসকগণ সেই কথিত গোপন চুক্তি জনসমক্ষে তুলে ধরতে পারেনি বা এমন কিছু তথ্য উপস্থাপন করতে পারেনি যার ফলে জনগণ বুঝতে পারে। সত্যিই এ ধরনের চুক্তি ছিল। ১৯৭২ সনের ১৯ মার্চ ভারতের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশ সফরে এসে ২৫ বছরের বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। বলাবাহুল্য এটা কোনো গোপন চুক্তি নয়, প্রকাশ্য চুক্তি যা পারষ্পারিক সৌহার্দ্য, সহায়তা, সার্বভৌমত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত।এত সব মিথ্যা প্রচারে জনগণ বিশ্বাস না করলেও তারা যে বিভ্রান্ত হয়েছিল তা নিঃসন্দেহে বলা যায় এবং এ সব মিথ্যা প্রচারের কিছু ভিডিও তৈরি হয়েছিল।

বাংলার দামাল মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে সংগঠিত হয়েছিল রক্ষী বাহিনী, তাদের বিরুদ্ধে চালোনো হলো অপপ্রচার। লক্ষ্য সেনাবাহিনীতে অসন্তোষ জাগিয়ে তোলা এবং রক্ষীবাহিনী সম্পর্কে জনমনে ভীতি ও বিভ্রান্তি জাগিয়ে তোলা। অনেক সময় মনে হয় বাঙালির সন্দেহবাদ , নিন্দাবাদ ও পরশ্রীকাতরতা উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া। কেউ কেউ বলেন বাঙালি শংকর জাতি, কিছুই করার নেই। কবি কামাল চৌধুরী'র একটি লেখার কয়েকটি লাইন এই পরিসরে উৎকলন করছি ।

নীহাররঞ্জন রায় বাঙালিকে শংকর জন (people অর্থে) বলে উল্লেখ করেছেন। ড. অতুল সুর বাঙালিকে বলেছেন মিশ্র জাতি। তিনি লিখেছেন, "বাঙালীকে মিশ্র জাতি বলা হয়। এ সম্পর্কে বলা প্রয়োজন যে অধুনা লুপ্তপ্রায় আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের অধিবাসীগণ ব্যতীত, জগতে এমন কোনো জাতি নাই, যারা মিশ্র জাতি নয়। অন্তত নৃতত্ত্ববিদগণের কাছে এমন কোনো জাতির নাম জানা নাই যারা বিশুদ্ধ রক্ত বহন করে। তার মানে, পৃথিবীর অন্যান্য জাতিরা যেমন মিশ্র জাতি, বাঙালীও তাই।

পুনশ্চ: 'পরনিন্দা সমাজের কণায় কণায় যদি মিশিয়া না থাকিত তবে নিশ্চয়ই একটা বড়ো রকমের অনর্থ ঘটিত । উহা লবণের মতো সমস্ত সংসারকে বিকার হইতে রক্ষা করিতেছে'। তথ্য সূত্র : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ' পরনিন্দা' বিচিত্র প্রবন্ধ।